একালের প্রেমের কবিতা—দীপ্তি ত্রিপাঠী; প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৬৯; বিশাখা প্রকাশনী, কলকাতা; পৃষ্ঠা: ??; ISBN: ??
লকডাউনের ফলে এমনিতেই বাড়ি থেকে বের হচ্ছি খুব প্রয়োজনে। সঙ্গে থাকছে সতর্কতা এবং ভয়। তো সেদিন বাজার করতে বেরিয়ে বইয়ের জন্য মনটা হাঁসফাঁস করছিল। সকাল বেলায় এই রকম হলেই সোজা চলে যাই রামকৃষ্ণের বইয়ের দোকানে, যেটা ওর নিজের ভাষায় ‘দোকান নয় দোকানের মতো’। শান্তিনিকেতন পোস্ট অফিসের মোড়ে সে খবরের কাগজ সাজিয়ে বসে থাকে। সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রকমের বই। প্রয়োজনীয় বইটি টপাটপ তুলে ফেলে পকেটে টাকা থাকলে দাম দিয়ে বা না থাকলেও ইতর বিশেষ না ঘটিয়ে তুলে আনা যায়। এখন সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাই বন্ধ। ফলে রামকৃষ্ণের দোকানে পুরোনো বইগুলোই একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। কিছু চেনা পরিচিত মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়। আড্ডাও জমে। রামকৃষ্ণের কাছে নতুন কোনো বই কিনতে না পেরে একটু হতাশ হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে ধাবিত হব বলে বাইকে চেপে বসলাম।
পোস্ট অফিস মোড়েই বিশ্বভারতীর পিয়রসন হাসপাতালের গায়ে বহু পরিচিত এবং শান্তিনিকেতনের একটি ল্যান্ডমার্ক ‘সুবর্ণরেখা’ অবস্থান করছে। প্রখ্যাত ব্যক্তি ইন্দ্রনাথ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত এই দোকান বহু বিখ্যাত মানুষের পদধূলি ধন্য। আমি একটু এগিয়েই গাড়ি থামাতে বাধ্য হলাম। তৃষিত নয়নে দেখলাম সুবর্ণরেখা খোলা আছে, ভিতরে আছে ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ছেলে ভোম্বল-দা। ভোম্বলদা-ই এখন দোকানের কর্ণধার। অতএব সুবর্ণরেখা ছেড়ে এগোতে পারলাম না। পকেটের মানিব্যাগে টাকার পরিমাণটা দেখে নিয়ে ঢুকেই পড়লাম। বই কিনতে বা বই দেখতে। এধার-সেধার বইয়ের ভিড়ে আমার লক্ষ্য ছিল সুবর্ণরেখা প্রকাশনীর পুরোনো বইগুলি যদি পাওয়া যায় সেগুলি সংগ্রহ করা। বই দেখতে দেখতে বাজারের কথা ভুলেই গেছিলাম। মনে পড়তেই সজাগ হলাম। যে দু-একটা বই বেছেছিলাম ভোম্বল-দার হাতে দিয়ে বিল করতে বললাম। বইগুলি দেখে নিয়ে ভোম্বলদা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কবিতা পড়ো?” উত্তরে যথারীতি ‘হ্যাঁ’ বললাম। আমাকে মাটিতে রাখা কিছু পুরোনো বইয়ের স্তূপ দেখিয়ে বলল, “এর মধ্যে কবিতার বই আছে, তুমি নিয়ে যেতে পারো। দাম দিতে হবে না।” ভোম্বলদার এরকম মহানুভবতায় আমি গলে গেলাম, ভেসে গেলাম। ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই’ এই প্রবাদটিকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। মনের মধ্যে আশা এখান থেকে কিছু একটা পেতে পারি। প্রবল উৎসাহে বসে পড়লাম বই ঘাঁটতে। বেশিরভাগ বই-ই পোকায় কাটা। অনেক বই বল্মীকের ভালোবাসার চিহ্ন বহন করছে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাছাই করে ফেললাম খানকয়েক বই। এর মধ্যেই একটি বই দেখে একটু চমকালাম।
