ISSN 1563-8685




পালামৌ ও প্রতিভার ‘গৃহিণীপনা’

তাঁর বিস্তৃত জীবনে কত কাজই যে করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ! এই কাজগুলির মধ্যে একটি হল পত্রিকা সম্পাদনা ও সাহিত্য সমালোচনা।

সাহিত্য সমালোচনা শুরু করেন তিনি ভারতী পত্রিকাতে।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্য আলোচনা সম্ভবতঃ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই সমালোচনার সুর ও ভাষা যথেচ্ছ পরিমাণে অরাবীন্দ্রিক।

“কবি বলেন: I despise Ram and his rabble। সেটা বড় যশের কথা নহে — তাহা হইতে এই প্রমাণ হয় যে, তিনি মহাকাব্য-রচনার যোগ্য কবি নহেন। মহত্ত্ব দেখিয়া তাঁহার কল্পনা উত্তেজিত হয় না।”
কি সাংঘাতিক রূঢ় বাক্য না? আবার অন্যত্র —
“বাংলার একটি ক্ষুদ্র কাব্যের সহিত বাল্মীকির বিশাল কাব্যের তুলনা করিতে যাওয়াও যা, আর মহাদেবের সহিত একটা দ্বারবানের তুলনা করাও তা, কিন্তু কী করা যায়, কোনো কোনো পাঠকের চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া না দেখাইলে তাঁহারা বুঝিবেন না।
ভূতলে অতুল সভা–ফটিকে গঠিত;
তাহে শোভে রত্নরাজি, মানসসরসে
সরস কমলকুল বিকশিত যথা।
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত স্তম্ভ সারি সারি
ধরে উচ্চ স্বর্ণ ছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,
বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে
ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,
পদ্মরাগ, মরকত, হীরা, যথা ঝোলে
খচিত মুকুলে ফুলে পল্লবের মালা
ব্রতালয়ে।
ইত্যাদি

ইহা কি রাবণের সভা? ইহা তো নাট্যশালার বর্ণনা!” রচনাকাল — পৌষ ১২৮৪। কবির বয়স — ১৭।

বর্ণনার মধ্যে আতিশয্য থাকলেও তাকে ‘নাট্যশালা’ বলে তার অমর্যাদা করা হয় নাকি? সুখের কথা জীবনের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ ভুল বুঝতে পেরে নিজেকেই শুধরেছিলেন। পরবর্তীকালে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখছেন,

“মেঘনাদবধ কাব্যে কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙিয়াছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙিয়াছেন”
           রচনাকাল – আষাঢ় ১৩১৪। কবির বয়স - ৪৭।

দুটি লেখার মধ্যে তফাৎ এতটাই যে তা চিহ্নিত করে কবির পরিণত হয়ে ওঠাকে। দুটি লেখার সময় কবির বয়সের তফাৎ ও লক্ষণীয়।

তাঁর অনুরূপ একখানি বিখ্যাত সমালোচনার বিষয় ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ভ্রমণকাহিনী — ‘পালামৌ’। ভ্রমণকাহিনীটি প্রকাশিত হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় — ১৮৮০ – ১৮৮১ সালে।

তখন সঞ্জীবচন্দ্র নিজেই বঙ্গদর্শনের সম্পাদক, তাই লেখকের আসল নাম ছিল না; “প্র. না. ব.” (প্রমথনাথ বসু) এই ছদ্ম নাম ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলা ১৩০১ সন রবীন্দ্রনাথ সঞ্জীবচন্দ্রের “পালামৌ” সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেন। এই আলোচনা সকলের পাঠ্য।

এখানে বেশ কিছু প্রশংসা সত্ত্বেও লেখকের সম্পর্কে তাঁর আক্ষেপেরও অভাব ছিল না। তাঁর মতে সঞ্জীবচন্দ্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু সেই প্রতিভাকে পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে উঠতে পারেননি। সম্ভবতঃ তিনি বলতে চেয়েছেন সঞ্জীবচন্দ্র নিজস্ব প্রতিভা সম্পর্কে সচেতন হলে বা আরো অধ্যবসায়ী ও যত্নশীল হলে তাঁর লিখিত ‘পালামৌ’ অনেক বেশি সাহিত্য গুণান্বিত হত।

