নবনীতা দেব সেন-এর শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন — ‘এখানে রইল তিরিশ বছরের কবিতার টুকরো। এতদিন ছেদহীনভাবে কবিতা প্রকাশিত হলেও ১৯৭১-এর পর আমার কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি, ...।’ শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম প্রকাশ — জানুয়ারি ১৯৮৯। শ্রেষ্ঠ কবিতার চারটি সংস্করণ হয়েছিল আমরা জানতে পেরেছি। চতুর্থ সংস্করণে তিনি সংক্ষেপে জানান — ‘চতুর্থ সংস্করণে ২০১০ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার কিছু কিছু যুক্ত হলো।’
আমার যেহেতু মনোযোগ নিবদ্ধ দে’জ প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রতি; তাই ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর কবিতা রচনার সূচনা থেকে ২০১০ পর্যন্ত রচিত কবিতাগুলো নিয়েই, বস্তুত, আলোচনার শুরু ও শেষ।
আগে কোনো এক নিবন্ধে আমি জানিয়েছিলুম যে, পদ্য কিংবা গদ্য আলোচনার প্রথাবাধ্য গতানুগতিকতায় আমি বিশ্বাস করি না; তাই এই আলোচনা শুরু হবে — নবনীতা-রচিত ‘নাজমা’ কবিতাটা নিয়ে। এই কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল — ২০০১ সালে, ১৮ জুলাই ‘দেশ’ পত্রিকায়। কিছুটা দীর্ঘ, ছন্দোবদ্ধ এই কবিতাতে কাহিনি-রেখা আছে, যা প্রকৃতপ্রস্তাবে জানায় বজরংবলীদের উন্মাদ হত্যালীলার ভয়াবহতা। আজিজের স্ত্রী - নাজমা, গর্ভবতী, ‘বাচ্চা হবে এই সেপ্টেম্বরে’; আর সে কারণেই ‘তরুণ যুবক স্বামী’, যে কীনা, নারোদা থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরের অফিসে চাকরি করে; স্কুটার কিনেছে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে স্ত্রীর সান্নিধ্যে ফিরে আসার জন্যে; এবং স্ত্রী গর্ভবতী, তাই ‘ছোটাছুটির অনেক আছে কীনা’...। একদিন ঘটল সভ্যতার মুখ ম্লান করে দেওয়া সেই ভয়ংকর ঘটনা। স্কুটারে আজিজ যাচ্ছিল অফিস। — ‘হঠাৎ কারা ধরলো পথের মাঝে/ হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে নিল নীচে/ একটা, দুটো, দশটা মানুষ - কারা?/ ওদের সঙ্গে নেই তো চেনাশোনা/ ওদের সঙ্গে নেই তো রেষারেষি?’ তারপর — “পেট্রোল ট্যাঙ্ক থেকে/ তেল বেরুলো/ যুবক স্বামীর গায়ে/ তেল ছড়ালো, ফুল ছড়ানোর মতো/ কে ছোঁয়ালো দেশলাইটার কাঠি?” তারপর কী হলো? “জ্বললো শরীর জ্বললো যুবক স্বামী/ ছটফটিয়ে ছটফটিয়ে খাক্/ অট্টহাস্যে মাতলো বালক বুড়ো/ জয় শ্রীরামের, জয় বজরংবলী/ জ্যান্ত মানুষ দ্যাখ না কেমন বাজির মতন পোড়ে।” নাজমা-কে — “রক্ত মাংস চামড়ার এক ডেলা—” দেখানো হ’লে নিজের স্বামীকে চিনতে পারে না, চিনতে পারে তার স্কুটারকে। এবার কবি - নবনীতার ভূমিকা: “নাজমা তোমায় ভাঙলে তো চলবে না/ নাজমা, তোমায় বৃক্ষ হতেই হবে/ ভালভাসায় ভর করে তুই দাঁড়া,/ আমরা হব পায়ের তলার মাটি—”
পাঠকের আত্মা-বিলোড়িত এই বিশুদ্ধ কবিতাটি শেষ হয় কবি-প্রদত্ত এই প্রতিশ্রুতিতে — “আমরা ওকে অন্য জগৎ দেব”, — অর্থাৎ নাজমার যে সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হবে তাকে। নাজমার মতো, এরকম অসংখ্য নির্যাতিত, সংখ্যালঘু সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রতি কবির বিশ্বাসের বজ্রঝংকার — “প্রতিজগতে বুক বেঁধে তুই দাঁড়া/ অন্য জগৎ এই মাটিতেই আছে/ আমরা ওকে আস্ত আকাশ দেব/ নাজমা, আকাশ বজ্রেও ভাঙবে না!”