বইটি হল দীপ্তি ত্রিপাঠী সম্পাদিত ‘একালের প্রেমের কবিতা’। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম প্রকাশকাল জুন ১৯৬৯। বিশাখা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। আধুনিক কবিতার ব্যাখ্যাতা হিসেবেই দীপ্তি ত্রিপাঠীর সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে স্নাতক স্তরে পড়ি। আধুনিক কবিতার আলোচনায় সাধারণত তাঁর বইটিই আমরা প্রথম তুলে নিয়ে থাকি। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত, সংকলিত এবং সম্পাদিত প্রেমের কবিতার বইয়ের জন্য ভীষণ উৎসুক হয়ে উঠলাম। সবজি, দুধ-দই ইত্যাদিতে ভর্তি থলিতে বইগুলিকেও ঠেসে দিলাম। আমার বাজারের থলিতে আলু পটল উচ্ছের সঙ্গে বইয়েদের এখনো পর্যন্ত সংঘাত হতে দেখিনি। গৃহিণী প্রায়ই দেখেন যে সবজির সঙ্গে সঙ্গে থলি থেকে বইও বের হয় এবং আগে কিছু বললেও এখন ওটা সইয়ে নিয়েছেন। ফলে বীরত্বের প্রকাশ না দেখালেও মানসিকভাবে আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করি আর উনি উচ্চবাচ্য না করে বইগুলিকে আলাদা রেখে দেন। বেলা গড়াতে না দিয়ে চললাম স্নান করতে। কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগল… সেই পোকা ধরা বইটা …
২
উত্তাল চল্লিশ পার হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছে এবং সেই ‘আজাদি ঝুটা’-ও হয়ে গেছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ভারতবর্ষের মানুষের মনে। দেশভাগ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তুর স্রোত প্রভৃতি ক্রমে ক্রমে মানুষের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। স্বাধীনতার যোদ্ধাদের মনে সেই প্রশ্নটি দৃঢ় ভাবে উঠে আসছে, ‘এই ভারতবর্ষের জন্য অসংখ্য বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছেন? এই স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীরা লড়াই করেছিলেন?’ পঞ্চাশের দশক থেকে প্রেক্ষাপট পালটে যাচ্ছে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে খাদ্যের হাহাকার! পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ১৯৫১ সালে খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল। পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলিচালনার ফলে দুই তরুণী সহ তিনজনের মৃত্যু হয়। গর্জে উঠলেন কবি শঙ্খ ঘোষ, “নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/ একটু আগুন দে,/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে!/ নোটন নোটন পায়রাগুলি খাঁচাতে বন্দী--/ দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা/ ওড়াতে মন দিই!/ হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়/ হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাই দিই হায়/ নিভন্ত এই চুল্লি তবে/ একটু আগুন দে,/ হাড়ের শিরায় শিখার মতন/ মরার আনন্দে!/ … দূর্বাতে তার রক্ত লেগে/ সহস্র সঙ্গী/ জাগে ধ্বক ধ্বক, যগ্গে ঢালে/ সহস্র মণ ঘি!/ যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে/ বিষের টোপর নিয়ে!/ যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ-পথ দিয়ে/ দিয়েছে পথ গিয়ে!/ নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে!” (যমুনাবতী: দিনগুলি রাতগুলি)। পরবর্তীকালে এই কবিতাটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, “মরিয়া কোনো ঘরের মেয়ে যদি একদিন ভুখামিছিলে বেরিয়ে আসে পথে, নিষিদ্ধ রেখার ওপারে টেনে নিয়ে সে-মিছিলের কোনো কিশোরীকে যদি হত্যা করে পুলিশ--হঠাৎ তখন ঝলক দিয়ে ওঠে দূরবর্তী তার মায়ের মুখ: দেশব্যাপী যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে সেই মৃত্যু তবে কবিতারই কথা হতে পারে।” (কবিতার মুহূর্ত, পৃ ১৫)