তাই তিনি মন্তব্য করেছেন —

“তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ------তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিণী নহে।”

এই মন্তব্যের সঙ্গেও আমরা একমত হতে পারি না। ‘পালামৌ’ গ্রন্থটি একেবারেই অন্যধরনের। বস্তুতঃ এটিকে একেবারে পথিকৃৎ সাহিত্যও বলা চলে।

এই মত ব্যক্ত করেছেন সাহিত্যিক শেখর বসু। ২০১৫ সালে লিখতে বসে তিনি আবিষ্কার করেছেন —

“একটুও ধুলো পড়েনি ‘পালামৌ’র গায়ে”! লিখছেন —

“সামান্য কিছু তথ্য, অতীতচারণা এবং বৈঠকী গল্পের পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসেছে অনবদ্য একটি ভ্রমণকাহিনি। এমনটি বাংলাসাহিত্যে আগে দেখা যায়নি, পরেও নয়। ওই যে বলা হয়না — কদাচিৎ একটিমাত্র রচনা নিয়েই একটি শ্রেণি নির্দেশিত হয় — এই রচনাটি বোধহয় তেমনই। সাহিত্যগুণে ভরপুর ‘পালামৌ’।”
অর্থাৎ এটি যাকে সাধারণ ভাষায় যাকে বলে — “Class of its own”!

অনুরূপ ধারণা পোষণ করেছেন সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। তিনি আরো উচ্চকণ্ঠ — ‘পঞ্চাশোর্ধে’ নামক স্মৃতিচারণে তিনি লিখছেন —

“সত্যিকথা বলতে কি রবীন্দ্রনাথকৃত ‘পালামৌ’ সমালোচনা আমিও পড়েছি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ সমালোচনা করতে বসে লিখলেন, ‘‘পালামৌ’- ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি যে ছাঁদে লিখিয়াছেন, তাহাতে প্রসঙ্গক্রমে আশপাশের নানা কথা আসিতে পারে — কিন্তু তবু তাহার মধ্যেও নির্বাচন এবং পরিমাণ সামঞ্জস্যের আবশ্যকতা আছে। যে-সকল কথা আসিবে তাহারা আপনি আসিয়া পড়িবে, অথচ কথার স্রোতকে বাধা দিবে না। ঝর্ণা যখন চলে তখন যে পাথরগুলোকে স্রোতের মুখে ঠেলিয়া লইতে পারে তাহাকেই বহন করিয়া লয়, যাহাকে অবাধে লঙ্ঘন করিতে পারে তাহাকে নিমগ্ন করিয়া চলে, আর যে পাথরটা বহন বা লঙ্ঘন–যোগ্য নহে’ তাহাকে অনায়াসে পাশ কাটাইয়া যায়। সঞ্জীববাবুর এই ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে এমন অনেক বক্তৃতা আসিয়া পড়িয়াছে যাহা পাশ কাটাইবার যোগ্য, যাহাতে রসের ব্যাঘাত করিয়াছে এবং লেখকও অবশেষে বলিয়াছেন, ‘এখন এ-সকল কচকচি যাক।’ কিন্তু এই-সকল কচকচি গুলিকে সযত্নে বর্জন করিবার উপযোগী সতর্ক উদ্যম তাঁহার স্বভাবতই ছিল না। যে কথা যেখানে আসিয়া পড়িয়াছে অনাবশ্যক হইলেও সে কথা সেইখানেই রহিয়া গিয়াছে।’ আমার ধারণা এই যে তথাকথিত ‘রসের ব্যাঘাত’, এটা রবীন্দ্রনাথের কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়েছে এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ ‘পালামৌ’কে একটি নিছক ভ্রমণকাহিনী বলে ধরে নিয়েছিলেন। পালামৌ অঞ্চলের প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, আরণ্যক বা সামাজিক পরিমণ্ডলের বাইরে যাওয়াই সে ভ্রমণকাহিনীর পক্ষে যেন অনাবশ্যক বাগাড়ম্বর। গ্রন্থটির নাম যদি সঞ্জীবচন্দ্র ‘রসালাপ’ বা ‘স্মৃতিচারণ’ জাতীয় কিছু রাখতেন, তাহলে বোধকরি এ অভিযোগ টিকত না! বস্তুতঃ পঞ্চাশোর্ধে সঞ্জীবচন্দ্র পালামৌ ভ্রমণকে অবলম্বন করে বৈঠকী মেজাজে অম্বুরী তামাকের ধোঁয়ায় মিশিয়ে কিছু রসালাপ করতে বসেছিলেন।”
আমরা সম্পূর্ণ একমত। সম্ভবত সাহিত্যের এই রীতিটি (বৈঠকী মেজাজে সাহিত্য রচনা) তখনো বাংলা সাহিত্যে বিশেষ প্রচলিত ছিল না। হয়তো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যবিচারে সেই কারণেই কিছু বিভ্রান্তি থেকে থাকবে।

রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনা সম্পর্কে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন আহমাদ মাযহার। চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা সিরিজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘পালামৌ’ গ্রন্থের ভূমিকায় এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন,

“যে সময়ে সঞ্জীবচন্দ্র এই রচনাটি লিখছিলেন, তখন আজকের মতো ভাষা চেতনা গড়ে ওঠেনি বাঙালি সমাজে। ভাষাচেতনার একটি ছোট দৃষ্টান্ত তাঁর রচনা থেকে উদ্ধৃত করি। তিনি বলেছেন — ‘সাধুভাষা অতি অসম্পন্ন, এই ভাষায় গালি চলেনা, ঝগড়া চলেনা, মনের অনেক কথা বলা চলে না।’ আমরা সাম্প্রতিককালে ভাষা নিয়ে যে ধরনের চিন্তা করছি তার সঙ্গে তাঁর এত আগের চিন্তার কি চমৎকার নৈকট্যই না রয়েছে।”
আর এক জায়গাতে লিখেছেন।
“রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের প্রসঙ্গান্তরে যাওয়াকে এই রচনার সৌষ্ঠবহানি বলে মনে করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যকে নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না। কারণ ‘রচনাসাহিত্য’ এমন এক মুক্ত সংরূপ যা একের মধ্যে অনেককে ধারণ করে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। লেখক যদি প্রসঙ্গান্তরে নাই যেতেন, তাহলে বাঙালি স্বভাব সম্পর্কে এই অসাধারণ পর্যবেক্ষণ কিভাবে করতেন?”
আমরা উপরোক্ত দুটি মন্তব্যের সাথেই একমত। আসলে ‘পালামৌ’ লেখার যে শৈলী তার সঙ্গে চলিত ভাষার একটি চমকপ্রদ যোগাযোগ রয়েছে। একদম শেষ ও ষষ্ঠ প্রবন্ধে সম্ভবতঃ সঞ্জীবের মনে সেই আক্ষেপই রয়ে গেছে।

পরবর্তীকালে প্রায় একইরকম ভাবে ‘দেশে বিদেশে’ লিখেছেন রবীন্দ্রশিষ্য সৈয়দ মুজতবা আলি। পালামৌ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানা গেলে বড় ভাল হত। তিনিও তো ভ্রমণ কাহিনীতে ‘আশকথা, পাশকথা’ লিখেছেন।

“সৈয়দ মুজতবা আলীর কলমে আমরা প্রথম পেলাম — বৈঠকি মেজাজে বিদেশের কথা। আফগানিস্তান থেকে, মিশর হয়ে ইউরোপ বা বলা ভালো জার্মানি। সামবাজারি বৈঠকি ভাষায় — তেরোসপরসোযোগ (ত্র্যহস্পর্শ)। লিখতে গিয়ে তিনি আশকথা, পাশকথা লিখেছেন।

“গুণীরা বলেন — এটা দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে যদি পথিক পথের ভুলে আশপথ বা পাশপথে না যায় তবে, অচেনা ফুলের নয়া নয়া পাখীর সঙ্গে পরিচয় হবে কিভাবে?”