যাঁরা নবনীতাকে উদাসীন কবি এবং অতি-মনোযোগী গদ্য-লেখক হিসেবে ‘ব্র্যানডেড’ করে ফেলেন; তাঁদের উদ্দেশে বিনম্র অনুরোধ তাঁরা কবি-রচিত এই পঙ্ক্তিগুলোকেও পড়েন; যদিও এই ধরনের কবিতা গত শতকের সত্তর দশকের পর থেকেই নবনীতা লিখেছেন — “রক্তপাতে, অশ্রুপাতে, অপ্রণয়ে, নিরাশ্রয়তায়/ এই শিক্ষা শুধু দিলে/ হে চিরনির্ভর —/জন্ম মানে যুদ্ধক্ষেত্রে বাস/ জন্ম মানে আমৃত্যু সংশয়/ হে শূন্যবিহারী কী করে গাইব বলো জয়?” বিশৃঙ্খল এবং সন্ত্রাস-আলোড়িত সমাজে নারীত্বের অপমান কিংবা সামগ্রিকভাবে চেতন-ঋদ্ধ মানবতার প্রাত্যহিক অপমান, নবনীতা প্রকাশ করেন মাত্র পাঁচ লাইনের চিত্রকল্পময় এরকম কবিতায় — “তীব্র অপমান/ বুকের বোতল থেকে হুশ করে/ শূন্যে উঠে যায়/ অন্ধকার থেকে ঝরে পড়ে/ বহুবর্ণ নক্ষত্রযন্ত্রণা’....।
একথা অবশ্য ঠিক, বাড়ির নাম যাঁর ‘ভালোবাসা’; ধারাবাহিক রচনার নাম যিনি দেন — ‘ভালোবাসার বারান্দা’; সেই নবনীতা, যুবতী-কবি শুরু করেছিলেন, কবিতার ভালোবাসার আকাশ-প্রদীপ জ্বালিয়ে; ‘প্রথম প্রত্যয়’ নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থটি শুরুই হয়, ভালোবাসার প্রতিশ্রুতিসহ: ... “তুলসীতলার যে- প্রদীপটি ধরে তুমি/ আমার মুখ দেখেছো/ তাকেও ভাসিয়ে দিয়ে,/ একটি শুভ্র স্তব হ’য়ে জ্বলবো তোমার শিয়রে’। শুধু এই পবিত্র উদ্ভাস নয়; আছে সংরাগময় আর্তিও — “আর তখন আমি তোমার হই, তখন/ তখন আমি তোমার হই/ তুমি/ আমার কোলের শিশু হ’য়ে আমাকে বরণ করো/ আমাকে হরণ করো/ পূরণ করো।’ সামগানসম উচ্চারণ: “নৌকো কাঁপে/ অন্ধকার, গান,/ গঙ্গা ছুঁয়ে সান্ত্বনার ভাষা/ যৌবনের চিরন্তন ধ্যান/ যৌবন-উত্তীর্ণ ভালোবাসা।”
সারা জীবন হাসতে চেয়েছেন নবনীতা, অন্যদের হাসিয়েছেন, ককর্টব্যাধিকে চোখ রাঙিয়ে বলেছেন — “আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি — জানিস, আমি স্যান্ডো করি?” জীবনভোর এই হৃদয়-পুলকের কারণ হল, তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন এক হাসির পাহাড়ের। “কেউ বলুক, না বলুক, তুমি সব জানো।/ তবু কোথাও পাহাড় আছে/ ছোটো কথা, বড়ো কথা, ছোটো দুঃখ, বড়ো-বেদনা/ সব ছাড়িয়ে/ মস্ত এক হাসির পাহাড়।”
তারপর জীবন গড়িয়ে গেছে আরও, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ নবনীতার প্রণয়কে মনে হয়েছে — ‘কালান্তক’। যে “বুকটাকে কাচের চৌবাচ্চা ক’রে;” তিনি সেখানে পুষেছেন — “লাল-নীল ভালোবাসাঞ্জলি;” একদিন — “হঠাৎ মার্জার এসে কাঁচ ভেঙে সব মরে গেলো।” ভালোবাসায় প্লাবিত তাঁর হৃৎপিণ্ড ছিল “শিশুর”; যা তিনি উপড়ে এনেছিলেন — “তোমার/ রত্নকোষের জন্যে।” কিন্তু তাতেও কি ভাঙনকে আটকানো গেছে? — “তবুও আমাকে তুমি ছুটি দিয়ে দিলে।”