১৯৫৩ সালে কলকাতা আবার উত্তাল হয়ে উঠল। ট্রামভাড়া বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে চলল হরতাল, রেল অবরোধ ইত্যাদি। এর বিপরীতে পুলিশের লাঠি গুলি চলতে থাকে। এই সময় বামপন্থীরা জঙ্গী আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। এই দশকের শেষের দিকে ১৯৫৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে আবার খাদ্য আন্দোলন শুরু হয়। তৈরি হয়েছিল ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। আগস্ট মাসে ধর্মতলায় লক্ষাধিক কৃষক সমবেত হয়। রাষ্ট্রের পুলিশ তার নখদন্ত নিয়ে তীব্র আক্রমণ করে। ৮০ জন প্রতিবাদী মানুষের মৃত্যু হয়, জখম অসংখ্য। অন্নদাশঙ্কর রায় গর্জে উঠলেন কবিতায়-- “ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারার গোঁসাই/ তুর্কি না তাতার না গৌড়ীয় মশাই।”
এই সময় জাতীয়তাবাদ প্রচারে ভারতের ঐক্য প্রচেষ্টার অন্তরালে ভাষা নিয়ে রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ভাষা নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। অসংখ্য উদ্বাস্তু আর নির্বাচনের দামামা মানুষের মনে আনছে হতাশা। একদিকে পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে জাতীয় উন্নতি বিধান ও চাকরি সংস্থানের চেষ্টা করা হচ্ছে অপরদিকে চতুর বণিক শ্রেণির ধনবৃদ্ধি হচ্ছে, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব ঘটছে। “তাই যখন লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে শেয়ালদা হাসনাবাদ বসিরহাট ধুবুলিয়ার রাস্তায় পথে ঘাটে শেয়ালকুকুরের মতো এক সঙ্গে ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খেতে দেখেছি, দেখেছি ন্যাঙটো হয়ে যুবতী মেয়েকে দেহ বিক্রি করতে, তখন সমস্ত জাতীয়তাবাদী নেতাদের ওপর ঘৃণা ও ধিক্কার জেগেছে।” (বার্ণিক রায়, পঞ্চাশের কবির জবানবন্দী) লুপ্ত জাতীয়তাবাদ নিয়ে হারিয়ে যাওয়া সুভাষচন্দ্রের জন্য বেদনাবোধ জাগ্রত হত যুবসমাজের মধ্যে।
এত উতরোলের মধ্যেও কবিতার সাধনা থেমে থাকেনি। এই দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতার পত্রিকা প্রকাশিত হতে দেখি। শচীন ভট্টাচার্য এবং পূর্ণেন্দু পত্রী সম্পাদিত অঙ্গীকার (১৯৫০); দীপঙ্কর দাশগুপ্ত, তরুণ মিত্র, আলোক সরকার সম্পাদিত শতভিষা (১৯৫১); দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস (১৯৫৩); শান্তি সেন সম্পাদিত কবিপত্র; রোহীন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত কবিতাপত্র; সত্যেন্দ্র আচার্য ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত শেষের কবিতা; ভূমেন্দ্র গুহরায়, স্নেহাকর ভট্টাচার্য এবং জগদিন্দ্র মণ্ডল সম্পাদিত ময়ূখ ইত্যাদি। কবিতার প্রবহমান চর্চার ধারায় এই পত্রিকাগুলি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল। বিশেষ করে কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে একদল কবিগোষ্ঠী উঠে আসছে যারা ‘কৃত্তিবাসী কবিগোষ্ঠী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে।
৩