“যে পথিক পথের ভুলে,
এলো আমার প্রাণের কূলে”
শুধু লিখলেন না, অনুপ্রেরণা রূপে নিয়ে এলেন খোদ রবিঠাকুরকেই। কি মুশকিল! ভাগ্যে তাঁর গুরু তখন পরপারে।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই ব্যাপারে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা যেতে পারে। যখন তিনি ‘পালামৌ’ সমালোচনা করছেন, তখন কোল নারীদের নৃত্যের বিবরণ পরে তিনি লিখছেন —

“এই বর্ণনাটি সুন্দর, ইহা ছাড়া আর কী বলিবার আছে? এবং ইহা অপেক্ষা প্রশংসার বিষয়ই বা কী হইতে পারে?”
কিন্তু পরবর্তী কালে আবার যখন তিনি ‘গদ্যছন্দ’ প্রবন্ধ লিখছেন, তখন গদ্যছন্দের উদাহরণ রূপে বলতে দ্বিধা করছেন না —
“সঞ্জীবচন্দ্র তাঁর ‘পালামৌ’ গ্রন্থে কোল নারীদের নাচের বর্ণনা করেছেন। নৃতত্ত্বে যেমন করে বিবরণ লেখা হয় এ তা নয়, লেখক ইচ্ছা করেছেন নাচের রূপটা রসটা পাঠকদের সামনে ধরতে। তাই এ লেখায় ছন্দের ভঙ্গি এসে পৌঁচেছে অথচ কোনো বিশেষ ছন্দের কাঠামো নেই। এর গদ্য সমমাত্রায় বিভক্ত নয়, কিন্তু শিল্পপ্রচেষ্টা আছে এর গতির মধ্যে।”১০
গদ্য সম্পর্কে এটি বিরাট প্রশংসাবাক্য নয়? বিশেষতঃ– “এর গদ্য সমমাত্রায় বিভক্ত নয়, কিন্তু শিল্পপ্রচেষ্টা আছে এর গতির মধ্যে।” এই বাক্যটিতে তিনি অভিনবত্বই দেখছেন নিশ্চয়ই? অর্থাৎ তিনি যেন ‘পালামৌ’ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত। তাঁর প্রশংসা করতে খুব ইচ্ছে করছে, আবার মনে হচ্ছে কিছু সমালোচনাও করা দরকার। এই রম্য গদ্যের যেন তিনি ‘আভাস পাইতেছেন, কিন্তু নাগাল পাইতেছেন না’

তুলনাতে পরবর্তী লেখকেরা ভালমতই নাগাল পেলেন। কারণ তাঁদের ইতিমধ্যেই ‘বৈঠকী মেজাজে অম্বুরী তামাকের ধোঁয়ায় মিশিয়ে কিছু রসালাপ’ জাতীয় লেখা পড়ে ফেলার সুযোগ হয়েছে। এই ধরনের গ্রন্থ লেখকদের মধ্যে আছেন অন্নদাশঙ্কর (পথে প্রবাসে), মুজতবা (দেশে বিদেশে, মুসাফির)।

এমনকি উপরে ভাষাচেতনা সম্বন্ধে যে আলোচনা হয়েছে তাও খুব প্রাসঙ্গিক। পরবর্তী কালে যাঁরা এই ধরনের ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন, অন্নদাশংকর বা মুজতবা, লিখেছেন চলিত ভাষাতেই। ফলে বৈঠকি মেজাজ পুরোমাত্রায় ধরা পড়েছে। মুজতবার ‘দেশে-বিদেশে’ তে কাবুল ভ্রমণকালীন মাঝে মাঝেই বাঙালী চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা চলে এসেছে।

বস্তুতঃ এই ছোট্ট পরিসরে সঞ্জীবচন্দ্র যে সমস্ত বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা সত্যিই তারিফযোগ্য। এই গ্রন্থটিতে যেসব মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে আমরা তারই কিছু আলোচনা করবো।

ভ্রমণে গিয়ে তিনি বাঙালীদেরই আবিষ্কার করেছেন — লিখেছেন সেই প্রবাদপ্রতিম পংক্তিটি —

