ঘন মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। ঝোড়ো হাওয়া বইছে প্রবল বেগে। মেঘ আর কুয়াশায় আশেপাশের কোনোকিছু ভালো দেখা যাচ্ছে না, তবে ধোঁয়া-ধোঁয়া ভাব ভেদ করে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে দু-পাশের ন্যাড়া, পাতাহীন গাছে ঘেরা রাস্তাটা একটা পোড়ো, ভাঙা বাড়িতে গিয়ে মিশেছে।
বাড়িটার সদর দরজা বন্ধ। সদর দরজার দু-পাশে দুজন সদ্যমৃত প্রহরীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ দেয়ালে বল্লম দিয়ে গাঁথা। এরা যে প্রহরী ছিলো তার প্রমাণ—মৃত অবস্থাতেও এদের দুজনেরই দুই হাতের একটি থেকে বল্লম ঝুলছে। দেখে মনে হয় কোনো অতর্কিত আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে এই প্রহরীদের। হাতের বল্লম হাতেই থেকে গেছে, ব্যবহার করবার অবকাশ মেলেনি।
দরজার চারপাশটা আর এই প্রহরীদের দেয়ালে গাঁথা শরীরের নিম্নাংশ কোনো অজানা লতাতে ঢাকা। রাস্তার গাছগুলোর মতন, এই লতারাও পাতাহীন। হয়তো লতার রঙ সূর্যের আলোতে সবুজই লাগতো, তবে এই অন্ধকারে সেই সবুজকেই কালো বলে মনে হচ্ছে। পাতাহীন ন্যাড়া লতার এই গুচ্ছগুলো থেকে থেকেই ঝোড়ো হাওয়ায় দুলছে, আর সেই দোলায় কখনো বা প্রহরীদের মুখগুলো কখনো বা দরজাটা ঢেকে যাচ্ছে এক এক লহমার জন্য।।
একা আশুতোষবাবু দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়। আশেপাশে মানুষ কেন, আর কোনো জনপ্রাণী নেই। উথালপাথাল ঝোড়ো হাওয়া যেন গলা ধরে ঠেলে দিচ্ছে আশুতোষবাবুকে বাড়ির দরজাটার দিকে, সাঁতার না জানা মানুষকে যেমন জোর করে তলায় টেনে নেয় গহীন জল। ছটফট করছেন আশুতোষবাবু। দরজাটা যেন চুম্বকের মতন টানছে তাঁকে, সেই টানে একটা তীব্র উল্লাসের রেশ বইছে সারা শরীর জুড়ে, অথচ তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে সতর্ক করে দিচ্ছে ক্রমাগত। যেন বলছে, "বিপদ! আর কাছে এগিয়ো না, বিপদ!" পালাতে চাইছেন আশুতোষবাবু, অথচ দরজার টানও এড়াতে পারছেন না। হাওয়ার ঘায়ে এগোতে এগোতে দরজার কাছাকাছি এসে পৌঁছালেই শুনতে পাচ্ছেন বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে কেউ যেন একটু থেমে থেমে তালে তাল মিলিয়ে হিসহিস করে ডাকছে তাঁকে, “আয়! আয়! আয়! আয়!”
