Subscribe to Magazines






পরবাসে
ফাল্গুনী ঘোষের

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




চুড়িঘর


নিয়মমাফিক যে কোনো মহাবিদ্যালয়ের ধারে কাছে একটি সিনেমা হল, দু-চারটে খাবারের ঠেলা, গলির চায়ের দোকান, একটা বই খাতা পেনের দোকান, দু-চারটে গয়নার দোকান থাকাই দস্তুর। সে নিয়ম এই এলাকাতেও বেনিয়মের খাতায় নাম লেখাতে পারেনি। কলেজমোড়ের ঝুটো গয়নার দোকানে মেয়েলি টানে ভিড় উপচে পড়ে। নিত্যনৈমিত্তিক জোয়ার ভাঁটায় ‘চুড়িঘর’ টুংটাং ছন্দে মুখর হয়। এলাকায় ওই নামেই পরিচিতি।

দোকানটি ইংরাজি এল শেপের। আলো ঝলমলে কিছু অংশের সঙ্গী হয়ে জুড়ে থাকে জমাটবাঁধা নিরাসক্তির এক ক্ষুদ্র অংশ।

“কাকু এই পাথরের সেটটার কত দাম?”

হাসিদোলানো প্রশ্নের উত্তর ভেসে আসে আলো নিভে আসা নিঃসীম নিরাসক্তির কোণ থেকে। শীর্ণ দৃষ্টি মেলে দোকানি উত্তর দেয়,

“তোমরা তো দোকানের নিয়ম জানোই, সেই দামেই পাবে!”

আর পাঁচটা দোকানের সঙ্গে চুড়িঘরের এখানেই তফাৎ। যে যাই কিনুক মোটের উপর দশ টাকা ছাড়। দু চারটে বিক্রিবাট্টা বেশি হয় সেকারণে। প্রতিবেশী দোকানের ঈর্ষার কারণও তা। সস্তা পাওয়ার লোভে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঝুটো গয়নায় মেয়েদের ছোটোখাটো ব্যাগ ভারী হয়ে ওঠে।

চুড়িঘরের ঠাসা রঙিন ফিতে, ক্লিপ, টিপ, ঝিলিক দেওয়া ঝুটো হীরে, ঝিকিয়ে ওঠা নকলি সোনার গয়নার হাজারো মাপ, ডিজাইনের মাঝে একচিলতে ফাঁকাতে ইতস্তত চলাফেরা করা আপাত নির্লিপ্ত উদাসীন ছিপছিপে ‘চুড়িঘর কাকু’র গৌরবর্ণে নেই কোনো চাকচিক্য। ফ্যাকাশে রঙ চোখদুটোয় এনে দিয়েছে শীর্ণতা, কুঁকড়ে থাকা একটা মানুষের ভিতর উৎসুক আরেক মানুষের বসবাসের ঠিকানা সেখানে ধরা পড়ে যেন! পরনে অধিকাংশ দিনই রংচটা গাঢ় বাদামি আভার প্যান্ট আর বহু ব্যবহারে লালচে হয়ে যাওয়া হালকা ফাটা ফাটা রোঁয়া ওঠা কলারের সাদা শার্ট। দোকানে আসা ঝাঁকের মেয়েগুলো গয়না দেখার পাশাপাশি দোকান মালিকের পোশাকের অপারিপাট্য আর একঘেয়েমি নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়ে না।

প্রতিনিয়ত এসব ঠুনকো হাসি আত্মসাৎ করে দোকানের অন্দর মহলের কুঠুরি থেকে দোকানি সারাদিনে একবারই বাইরের আলোয় আসে। পাঁচমাথার মোড়ের বড়ো ঘড়িটায় পাঁচটার ঘন্টা বাজলেই তার পা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নিঃশ্বাস জোরদার হয়। সেই মেয়েটার আসার সময় হয় যে!

চুড়িঘরের মালিকের দৈনন্দিন রোজনামচা প্রায়শঃ এরকমই। সকাল থেকে দুপুর অবধি কুনকের মাপে হাসি, টুকরো কথা, ঝুটো গয়নার বিকিকিনি, দুপুরের চাট্টি ডাল ভাত। নিয়মমাফিক জীবন একটু শ্লথ হয়ে আসে গড়ানো বিকেলে। চারদিকে আলোর আভায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে আসে পাতলা ধোঁয়াটে চাদর। পশ্চিম আকাশে বিদায়ী সূর্য যখন ঢলোঢলো, ঠিক তখনই মেয়েটি আসে। চুড়িঘর থেকে পুবদিকে চলে যাওয়া ব্যস্ত রাস্তায় ধুলো-ধোঁয়া, বাইক, অটো, রিক্সা, সাইকেল, বাসের হাঁসফাঁসানি। সেদিকে দৃষ্টি দিলে সামাজিক অস্থিরতা মনে চেপে বসে। দোকান থেকে উত্তরমুখী চলে যাওয়া আরেকটা পাথর ছড়ানো রাস্তায় পায়ের দাগেরা গল্পকথা বিছিয়ে নিঃশেষ হয়। নির্জনতা বুকে নিয়ে রাস্তা উদোম হয়ে শুয়ে থাকে আকাশের নীচে। কালে কস্মিনে দু-একটা লড়ঝড়ে সাইকেলের ঘন্টি ক্রিং ক্রিং আওয়াজে অষ্টাদশী পথের বুকে ঢেউ তোলে।