পঞ্চাশের কবিদের লক্ষণ নির্ণয় করতে গিয়ে অরুণকুমার সরকার বলেছেন, “তাঁদের কারুর রচনাতেই জৈব-যন্ত্রণা নেই, অথচ একটা মৌল জীবন-বেদনায় তা ওতপ্রোত। আধুনিক জীবনের বাইরের উপকরণ--যন্ত্র, শহর, শোষিতের সংগ্রাম, বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি এঁদের কাব্যে উপজীব্য নয়। অথচ একটা সুস্থ মানব-সম্বন্ধের উত্তাপ এঁদের কবিতায় সার্বজনীন। … প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির ভিতর দিয়ে আগের যুগের কবিরা যেখানে এসে পৌঁছেছিলেন, কালধর্মে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার অনুকূলতায় সেখান থেকেই এঁদের যাত্রা শুরু হয়েছে। তাই আধুনিক হবার প্রয়োজনে এঁদের কাউকে নালা নর্দমায় স্নান করতে হয় নি, নৌকো পুড়িয়ে দেবার ভাণ করতে হয় নি, আশ্রয় নিতে হয় নি উপরচালাকির। ( অরুণকুমার সরকার, বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা, শতভিষা ১৮, ১৩৬৩ )
এই সময়ের কবিরা শুধু কবিতার জন্যই যেন জীবনযাপন করেছিলেন, কবিতার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন সার্থকতা, কবিতায় হতে চেয়েছিলেন লীন। বক্তব্যটির স্বপক্ষে দুটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে--
“শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু …
কবিতার জন্য এত রক্তপাত …” (শুধু কবিতার জন্য : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )
“প্রতিদিন কবিতায় যৌবন যাচাই প্রতিদিন
শব্দের কষ্টিতে ধ্বনি ঘষা প্রতিদিন
দগ্ দগে সোনার ছড় ফুটে ওঠা চাই প্রতিদিন
কবিতা কবিতা করে ওষ্ঠাগত প্রাণ …” (প্রতিদিন : কবিতা সিংহ )
শুধু প্রেম নয়। পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে ছিল আরও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। এই সময়ের কবিদের মধ্যে ‘রোমান্টিকতার সঙ্গে ব্ল্যাক রোমান্টিকতা, আলোর সঙ্গে অন্ধকার, দেহকামনার সঙ্গে অতীন্দ্রিয় বোধ, স্বদেশকের ভালোবাসার সঙ্গে নিরাশ্রয়তা, নাস্তিত্বের সঙ্গে ঈশ্বর বিশ্বাস, পাপ ও পুণ্য পাশাপাশি হাত ধরে চলেছে।’ (বার্ণিক রায়, পঞ্চাশের কবির জবানবন্দী)
কিন্তু তাঁদের কাছে প্রেমের আবেদন ছিল অন্যতম। স্বাভাবিক জীবনযাপনের সঙ্গে প্রেমও ছিল স্বাভাবিক। যৌবনের স্পর্ধায় কবির দর্পিত উচ্চারণ, ‘দুঃসাহসী হও, ভালোবাসো,/ জানাও তোমার প্রেম লজ্জাহীন লম্পটের মতো’। অলোকরঞ্জন উচ্চারণ করেন, ‘ভগবান জানি না, কাকে প্রেম বলে জানি না/ মানবো যা বলবে, মা-মণি।’ আর সুনীল বলে ওঠেন, ‘ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে--/ সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায়’। আর তারাপদ ভালোবাসার স্বাধীনতা ভুলতে না পেরে বলেন, ‘ছিলাম ভালোবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন/ কয়েকদিন মাত্র তবু এখনো সেই স্বাধীনতার স্বাদ/ এখনো ভোলা গেল না।’
আর এই সময়ের অন্যতম কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রেমের কবিতার কথাই উল্লেখ করে বলছেন, “১৯৫৩ সাল। বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা সবেমাত্র বেরিয়েছে। ইন্দ্র দুগারের আঁকা কলকা দেয়া নয়নাভিরাম প্রচ্ছদ, ভেতরের মসৃণ সুগন্ধ পৃষ্ঠাগুলি পরিপূর্ণ হয়ে আছে রাশি রাশি সরল সুন্দর আবেগময় কবিতায়। সদ্য যৌবন প্রাপ্ত একটি বালককে অভিভূত করেছিল এই সব। পাতা উলটে যেখানেই চোখ পড়ে, আটকে যায় দৃষ্টি। অদৃশ্য কিন্তু স্পর্শগ্রাহ্য একটি মেয়ের অস্তিত্ব সে টের পায়, যে তার অনালোকিত অনিশ্চয়তাময় ভবিষ্যতের দিনগুলি যুঁই আর বকুল ফুলে ভরে দেবে। কী ভালো যে তার লাগে, সে বলতে পারে না।