***
গত দশদিন ধরে বারবার এই এক স্বপ্ন দেখে চলেছেন আশুতোষবাবু। রাত্তিরবেলা চোখ বন্ধ করার আধ ঘণ্টার মধ্যে স্বপ্নটা আসে। “আয়! আয়!” ডাকটা শুরু হলে স্বপ্নের মধ্যেই ভয়ে চিৎকার করে উঠতে যান আশুতোষবাবু। এমন একটা কিছু আছে ওই ডাকে যা শরীরের সব রক্ত হিম করে দেয়। ডাকটা শোনামাত্র স্বপ্নের চিৎকারটা তাই সত্যিকারের একটা আর্তনাদ হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় এক ঝটকায়। মুশকিল হলো: ঘুম ভাঙার পরেও স্বপ্নটার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। বুক ধড়ফড় করতে থাকে। ঘামে ভিজে যায় জামাটা। উঠে এক গ্লাস জল খান আশুতোষবাবু। তারপর চেয়ারে বসে জেগে কাটিয়ে দেন সারারাত।
প্রথমবার যে রাতে এই স্বপ্নটা দেখেছিলেন আশুতোষবাবু সেদিন সন্ধ্যাবেলা টিভির নিউজ চ্যানেলগুলো বারবার একটা বীভৎস খুনের খবর ফ্ল্যাশ করছিলো। ঘুমোতে যাবার সময় শরীরটা তাই ভালো লাগছিলো না আশুতোষবাবুর। রাত্রে হোটেলের মসলা-গরগরে চিকেন কারিটা হজম হয়নি ভালো। গুরুভোজন এই বয়সে শরীরের পক্ষে ভালো নয়। একটু বমি-বমি পাচ্ছিলো। বুকের বাঁ দিকে একটা চিনচিনে ব্যথাও ছিলো সামান্য। অসুস্থ শরীরে ঘুম না আসার জন্য বারবার তাই চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো মুনিয়া নামের সেই অপহৃতা কিশোরীর চোখ উপড়ে নেওয়া ক্ষতবিক্ষত মুখের ক্লোজ আপ ছবিটা। গত তিনদিন ধরে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না মেয়েটির, মৃতদেহটা মিলেছে সেদিন সন্ধ্যায় আর সেইদিনই সবগুলো টেলিভিসন চ্যানেল একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে টি আর পি বাড়াতে। পুলিশের অনুমান দুই সমাজবিরোধী দলের লড়াইয়ের শিকার মেয়েটি। ড্রাগ নিয়ে এলাকা দখলের এই লড়াইয়ে হয়তো কোনো একটি দলের কিছু গুপ্ত খবর জেনে ফেলেছিলো এই কিশোরী। প্রথমে ধর্ষণ আর সবশেষে খুন তো কতই হয়—মধ্যভাগে ওর উপর এত নৃশংস অত্যাচার করা হয়েছে সম্ভবত সেই গুপ্ত খবর বের করার জন্য।
সাধারণত আশুতোষবাবু টেলিভিসন দেখেন না। কলকাতাতে এলে তাঁর কাজের ধরনটাই এমন যে সন্ধ্যা থেকে প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত খদ্দের সামলাতে হয়। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় অন্য কোনো কাজ না থাকায় হোটেলের লবিতে বসে কাগজ পড়ছিলেন। একটু দূরে টিভিটা অন ছিলো। আর একবার এমন খবর টিভিতে ফ্ল্যাশ করলে মনটা ওই দিকেই চলে যায়। ক্রমাগত মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে, চেষ্টা করেও সরানো যায় না।
প্রথমবার সঙ্গত কারণেই আশুতোষবাবু স্বপ্নটাকে খুব একটা পাত্তা দেননি। সকালবেলা আপনা থেকেই শরীরটা অনেক ঝরঝরে হয়ে গেছিলো। দিনের বেলা নানান কাজের চাপে ভুলেও গেছিলেন স্বপ্নটার কথা। কিন্তু অসম্ভব ব্যস্ত একটা দিনের পর দ্বিতীয় রাতেও যখন সেই একই স্বপ্ন দেখলেন তখন ব্যাপারটা, সত্যি কথা বলতে কি, তাঁকে একটু ভাবিয়েই তুলেছিলো। এরকম একটা স্বপ্ন দু’-দুবার দেখাটা বেশ একটু অস্বস্তির ব্যাপার। তারপর তৃতীয় রাতেও যখন সেই একই স্বপ্ন আবার ফিরে এলো, তখন আশুতোষবাবুর মনে হলো কাকতালীয় ভেবে ব্যাপারটাকে আর উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এই স্বপ্ন আবার দেখাটা বন্ধ হওয়া দরকার—পাকাপাকিভাবে এবং এক্ষুনি।
সেই থেকে পরপর তিন রাত ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন আশুতোষবাবু, প্রথম রাতে আধখানা, তারপরের রাতে একটা, তারপরে দুটো। ওষুধের ডোজ বেড়েছে শুধু, কোনো ফল হয়নি। বিছানায় শুয়ে ঘুম না এলে মাথা গরম হয়ে যায়। শেষ অবধি সেই চেয়ারে বসেই রাত কাটাতে হয়েছে।
এই ধরনের স্বপ্ন-টপ্নর মানে কি, কেনই বা ওরকম একটা দরজাকে বারবার দেখছেন, এসব জানবার জন্য কোনো মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যেতে চান না আশুতোষবাবু। কতটুকু জানে ওরা? আশুতোষবাবু নিজেকে যেমন জানেন, তার চেয়েও বেশি? বিশ্বাস বা ভরসার অভাব তো আছেই, তার চেয়েও বড় কথা এই যে নিজের সমস্ত ভয়, ভাবনা বা চিন্তাকে অন্য কারো হাতে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিতে পারবেন না তিনি, প্রাণ গেলেও নয়। আশুতোষবাবু জানেন, এই পৃথিবীতে তিনি একলা। একলা এসেছেন মাতৃগর্ভ থেকে, যেতেও হবে সেই একলা। মাঝপথে যে-সব সমস্যা আসবে, সেগুলো সবই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা, নিজেকে শক্ত করে নিজেই সবকিছুর সমাধান বের করে নিতে হবে তাঁকে, যেভাবেই হোক ...
