১
বইটার প্রথম পাতা খুলতেই বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হল... ‘সু-কে অনি’, সস্তার বল-পয়েন্ট পেনের কালি এখনও ম্লান হয়নি। বইটার বত্রিশ আর তেত্রিশ পাতার মাঝখানে একটা গোলাপ-কুঁড়ি থাকার কথা। অনির্বাণ পাতা উলটে দেখল একটা আবছা কালচে সবুজ দাগ লেগে আছে শুধু, আর কিছু নেই। সাত বছরের পুরনো ফুলের কুঁড়ি কবেই শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে খসে পড়ে গেছে, সম্পর্কটাই রইল না। তবুও সে মল্লিকদার স্টলের সামনে বইটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দু তিন সপ্তাহ অন্তর অন্তর মল্লিকদার স্টলে ঢুঁ মারাটা ইদানীং একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আউট অভ প্রিন্ট বই দরকার হলে কলেজস্ট্রিটে মল্লিকদার স্টল ছাড়া গতি নেই। আজকে অবশ্য এসেছিল সালিম আলির অটোবায়োগ্রাফি ‘দ্য ফল অভ আ স্প্যারো’র খোঁজে। বইটা অ্যামাজনে পাওয়া যায়, তবু সস্তায় সওদা করতে পারলে, কে আর ছাড়ে? মল্লিকদা চা খাচ্ছিল, বলল, ডান দিকের ওই গাদাটায় দেখো তো। ওপর থেকে দুটো বই সরাতেই পূর্বজন্মের অন্ধকার ঠেলে এই কবিতার বইটা হাতে উঠে এল। খুব সম্ভবত বইটা রদ্দিতে বেচে দিয়েছে সুচরিতা, শো-কেসে রাখার জায়গা হচ্ছিল না। সৌখিন ক্রকারি কিংবা বিদেশী পুতুলদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে হতভাগ্য বইটা মল্লিকদার স্টলে চলে এসেছে। আহা বেচারা! মল্লিকদার স্টলে পৌঁছনোর আগেও না-জানি কত বার হাত-বদল হয়েছে, কত জায়গায় বেকার বেকার ধাক্কা খেয়েছে। পয়সা দেওয়ার সময় বাউন্ড ভল্যুম ‘সালিম আলি’র সঙ্গে দুঃখী বইটাকেও মল্লিকদার হাতে গুঁজে দিল অনির্বাণ।
কেউকেটা কোনও লেখক নয়, অনির্বাণদের সঙ্গে ইংরিজি অনার্স পড়ত প্রীতম, তার একটা লাজুক লাজুক তিন ফর্মার প্রেমের কবিতার বই ছাপিয়েছিল বন্ধুরা, চাঁদা তুলে। সেটারই এক কপি সুচরিতাকে গিফট করেছিল অনির্বাণ। কাঁধের ঝোলায় বইটা ঢোকাতে ঢোকাতে মনে হল বাংলা সিরিয়াল-টিরিয়ালে এইরকম ঘটনা দেখালে লোকে নির্ঘাত অতিনাটকীয় বলে খিস্তি করত। গোলাপ-কুঁড়ি লুকিয়ে রাখা কবেকার একখানা কবিতার বই সাত ঘাটের জল খেয়ে ঘুরে ফিরে চুপচাপ তার ঝোলায় এসে শুয়ে পড়ল, ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? কোনও জিনিষ দিয়ে ফেরত নিলে নাকি কালীঘাটের কুকুর হতে হয়। বইটা অবশ্য আজ সে রীতিমত দাম দিয়ে কিনেছে। এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে যাবে, কুকুর-টুকুর হতে হবে না। হলেও বড়লোকের কোনও আদুরে মেয়ের কোলে চিহুয়াহুয়া বা টয় পুড্ল টাইপের নেটিপেটি কুকুর। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু ঘটনাটার একটা কার্য-কারণ তো থাকবে! আপাত নিরীহ একটা শনিবারের দুপুরে দুম করে এই বেওয়ারিশ বইটা চোখে পড়ে যাওয়ার কোনও যুক্তিই খুঁজে পেল না অনির্বাণ।
সবে সাড়ে তিনটে, এক্ষুণি বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। মল্লিকদার স্টল থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে অর্ককে মেসেজ করল অনির্বাণ, রুকু, কী করছিস? কোথায় তুই? আজ ফোর্থ স্যাটারডে, ব্যাঙ্ক হলিডে, অনির্বাণের ছুটি। অর্কর সেক্টর ফাইভ, আই-টি, অফিস আছে, বলেছিল তোর কাজ হয়ে গেলে ফোন করিস, বসকে পটিয়ে বেরিয়ে আসব। অর্কর প্রোজেক্ট লীড একটা সাউথ ইণ্ডিয়ান মেয়ে, অর্কর থেকে দু’-তিন বছরের বড়। অর্কর ধারণা ওর ওপর মেয়েটার গোপন টাল আছে। এবং ব্যপারটা বুঝে যাবার পর থেকে অর্ক ছোটখাটো সুবিধে নিয়ে যাচ্ছে, যেমন আজকে...। অর্ক মেসেজের জবাব দিল, ‘কফি হাউসে, কুচিপুড়ি নাচ প্র্যাকটিস করছি... চলে আয়।’ সিঁড়িতে বসে থাকা গাঁজাখোর আর ভিখিরিদের ডিঙিয়ে কফি হাউসে পৌছে অনির্বাণ দেখল অর্ক কোণের দিকে একটা টেবিলে বসে আছে, সামনে একটা মিষ্টি মুখের কৃষ্ণকলি মেয়ে। অনির্বাণকে দেখে হাত তুলে ডাকল অর্ক, কাছে যেতে আলাপ করিয়ে দিল, “মিট মীনাক্ষি রেড্ডী, মাই সিনিয়র কলীগ... অনির্বাণ, তোকে মীনাক্ষির কথা তো আগেই বলেছি।”
মীনাক্ষী নামের মেয়েটা সপ্রতিভ হেসে বাংলাতেই বলল, “কী বলেছে আমার সম্বন্ধে? শুনি একটু... ”
অনির্বাণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “বাঃ, আপনি তো সুন্দর বাংলা বলতে পারেন।”
মীনাক্ষী বলল, “আয়াম বর্ন এন ব্রট আপ ইন কলকাতা, বাবা আইআইএম জোখায় ইকনমিক্সের প্রোফেসর ছিলেন, আমার স্কুলিং লা মার্টে... অনেক বাঙালি বন্ধু ছিল, স্কুলে অবশ্য বাংলায় কথা বলা অ্যালাউড ছিল না। বাট আই লাভ্ড বেঙ্গলি ফুড, উইকেন্ডে প্রায়ই ওদের বাড়ি চলে যেতাম আড্ডা দিতে।”
অর্ক পাশ থেকে ফুট কাটল, “আড্ডা দিতে না খ্যাঁটন দিতে?”
মীনাক্ষী অর্ককে ধমক দিল, “জাস শাট আপ,” তারপর অনির্বাণের দিকে ফিরে বলল, “ইউ নো, দোজ মাসীমাজ ওয়ার রিয়ালি ওয়ান্ডারফুল লেডিজ... দে কুক্ড সাম্পচ্যুয়াস ফুড। আই হ্যাভ লারন্ট দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ফ্রম দেম। বেঙ্গলি রেসিপিজ টু...”
অনির্বাণ হেসে বলল, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি খুব ফুডি।”
মীনাক্ষী বলল, “ওই জন্যেই তো আজ অর্ক এখানে আসছে শুনে, ওর সঙ্গে কবিরাজি কাটলেট খেতে চলে এলাম, নেভার কেম টু দিস প্লেস আর্লিয়ার। অনেক গল্প শুনেছি জায়গাটার। তাছাড়া অর্ক আজকাল প্রায়ই অফিস বাঙ্ক করছে, চেক করে গেলাম অর্ক আমায় ঝুট বলে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে টাইম-পাস করে কি না। আফটার অল, অ্যাজ আ সিনিয়র কলীগ আমার একটা রেস্পন্সিবিলিটি আছে।”
মীনাক্ষীর বাংলায় অল্প টান আছে, অসাবধানে কথার মাঝখানে হিন্দি ইংরিজি শব্দ ঢুকে পড়ে। কিন্তু মেয়েটা ভারি হাসিখুশি, মিশুকে। অনির্বাণের মন ভালো হয়ে যাচ্ছিল। মীনাক্ষী বলল, “কাল সানডে, অর্কর সঙ্গে চলে আসুন, উই’ল টেক আ হেরিটেজ ওয়াক থ্রু দ্য ওল্ড স্ট্রিটস অভ নর্থ ক্যালকাটা। তারপর সবাই মিলে ফুচকা খাব।”
অর্ক বলল, “ব্যাস, হয়ে গেল, অল রোডস লীড টু ফুচকা।”
মীনাক্ষী মুখ ভেঙাল। অনির্বাণ কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, “রুকু তোর প্রীতমকে মনে আছে?”
অর্ক মুখ খোলার আগেই মীনাক্ষী খিল খিল করে হেসে বলল, “ওহ্ মাই গড, রুকু? অর্ক, দ্যাট’স ইয়োর পেট নেম, অ্যাম আই রাইট? রুকু, রুকু, ইউ নীড আ খুকু...”
অর্ক রাগ রাগ মুখ করে অনির্বাণের দিকে তাকাল। অনির্বাণ বুঝল কেলো হয়েছে। তাড়াতাড়ি কবিতার বইটা ঝোলা থেকে বার করে বলল, “আজ মল্লিকদার দোকানে প্রীতমের এই বইটা চোখে পড়ল। আমরা সবাই মিলে ছাপিয়েছিলাম...”
অর্ক বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাল, বলল, “আবছা আবছা মনে পড়ছে, তোর সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখেছি... উত্তরপাড়া না কোথায় থাকত।”
অনির্বাণ বলল, “উত্তরপাড়া নয়, শ্রীরামপুরে... কে জানে কোথায় আছে এখন! তারকেশ্বরের দিকে একটা স্কুলে পার্ট টাইমে ঢুকেছিল। তারপর আর কোনও খবর নেই। আজ এতদিন পর...”
