একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন ব্রীজের উপরে। নিচে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী, পশ্চিমে হেলে পড়ছে সূর্য। ভদ্রলোক একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন, অনবরত। এক প্যাকেট পুরো শেষ করেছেন এখানে দাঁড়িয়ে। আরেকটাতে মাত্র তিনটা সিগারেট আছে, হাতে জ্বলছে একটা। এই প্যাকেট শেষ হলেই তিনি নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। সাঁতার শেখা হয় নি। ফলে নির্ঘাত মৃত্যু।
অর্থাৎ লোকটি আত্মহত্যার জন্য এই বিকেল বেলায় এসেছেন ব্রীজের উপরে। তিনি একমনে সিগারেট খাচ্ছেন আর নিজের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে ভাবছেন। কোনরকম বাকবিতণ্ডা তার ভেতর হচ্ছে আত্মহত্যা করবেন কি না এ নিয়ে, এরকম বলা যায় না। এই পর্যায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। গত ছয় মাস ধরে তিনি নিজেকে বার বার প্রশ্ন করেছেন। নিজের সাথে তর্ক করেছেন, জীবন ও মরে যাওয়ার নানা দিক সামনে এনে বিবেচনা করে দেখেছেন। এরপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে, ওই বিষয় নিয়ে ভাবার কিছু আর নেই।
ভদ্রলোক ভাবছিলেন এই যে ব্রীজ আছে, অনেক বয়েস হলো তার, সাড়ে তিনশো তো হবেই। এই সময়ের মধ্যে কত লোক নিশ্চয়ই এর উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। তারা কি সবাই এখন একসাথে আছেন পরকালে? বা এরকম কি হয়, যারা এক জায়গায় মারা যান, ধরা যাক রেললাইনে বা হাসপাতালে, তারা কি পরকালে সবাই একসাথে থাকেন? অথবা, এটা কি এমন যে, এইগুলা আসলে পরকালে যাবার এক একটা দরজা বিশেষ, আমরা কেবল বুঝতে পারি না?
এসব বিষয়ে ভাবছিলেন তিনি। তখন একটা কণ্ঠ শুনলেন পিছন থেকে। একজন মাঝবয়েসি লোক বলছেন, ভাই, কিছু মনে না করলে, একটা সিগ্রেট যদি দ্যান, ভালো লাগবে।
প্রথম ভদ্রলোক লোকটার দিকে ফিরে তাকালেন।
সুন্দর চেহারার একটি লোক। স্বাস্থ্যবান, পরনে পাঞ্জাবী। মুখ হাসি হাসি।
লোকটি বলতে থাকলেন, ভাই আমার নাম হাসনাত। এইদিক দিয়ে যাইতেছিলাম। আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে এত ভালো লাগল, এত লোভ চলে আসল যে, না চাইয়া পারলাম না।
প্রথম ভদ্রলোক সিগারেটের বাকসো এগিয়ে দিলেন। লাইটার দিলেন। হাসনাত সাহেব একটি সিগারেট নিয়ে ধরালেন। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন।
এরপর বললেন, একসময় প্রচুর সিগারেট খাইতাম, বুঝছেন। পরে সব ছেড়ে দেই। এটা খাইতেছি আজ আট বছর পরে।
প্রথম ভদ্রলোকের বিরক্তি লাগল। মানুষের কথাবার্তা তার ভালো লাগে না। এজন্যই তিনি নির্জনতা চান, চির নির্জনতা।
হাসনাত সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, অনেকক্ষণ ধরে আমি দেখতেছি, আপনি এইখানে দাঁড়াইয়া আছেন। আর পানির দিকে দেখতেছেন নিচে। কোন সমস্যা ভাই?