মুস্কিল হলো, প্রতিবারেই স্বপ্নে হাওয়ার জোর যেন আরও বাড়ছে। স্বপ্নের প্রথমদিকটাতে দরজাটা দেখা দিলে আগের চেয়েও আরো বাড়ছে শরীরে কাঁটা দেওয়া উল্লাস। কোনো অমোঘ আকর্ষণে একটু একটু করে দরজাটার দিকে রোজই আরও এগিয়ে যাচ্ছেন আশুতোষবাবু। শেষ দিনে একেবারে দরজাটার ঠিক সামনে এনে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলেছে সেই ঝোড়ো হাওয়া। "আয়! আয়!" ডাকটা শুরু না হলে হয়তো দরজাটা ভেঙেই ফেলবার চেষ্টা করতেন সেদিন।
কে জানে, আজকের স্বপ্নে হয়তো খুলে যাবে দরজাটা। বুঝতে পারছেন আশুতোষবাবু যেভাবেই হোক এই দরজা খোলার ব্যাপারটা আরও অন্তত একটা রাত ঠেকিয়ে রাখতে হবে তাঁকে। আজ রাতে তাই ঘুমোবেন না আশুতোষবাবু।
ঢং ঢং করে দূরে কোথাও রাত দুটোর ঘণ্টা বাজলো। আর মাত্র দু’ ঘণ্টা জেগে থাকা। ভোর চারটেতে বিডন স্ট্রিটের এই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন আশুতোষবাবু।
প্রথমে প্লেনে দিল্লি। সেখান থেকে দেড় ঘন্টা পরে সেই একই প্লেনে নিউ ইয়র্ক। আর তারপর নিউ ইয়র্ক থেকে মেক্সিকো সিটি। নতুন জীবন।
কেন জানি না আশুতোষ বাবুর দৃঢ় বিশ্বাস যে একবার আমেরিকার ফ্লাইটে চাপতে পারলে আর এই স্বপ্ন ভবিষ্যতে তাঁর পিছু নেবে না।
চেয়ারে বসে হোটেলের জানলা দিয়ে এই দু’ ঘণ্টা শেষবারের মতন রাতের কলকাতার রূপ দেখবেন আশুতোষবাবু। এই রূপ তাঁর চেনা। অনেক ঘুরেছেন তিনি মধ্যরাতের কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। আজ পাঁচ বছর হলো কলকাতা ছেড়েছেন, তবু এখন-ও চোখ বেঁধে তাঁকে কলকাতার কোনো গলিতে ছেড়ে দিয়ে তিন মাইল দূরের অন্য কোনো গলির নাম করলে ঠিক সেই গলিতে গিয়ে হাজির হতে পারবেন আশুতোষবাবু।
জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাতের কলকাতার রাস্তা। এ এক অন্য কলকাতা। এক মিনিট হাঁটলেই বিডন স্ট্রিট। বড় রাস্তার এত কাছে, তবু কোন লোক নেই এই গলিটাতে। কোন গাছও নেই। কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট অবশ্য আছে। রাস্তার কমজোরী আলোতে ন্যাড়া, পাতাহীন, আগুনচোখো তালগাছের মতন লাগছে ওগুলোকে। উল্টোদিকে আবছা আলোছায়ায় মিশে রয়েছে একটা প্লাস্টার খসে পড়া পুরোনো বাড়ি। বাড়ির সদর দরজাটা বন্ধ। আশেপাশে কি রয়েছে সেটা আলোর অভাবে ভালো বোঝা যাচ্ছে না।
দূরে একটা কুকুর ডাকছে থেকে থেকে। ডাকটা যেন ঠিক আনন্দের ডাক নয়, কেন জানি না মনে হচ্ছে যে এটা ভয়ের ডাক। কুকুরেরা কক্ষনো একা ডাকে না। একটা ডাকলে সাড়া দেয় আরও অনেকগুলো, কিন্তু এ কুকুরটা বোধ হয় একা। কোনো বিপদ হলো নাকি কুকুরটার? অন্য কুকুরগুলো সাড়া দিচ্ছে না কেন? রাস্তার দিকের জানলাটা বন্ধ করতে হবে। রাত্তিরবেলা অকারণে বড় বিরক্ত করে এই কুকুরগুলো।