মীনাক্ষী বলল, “ওকে গাইজ, আমি এবার উঠব। অনির্বাণ ডোন্ট ফরগেট এবাউট টুমরোজ প্রোগ্রাম। আমার মোবাইলটা ভুল করে অফিসের ড্রয়ারে ফেলে এসেছি। রুকুবাবু, একটা ওলা বুক করে দেবে প্লিজ।”
অর্ক বলল, “অনির্বাণ তুই একটু বোস, আমি ওকে নিচে ছেড়ে দিয়ে আসছি।”
অর্ক বইটা টেবিলের ওপর আধখোলা ছেড়ে রেখে গিয়েছিল, বল-পয়েন্ট পেনের লেখাটায় আবার চোখ পড়ল অনির্বাণের, ‘সু-কে অনি’, খানিকটা নিচে খুদে খুদে অক্ষরে আরও কী সব যেন লেখা। আগে নজরে পড়েনি। লেখাগুলো নীল কালিতে হলেও রঙের শেড আলাদা। সম্ভবত জেল পেন-এ লেখা। বইটা চোখের কাছে তুলে আনল অনির্বাণ, হাতের লেখাটাও ওর নয়। সুচরিতার হাতের লেখা কি? কে জানে? সুচরিতা অনির্বাণকে কোনোদিন চিঠি লেখেনি। নর্থ কলকাতার একটা ঠিকানা। গলির গলি তস্য গলি, ভগ্নাংশে লেখা বাড়ির নম্বর, কে লিখল? কেনই বা লিখল? নাম-ধান্ধা কিচ্ছু নেই, শুধু একটা ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকা ঠিকানা। কে থাকে ওই ঠিকানায়, কারা থাকে? তারা কি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নাকি পরিযায়ী পাখিদের মতো উড়ে এসে সাময়িক আস্তানা গেড়েছে? পাখি হলে সালিম আলির বইটা পড়ে হয়তো তাদের স্বভাব-চরিত্রর কিছু হদিশ পাওয়া যাবে। কাঁধে কে হাত রাখল! অনির্বাণ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল নিঃশব্দে কখন অর্ক এসে দাঁড়িয়েছে, বলল, “সুচরিতাকে এখনও ভুলতে পারিসনি, না রে?”
২
অনির্বাণ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “কী রে?”
অনির্বাণ বিড়বিড় বলল, “এই গলিটাই মনে হচ্ছে...”
শীতের সকাল। সবাই জড়ো হতে হতে সাড়ে নয়, দশ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখে ওরা হাঁটতে শুরু করেছিল। সেখান থেকে মার্বেল প্যালেস, শোভাবাজারের রাজবাড়ি... ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা হাঁটছিল, গল্প করতে করতে। মীনাক্ষী অনির্বাণকে বলল, “আমি বেশিক্ষণ কাউকে আপনি বলতে পারি না... ইজ ইট ফাইন টু কল ইউ তুমি?”
অনির্বাণ বলল, “অফ কোর্স, আমারও আপনি আজ্ঞে করতে অস্বস্তি হচ্ছিল। বন্ধুদের মধ্যে তুমিটাই ভালো।”
মীনাক্ষী বলল, “ইন ফ্যাক্ট, অনেক ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজে আপনি শব্দটাই নেই।”
অর্ক বলল, “বাট, মীনাক্ষি, ডোন্ট কাম ডাউন টু তুই। উইথ ইয়োর ক্রুকেড প্রোনান্সিয়েশান ইউ উড সাউন্ড লাইক আ চার্পিং বার্ড... টুই... টুই... টুই...”
মীনাক্ষী চোখ পাকাল, “অর্ক, ওপ্ন ইয়োর মাউথ, ওনলি হোয়েন আস্কড...”
অনির্বাণ ওদের খুনসুটি শুনতে শুনতে হাঁটছিল। কুমোরটুলি যাবার পথে গলিটার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “তোরা এগো, আমি আসছি...”
মীনাক্ষী জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কোনও রিলেটিভ থাকে এখানে?”
অনির্বাণ বলল, “না, না... একজন পরিচিত... জাস্ট গিভ মি টেন মিনিটস... আই’ল জয়েন...”
ওর এগিয়ে যেতে অনির্বাণ গলিতে ঢুকল। যদিও পিচ রাস্তা, এত সরু যে কোনওক্রমে গা বাঁচিয়ে একটা ট্যাক্সি চলে যেতে পারে। মনে হচ্ছিল এই রকম রাস্তা ধরেই মানুষ অন্তর্জলী যাত্রা করে, ফেরার দায় থাকে না। খানিকটা যাবার পর অবশ্য রাস্তাটা একটু চওড়া হল, দু’-দিকে পুরনো আমলের ঝুল-বারান্দা, রোয়াকওয়ালা বাড়ি। ঠিকানার নম্বর খুঁজে দেখল একটা খোলা দরজা, ভেতরে কয়েক ধাপ অন্ধকার সিঁড়ি, দোতলায় উঠে গেছে। সিঁড়িতে পা রাখতেই খস খস শব্দ তুলে একটা কালো বেড়াল নেমে গেল পাশ কাটিয়ে। অনির্বাণ দোতলায় উঠে দেখল একটা চৌখুপির তিনদিকে তিনটে শক্ত কাঠের দরজা। ওপরে চক খড়ি দিয়ে সাংকেতিক নম্বর লেখা, সম্ভবত পোলিওর টীকা সংক্রান্ত অথবা জনগণনার। তাছাড়া ঘর চেনবার আর কোনও আইনসম্মত উপায় নেই। চোখ বুজে সামনের দরজাটার পাশে ঝুলন্ত তারে আটকে থাকা কলিং বেলটা বাজিয়ে দিল। মিনিট দু’-এক পরে ঘরের ভেতরের অন্ধকার ঠেলে একজন ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। ভদ্রমিহিলাকে দেখে অনির্বাণ চমকে উঠল, বয়স চল্লিশের আশেপাশে, কাগজের মতো সাদা মুখ, কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে গালের সমস্ত রং শুষে নিয়েছে। ভদ্রমহিলা ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে চাই?”