নতুন করে স্বল্পায়ু বিকেলে প্রতিদিন রাস্তাকে চিনে নিতে বড্ড ভালো লাগে চুড়িঘরের মালিকের। গোধূলির ঘোলাটে আলোয় নির্জন রুগ্ন পথ কেমন বিদ্যুৎরেখার মতো চোখের সামনে জেগে থাকে। ওই পথে ভিড় করে আসা গাছেদের সীমারেখায় মেয়েটি এলেই মগ্ন হয়ে দেখে সে।

“এই নাও তোমার চা...... বেশিক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকো না …”

রোজকার স্ত্রীর সাবধানবাণীর উত্তরে কোনোদিন উত্তর আসে, “তুমি ঘরে যাও, তোমার কাজ সারো” কোনোদিন বা সেটুকুও নয়!

স্ত্রীর সাথে টুকটাক শব্দের আদানপ্রদান হলেও স্ত্রী জানে তার স্বামী এখন সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি। এসময় বিভোর হয়ে থাকে সে।


চুড়িঘরের মালিক আসলে শিল্পী মানুষ। মাটি, পাথর, গয়নার সাম্রাজ্যে সে নিজেই নিজের রাজা। অন্যান্য ঝুটো গয়নাগাঁটি বাইরে থেকে আমদানি করলেও পাথর কুঁদে, কাঠ খুঁটে খুঁটে, দুহাতে মাটি মেখে সে বানিয়ে চলে নতুন নতুন গয়নার ডিজাইন। সমঝদার না হলে বিক্রিও করে না সেসব গয়না।

সন্ধে জাঁকিয়ে বসলে চুড়িঘরের ঝাঁপ পড়ে যায়। মালিকের ঘরের দরজা খুট শব্দে খোলে। দোকানের সমান্তরালে ভিতরের অংশে মালিকের নিজস্ব ঠিকানা। সেখানেই হাজারো নতুন নির্মাণের ভিড়ে বিভিন্ন আকৃতির মেয়েলি ছাঁদের মুখ আলো করে থাকে। মাধ্যম যাই হোক, সে মুখ মালিকের সৃষ্টি। ঘরের ক্লান্ত, মলিন হলদেটে আলোয় মুখগুলোকে আপন মনে হয় তার। এদের প্রতি বড়ো মায়া। বড্ড মমতা। সারাদিনের যন্ত্রণা, কষ্ট, না পাওয়ার ক্ষতিয়ান যেন মুছে যায় এদের কাছে এলে। তখন সে খুব মন দিয়ে দেখে প্রতিটি অবয়বের মৌখিক বিভঙ্গ—‘নাহ! গোধূলিবেলার নির্জন পথের সেই মেয়ে তার শিল্পীসত্তায় ধরা পড়ে না!’ ওড়না ঢাকা আবছা অবয়বটিকে সে অনেক ভঙ্গিমায় ধরার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুতেই যেন মনের মতো হয় না! বিষাদে মাথা নাড়ে প্রতিনিয়ত। গভীর অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে।

তবু একাকী রাত্রিকে সঙ্গী করে চলে অক্লান্ত চেষ্টা। রাত দুপুরের হতাশ খুটখাট একসময় নিশ্চুপ হয়ে আসে আনমনেই, কেননা বাইরের রাস্তায় কুকুরের গোঙানি আর রাত্রির নিস্তব্ধতা বাতাসে ফেনিয়ে ওঠে তখন। সে ফেনায় মিশে যায় গৃহবন্দী সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসেরা।

এভাবেই সকাল হয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর এগিয়ে যায় বিকেল আর সন্ধের মাহেন্দ্রক্ষণে। প্রতিদিন যে সময়টুকুর অপেক্ষা থাকে শুধু মালিকের নয়, চরাচরেরও বুঝি বা।

“বুঝলে গিন্নী, আজ ওই মেয়েটির মুখ আমাকে দেখতেই হবে... এমন করে আমি হেরে যেতে পারি না... কিছুতেই না...”

ভাতের গ্রাস জোরে মুখে ঠেলে গলায় চালান করে মালিক। ঠক করে ঠুকে রাখে ফাঁকা জলের গ্লাস। স্ত্রীকে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে চুড়িঘরের নিজস্ব কোণে গিয়ে বসে সে।


বসন্ত শেষে বেশ গরমের আঁচ পড়েছে। এসময় এই এলাকায় লু বয়। আগুনের হলকায় আঙার হয়ে ওঠা লাল রুক্ষ মাটিকে সাক্ষী রেখে আকাশের অনেক উঁচুতে ঘুরপাক খায় চিলের দল। সাদা ইস্পাত রোদ দিগন্তে মরীচিকা এঁকে দিলে, প্রায়শ গলার নলি শুকিয়ে আসা পথিক হন্তদন্ত হয়ে সতৃষ্ণ দৃষ্টিসহ ঘুরপাক খায় দিগন্তরেখায়। আজও তেমনই ঝাঁঝালো দুপুর। চুড়িঘর মালিকের মুখে চোখে জ্বালা ধরেছে। আজ তাই নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই এসে দাঁড়ায় সে উত্তরমুখী রাস্তার কাছে। এরকম দুপুরের শেষে উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে হাওয়া বয়ে আসে প্রায় দিন।

“আজ সন্ধে নামার আগেই যেন ঝড়বৃষ্টি না নামে!...”