রাস্তার দিকের এই জানলাটা ছোট্ট, পুরো আকাশটা দেখা যাচ্ছে না তাই, তবে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকুতে চাঁদ, তারা কিচ্ছু নেই। দেখে মনে হচ্ছে মেঘ রয়েছে আকাশে। রাস্তা আর আশেপাশে কেমন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব, এমনিতে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু আলোগুলোর দিকে তাকালে কেন জানি না মনে হচ্ছে ওগুলোর উপরে ঘষা সেলোফেন জড়ানো। ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। উত্তর ভারতের মতন কুয়াশাও কলকাতার শীতে বিরল। তবে আজকাল পরিবেশদূষণের ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সবকিছু।
ধুলো উড়ছে রাস্তায়। ঝড় শুরু হলো নাকি?
জেগে থাকতে সুবিধে হবে ভেবে ঘরের মাস্টার কি-টা অন রেখেছিলেন আশুতোষবাবু। আলো নিবে গেল হঠাৎ দপ করে। লোডশেডিং হয়ে গেছে ঝড়কে সামাল দিতে। জেনারেটর রয়েছে হোটেলের। তবে উঠে গিয়ে সেটা চালু করতে হবে রিসেপশনের লোকেদের, যদি অবশ্য তারা জেগে থাকে এত রাতে!
আজকাল অন্ধকার একদম ভালো লাগে না আশুতোষবাবুর। ভয় করে, খুব খুব ভয় করে। খালি মনে হয়, আলো যদি আর ফিরে না আসে কখনো? চোখ খুলে আশেপাশে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে না পেলে আজকাল ভয় হয় অজানা কেউ যেন তাঁর চোখ দুটো খুবলে নিচ্ছে। দশদিন আগেও এত ভয় ছিল না শরীরে বা মনে।
জেনারেটরের শব্দ কানে না আসা পর্যন্ত চোখ বুঁজে রাখবেন আশুতোষবাবু, ভাবলেই তো হলো আলো রয়েছে আশেপাশে, প্রচুর, প্রচুর আলো। চোখ খুললেই দেখতে পাবেন যে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের মতন সারি দিয়ে আলো ঘিরে আছে তাঁকে, মালার মতন চারপাশে সাজানো আলোগুলো, কোনটা লাল, কোনটা নীল, কোনটা সবুজ ... দপদপ করছে আলোগুলো। জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে ...না, না, নেভার কথা ভাবলে চলবে না। জ্বলছে, শুধু জ্বলছে, জ্বলেই রয়েছে। নিভবে না কখনো, সুইচ টিপলেও নয় ...
জানলা বন্ধ, কারেন্ট নেই, তবু এত হাওয়া লাগছে কেন গায়ে? ফ্যানটা কি করে এত জোরে জোরে ঘুরছে? হাওয়ার ঝটকা লাগছে গায়ে, হঠাৎ করে যেন খুব হালকা হয়ে গেছে শরীরটা। শূন্যে ভাসছে পালকের মতন। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কি আরাম সারা শরীরে। এখন শুধু ধাক্কা দেওয়া দরকার কোনো দরজায়। দরকার—খুব, খুব দরকার—কোনো না কোনো দরজা ভাঙার।
ঝোড়ো হাওয়া এবারে তাঁকে খোলা জানলা পার করে হোটেলের ঘর থেকে আকাশে ভাসিয়ে দিলো। অন্ধকার, তবু উপর থেকে সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন আশুতোষবাবু। এই তো সেই রাস্তা, যার দুপাশে ন্যাড়া, পাতাহীন গাছের সারি, যার শেষ সেই ভাঙা পোড়ো বাড়িটাতে। হাওয়ায় লটকাতে লটকাতে নিচে নামছেন তিনি, ঘুড়ির মতন। ঘুড়ির সুতোটা কার হাতে বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য। বুঝবার দরকারই বা কি, যখন এত আরাম শরীরে?