প্রথম ভদ্রলোক বিরক্ত কন্ঠে বললেন, না কোন সমস্যা নেই। আমি একজন ব্যর্থ এবং হতাশ মানুষ। তাই উপর থেকে দাঁড়িয়ে নদী দেখছি। ব্যর্থ ও হতাশেরা উপর থেকে দাঁড়িয়ে নিচের জীবদের দেখে থাকেন।
এই কথা বলে ভদ্রলোক আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ পরিষ্কার, ভেসে যাচ্ছে শাদা শাদা অনেক মেঘখণ্ড, ধীরলয়ে। দেখলে মনে হয় এরা যেন খুবই হালকা কিছু তুলার স্তূপ।
হাসনাত সাহেব ব্রীজের রেলিং ধরে নিচে গিয়ে পানির দিকে তাকালেন। নদীর স্রোত বইছে।
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমার জীবনের একটা কথা আপনি মনে করাইয়া দিলেন ভাই। একসময়, আজ থেকে আট বছর আগে আমারো এমন হইছিল।
প্রথম ভদ্রলোকের ভ্রু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে। এটা তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, এ যদি তাকে উপদেশ দিতে আসে, তাহলে মরার আগে এর গালে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে যাবেন।
হাসনাত সাহেব নদীর দিকে তাকিয়েই বলছিলেন, আমি ছিলাম একজন ট্রেডার ভাই। স্টক মার্কেটে ট্রেডিং করতাম। শর্ট সেলিং। হঠাৎ, এমন খারাপ অবস্থা হইল আমার, সকল পুঞ্জি শেষ, অনেক বড় এমাউন্টের টাকা, তখনকার সময়ে আট কোটি। দুইদিনেই শেষ। আর আমি বেদিশা হইয়া গেলাম। তাও আমার নার্ভ শক্ত ছিল। মরার চিন্তা আসে নাই। কিন্তু পারিবারিক কিছু অনাকাঙ্খিত ঝামেলায় পইড়া যাই তখন, এবং হতাশ হইয়া মরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
প্রথম ভদ্রলোক শেষ সিগারেটটি ধরিয়েছেন। এটি শেষ হলেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু এর আগে এই লোকটাকে এখান থেকে সরানো দরকার। কারো সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লে হইচই হবে। মানুষ মরার সময় হইচই পছন্দ করে না।
তিনি ধোঁয়া ছেড়ে লোকটাকে বললেন, ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে আপনি আপনার গল্পটা বলে এখান থেকে সরে যান প্লিজ। মৃত্যু একটা ব্যক্তিগত জিনিস। আমি একা মরতে চাই, অন্যের চোখের সামনে নয়। আশা করি আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন।
হাসনাত নামের লোকটি বললেন, জী অবশ্যই। আমি এটা জানি, দ্রুত বলেই সরে যাইতেছি।
একটু থেমে বলতে থাকলেন, আমি মরতে গেছিলাম রেললাইনে। ট্রেন একটু লেইট করল। স্টেশনের ওইদিকে গিয়ে কী মনে করে যেন ওইখানের একটা বইয়ের দোকানে ঢুকছিলাম। আর একটা ছোট বই পাই, ছোট একটা উপন্যাস। অদ্ভুত একটা উপন্যাস। এমন আমি আর কখনো কিছু পড়ি নাই। আর এমনিতেই আমি ভালো পাঠক ছিলাম না। কিন্তু ওই বইটা আমাকে এতো টানল। কিনে নিয়ে বসে পড়লাম। ভেবেছিলাম ওইটা পড়ে শেষ করব, বড়জোর এক ঘন্টা লাগবে, ট্রেন আসতেও এইরকম সময় লাগবে। ঠিক করছিলাম পড়া শেষে কাউকে বইটা উপহার দিব রাস্তায়, এবং আত্মহত্যা করব।
কিন্তু তা আর হইল না। বই পড়া শেষ করলাম। এবং আমি হাইটা বাড়ি ফিরে আসলাম। আমার জীবন বদলে গেল।
প্রথম ভদ্রলোক সিগারেটে শেষ টান দিয়ে শেষাংশ নদীতে ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী বইটার?
হাসনাত বললেন, পালানোর পরে। লেখক সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ।
কথা শেষ করে হাসনাত নামের লোকটি চলে যেতে থাকলেন।
প্রথম ভদ্রলোক তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
পরদিন পত্রিকায় খবর বের হয়, লেখকদের লেখক বলে খ্যাত, সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ গতকল্য বিকেলে অস্তমান সূর্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে লাফিয়ে পড়েছিলেন খরস্রোতা নদীর বুকে, জলে ভেসে যান তিনি। নদীতে তার মরদেহের খোঁজ চলছে।
পত্রিকায় একজন তরুণ লেখক ইমতিয়াজ সাহেবের পালানোর পরে উপন্যাস নিয়ে কিছু লিখেছেন। ঐ উপন্যাসের নায়কেরও এমন হয়েছিল, সে একটি উত্তাল নদীতে পড়ে যায়, এবং অলৌকিক ভাবে এক আশ্চর্য মাছের পেটে সে বসবাস করতে থাকে ইউনুস নবীর মতো।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)