Subscribe to Magazines






পরবাসে দীপঙ্কর ঘোষের
ছবি


সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের
লেখা

এবং বই



ISSN 1563-8685




সঞ্জীবনী



খ্রীষ্টাব্দ আনুমানিক ১৪২০। বৈশাখ। একে গরম, তায় অপমান। জানে সে হিসেবে ভুল করেনি, তবুও খাজাঞ্চিমশাই তার নামে মিথ্যে নালিশ করে তাকে কটা কড়া কথা শোনালেন মন্ত্রীমশায়ের কাছে। অনাথ ব্রাহ্মণ কিশোর সুব্রহ্মণ্যম মনটা খারাপ করে রাজসভার ঠিক বাইরেটায় একটা নিমের ছায়া দেখে বসে রয়েছে। হঠাৎ শুনলো সিংহাসন থেকে রাচাকোন্ডার মহারাজ সিংহভূপাল স্বয়ং তাকে বলছেন - ওরে ও সুব্বু দেখ তো বাবা একবার দূরে কারা মোড় ঘুরে রাজপথে উঠলেন, ব্রাহ্মণ মনে হচ্ছে। যা এগিয়ে যা একটু।

মন্ত্রীমশাই বলে ফেললেন - এই রে, মহারাজ আবার কোন এক ভিখারীর পাল্লায় পড়বেন, আপনার দানের সুনাম তো রাজকোষকে সত্যি মুশকিলে ফেলল।

আপনি থামবেন মহামাত্য, দুঃস্থ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সাহায্য করা রাজার দায়িত্ব, নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে এটুকু জানেন না?

না না মহারাজ, তা বলিনি আমি তা বলিনি, আসলে অনেকেই তো আপনাকে উলটো পালটা কাহিনী শুনিয়ে যায়, তাই আর কি।

বলতে বলতে এসে পড়েছেন প্ৰৌঢ় ব্রাহ্মণ, সঙ্গে এক যুবক, তাঁদের পিছনে সুব্বু। খড়মটি সভার বাইরে খুলে রেখে এক পা এগিয়ে ব্রাহ্মণ বললেন - জয় হোক রাচাকোণ্ডাধিরাজের, মঙ্গল হক। আমরা আসছি কোলাচরম থেকে। আমরা এ রাজ্যে আশ্রয়প্রার্থী।

আসুন আসুন পণ্ডিত, প্রণাম হই, সব ব্যবস্থা হবে, অত দূর থেকে আসছেন, আজ ব্রাহ্মণশালায় বিশ্রাম করুন, কাল সব কথা হবে। ওরে এই সুব্বু, দেবতাদের দেখিয়ে নিয়ে যা, যা যা প্রয়োজন সব দেখিস বাবা। পণ্ডিত মশায়, সব গোত্রের সব ব্যবস্থা আছে, স্বপাকের প্রয়োজন হবে না। ওরে, রানিমাকে একবার পাকশালাটা নিজে দেখে দিতে বলে আসিস।

ওনারা প্রাসাদের অন্দরে চলে গেলেন, ব্রাহ্মণশালাটা সে দিকেই কি না। আর মন্ত্রীমশাই--

দেখলেন তো মহারাজ, কিছু না বলেই আপনাকে কীরকম …

শাস্ত্রীমশায়, স্বচক্ষে দেখলুম দেবী ভারতী পদব্রজে ওনাদের পিছনে পিছনে আসছেন, সুব্বু ব্যাটা একটা ভূত, তাই কিছু বোঝেনি।

মহারাজার চক্ষুদ্বয় আর্দ্র। ভর্ৎসনাটা বুঝতে পেরে মহামাত্য চুপ করে গেলেন।


পরের দিন প্রাতেই ব্রাহ্মণ দুজন সভায় হাজির। ততক্ষণে তাঁদের পরিচয় ভালোভাবেই জেনে নিয়েছেন মহারাজ সিংহভূপাল।

