Subscribe to Magazine



পরবাসে নিবেদিতা দত্তর
আরো লেখা



ISSN 1563-8685




বিয়া, বাটপাড়ি, মহব্বত—২০২০

বিয়া

কদিন থেকেই পলটুর মনটা ভাল নেই। সব যেন বিষাদ বিষাদ ঠেকছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। কাজ বলতে তো পাড়ার সবার উপকার করে বেড়ানো। কার ঘরে বিয়ে লাগবে, মেরাপ, সানাইয়ের দাদন থেকে খাবার পরিবেশন—সবেতেই পলটু। এমনকী কখনও কখনও বরপক্ষকে বলে বুঝিয়ে পণের টাকাও কমিয়ে দিতে ও ভারি পোক্ত। এছাড়া আত্মীয়পরিজনহীন পাড়ার দিদা-দাদুদের দেখভাল, তাঁরা মারা গেলে তাঁদের দাহ করা এ' তো আছেই। আর অবসর কাটানো মানেই রাখো-মুদির দোকানের সামনে বংশীর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে খুরি খুরি কিটকিটে কালো তেতো চা ওড়ানো আর রাখোর দোকানে কে এল গেল নজর রাখা।

কে এল গেল মানে তো ওই একজনই—বিন্তি—রাখোর মেয়ে। আর সব ভাল না লাগার মূলে তো ও-ই। সেই যে সেদিন লাল ফুলো ফুলো চোখে বলে গেল বিয়ের কথা তারপর থেকে মেয়ের আর দেখা নেই। চা গিলে গিলে পেটে চড়া পড়ে গেল, কত চেষ্টাই না করছে একবার যদি দেখা পায়। আর সেটা তো এতদিন সহজই ছিল। বিন্তি বাপের দোকানে বিক্রিবাটায় হাত লাগাত আর প্রায়শই বাঁকা চোখের বাণে পলটুকে বিঁধত। বেশ চলছিল, কিন্তু ওই বিয়ের খবর (সব্বোনেশের একখানি) জানান দিয়েই মেয়েটা যেন হাওয়ায় উবে গেল। আর কি ভাল লাগে? মনে হচ্ছে ঢকঢক করে এক বোতল ধেনোই গলায় ঢেলে দিয়ে সব ভোলে। তবে কিনা বিন্তিকে যে কথা দিয়ে ফেলেছে আর ওসব ছোঁবে না।

পলটু অবশ্য করিৎকর্মা। এরমধ্যেই চর লাগিয়ে (চর বলতে ওই সাত আট বছরের সাঙ্গোপাঙ্গ গুলো—ভোঁদাই, লটকে আর গুঁতো) বরটি কে জেনে নিয়েছে। ওই রাখোর দোকানের মাধব। আর ছেলে পেলে না কাকু। অমন ছিপলি মেয়ের ওই জুড়ি? আসল মতলবটা পলটু ধরে ফেলেছে। কাকুর মা মরা মেয়ে বিন্তি। মাধবের সাথে জুড়ে দিলে দোকানও বিন্তির নামে করে দেওয়া যাবে বিক্রিবাটা মাধব দেখবে। তা এইটুকু কি পলটুকে দিয়ে হোত না? খুব হোতো। কিন্তু রাখোহরি যে পলটুর মহৎ কাজগুলো একেবারে সহ্য করতে পারে না। কথা উঠলেই বলে ‘আরে ধ্যুর, ওটা আবার একটা পাত্তর নাকি! যা হাতি পাবে সবই দান করি উৎসন্নে যাবে।’

বিয়ের আর কদিনই বা বাকি, বোধহয় রথের দিনই। এবার তো আর রথ নেই--অমন দিনে পাড়ার ছোটগুলো রথ নিয়ে কত দৌড়োয়, ছোট ছোট কাঁসার রেকাবিতে প্যাঁড়া-প্রসাদ বিলোয় সকলকে। সে আর এবার কই? এখন তো সবাই মাথা নীচু করে মাস্ক পরে ঝটতি-পটতি দূরে দূরে থেকে কেনাকাটা করে যে যার ঘরে ঢুকে পড়ে। যার মাস্ক নেই সে আপাদমস্তক চাপা দিয়ে বেরোয়, কে সজ্জন কে দুর্জন বোঝা দায়। পলটুও একটা মাস্ক না কি যেন বলে জোগাড় করে চায়ের বেঞ্চিতে ঠায় কিছুক্ষণ বসে থাকে। তা সে বেঞ্চিও শূন্য হা-হা করছে। মফস্‌সলি পাড়াটাই যেন একটা শ্মশান।