না, খোলা নয়। বাড়িটার সদর দরজা আজও বন্ধ। কিন্তু এমনই শক্তি আজ ঝোড়ো হাওয়ার যে তা কোনো লোহার দরজাকেও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নিজের মধ্যে এক তীব্র শক্তি আর উত্তেজনা অনুভব করছেন আশুতোষবাবু। প্রহরীরা তো মৃত, আজ আর তাঁকে আটকানোর মতন কেউ নেই আশেপাশে। আজ ওই দরজাটা ভাঙবেন আশুতোষবাবু। আসুক সেই "আয়! আয়! আয়! আয়!" ডাক। আজ যাবেন। ওই ডাকের উৎসে পৌঁছে একটা হেস্তনেস্ত করবেন আজ। দেখবেন, জানবেন কি রহস্য লুকিয়ে আছে বাড়ির ভিতরে। সাপের বিষের মতন অবশ করা এক তীব্র নেশা শরীরে। তবু তার মধ্যেও সব টের পাচ্ছেন আশুতোষবাবু। টের পাচ্ছেন যে সমুদ্রতরঙ্গের মত ঝড়ের বিপুল এক ধাক্কা সদর দরজাটা ভেঙে ঠেলা মেরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তাঁকে বাড়ির অন্দরে।
প্রথমে একটা লম্বা সরু করিডোর—কলকাতার অসংখ্য কানাগলির মতন। করিডোরের ছাতে, দেয়ালে সর্বত্র নোনা ধরা। ছাত থেকে জল পড়ছে টিপটিপ করে। মেঝে আর দেয়াল শ্যাওলাতে এত পিছলে যে সাবধানে পা টিপে টিপে না গেলে হড়কে পড়বার সম্ভাবনা প্রবল। করিডোরের শেষে তিনটে সিঁড়ি, সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে মূল বাড়িতে ঢোকার দরজা। আশুতোষবাবুকে অবশ্য পা হড়কে পড়ে যেতে হলো না। ঝোড়ো হাওয়ার এক প্রবল ঝটকা তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেললো এই দ্বিতীয় দরজার মুখে। প্রথম দরজার মতন বন্ধ নয় এই দ্বিতীয় দরজাটা। বন্ধ হলেও লাভ হতো না কোনো, আশুতোষবাবু আর ঝড় আজ এক হয়ে গেছে পৃথিবীর সব বাধাকে ভাসিয়ে দূরে নিয়ে যেতে।
একটা পচা গন্ধ এই দ্বিতীয় দরজার ঠিক মুখে। সাদা দুধের মত কোনো তরল জলের সাথে মিশেছে। গন্ধের উৎস ওই তরল। কি ওটা? দুধ? এখানে হঠাৎ দুধ এলো কোথা থেকে? কতদিন ধরে পচছে ওই দুধ? আধা আলো আধা অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছে না। কিছু যেন নড়ছে ওই পচা দুধের ভিতরে। কি ওগুলো? কৃমি?