নবনীতার সজল অভিমান, বিরহবেদনার যন্ত্রণা কোনোদিনই প্রকাশ পায়না রাগ কিংবা ভর্ৎসনা অথবা আত্মধিক্কারের শানিত শব্দ-বাণে; তখনকার প্রকাশভঙ্গীতেও আমরা চমকিত হই — পারিশীলিত হাস্যরসের উৎসর্জনে। এই প্রসঙ্গে আমার খুব প্রিয় দুটি কবিতা-কণিকা উদ্ধৃত করছি:
মশারিজীবনের যে পর্বে নবনীতা মানসিকভাবে দৃশ্যত বিপর্যস্ত; যখন কঠোর-কঠিন বাস্তবের কশাঘাত ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তাঁর মনের ভারসাম্য; যখন — ‘প্রতিটি আঘাত কাঁপে কন্টকিত, কেতকীর ঝাড়ে’; ‘সমস্ত বেদনা এক পুষ্পময় প্রহারে সংহত।’ তখন যা স্বভাব নবনীতার, তিনি ভেঙে পড়েননি; আবার মেরুদণ্ড-সোজা সদর্থক জীবনকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, স্থিত হয়ে চেয়েছেন মননে; আর সেই আস্তিক পুনরুজ্জীবনের সন্ধিক্ষণে তিনি লিখছেন এরকম কবিতা — ‘বৃথা ভাবনা ছেড়ে দিয়ে আকাশে তাকাও।/ পবিত্র, বিমুক্ত, বৃদ্ধ, অশোক আকাশে। ‘সমুদ্র’ কবিতাটি তাঁর শিল্প-চেতনার, কলা-কৈবল্যের, শিল্পের সঙ্গে সহবাসে পুনরুজ্জীবনের প্রতীকী ইঙ্গিত: ‘পুনশ্চ সমুদ্র সত্য। সিন্ধুর ডাকেই/ বারংবার সাড়া দিয়ে জেগে উঠি। নেই/ কোথাও স্বপ্নের নেশা। সমস্ত বাস্তব/ একটি তরঙ্গতৃপ্ত সমুদ্রের স্তব।’
তুমি এখন আমস্টারডামে, নাকি মেক্সিকোয়? তুমি
এখন ভূমধ্যসাগরের আকাশে, নাকি অতলান্তিকের
ঢেউয়ে নাচছে তোমার হালকা ডানার ছায়া – নাকি।
তুমি আস্তে শুয়ে আছো ম্যানহ্যাটানের কোনো
পঁচিশতলার পালঙ্কে? মোটামুটি তুমি এখন
কলকাতাতে নেই। কিংবা শান্তিনিকেতনেও না।
মোটকথা, মশারির মধ্যে আমি আর
এক-মশারি রক্তখেকো মশার পিন্ পিন্ পন্ পন্।
বেস্পতিবারভেবেছিলুম বেস্পতিবার যাবো। তার পরেই কাজ প’ড়ে
গেলো। বুধবার তোমার অফিস। সোমবার ছেলেটার ইশকুলে
পুরস্কার-সভা, আর মঙ্গলবারে বুঝি ভাইঝির আশীর্বাদ ছিলো।
শুক্র শনি মাসশাশুড়ি এলেন। আর রোববারেই তুমি
চ’লে গেলে।