তবে রাখো নিয়ম মেনেই মেয়ের বিয়ে দেবে। এ তল্লাটে ওর দাপট আছে, কারণ ওর রেস্তও আছে। ও বলেই দিয়েছে বরযাত্রী কনেযাত্রী এমনকি খোদ বরও যেন মাস্ক পরে আসে, আর মাধবের সাধ্যি কি সে কথা অমান্যি করে। হাজার হোক ও তো রাখোর অধস্তন কর্মচারী বই কিছু না।

রাখোহরি বরাবরই হিসেবী। মেয়েকে 'ব্যানারসি' আর জামাই-এর একটা পলিয়েস্টরের চকচকে পাঞ্জাবী (একটু জ্যালজ্যালেই—তা হোক, পরবে একদিন বই তো নয়) কিনেই বিয়ের বাজার সেরে ফেলেছে। বাকি সাজ ফুলেরই হবে। বিন্তির পাতলা একটা চেন, হাতেরটা, কানেরটা, সে তো আগেই গড়ানো ছিল। তাছাড়া দোকান মায় সব সম্পিত্তেও (সম্পত্তি) তো মেয়ে-জামাইয়ের হবে, সেটাও তো ওদের মনে রাখা উচিত।

বিয়ের সন্ধ্যে। বিন্তিকে ওর সইরা আর বুঝিয়ে পারে না। এত কাঁদলে কী ছাই সাজ হবে। বিন্তি খিঁচিয়ে ওঠে ‘বেশ করছি কাঁদছি তোদের কী লা?’ ধমক খেয়ে সইরা যে যার বাড়ি চলে যায় নিজেদের সাজের তদারক করতে।

সাতটায় লগ্ন। কাগজের মালায় সাজানো ভ্যান রিকশা থেকে মাস্কপরা বরের হাত ধরে মুখ ঢেকেই রাখো নামালে। ওই বাপ ও-ই যে মা। পাড়ার বৌ-ঝিরা দূরে দূরেই দাঁড়িয়ে খানিক শাঁখ বাজালে উলু দিলে। রাখোর মুখে মাস্ক ঘামে চোখ ঝাপসা। তবু যেন মনে হল মাধবটাকে বেশ রোগা রোগা লাগছে। পাঞ্জাবীটাও বেশ ঢিলেঢিলে, মাপ নিয়েই তো কিনেছিল। এমনিতে তো মাধোর বেশ নাদুসনুদুস চেহারা। কে জানে হয়ত বৌয়ের ভার নিতে হবে সেই ভেবেই। কদিন তো পাশের গাঁয়ে নিজের বেধবা মায়ের কাছেই ছিল, ভালো করে খায়দায়নি কি? রাখো নিজেই বলেছিল ‘এ কদিন আর দোকানে আসতে লাগবেনি।’

গোধূলি লগ্নে বিয়ে। মাস্ক পরা পুরুত তাড়া দিলেন ‘সোজা বরকে ছাঁদনা তলায় আনেন’। উকিল বাবু শহরে যান, কী যেন অন লাইন বিয়ের মন্তরের কথা বলেছিলেন। কিন্তু রাখোর মন সায় দেয়নি। একটাই তো মেয়ে, ভাল করেই হোক বিয়ে। নাহয় পুরুত বাবদ কিছু বেশি যাবে। যাইহোক বিন্তি কেঁদে কেঁদেই পিঁড়িতে উঠলে। সাত ফেরাও হল মুখে মাস্কের উপর পান চাপা দিয়ে। হঠাৎ আলো গেল। ভটভটে ডিজেল মেশিনের আলো জ্বলে উঠল। আর আর বিন্তি যেন মুহূর্তের জন্য দেখল, বর চোখ মারল কি? কে জানে হয়ত মনের ভুলই। তবু কী ভেবে শ্রী জগন্নাথ প্রভুর নাম নিয়ে খানিক নির্ভাবনাতেই মালা পরিয়ে দিলে।

রাখোহরি সরকারি আইন মেনে পঙ্‌ক্তি ভোজ করায়নি। দু মিটার দূরে দূরে দাঁড়িয়ে পাড়ার সবাই খাবার প্যাকেট নিয়ে বাড়ি চলে গেল। রাখোও বর-বধূকে ধান দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ সেরে ঘরে দোর দিতে আদেশ দিলে। বাসর তো ওই পরিস্থিতিতে অবান্তর।