অনির্বাণ কী বলবে কিছু ভেবে আসেনি। আচমকা প্রশ্নের সামনে পড়ে ঢোঁক গিলল, কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করল, “এখানে সুচরিতা বলে কেউ থাকে?”
ভদ্রমহিলা অস্ফুট স্বরে বললেন, “না...”
কথা চালাবার মতো কিছু মাথায় আসছিল না। অনির্বাণ ভাবল এখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। ভদ্রমহিলা দরজা বন্ধ করার জন্য হাত উঠিয়েছিলেন, একটা লোক খালি গায়ে কোমরে লুঙ্গির কশি গুঁজতে গুঁজতে ভদ্রমহিলার পেছনে এসে দাঁড়াল। লোকটার গায়ে বনমানুষের মতো ঘন লোম, চাহনিতে সন্দেহ। অনির্বাণ ফিরে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কুৎসিত গলায় কেউ চেঁচিয়ে উঠল, “আজকাল ঘরেও লোক বসাচ্ছিস না কি!”
অনির্বাণ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, গাড়ল লোকটাই হবে, আড়াল থেকে মৃদু মেয়েলি প্রতিবাদ... একটা চড়ের শব্দও পেল মনে হল। নামার সিঁড়িতে পা দিয়েও থমকে গেল অনির্বাণ। ভয়ানক বিব্রত বোধ করল, তার জন্য মিছিমিছি একজন নিরীহ মানুষ অপদস্থ হল। সিঁড়িটা চাতালের থেকে ঘুরে গেছে, দেওয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে উত্তরায়ণের টুকরো টুকরো আলো এসে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনির্বাণ নেমে যেতে যেতে ভাবল এখানে না এলেই ভাল হত। একটা উটকো ঠিকানা দেখে আগুপিছু না ভেবে আহাম্মকের মতো দৌড়ে চলে এল। নিজেকেই দুষল, জ্ঞানগম্যি আর কবে হবে? হাঁটতে হাঁটতে প্রায় গলির মুখে চলে এসেছিল, পেছন থেকে কেউ হাত ধরে টানল, “কাকু, কাকু! এক মিনিট! এই নাও...”
একটা দশ বারো বছরের বাচ্চা ছেলে, হাঁপাচ্ছে, তার এক হাতে একটা রাবারের বল, অন্য হাতে মুঠো করে এক টুকরো কাগজ ধরা। ছেলেটা অনির্বাণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অনির্বাণ হতভম্ব হয়ে বলল, “কী?”
ছেলেটা বলল, “মা, এটা তোমায় দিতে বলল।”
অনির্বাণ কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে দেখল এবড়ো খেবড়ো হাতের লেখায় একটা মোবাইল নম্বর লেখা। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ছেলেটার মা কে, কোথায় থাকে, কাগজের টুকরোটা সত্যি সত্যি তার জন্যই কি না। চোখ নামিয়ে দেখল বাচ্চাটা ভাগলবা, রাবারের বলটা ড্রপ দিতে দিতে দৌড় লাগিয়েছে। কে পাঠাল বাচ্চাটাকে? যে ভদ্রমহিলা দরজা খুলে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিই কোনওভাবে ঘরের লোকের দৃষ্টি এড়িয়ে কাগজের টুকরোটা পাঠিয়েছেন? নাকি অন্য দুটো বন্ধ দরজার কোনও একটার ফাঁক দিয়ে তাকে কেউ লক্ষ করছিল? অনির্বাণের মাথা কাজ করছিল না। আগামুড়ো জানা নেই, এই মোবাইল নম্বরটা নিয়ে সে ছাতার মাথা কী করবে? কাগজটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল। কী মনে করে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। অর্করা অনেকটা এগিয়ে গেছে। অনির্বাণ পা চালাল। সুচরিতা কোনওদিনই অনির্বাণকে পাত্তা দেয়নি। সর্বদা রূপের অহংকারে মটমট করত। অনির্বাণেরই বা কী দায় পড়েছে একটা ফসিল হয়ে যাওয়া প্রত্ন-সম্পর্কর হদিশ খুঁজে বেড়ানোর। সাত বছর ধরে বুকের ক্ষতটার ওপর একটা জগদ্দল পাথর চাপিয়ে রেখেছে। খোঁড়াখুঁড়ি করা মানেই অব্যক্ত যন্ত্রণার উৎস-মুখ থেকে পাথরটা সরিয়ে নেওয়া। এই পাগলামির কোনও মানে হয় না। পাগলেও নিজের ভাল বোঝে। অনির্বাণ ভাবল, চুলোয় যাক। সে আর এই নিয়ে মাথা খারাপ করবে না।