“বয়ঃসন্ধির জ্বালা ও যন্ত্রণা এবং যৌবনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তাঁর কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাংলাদেশের সব যুবকদের হয়ে বুদ্ধদেব বসু তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দরীকে প্রেম নিবেদন করছেন।”
বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠী যখন বলেন “সমকালীন কবিদের সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা প্রায় লজ্জার বস্তু হয়ে হয়ে পড়েছে” এবং সেই লজ্জা মোচনে দায়ভার গ্রহণ করে কবিদের কবিতা সংকলন করতে যান তখন প্রেমকেই করে তোলেন বিষয়বস্তু। প্রেমের কবিতায় পাঠক হলেন তৃতীয় ব্যক্তি, “a good love poem, though it may be addressed to one person, is always meant to be overheard by other people.” (T S Eliot, The Three Voices of Poetry).
৪
এই সংকলনটিতে দীপ্তি স্থান দিয়েছেন রাজলক্ষ্মী দেবী, অরবিন্দ গুহ, সিদ্ধেশ্বর সেন, শান্তিকুমার ঘোষ, সুনীল বসু, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, শঙ্খ ঘোষ, শংকরানন্দ মুখোপাধ্যায়, আলোক সরকার, তরুণ সান্যাল, কবিতা সিংহ, যুগান্তর চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আনন্দ বাগচী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, স্বদেশরঞ্জন দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, সুরজিৎ দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার, দীপক মজুমদার, মানস রায়চৌধুরী, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সুধেন্দু মল্লিক, অমিতাভ দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত, শান্তি লাহিড়ী, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ রায় এবং উৎপলকুমার বসুর কবিতা। এর মধ্যে সিংহভাগ লেখক পঞ্চাশের প্রতিনিধি-স্থানীয় কবি এবং পরবর্তীকালেও তাঁরা নিজেদের কাব্যকৃতিত্বে বঙ্গসাহিত্যের কাব্যআঙিনায় উজ্জ্বল ছিলেন।
পঞ্চাশের কবিরা যখন লিখতে শুরু করলেন তখন বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতের জন্ম হয়েছে এবং নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। সেই শুভক্ষণে কবিদের যৌবনের সোনার ঘন্টা বেজেছে। এই পরমলগ্নটিকেই ধরার চেষ্টা করেছেন সংকলক। (দীপ্তি ত্রিপাঠী, ভূমিকা)
পপিফুল প্রিয় কিন্তু তার মধ্যে আছে আফিমের মৌতাত। সেই মৌতাতের মধ্য দিয়েই কখন জীবন নীলাম হয়ে যায়। (এ তুমি কী করলে: রাজলক্ষ্মী দেবী)। প্রেমের আসরে গোলাপের কদর আছে। কিন্তু আফিমের নেশা যুক্ত পপি ফুলকে এনে কবি আমাদের চমকে দেন। কিন্তু গোলাপও তো এই সময়ের কবিদের কাছে ধরা দেয় অন্যভাবে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থের নাম ‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। শংকরানন্দ ইজিচেয়ারের আলস্যে ভ্রমণ বাসরে দুজনের স্মৃতিসংলগ্ন গোলাপটিকে স্মরণ করেন আর শক্তি (চট্টোপাধ্যায় ) ও সুনীল (গঙ্গোপাধ্যায়) গোলাপের মধ্যে নশ্বর প্রেমের ছবিকে তুলে ধরেন— ‘গোলাপ ফুটেছিলো, গোলাপ ঝরে গেছে।