খাটে বসে বিন্তি আশা নিরাশায় দুলছে। হঠাৎ পাশের লোকটি অতি পরিচিত গলায় বলে উঠল ‘জয় বাবা কোভিদ রাম---আয় বিন্তি কাছে আয়’। তখন পলটুর বুকে মাথা রেখে আদরে সোহাগে মাখামাখি বিন্তি শুনলে সে গল্প—কী করে বকে ধমকে নয়, নিজের বোঝাবার ক্ষমতা দিয়েই পল্টু মাধবকে বলেছিল ‘এ জন্মের মত তুমি আমাকে বাঁচাও মাধবদা, বিন্তি ছাড়া আমি যে আর কিছু জানি না---’। আর তারপর--তারপর তো আমরা আগেই জেনেছি কি হয়েছিল।

বাটপাড়ি

চার বছর পর বেণীবাবুর সল্টলেকের বিশাল বাড়ির সরু সাইডগলিতে একটা পেঁপে গাছে বিস্তর ফল ধরেছে। মাটি ঠিকমত না পাওয়াতে অসময়ের আম্ফান, আর তার হাত ধরে বরষার বিষ্টিতে গাছ একবার এদিকে হেলে তো একবার ওদিকে। প্রাতঃকৃত্য সেরেই গাছ দেখতে বেণীবাবু উঠে যান গ্যারেজের ছাদে, তারপর নেমে এসে দরকার মত গাছকে একবার টেনে বাঁধেন ডাইনে তো পরের দিন বাঁয়ে। বেশ টেনিস-বলের চেয়েও বড় সবুজ ফলগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। গাঁ গঞ্জে পেঁপেগাছ কেউ পোঁছে না কিন্তু এমন শহুরে এলাকায়? উফ ভাবাই যায় না। অন্তত বেণীবাবু তো তাই ভাবেন।

এই লক ডাউনের বাজারে সকালবেলা সবুজ পেঁপেগাছে সবুজ ফল ভারি আনন্দ দেয়, মনে হয় অন্তত কোথাও তো নিষেধ নেই। সবই তো গেছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটা বেণীবাবুর ভারী প্রিয়। শীতের দিনে চাট্টি ভাত খেয়েই জামা জু্তো পরে নার্সারিগুলোতে ঢুঁ মারতেন। আর সল্টলেকে নার্সারিগুলোর শীতকালে ঠিক রাজার হাল। কী তাদের রমরমা। গাড়ি করে সব আসে আর হাজার হাজার টাকার গাছ কিনে নিয়ে যায় সবাই। আবার গাছ না বাঁচাতে পারলে (শখ থাকলেও সবার তো ও যাদুমন্ত্র জানা থাকে না) তাদের ফেরতও দিয়ে যায় পরিচর্যার জন্য।

এছাড়া আরও কত ঘোরা ছিল। কেনাকাটা না থাকলেও শিশুর মত সিটি সেন্টারের এস্কালেটরে ওঠানামা করা। অটোতে করে গিয়ে বিগবাজারের কাছে স্ন্যাক্স সেন্টারের সিঁড়িতে বসে গ্রিল্ড স্যান্ডউইচ আর চা খাওয়া। কখনো বিধান মেলা তো কখনো সবলা সরস মেলা। সব মেলাই প্রায় এক কিন্তু কী যে মুক্তির সাধ ছিল। আবার কখনো ভাল না লাগলে শীতের বেলা পড়ে এলে লড়ঝড়ে মিনিবাসে ভিড়ের গুঁতো খেতেই উঠে বসেছেন উনি। এত তাড়াতাড়ি কেমন করে গল্পকথা হয়ে গেল সব।

এখন তো কেবল বিকেলে ওই তেতলার ছাদে ঘোরা আর অন্ধকার ঘন হলে লোহার সিঁড়ি বেয়ে জলের ট্যাঙ্কে কত জল উঠল দেখা মোবাইলের আলোতে। তবে ওনার ওই লুঙি পরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মধ্যে পাড়ার আর সব কর্তারা বেশ আমোদ পান—ওঁরা ভাবেন এক হাতে মোবাইল অন্য হাতে সিঁড়ির রেলিং ধরা—লুঙির ফাঁসটা যদি---বেণীটা যেন কী।