বিড়বিড় করে মালিক। মনটা কুঁকড়ে যায় ভাবনায়। নাহলে যে সে আসবে না। শ্রান্তিতে চোখ বুজে আসে তার। আকাশের পুবের আধখানা বাদ দিলে বাকি থাকা আধখানা আকাশ জুড়ে ছাইরঙা ঘোমটার আবরণ তখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে উজ্জ্বল হলুদ আলোকে।

...ঝুমুক ... ঝুমুক... ওই তো ওই তো ... পায়েলার মিঠে আওয়াজ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। ... সে আসছে!

চকিতে দৃষ্টি উন্মুক্ত করে মালিক। দূর থেকে ঠাহর হয় একমাথা ঘন চুলে দোলানো বেণীগাঁথন। ... ঝুমুক... ঝুমুক... আওয়াজের উৎসে অবয়ব আকার নেয়। আজ পড়েছে কমলা আর আকাশির সাজ।

এরপর ধীরে ধীরে সে খুব কাছে চলে আসবে। শুধু ওড়নার অবগুন্ঠন থেকে জেগে থাকবে পদ্মকুঁড়ি চোখদুটি আর কানে বাজবে একটি সুরেলা কণ্ঠ --

“মাটির এই গয়নাগুলো দেখতে পারি?”

শশব্যস্তে মালিক সব গয়না বিছিয়ে দেবে...মাটি... পাথর... কাঠের ছাঁচ... সে শুধু একবার নেড়েচেড়ে দেখুক! আর মালিকের বোবা দৃষ্টিকে একটু সময় দিক মেয়েটির সমগ্র অস্তিত্ব জরিপের!

নাহ! এই কমলা আকাশি সাজ পছন্দ হবে না চুড়িঘরের মালিকের। কোমল চাউনির কিশোরীকে সে লালপাড় সাদা শাড়িতে সাজাবে। না হলে মানায়! ওরকম নরম মুখ! একঢাল কালো চুল! সীমন্তে ঝিকিয়ে উঠবে চুলুটি, গলাভরা জমাট হীরের হার। বিকেলের সোহাগী সূর্যরশ্মি কপালে এঁকে দেবে লাল আভা। সে নত মুখের মধ্যে জেগে থাকা লাজুক নথের দিকে চেয়ে মালিক বলবে... ‘লজ্জা কিসের! মুখ তোলো দেখি!...”

আর দেরি সয় না মানুষটার। শীর্ণ, রোগাটে দুহাত এগিয়ে প্রায় রাস্তায় নেমে পড়ে যুবতীর মুখ হাতের আদরে নেওয়ার জন্য।


নিজের কাছে রাখা পণে তাকে নিজেকেই হারিয়ে দেওয়ার খেলায় ধীরে ধীরে প্রকৃতিও যেন মাতাল হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। আকাশে প্রবল কালবৈশাখীর দাপট, দ্রুত ধুলোর আস্তরণ ফেলে এগিয়ে আসা অবয়বের দিকে। চুড়িঘরের মালিকের চোখ ঝাপসা করে মাতাল বৃষ্টি নামে মুহূর্তে। বৃষ্টিভেজা বাড়ি, রাস্তা, গাছপালা, রমণীর অবয়ব মিলিয়ে গিয়ে ঘষা কাঁচের আবছা ছবি তৈরি হয় ধীরে ধীরে। বৃষ্টির বুদবুদের আড়ালে অনন্তকাল গলে গলে পড়ে যেন! হাহাকার করে ওঠে দোকানি। মেঘের প্রচণ্ড গর্জনের আবডালে হারিয়ে যায় সে আর্তনাদ।

“... চলে গেল... চলে গেল... ধরে রাখতে পারলাম না! আজ যে মুখটা দেখার কথা ছিল!”

ভেঙেচুরে চুড়িঘরের দরজায় বসে পড়ে মালিক। আকুল বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে কাঁপতে থাকে থরথর করে।

ঠিক তখনই দোকানের সমান্তরাল কোণে, ভিতরের অংশে চুড়িঘর মালিকের স্ত্রী আঠারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পাথুরে দৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া এক ‘বাবা’কে দেখতে থাকে, যেভাবে সে প্রতিদিন দেখে!


* * * * *


পরদিন দুপুরে একদলা ভাত মুখে ঠুসে চুড়িঘরের দোকানি তার স্ত্রীকে বলে,

“বুঝলে গিন্নী, আজ ওই মেয়ের মুখ দেখেই তবে ছাড়ব...!”



(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)