গলির বাইরে পা রেখেই মনে হল এমন তো নয় সুচরিতা কোনও বিপদের মধ্যে আছে। সরাসরি পারছে না, তাকে লুকিয়ে চুরিয়ে মেসেজ পাঠাচ্ছে। কলকাতার একটা নামকরা ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে হয়েছিল সুচরিতার। অনির্বাণকে অবশ্য বিয়ের কার্ড পাঠায়নি। কে যেন পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে খবরটা জানিয়ে গিয়েছিল। আজকাল রক্তের সম্পর্কই মানুষ অবলীলায় ধুয়ে ফেলে, অন্যান্য সম্পর্কগুলোর তো কথাই নেই। কী পরিস্থিতিতে মেয়েটা আছে কে জানে! অনির্বাণ পকেট থেকে বার করে নম্বরটা দেখল আর একবার। আজকাল এক ধরনের অ্যাপ হয়েছে। মোবাইল নম্বর দিলে মালিকের নাম ঠিকানা বলে দেয়। হাঁটতে হাঁটতেই নম্বর দেখে কী-প্যাডে আঙুল ছোঁয়াল অনির্বাণ, দেখল নম্বরটা একটা এনজিওর, ভদ্রেশ্বরের ঠিকানা। যোগাযোগ করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারল না। ফোন করে কী ছাই বলবে?
“অনি... এই অনি,” অর্ক চিৎকার করে ডাকছে, “এই যে, এদিকে...”
কুমারটুলির থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে ওরা দুজন। অনির্বাণ এগিয়ে গেল। কাছে যেতে অর্ক ভুরু নাচাল। অনির্বাণ বলল, “বলছি, আর একটা চা বল।”
ওদের কাছ থেকে ঘটনাটা লুকিয়ে রাখার মানে হয় না। চায়ে চুমুক দিয়ে অনির্বাণ বলল, “তোদের হেল্প চাই।”
অর্ক বলল, “পাঁয়তাড়া না করে ঝেড়ে কাশ।”
অনির্বাণ বলতে শুরু করল, এক নিঃশ্বাসে প্রীতমের কবিতার বইয়ের মধ্যে লেখা ঠিকানা থেকে শুরু করে কোঁচকানো কাগজের টুকরোয় লেখা মোবাইল নম্বর পর্যন্ত বলে থামল। দম নিল। ওদের বলতে পেরে হালকা লাগল, যেন মাথা থেকে জ্বর নামল। মীনাক্ষী বলল, “ইন্টারেস্টিং...”
অর্ক বলল, “কী নাম বললি এনজিওটার?”
অনির্বাণ বলল, “সৌহার্দ্য না কী যেন একটা নাম...”
অর্ক মোবাইলে খুটখাট করে বলল, “এই দেখ গুগল কী বলছে... সৌহার্দ্য ফাউন্ডেশন, বাপরে কী খটোমটো নাম! একটা রেসকিউ হোম চালায়, ভদ্রেশ্বরে, ডেস্টিচ্যুট মেয়েদের জন্য, অ্যাসিড অ্যাটাক সারভাইভারদের রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ করে। পুলিশ রেড-লাইট এরিয়ায় থেকে যে সব মেয়েদের উদ্ধার করে আনে তাদেরও সাময়িক আস্তানা দেয়, যতক্ষণ না তাদের পরিবারের লোকজন এসে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অনেক সময় অবশ্য পরিবারের লোকেরা আবার এদের বেচে দেয়... সে ক্ষেত্রে তারা হয় পুরনো পেশায় ফিরে যায় নয়তো সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করে...।”
অনির্বাণ অসহিষ্ণু হয়ে বলল, “কী যা-তা বলছিস!”
অর্ক হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি নয়, গুগল-আন্টি তাই বলছে... নাম্বারটা দেখি...”
অনির্বাণ পকেটে হাত চালিয়ে কাগজটা বার করে দিল। অর্ক মোবাইলে নম্বরটা ডায়াল করে ফোনটা স্পিকারে দিল। রিং হচ্ছে... এক মহিলা কন্ঠ উত্তর দিল, “কাকে চাই?”
অর্ক বলল, “সৌহার্দ্য রেসকিউ হোম? সুচরিতা সান্যালের সঙ্গে কথা বলা যাবে?”
মহিলা বললেন, “এখানে সুচরিতা সান্যাল বলে কোনও ইনমেট নেই। সুচরিতা রায় বলে একজন এসেছে, দিন দশেক আগে... আপনি কি তার সঙ্গে... আপনি কে বলছেন?”
অর্ক বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, রায়... সুচরিতা রায়... বিয়ের আগে সান্যাল ছিল, আমি ওর মামাতো দাদা, একবার ডেকে দিন না।”
মহিলা বলল, “ধরুন, দেখি...”