বেণীবাবু অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করেন না। আজকাল ওঁকে একটা ভাবনাই পেয়ে বসেছে। রাতে যদি কেউ পেঁপেগুলো সাবাড় করে দেয়? আসলে খুঁতখুঁতে স্বভাব তো, কিছু একটা মাথায় ঢুকলে হয়। ঘুরে ফিরে তাই ভাবছেন পেঁপে রক্ষার স্ট্রাটেজি। পেঁপে কি চুরি করার মত রত্ন? বলা যায় না। লক ডাউনে কত মানুষ অর্ধাহারে আছে। এক বস্তা পেঁপে (ছোট বস্তা হলেও) চল্লিশ টাকা দরে, ভালোই আমদানি হতে পারে।

যা ভাবা তাই কাজ। বিধাননগর পুলিসে অন লাইন একটা ডায়রি করে সিকিউরিটি চাইলেন। বড়বাবু যত গাঁইগুঁই করে বোঝান ‘কিছু তো হয়নি খামোখা পাহারা—' বেণীবাবু নাছোড়বান্দা। শেষমেশ রাতে একটি কনস্টেবল টহল দেবে ঠিক হল।

এদিকে সিঁধেল কুঞ্জ বেশ কিছুদিন ঘরে বসা। (নিজেকে ও বাটপাড় বলতে ভালবাসে; ওর মনে হয় কথাটায় একটা বীর বীর ভাব আছে)। থানায় ওর নাম আছে, বেগতিক দেখলেই তো পুলিসের গুঁতো। তাছাড়া এ যা ছোঁয়াচে রোগ রাতে কাজে বেরতে ঠিক ভরসা পায় না কুঞ্জ। তবে কী, পেট তো মানে না। ধারে একটা মাস্ক জোগাড় করে কুঞ্জ ধান্দায় নেমেই পড়ল। বেণীবাবুর পেঁপেগুলো কেমন চোখে ভেসে উঠল। সেদিন ঝাঁঝাঁ রোদে বেলা দুটোয় হন্যে হয়ে বাড়ি ফেরতা দেখে ফেলেছিল। হাঁড়ির ফুটন্ত ভাতে কটা পেঁপে ছাড়িয়ে ফেলে দিলেই তো হল। তারপ র নুন তেল মেখে--আহা কী সোয়াদ!

সেদিন অমাবস্যা। তারার আলোই ভরসা। বাড়ির সামনে সরকারের শখের ত্রিফলা আলোর দুটো জ্বলছে না। বেণীবাবুর সিকিউরিটিতে তেমন ভরসা নেই। ঘন নীল মাস্কটা গলিয়ে নিয়ে চুপি চুপি গলিতে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। মাস্ক পরা আরেকজনও যেন এসে দাঁড়াল। বেণীবাবু একটা শিস দিলেন। আগে থাকতে বলা ছিল। গার্ড পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ল। মুহূর্তে সেকি ঝটাপটি—আর ‘বাবা গো মাগো, মেরে ফেললে যে, থামো থামো’।---তারপ র সব চুপ। কে যেন ধুপ করে ভারি কিছু পাঁচিলের ওপাশে ফেলে দিয়ে টপকে বেরিয়ে গেল।

চোর ধরার উত্তেজনায় মোবাইলটা ঘরেই থেকে গিয়েছিল। একছুটে নিয়ে আসাতে দেখা গেল মাস্ক পরা বেহাল বেণীবাবুকে। চিনতে পারেনি কনস্টেবল। এলোপাথাড়ি পিটিয়ে গেছে। সেই ডামাডোলে আরেক মাস্কধারী, রোগা পাতলা কুঞ্জ পাঁকাল মাছের মত গলে গিয়ে পেঁপের বস্তা নিয়ে হাওয়া।

সবই তো ইচ্ছেমাফিক হল কুঞ্জর। তবু কেমন যেন আনমনা সে। অমন টাটকা পেঁপে তার সোয়াদই ভেন্ন। কিন্তু তাও যেন পানসা লাগছে। তবে কি ওর বয়স বাড়ছে? আগে কত মজা পেত এসবে। আর আজ কদিন থেকেই বুড়োবাবুর 'বাবা গো গেলুম গো’ কানে ধাক্কা মারছে। কটা চেয়ে নিলে কি আর দিত না? সাতপাঁচ ভেবে কুঞ্জ ঠিক করলে ধুত্তোর, ঢের হয়েছে, এবার সব ছেড়েছুড়ে ওই সব্জি বিক্রীই ধরবে।