স্থান নিয়ে রাচাকোণ্ডাধিরাজকে বলতে শুরু করলেন পণ্ডিত--

মহারাজ, এ আমার পুত্র। আমরা কোলাচরমের বাসিন্দা। চার পুরুষে ওখানেই অধ্যাপনা করি। বাহামনি রাজ্যে আদর ঠিকই পাই, কিন্তু আপনি তো জানেন সে রাজ্য পড়তির মুখে। তার ওপর সুলতান ফিরোজ শাহ যদিও দেবভাষার যথেষ্ট মর্যাদা রাখেন, নথিপত্র সংস্কৃতে লিখলে স্বীকার করে নেন, তাও অন্য রাজপুরুষরা এমন কি যাঁরা আমাদেরই উচ্চবর্ণের তাঁরাও ওই সুদূর পারস্যের ফার্সিই পছন্দ করেন। মানছি, ফার্সি অতি উন্নত ভাষা, আমি নিজেও জানি, সম্প্রতি প্রয়াত শিরাজের কবি হাফিজ সাহেবকে তো আমি মহাকবিই বলব, কিন্তু বড়ো অস্বস্তি হয় যখন দেখি যে হাফিজ আওড়ানো ব্রাহ্মণগণও মাঘ ভারবি দূরের কথা, ভাসের বা কালিদাসের নামও শোনেন নি!

তাই মহারাজ, ঠিক করেছি এমন ভাবে সর্বসাধারণের জন্য ভারতভূমির মহাকাব্যগুলির সহজবোধ্য টীকা লিখে রাখব যাতে সেগুলির সমাদর পুনরায় ফিরে আসে। আমার ছেলেও এ কাজে আমাকে সাহায্য করে, আমাদের আর কিছু নেই, এই কাজই আমাদের জীবনের ব্রত এখন। অনেকটাই করেও ফেলেছি, আজ্ঞা পেলেই ফিরে গিয়ে পুঁথিপত্র পরিবার সব নিয়ে আসব।

বিজয়নগরের সঙ্গমসম্রাট দেবরায় আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন, অনেক সাংসারিক প্রলোভনও ছিল সেখানে চলে যাওয়ার, কিন্তু আমরা বুঝেছি যে আমাদের এই সরল জীবনযাপন সেখানে সম্ভব হয়ে উঠবে না, সে রাজ্য কুবেরের ঐশ্বর্য্যমণ্ডিত।

ওদিকে আবার কাকতীয় বংশও লুপ্তপ্রায়, মুসুনুরি নায়কেরা তো দাঁড়াতেই পারলেন না। চারিদিকে বড়ো দুর্ব্যবস্থা আজ।

অনেক ভেবে দেখলাম মহারাজ, আপনার রাচাকোণ্ডায় আশ্রয়ই মনে হল আজ আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ।

থামলেন ব্রাহ্মণ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন মহারাজ সিংহভূপাল--

মহামহোপাধ্যায়! আপনাদের পরিকল্পনা শুনলাম। সাধুবাদ ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না। রথ, শকট যেমন ইচ্ছা নিয়ে আপনি আপনার মহোপাধ্যায় পুত্রকে পাঠিয়ে দিন, সমস্ত পরিবার ও পুঁথিপত্র নিয়ে আসুন তিনি। আমি স্পষ্ট দেখছি আপনাদের এই মহান ব্রত আমাদের এই ক্ষুদ্র রাচাকোণ্ডার মুখ সারা ভারতে উজ্জ্বল করবে। আমি বুঝতে পারছি আপনাদের জন্যই দেবভাষা ভারতে পুনরুজ্জীবিত হতে চলেছে; যদি অনুমতি দেন তো আপনাদের রচনার নাম আমি দিলাম “সঞ্জীবনী”।

রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান!

রাজসভার প্রতিটি কোণ স্তম্ভিত হয়ে রইল।

মহামহোপাধ্যায় কোলাচরম মল্লিনাথ সুরি দাঁড়িয়ে উঠে মহারাজকে পুনঃপুনঃ আশীর্বাদ করতে লাগলেন।

বহু দুষ্কর্মের জন্য মোক্ষপ্রাপ্তি আর হয়ে ওঠেনি সুব্বুর। সতেরো বার আরো জন্মেছে এ পর্যন্ত।


আষাঢ়ের রাতে বর্ষণমন্দ্রণসঙ্গীতে সুপ্ত ছিলাম। স্বপ্নে এই সব ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে কোথায় যে পালাল সুব্রহ্মণ্যমটা!

মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ঠাকুরদাদা সঞ্জীবনী খুলে পড়াতে পড়াতে দেখিয়েছিলেন মহাকাব্য নিয়ে কেমন খেলা করেছিলেন মল্লিনাথ!

আর মনে পড়ে গেল সেই কত জন্ম আগের রাজসভা, সেই মহারাজ, সেই মহাপণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় …




(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)