অতিথি-লেকচারার হয়ে, পড়াশোনার নানা অনুষঙ্গে নবনীতাকে বিদেশ যেতে হয়েছে বারবার। এবং তাঁর অনেক কবিতাই রচিত হয়েছে বিদেশের নানা স্থানে, প্রধানত আমেরিকার নানা অঞ্চলে। এ-ধরনেরই একটা কবিতা — ‘ময়লা ফেলার টিনে কুকুরছানা’। এটি রচিত ১১মার্চ ১৯৬৫ বার্কলি, ক্যালিফোর্নিয়া-য়। এই কবিতাটিকে আমার মনে হয়েছে শিল্প-সিদ্ধ এক প্রতীকী কবিতা। ময়লা ফেলার টিনে — নিরীহ, নরম তুলতুলে কুকুরের অবস্থা সঙ্গীন; যেন নরকের অন্ধকারে পতিত সে; নোংরা আর আবর্জনার সীমিত গহ্বরে তার অবস্থা এরকম — ‘চিরকাল গোনা যাবে পাঁজরাগুলো তোর/ চিরকাল থিকথিকে পোকা ঘুরবে গা-য়/ কোন্দিন ছাইয়ের গাদায় তুই পিষে ম’রে যাবি।’ নিজের কবিতায় সেই মৃত্যু-পথযাত্রী কুকুরকেই তিনি বলেন ঘুরে দাঁড়াতে; আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলতে। — “কেঁদে কোনো লাভ নেই। ওরা সব জানে। তোকে শক্ত হ’তে হবে।/ ঠেলে ফেলে দিতে হবে দুশমন লোহার আকাশ...”; আমার মনে হয়েছে তিনি নিজেকেই যেন বলছেন এই অভয়বাণী। আর সে কারণেই আপাতদৃষ্টিতে কবিতাটিকে সাধারণ মনে হলেও; তা একান্তভাবেই আত্মজৈবনিক; টের পাই এখানে-- ‘জিজিবেষু প্রজাপতির বিভ্রমণ’, (বিষ্ণু দে)।
‘রক্তে আমি রাজপুত্র’ সংকলন-গ্রন্থের ‘এবারে আরম্ভ খেলা’ কবিতাটিকেই মনে পড়বে আমাদের। যার শুরুতে ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তিগুলোর উদ্ধৃতি: “For, from this instant/ there’s nothing serious in mortality;/ All is but toys.” এই কবিতারই শেষ পঙ্ক্তি — “অতঃপর সব ঘর পর্যবসিত খেলাঘরে।”
‘এইকাল : চিরকাল’ কবিতায় নবনীতার অদম্য প্রাণশক্তির প্রকাশ। সারাজীবন তিনি কাটিয়েছেন দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাসের জোরে। কোনো বিপন্নতাকে পাত্তা দেননি কোনোদিন; — না গার্হস্থ বিপন্নতা, না সামাজিক বিপন্নতা, না সময়ের বিপন্নতা। তাঁর এই আন্তরিক ও আত্মস্থিত উচ্চারণ: “আমাকে নেবাতে পারে এতো শক্তি রাখে না সময়।/ কখনো ভেবোনা আমি সময়ের মুখ চেয়ে থাকি।” ... ‘আমাকে রাঙাবে চোখ, এতো শক্তি রাখে না সময়।’
জীবনের সব আঘাত, সব অপমান, সময়ের রক্তচক্ষুকে ফিরতি রক্তচক্ষু দেখিয়ে সহর্ষে বেঁচে ছিলেন নবনীতা, নিজের শারীরিক বিপন্নতাকেও হেলায় তুড়ি মেরে। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল একটাই কারণে, — আজীবন তিনি হৃদয়ের রত্নগুহায় জমিয়ে রেখেছিলেন ভালোবাসার অশেষ সুধারস। এরকম উচ্চারণ তাঁকেই মানায়:
আমার নিজস্ব বলতে শুধু এই
শুধু ভালোবাসা
আমার সর্বস্ব বলতে শুধু এই
শুধু ভালোবাসা
সপ্তসিন্ধু মন্থনের সুধা
নিঃশর্ত, নিঃস্বত্ব হয়ে তোমাদের উৎসর্গিত করি
(পরবাস-৭৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০)