পেটে তো বিদ্যে একেবারে তলানি। তাও কষ্টেসৃষ্টে লিখলে ‘বাবু পিপা বেচে দুশো টেকা পাইছি আপনেরে দিয়া গেলাম।’ রাতেই তো বাটপাড়ের যত কারবার। তা রেতের আঁধারেই ইটচাপা দিয়ে দুশোটা টাকা আর চিরকুটটা সে রেখে এল চুপিসাড়ে পাঁচিলের পটিতে।

ভোর ভোর গেট খুলতে গিয়ে বেণীবাবুর চোখ এড়াল না কাগজের টুকরোটা। হাতে নিয়ে পড়ে মৃদু হাসলেন উনি। ঘর থেকে পেন নিয়ে এসে লিখলেন, ‘টাকা দিয়ে কোনো ব্যবসা শুরু করো।’

আবার সেই রাতের অন্ধকারেই কুঞ্জ কূতুহল না চাপতে পেরে পাঁচিলের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে গিয়ে দেখল সব। মিশি কালো রাতে সাদা খড়ির মত দাঁত বার করে হেসে একরকম নাচতে নাচতেই ফিরে গেল সে। গুনগুনিয়ে একেবারে নিজসৃষ্ট দু-কলি গেয়েও নিলে ‘পিপাও খালাম টাকাও পালাম টাক ডুমা ডুম ডুম।’

মহব্বত

পড়বি তো পড় এলাকার ইমাম রফিকুল সাহেবের মেয়ে নাজমার প্রেমেই পড়ল নাফিস। বড় মসজিদের ইমাম রফিকুল। বাড়ির লাগোয়া একুশ বিঘে জলের ভেড়িতে মাছ চাষ, সর্ষের খেত, সর্ষে মাড়াই কল। সেই তাঁর মেয়ের সাথে পান্তা খাওয়া মায়ে-পোয়ে এক কামরায় থাকা নাফিসের ইশক কে সহ্য করবে, পড়লই বা এক কলেজে। কিন্তু কথায় বলে না অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। তাছাড়া নাফিস বাধা মানার বান্দা নয়। ওর মগজে বাধা কাটাবার শত আইডিয়া নিরন্তর গিজগিজ করছে। যত্নে ছাঁটা সূচালো গোঁফজোড়ায় হাত বোলাতে বোলাতে ভেবেই চলে ও।

কোভিদের মেহেরবানীতে এখন কলেজ বন্ধ। দুদিন ঘুর ঘুর করতে না করতেই রফিকুল একান্তে ডেকে কড়কে দিলেন। তারপর থেকে নাফিসকে আর দেখা যায় না, বড় সুবোধ তো। তার বদলে নাজমা বুরখা পরে লাইব্রেরি গেলে (আব্বু বলে দিয়েছে বুরখা মাস্ট, তার ভিতর মাস্ক) তার এক সহেলী সামিমা রীতিমত সঙ্গ দেয়। সেও অবশ্য ধর্ম মেনে বুরখা পরে আর কোভিদ মেনে মাস্ক।

বেশ মেয়েটি। সিল্কের সালোয়ারের নীচ দিয়ে নখ পালিশ পরা ফর্সা পা দেখে যে-কেউ দিওয়ানা হবেই। আর হলও তাই। কদিন ধরেই সামিমা বই নিয়ে ফুটপাথে নাজমার জন্য দাঁড়ালেই এক বান্দা জোটে, আর খানিক সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং রেখে সেই লাইব্রেরি পর্যন্ত মিনিট পনেরো ফলো করে চলে।

প্রায় দেড়মাস এমন চলার পর সন্ধ্যে সন্ধ্যের সময় সামিমা চলেছে। পিছে পিছে সেই আশিক। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ‘তেরি তো—’ বলে সামিমা বুরখার ঢাকা তুলে মাস্ক নামিয়ে ফেললে। আর তারপরই ‘সরি ইয়ার ভেরি ভেরি সরি, ক্যারি অন ক্যারি অন---’ বলেই মাস খানেকের দিলদার হাওয়া। মাস্ক তুলে মুখে নাকে চাপা দিয়ে যা ঢাকার ঢেকে সামিমা উর্ফ নাসিমের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। জয় বাবা কোভিদ, নয় তো কি?



(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)