কোনো কিছু ভালো করে বোঝার আগেই তুফানি হাওয়ার ধাক্কা করিডোর, দরজা সব পার করে আছড়ে পড়লো দ্বিতীয় দরজার উল্টোদিকের দেয়ালে। কোনো হাতল নেই দেয়ালে, আঁকড়ে ধরবার মতন। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে সোজা নিচে মেঝেতে আছড়ে পড়লেন আশুতোষবাবু।
ঝড়টা থেমে গেছে হঠাৎ করে। আর কি আশ্চর্য! ঐ "আয়! আয়! আয়! আয়!" ডাকটাও শোনা যায়নি আজ। তবু আশুতোষবাবু জানেন, তিনি এসে গেছেন। গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন—যেন জন্ম থেকে এখানেই আসার কথা ছিলো তাঁর। হালকা লাগছে খুব এখন। মনে ফুর্তি আসছে ফুরফুর করে। ইচ্ছে করছে বারবার একই ভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় ভেসে ওই দরজাটা ধাক্কা মেরে ভেঙে দিতে।
মনের এই ফুরফুরে ভাবটা নিয়েই দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালেন আশুতোষবাবু। হাতে কিছু একটা লেগেছে। আঁশটে গন্ধওলা কিছু—ডিমের মতন। বোধ হয় ভেঙে গেছে ডিমটা। দেয়ালের ঠিক নিচে ডিম রাখা কেন এখানে? এ বাড়ির লোকেরা কি হাঁস-মুরগি জাতীয় কিছু পোষে? বাড়ির বাইরে রাখে না কেন ওদের?
একটা ছোট ঘর এটা। ভ্যাপসা গন্ধ ঘরটাতে। অনেকদিন কোনো বাড়ির সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকলে যেরকম হয়। কয়েক ইঞ্চি পুরু ধুলো জমে আছে ঘরটার মেঝেয়। ঘেয়ো দেওয়াল, প্লাস্টার খসে পড়ছে সর্বত্র। মাকড়শার জালে ভরা সবগুলো দেওয়াল। ভাঙা পুরোনো একটা খাট ডানদিকের দেওয়ালটা লেপটে, তারপাশে আদ্যিকালের কারুকার্য করা একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। একটু দূরে একটা আলমারি আর একটা ফাঁকা বুকশেলফ। বুকশেলফের উপরে দু'প্রান্তে দুটো গোল ল্যাম্পশেডের মধ্য থেকে দুটো ইলেকট্রিক বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছে, হঠাৎ করে দেখলে কোনো বড় শিকারি প্রাণীর চোখ বলে মনে হয়।
যাক। একেবারে অন্ধকার নয় তাহলে। বাড়িটা থেকে এবার বেরোবেন আশুতোষবাবু। বেরিয়ে হাত ধুতে হবে সবচেয়ে আগে। ভালো করে হাতে সাবান না মাখালে এ গন্ধ যাবে না। কি অদ্ভুত! ডিম খেতে এত ভালো লাগে আশুতোষবাবুর অথচ কাঁচা ডিমের এই বিটকেল আঁশটে গন্ধটা সহ্য হয় না একেবারে।
বেরোবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে উঠলেন আশুতোষ বাবু। ঘরের দরজাটা গেল কই? এ তো নোনা ধরা দেয়াল শুধু চারধারে। দেখে মনে হচ্ছে না সাতজন্মে এ ঘরে কোনো দরজা ছিলো। বেরোবেন কোথা দিয়ে? নাকি … নাকি … এই অন্ধকূপেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে আশুতোষবাবুকে, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে মুক্তি দেয়?
ঘামে ভিজে গেছে শরীর। টপটপ করে ঘাম পড়ছে মেঝেতে। এরকম তো কথা ছিলো না। ধুলোর সাথে ঘাম মিশে কাদা হচ্ছে চারপাশ। পাঁক। নরক। এ কোন নরকের পাঁকে এসে পড়লেন আশুতোষবাবু?
দরজা খুঁজে বের করতে হবে যেভাবেই হোক। তা না হলে আর একটু পরে ভোর চারটের সময় হোটেল থেকে বেরোবেন কি করে? আর সকাল সাতটার নিউ ইয়র্কের ফ্লাইটই বা ধরবেন কি করে? সামনে নতুন জীবনের হাতছানি। এতদিন ধরে এত চেষ্টা, এত ছল-বল-কৌশল সব ব্যর্থ হয়ে যাবে যেতে না পারলে ...
প্রাণপণে দরজা খুঁজতে খুঁজতে আবার সামনের দেয়ালে চোখ চলে গেল আশুতোষবাবুর। আরে! দেয়ালের ঠিক মাঝখানে এত বড় একটা আয়না চলে এলো কখন? নাকি আগে থেকেই ছিলো আয়নাটা, আশুতোষবাবু খেয়াল করেননি? এত নোংরা ঘর, তবু কি পরিষ্কার আয়না। যতই বিপদ আসুক, একটা আয়না কাছে থাকলে আর একা লাগে না নিজেকে। নিজের প্রতিবিম্বের চেয়ে বড় আপন আর কে আছে পৃথিবীতে?
আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে ফের চমকে উঠলেন আশুতোষবাবু। এ কোন মুখ? এ তো তাঁর এখনকার মুখ নয়। এ তো তাঁর লোহিয়া মাতৃসদনে তোলা সারা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো সেই প্রথম ফোটোর মুখ—অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর দিকে আধখোলা চোখে তাকিয়ে থাকা সেই মুখ, যে মুখে তখনো কোনো পাপের ছোঁয়া লাগেনি। তাঁর এখনকার মুখ গেলো কোথায়?
কেউ কোত্থাও নেই, তবু আশুতোষবাবু পরিষ্কার শুনতে পেলেন হিসহিস করে তাঁকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে মুখোশটা খুলে ফেলতে। তিনি কি তাহলে মুখোশ পরে? জন্মের ঠিক পরের এই মুখটা কি আসলে একটা মুখোশ? এ কেমন মুখোশ, চামড়ার সাথে একেবারে এঁটে আছে অথচ বোঝা যাচ্ছে না একফোঁটা? আদেশ অমান্য করবেন আশুতোষবাবু? কে যেন সেই পুরোনো হিসহিস করা গলাতে তালে তাল মিলিয়ে তাঁর দু’ কানের মধ্যে একটানা বলে চলেছে, “খোল! খোল! খোল! খোল!” কান ঝাঁ ঝাঁ করছে আশুতোষবাবুর। মাথা ঘুরছে। এ আদেশ অমান্য করার সাধ্য তাঁর নেই।
তাড়াতাড়ি মুখোশ খোলার ভঙ্গিতে মুখের উপর হাত বোলাতে গিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলেন আশুতোষবাবু। কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না, অথচ হাত বোলালেই একটু একটু করে সারা মুখের চামড়া উঠে যাচ্ছে তাঁর, মুখোশ খোলার সময় যেমন হয়। কানাগলির শেষ দেয়ালের আয়নায় দেখতে পাচ্ছেন আশুতোষবাবু তাঁর আসল মুখ—পচা, গলা মাংস খসে পড়া একটা মুখ, তাঁর নিজের কাঁধের উপর বসানো।
“আয়! আয়! আয়! আয়!”
হিসহিস করে কে যেন ডাকছে তাঁকে। না, গন্তব্যে এখনো পৌঁছানো হয়নি তার মানে। আরো যেতে হবে? কোথায়? কত দূরে?
“আয়! আয়! আয়! আয়!”
কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। বুক ধড়ফড় করছে। এ ঘরে ঢোকার রাস্তাটা কি সহজ, কি সহজ—যেন আকাশে উড়ে উড়ে দরজা ভেঙে ভেঙে, অথচ বেরোনো?
“আয়! আয়! আয়! আয়!”
ইলেকট্রিক বাল্বদুটো নিভে যাচ্ছে কেন আস্তে আস্তে? লোডশেডিং? নিজেই চোখে অন্ধকার দেখছেন আশুতোষবাবু? নাকি … নাকি … চোখদুটো আস্তে আস্তে খুবলে নেওয়া হচ্ছে তাঁর, মুখের চামড়াটাকে যেভাবে খুলে নেওয়া হয়েছে?
“আয়! আয়! আয়! আয়!”
রেহাই নেই।
যেতে হবে এবার।
দু’ হাতে বুক চেপে ধরে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে ঘড়ঘড়ে গলায় কোনোক্রমে শুধু বলতে পারলেন আশুতোষবাবু, “সরি, মুনিয়া, সরি! এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমার!”
***
রিজেন্ট হোটেলের গলির দিকের দোতলার ২০২ নম্বর রুমে ডক্টর সৃঞ্জয় বোস ম্যানেজারের দিকে চেয়ে হাসলেন।
-- কি নাম বললেন? আশুতোষ পোদ্দার? লাকি চ্যাপ! আরে এরকম ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু তো আমার স্বপ্ন মশাই, এত আরামে মরা মানে সামনে সিধে স্বর্গের খোলা দরজা!
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)