/ অমন কতফুল ফোটে ও ঝরে যায়--/ কে তার খোঁজ রাখে?’; ‘বাসের অমন ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা/ আমাকে এক লাইন কবিতা দিয়ে হঠাৎ নম্র-নেত্র পাতে/ বেলগাছিয়ায় নেমে গেল রক্তগোলাপ হাতে’। প্রেমিকা শাপলা ফুলের কাঁকন চেয়েছিল বলে দুরন্ত আষাঢ়ে মেঘ মাথায় নিয়ে, বৃষ্টি মাথায় প্রেমিক দিঘি থেকে সংগ্রহ করে আনে সেই ফুল। কারণ ‘ও সাঁঝে আসবে বিশালাক্ষী বটের তলাতে’। কোনো নামজাদা ফুল নয়। গ্রামের প্রেমিক প্রেমিকার গল্প উঠে আসে সামান্য শাপলা ফুলকে কেন্দ্র করে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে।
প্রেম নশ্বর। তা আবহমান কাল ধরে বয়ে চলেছে, প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাত্রায়। এই কবিতাগুলিতে আমরা প্রেমের সেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দেখি। শঙ্খ ঘোষের কবিতার ছোট্ট অবয়বে উঠে আসে প্রেমের আশ্চর্য প্রতিহিংসা-- ‘যুবতী কিছু জানে না, শুধু/ প্রেমের কথা ব’লে/ দেহ আমার সাজিয়েছিল/ প্রাচীন বল্কলে।/ আমিও পরিবর্তে তার/ রেখেছি কথা সব:/ শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি/ আগুন প্রবণতা।’ আর বিনয় মজুমদারের প্রেমিক পড়ে থাকে ক্ষত নিয়ে--‘প্রাচীন চিত্রের যতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি/ চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।’ সুনীল বসুর প্রেমিক প্রেমিকার জন্য করতে পারে বিভিন্ন কিছু, এমনকি প্রাণও দিতে পারে--‘তোমার হৃদয় জয় করবার পণে/ ভীষণ-ভীষণ কাণ্ড ঘটাতে পারি/ তরোয়াল খেলে মরতেও পারি রণে।’
এই গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৬৯। ষাটের দশকে দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে। সত্তরের উত্তাল দশকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেমের কবিতার সংকলনটি আমাদের আশ্চর্য করে। বাতাসের বারুদের গন্ধ, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার গল্পে বুঁদ বাঙালি যুবসমাজ তখন ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রেমকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ের গল্প আলাদা। কিন্তু ধ্বংসকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতায় প্রেমের বিভিন্ন স্বরূপ, স্বরকে এক মলাটের মধ্যে নিয়ে এসে আসলে সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে প্রেমের জয়গান, জয়যাত্রাই ঘোষিত হয়। ভালোবাসার জগৎটিকে বাঙালি পাঠকদের সামনে এইভাবে তুলে ধরবার জন্য সংকলক দীপ্তি ত্রিপাঠীর অজস্র ধন্যবাদ প্রাপ্য।
লেখক পরিচিতি
সৌগত মুখোপাধ্যায় জন্ম বর্ধমানের (বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান) রূপসা গ্রামে। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে নারায়ণগড় সরকারি মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক (ওয়েস্ট বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিস) হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের রবীন্দ্রনাথ’। কোরক, রবীন্দ্র ভাবনা প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লেখালেখি করেন। পেয়েছেন প্রবোধচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র মেধা পদক, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির গবেষক সম্মাননা (২০১৬)। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা।
(পরবাস-৭৯, ৯ জুলাই, ২০২০)