কয়েক মিনিট কোনও সাড়া-শব্দ নেই। তারপর মৃদু গলায় কেউ ‘হ্যালো’ বলল। অর্কর দিকে তাকিয়ে ফোনটা স্পিকার থেকে বার করে কানে নিল অনির্বাণ, “সুচরিতা, আমি অনির্বাণ বলছি।”
অন্য দিক থেকে ফোঁপানির শব্দ এল, ফিসফিস করে কেউ বলল, “অনি, আমি আর পারছি না, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে, এখান থেকে আমায় নিয়ে যাও প্লিজ... প্লিজ অনি...”
৩
মীনাক্ষী বলল, “অনির্বাণ, আই থিঙ্ক আই নো ইয়োর সু, আই মীন সুচরিতা... সুদেষ্ণা রায় আমাদের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। আমি অনেকবার ওদের বাড়িতে গেছি। ওর নতুন বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। নাম বলেছিল, সুচরিতা। সুদেষ্ণার সঙ্গে এখনও আমার যোগাযোগ আছে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেয়ার ইজ সামথিং সিরিয়াসলি রং সামহোয়্যার... কলকাতার ব্যবসায়ী মহলে রায় পরিবারের নাম আছে, উল্টা-সিধা কিছু হলে জানতে পারতাম।”
অর্ক বলল, “তুই ঠিক শুনেছিলি? সুচরিতার গলা? চিনতে ভুল করিসনি তো?”
ওরা মীনাক্ষীর গাড়িতেই ভদ্রেশ্বর রওনা দিয়েছিল। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পড়ে মীনাক্ষী সামান্য কিন্তু কিন্তু করেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। অনির্বাণ বলল, “তাহলে মেসেজগুলো কে পাঠাচ্ছে? প্রীতমের বইতে লেখা ঠিকানা, মোবাইল নম্বর...”
অর্ক মীনাক্ষীকে বলল, “সুদেষ্ণার ফোন নাম্বার আছে তোমার কাছে? একটা ফোন করে দেখো না, কী বলে।”
মীনাক্ষী বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম, ওয়েট...”
মোবাইলে নম্বর খুঁজে ডায়াল করল। স্পিকার অন ছিল, মীনাক্ষী দু’-চারটে খেজুরে আলাপ... ‘কতওদিন পর তোর সঙ্গে কথা হচ্ছে’, ‘মাসীমা কেমন আছেন রে’, ইত্যাদি করে কাজের কথায় এল, বলল, “আর তোর সেই বৌদির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, দ্য লেডি উইথ বিউটিফুল আইজ... সুচরিতা না কী যেন নাম, হাও ইজ শী ডুইং?”
সুদেষ্ণা বলল, “দাদা বৌদি তো কানাডায় মাইগ্রেট করে গেছে, লাস্ট ইয়ার...”
মীনাক্ষী আরও দু’-একটা সাধারণ কথা বলে ফোন কেটে দিল। অর্ক ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “শান্তি হয়েছে? এবার কী বলবি? ফালতুই মরীচিকার পেছনে দৌড়োচ্ছিস। আমার তো মনে হচ্ছে কেউ তোকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছে।”
মীনাক্ষী বলল, “ওয়াট ইজ মরীচিকা?”
অর্ক বলল, “এই মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল! মরীচিকা ইজ মিরাজ... ইল্যুশন... দূর থেকে দেখলে টলটলে জল, কাছে গেলে বালি আর বালি, ধূ-ধূ মরুভূমি।”
অনির্বাণ বলল, “আমাকে ফাঁসিয়ে কার কী লাভ?”
অর্ক গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “সে আমি কী জানি?”
অনির্বাণ অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “দেখাই যাক না, সে রকম বুঝলে চলে আসব।”
রবিবারের দিল্লী রোড মোটামুটি ফাঁকা। জল-জঙ্গল, ধানক্ষেত, পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি, নিয়মিত দূরত্বে গজিয়ে ওঠা দু’-চারটে ভুঁইফোঁড় ধাবার পাশ কাটিয়ে গাড়িটা একটা সরু পিচের রাস্তা ধরল। ঠিকানাটা ভদ্রেশ্বর রেল স্টেশনের পশ্চিমে। এদিকটায় এখনও হুড়মুড় করে শহর ঢুকে পড়েনি। রেসকিউ হোমটা বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতর গাছপালার ছায়ায় এক সারি ব্যারাক, অন্য দিকে একটা দু’-তলা বাড়ি। বারান্দা দিয়ে উঠে ছিমছাম রিসেপশন, একদিকে একটা সোফা পাতা রয়েছে, সেন্টার টেবিলের ওপর সকালের খবরের কাগজ। রিসেপশনের ডেস্কে বসা ভদ্রমহিলা একটু অবাক হয়েই বললেন, “আপনারা সুচরিতার বাড়ির লোক? মেয়েটা তো ফোন নম্বরই দিচ্ছিল না। বোঝেনই তো এখানে তো আর কাউকে অনির্দিষ্টকাল বসিয়ে রাখা যায় না। রোজ দশটা করে নতুন মেয়ে আসে। আপনারা বসুন, আমি খবর দিচ্ছি।”
অর্ক সোফায় বসে খবরের কাগজটা টেনে নিল। অনির্বাণের অস্থির লাগছিল। উঠে গিয়ে রিসেপশনের ডেস্কে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। রিসেপশনের পাশ দিয়ে ভেতরে যাবার করিডোর, অর্ধেক খোলা দরজা। কয়েক মিনিট পরে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। মেয়েটার পরনে একটা সস্তার সালোয়ার কামিজ, মুখ মাথা সুতির কাপড়ের ওড়না দিয়ে ঢাকা। রিসেপশনের মহিলা চাপা গলায় বললেন, “রাক্ষস, রাক্ষস, নইলে কেউ এভাবে একটা মেয়ের সর্বনাশ করতে পারে!”
