--কেন? চিনতে পারছিস না নাকি? নব্বইয়ের মাধ্যমিক ব্যাচ। পরেশ স্যারের কোচিং-এ পড়ত। তুইও তো ওর সাথে আমাদের ব্যাচেই…
--হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। সেই রোগা, শ্যামলা মেয়েটা। পড়াশোনায় আমার থেকে ভালো ছিল। মাঝে মাঝে স্যারের কথা বুঝতে না পারলে ওর কাছে অঙ্কটা বুঝে নিতাম।
--সেদিন মেট্রোতে দেখা হল। অনেক মোটা হয়ে গেছে। চিনতেই পারছিলাম না। তবু মুখের আদলটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন খুব চেনা চেনা। আমি একটু দ্বিধা নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কবিতা না?”
ভীষণ অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বলল, “আপনাকে তো ঠিক…”
--আমি রঞ্জন, তোমাদের সাথে পরেশ স্যারের কোচিং-এ পড়তাম।
--ওঃ হো! সে কি আজকের কথা? আপনি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছেন। গালে চাপ দাড়ি, বাব্বাঃ।
--তুমিও তো অনেক বদলে গেছো। কোথাও চাকরি করো না কি?
--হ্যাঁ, একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে এগজিকিউটিভ সেক্রেটারি।
--বাহঃ খুব ভালো। তোমার বিয়ে হয়েছে?
কবিতা এবার গাল ভরে হাসল। বলল, “আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। একজন ক্লাস ফাইভে আর একজন ক্লাস থ্রি-তে।”
--তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না। তোমার হাসব্যান্ড কী করেন?
--ও একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে খুব উঁচু পোস্টে আছে। ওদের ফরেন কোলাবরেশনে কাজ হয়।
--আচ্ছা। তা এখন থাকো কোথায়?
--লেকটাউনে। আরে, তখন থেকে তো আমার কথা্ই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন। আপনার কথা বলুন কিছু।
--প্রথমত আমাকে আর আপনি বলবে না। আমি তোমাদের সাথে একই কোচিং-এ পড়তাম। যদিও আমার স্কুল ছিল আলাদা। আমি আর তন্ময়--আমরা একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তোমার মনে আছে তন্ময়কে? গায়ের রঙটা ছিল চাপা, ভাসা ভাসা চোখ?
--মনে থাকবে না আবার? রোজ রোজ কোচিং-এ এসে একটা না একটা অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে বলত। সব ক’টা করে আনতে পারত না। হোমটাস্কের ব্যাপারে আমাদের পরেশ-স্যার খুব কড়া ছিলেন। সব অঙ্ক না হলে ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। তাই তন্ময় রোজ এসে ভয়ে ভয়ে বলত, “প্লিজ কবিতা একটু হেল্প করো। এই অঙ্ক দুটো বলে দাও প্লিজ।”
--সেই তন্ময় এখন একটা বড় কোম্পানিতে চিফ একাউন্টেন্ট।
--সত্যি?
--সত্যি। তন্ময় এখন বেহালাতে ফ্ল্যাট কিনেছে। বিয়েও করেছিল। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেল। আমি ওর ইন্টিমেট ফ্রেন্ড, কিন্তু এ-ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি কিছু।
কবিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভালো করেছ। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে জানতে না চাওয়াই ভালো। এইবার আমি নামব। চলি, আমার ফোন নাম্বারটা সেভ করে নাও। নাইন এইট…”
কবিতা বেলগাছিয়া স্টেশনে নেমে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল।
--তারপর?