মেয়েটা কান্না ভেজা গলায় বলল, “অনি, এসেছ? খুঁজে পেলে তা-হলে...”
মেয়েটা অনির্বাণের দিকে এগিয়ে আসছিল। অর্ক সোফা থেকে উঠে এল, বলল, “এক মিনিট, কে আপনি? মুখ থেকে ওড়নাটা সরান, আমরাও দেখি।”
মেয়েটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্কর নিষেধ স্পষ্টতই তাকে দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রিসেপশনের মহিলা বললেন, “ওকে দেখলেই কি চিনতে পারবেন? দুষ্কর্মটি যে করেছে, সে কি আর চেনবার জো রেখেছে? শুনেছি নাকি ঘরের মানুষ। আদৌ মানুষ না পিশাচ কে জানে!”
অর্ক বলল, “কী নাম আপনার? অনির্বাণকে কীভাবে চেনেন?”
মেয়েটা বলল, “রুকু, আমি সুচরিতা...”
অর্ক হাসল, “হোম ওয়ার্ক ভালই করেছেন। আমার ডাকনাম পর্যন্ত... সে যাক, শুনলে খুশি হবেন, আসল সুচরিতা আপাতত স্বামীর সঙ্গে কানাডায় সেটল্ড।”
মেয়েটা মাথা ঝাঁকাল, বলল, “না, না, ওর সঙ্গে যে মেয়েটা কানাডা গেছে তার নাম অপর্ণা। ওদের বাধা দিয়েছিলাম বলেই... তাও হয়তো রেহাই পেয়ে যেতাম, কিন্তু আমায় ছেড়ে দিলে রায় বাড়ির অনেক লুকনো খবর ফাঁস হয়ে যেত।”
অর্ক বলল, “ভালই গল্প ফেঁদেছেন, কী ফাঁস হয়ে যেত?”
মেয়েটা থেমে থেমে বলল, “ওদের বাড়ির বৌ হওয়া মানেই সে এজমালি সম্পত্তি, পরিবারের যে কেউ... ছোট, বড়... সবাই তাকে ভোগ করতে পারে... ওরা ভেবেছিল, আমি বেরিয়ে এলে সে সব কথা চাউর হয়ে যাবে। একবার মিডিয়ার কানে গেলে রায় পরিবারের যাবতীয় সুনাম মাথায় উঠত।”
অর্ক একটু থতমত খেল। সম্ভবত এই দৃষ্টিকোণ থেকে সে ব্যাপারটা চিন্তা করেনি। বনেদী ব্যবসায়ী পরিবারের অনেক লুকনো কেচ্ছা থাকে। কে জানে মেয়েটা সত্যি বলছে না মিথ্যে? মীনাক্ষী এতক্ষণ চুপ করে কথা কাটাকাটি শুনছিল, এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা, বলুন তো আমি কে?”
মেয়েটা ঘাড় নাড়ল, “মনে করতে পারছি না। আগে কি দেখেছি আপনাকে?”
মীনাক্ষী বলল, “সুদেষ্ণা আমার বন্ধু...”
মেয়েটা বলল, “সুদেষ্ণার অনেক বন্ধুই আসত, কলেজ থেকে, দল বেঁধে। মনে পড়ছে না।”
অর্ক বলল, “ধরা পড়ে গেলেন তো? এবার দয়া করে ওড়নাটা সরান। নিজের আসল পরিচয়টা দিন। বলুন অনির্বাণকে ঠকাতে চাইছেন কেন?”
মেয়েটা এক ঝটকায় মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিল। অ্যাসিডে কোঁচাকানো, অবয়বহীন একটা মুখ, ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখের মণি, বলল, “আমাকে দেখতে যখন তোমাদের এতই আগ্রহ... দেখো... প্রাণ ভরে দেখো।”
অর্ক মুখ ফিরিয়ে নিল। মীনাক্ষী অর্কর হাত চেপে ধরল। মেয়েটার চেহারা চোখে দেখা যায় না। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “কী হল রুকু? মুখ ফিরিয়ে নিলে কেন?”
অর্ক জোর করে নজর ফেরাল। সাত বছর আগের সুচরিতার সঙ্গে মেয়েটার কোনও মিল নেই। সুচরিতার সোনার মতো গায়ের রং, দেবী হেন চোখ, অপরূপ পানপাতা মুখশ্রী, যতক্ষণ সামনে থাকত অনির্বাণ হাঁ করে গিলত। আড় চোখে অনির্বাণের দিকে তাকাল অর্ক, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চেনা যায় না। সত্যিই চেনা যায় না। মেয়েটা বলল, “অনি, তুমিও কি আমায় চিনতে পারছ না?”
অনির্বাণ জবাব দিল না। মেয়েটা বলল, “শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। দিন দুপুরে খোলা রাস্তায় অ্যাসিড ছুঁড়ল। রাস্তার লোকেরা তুলে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। রায় পরিবারের হাত অনেক লম্বা। হাসপাতালেই আমায় শেষ করে দিত। সেখান থেকে পালালাম। তারপর সাত ঘাটের জল খেয়ে জয়ন্তীদির বাড়ি, জয়ন্তীদি এখানকার সেক্রেটারি... ।”
অর্ক বলল, “কিছু মনে করবেন না, আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে আপনিই সুচরিতা, মানে অনির বন্ধু সুচরিতা?”
মেয়েটা বলল, “আমার এক মাসতুতো দিদি থাকে কলকাতায়, আমায় খুব ভালবাসত, অনির্বাণের কথা জানত। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় আমার সব বইপত্তরগুলো ওকে দিয়ে এসেছিলাম। এখানে আসার পর ফোন করে এই রিসেপশনের দিদির নম্বরটা দিয়েছিলাম ওকে, যদি কোনওভাবে অনির হাতে পৌঁছে দিতে পারে। দুঃসময়ে অনি ছাড়া আর কারও কথা মনে পড়েনি।”
অর্ক বলল, “তাতে কী প্রমাণ হয়?”
মেয়েটা বিস্ফারিত চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অর্ক এগিয়ে গিয়ে অনির্বাণের কাঁধে হাত রাখল, বলল, “চল, অনি, এনাফ ইজ এনাফ...”
মেয়েটা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রিসেপশনের মহিলা বললেন, “এটা কিন্তু আপনাদের অন্যায়, বললেন বাড়ির লোক, অথচ... এত কিছু বলার পরও অস্বীকার করছেন।”
মেয়েটা আবার ওড়না দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে নিচ্ছিল। অন্ধকার করিডোর ধরে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। আলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে লাগে। মনে হয় ছুরির ফলার মতো চোখের মধ্যে বিঁধে যাচ্ছে। চোখ থেকে চোখের পেছনে নেমে যাচ্ছে... আলোকিত স্মৃতি বড় কষ্ট দেয়। কাঁধ থেকে অর্কর হাত সরিয়ে দিয়ে অনির্বাণ এগোল। অর্ক ওকে আটকাতে গেল। অনির্বাণ শুনল না। এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরল, বলল, “সু, কোথায় যাচ্ছ? আবার আমায় ফেলে পালাবে?”
মেয়েটা ফিরে দাঁড়াল। নির্দ্বিধায় অনির্বাণের বুকে মাথা রাখল। অনির্বাণ তাকে কাছে টানল, পিঠে হাত রাখল। স্নেহের স্পর্শ পেয়ে সুচরিতা কেঁপে উঠল একবার। অনির্বাণের মনে হল মেয়েটা যেন সালিম আলির পাখি, নিয়মমাফিক পরিভ্রমণ সাঙ্গ করে আবার চেনা জায়গায় ফিরে এসেছে। রূপ শেষ হয়ে গেলেই বোধ হয় এই রকম অপরূপ সম্পর্কের শুরু হয়। আহা পৃথিবীর সব সম্পর্কই যদি এমন শর্তহীন, চাহিদাহীন হত! অর্ক অস্ফুট স্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল। মীনাক্ষী অর্কর হাত চেপে ধরল।
রেসকিউ হোমের নিয়ম অনুসারে সই-সাবুদ সেরে বেরোতে খানিকটা দেরি হল। সুচরিতা সালোয়ার কামিজ ছেড়ে একটা শাড়ি পরে এল। গাড়িতে সুচরিতার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসেছিল অনির্বাণ। দু’জনের কেউ কথা বলছিল না। অনির্বাণ ভাবছিল, মেয়েটা অনেক কিছুই জানে, আবার জানে না। সুচরিতার কোমরের কাছে একটা জড়ুলের দাগ ছিল। সেটা তার নেই। কিন্তু তাতে সত্যিই কী কিছু যায় আসে? হোক না অন্য মেয়ে, তবু তো সে অনির সু। অনিকে চায়। ওকে সুচরিতা ভেবে ভালবেসেই অনির্বাণের জীবন কেটে যাবে। সুচরিতা ভাবছিল, অনির্বাণ কিছুই ভোলেনি। এমনকি কোমরের চিহ্নটা পর্যন্ত... বেরোবার সময় সন্ধানী চোখে সেটার খোঁজখবর করছিল। জয়ন্তীদির তত্ত্বাবধানে ওখান থেকে মাংস তুলে প্লাস্টিক সার্জারি শুরু হয়েছে। সেই দাগটা আর ফিরে আসবে না। যাক গে, ওই একটা দাগের বদলে শরীরে আরও কত নতুন কাটাছেঁড়ার দাগ দেখতে পাবে অনির্বাণ। এই তো সবে চেনা জানার শুরু।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)