তন্ময় এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল রঞ্জনের কথা।
--তারপর আর দেখা হয়নি।
রঞ্জন চলে যাওয়ার পর তন্ময় বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরালো। আজ রঞ্জন এসে তার পুরোনো স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে গেছে। কবিতাকে তার বেশ মনে আছে। অঙ্ক শেখার ছল করে সে কবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। মেয়েটা শ্যামলা হলেও মুখে সারল্য মাখানো ছিল। গালে, কপালে লম্বা চুলগুলো ঘামে লেপটে গিয়ে পঞ্চদশীকে আরো সুন্দর দেখাত। আর সেটা আরো কাছ থেকে দেখার জন্যই তন্ময়ের অঙ্ক আটকে যেত যেটা কবিতা কোনদিন জানতেই পারত না।
মন দিয়ে অঙ্ক বোঝাতে বোঝাতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে কবিতা দেখত তন্ময় শুধু ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে রেগে যেত। তন্ময় তার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিত।
কোন কোন দিন আবার সন্ধ্যাবেলায় কোচিং ক্লাস শেষ হলে কবিতাকে একটু এগিয়ে দিত সে। ওদের বাড়ির রাস্তাটা বড় অন্ধকার আর নির্জন। তাই কবিতাও তেমন আপত্তি করত না।
পুকুর ধারে লক্ষ জোনাকির ঝিকিমিকি। চাঁদের আলোয় পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছা করত কবিতার হাতটা একটু ধরতে। কিন্তু সাহসে কুলোতো না।
কবিতা তার দিকে তাকালে বুকের ভিতর ঢাকের আওয়াজ শুনতে পেত সে।
হঠাৎ একদিন তন্ময়ের ছোটকাকা সাইকেলে চড়ে যাওয়ার সময় ওদের দুজনকে একসাথে হেঁটে যেতে দেখে বাড়ি ফিরে বলেছিল তন্ময়ের বাবাকে। তন্ময়ের বুদ্ধিমান পিতা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে নিজের মামাতো ভাইয়ের কাছে বেহালাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসার কাজ শেখার জন্য।
একদিন রাত্রে খেতে বসে তিনি তন্ময়কে বললেন, “মোহন বলছিল চাকরির বাজার মন্দা। লেখাপড়ার পাশাপাশি বরং ওর সাথে থেকে একটু ব্যবসার কাজ শিখে নিতে পারলে লাভ আছে।”
--কিন্তু বাবা, আমার তো সামনেই পরীক্ষা।
--তাতে কী হয়েছে? তোর তো এখন স্কুল ছুটি। মোহনের বাড়িটা বড়। ওখানে ও একটা ঘর তোকে দিয়ে দেবে। নিরিবিলিতে পড়াশোনা করতে তোর সুবিধাই হবে। তাছাড়া মোহনের স্ত্রী ভীষণ ভালো মানুষ। ও তোর খেয়াল রাখবে সব সময়।“
--বাবা, তাহলে তো আমি অঙ্কের স্যারের কাছে পড়তে যেতে পারব না।
--আরে, মোহনের ওখানে খুব প্রভাব প্রতিপত্তি। একজন ভালো স্যার দেখে দেওয়া ওর কাছে কোন সমস্যা নয়।
তন্ময় বুঝতে পারল বাবার কাছে কোন অজুহাত খাটবে না। যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাই ফাইনাল। তাকে বেহালাতে যেতেই হবে।
সেদিন ছিল পরেশ স্যারের কোচিং-এ তার শেষ দিন। ফেরার পথে সে কবিতাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল অন্যান্য দিনের মতই। চলে আসার আগে বলেছিল, “আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি কবিতা। আর হয়ত কখনও দেখা হবে না। বাবা আমাকে বেহালাতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন কাকুর বাড়িতে। সেখানে থেকেই পড়াশোনা করব। কিন্তু তোমাকে একটা কথা বলতে চাই…”
কবিতা তার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। কী বলতে চায় তন্ময়? অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু তন্ময় কোন রকমে তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। ওর নাম লতিকা। ও বিনোদনী স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী।”
কবিতার মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর বুকের ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। সে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এতো খুব ভালো কথা। যেখানেই থাকো খুব ভালো থেকো। সুখী হয়ো তোমরা দুজনে।”
সেদিন কেন কবিতাকে সে মিথ্যা কথাটা বলেছিল তার কারণ নিয়ে পরে ভেবেছিল প্রচুর। হয়ত এই আঘাতটা দিয়ে সে কবিতার মন থেকে তার সমস্ত ছাপ মুছে দিতে চেয়েছিল।
পরবর্তী কালে অফিস কলিগ রিয়াকে সে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু সংসার করতে গিয়ে বুঝতে পারল ভালোবাসা আর অ্যাডজাস্টমেন্ট এক জিনিস নয়। যেখানে ভালোবাসার ফল্গুধারা, সেখানে সমস্ত দোষত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়, আর যেখানে শুধু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা, সেখানে জীবন যেন প্রতি মুহূর্তে ক্যাকটাসে হোঁচট খায়। তার থেকে ভালো পিঞ্জর থেকে মুক্তি।
তন্ময়ের হঠাৎ মনে হলো রঞ্জনকে একবার ফোন করে কবিতার মোবাইল নম্বরটা জেনে নেয়।
রিং হচ্ছে… হঠাৎ তন্ময় ফোন কেটে দিল।
--তুই ফোন করছিলি? আমি বাথরুমে ছিলাম।
--আরে না। হঠাৎ ভুল করে লেগে গিয়েছিল।
--ও আচ্ছা। গুডনাইট।
--গুডনাইট।
তন্ময়ের খুব ঘুম পাচ্ছে। আজ আর খেতে ইচ্ছা করছে না। দুটো বিস্কুট খেয়ে জল খেয়ে নিল। তারপর ঘরে ঢুকে বিছানায় শুতে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে একবার বইয়ের আলমারিটা খুলল। অনেক বইয়ের খাঁজ থেকে বেরিয়ে এল পুরনো অঙ্কের বইটা। পাতা ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা শুকনো গোলাপ। সেটা আর কখনও দেওয়া হয় নি কবিতাকে। সে ভালো থাক, সুখে সংসার করুক।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)
অলংকরণঃ লেখক এবং অনন্যা দাশ