‘কেননা বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা, যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক।”
প্রায় এরকম হাল্কা চালেই শুরু হয়ে গেল এই সুমধুর ভ্রমণবৃত্তান্তটি। বর্ণনা এত সজীব যে মনে হয় আমরা নিজেরা তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ করছি। যেমন ধরা যেতে পারে — প্রথম পাহাড়ের কাছে যেতে গিয়ে তাঁর দূরত্বের ভ্রমসংশোধন। গাড়িতে করে যেতে যেতে কাছেই দেখলেন ছোট্ট পাহাড়, খুব ইচ্ছে হল একটু পাহাড়ে চড়ে আনন্দ লাভ করবেন। গাড়োয়ান পই পই করে বারণ করলো, জানালো — দেখতে যত কাছে আদৌ তত কাছে নয়। কিন্তু লেখক দমবার পাত্র নন, সরেজমিনে তদন্ত করে দেখলেন — কথাটা ঠিকই, ১৫ মিনিট হাঁটার পরও সেই পাঁচ মিনিটের দূরত্ব আর কমছে না। ব্যস, ফিরে এসে সিদ্ধান্ত, — “পর্ব্বত সম্বন্ধে দূরতা স্থির করা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় কঠিন”!

বেশ রঙিন বর্ণনা আর সুমধুর স্বীকারোক্তি। আমরা সানন্দে একমত হই।

প্রবাসে গিয়ে তিনি স্বজাতিকে পুনরায় আবিষ্কার করলেন। তার প্রচুর বিবরণ ছড়িয়ে আছে কাহিনীতে। বড় রম্য সেই বৃত্তান্তগুলি। শেখর বসুর লেখাটিতে আছে সেই ঈর্ষাপ্রবণ বাঙালীর কথা, আছে বার্ধক্যজনিত সৌন্দর্যের কথা। অন্য একটা বলে ফেলা যাক।

ভ্রমণকাহিনীতে একটি বিশেষ স্থান জুড়ে আছে ‘লাতেহার’ পাহাড়। তিনি এই পাহাড়টিকে খুব ভালবাসতেন। প্রায়শই বিকেলে গিয়ে এই নির্জন পাহাড়ে বসে তিনি মন খুলে চিন্তা করতে ভালোবাসতেন। একদিন তিনি দুপুরের দিকে পাহাড়ে যাচ্ছেন, অন্যদিনের মতই। হঠাৎ দেখেন একটি যুবক বীরদর্পে হনহন করে হাঁটছে, সঙ্গে কজন স্ত্রীলোক তাকে নিরস্ত করার জন্য সাধছে। সঞ্জীব সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন, নিশ্চয়ই ভাত ছেড়ে উঠে এসেছে, তাই সাধছে। বাঙালিদের তো তাই হয়, তাঁর নিজেরই কতবার হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কথাবার্তাতে জানতে পারলেন যুবকের খুব রাগ হয়েছে বাঘের ওপর, বাঘ নাকি তার ছাগল খেয়েছে। সে ব্রাহ্মণ সন্তান, বাঘ না মেরে ভাত খাবে না। সঞ্জীবও তাকে ছাড়তে পারলেন না, চললেন সঙ্গে সঙ্গে। ছেলেটি আবার তাঁকে জানিয়ে দিল বাঘ কিন্তু সে নিজের হাতেই মারবে। সঞ্জীবের তো নিজের হাতে বাঘ মারার কোন সাধ ছিলনা, তবে তাঁর সাহেবী পোষাক দেখে যে ছেলেটি তাকে বাঘ মারার উপযুক্ত মনে করেছিল তাতেই তিনি কৃতার্থ। ভারী মনোগ্রাহী বাঘ পর্বটি। এমনকি এই পর্বের লেখার আলোচনা দিয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর পালামৌ বৃত্তান্ত শেষ করেছেন,

“অবশেষে গ্রন্থ হইতে একটি সরল বর্ণনার উদাহরণ দিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করি। গ্রন্থকার একটি নিদ্রিত বাঘের বর্ণনা করিতেছেন—

‘প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে ব্যাঘ্র নিরীহ ভালোমানুষের ন্যায় চোখ বুজিয়া আছে; মুখের নিকট সুন্দর নখরসংযুক্ত একটি থাবা দর্পণের ন্যায় ধরিয়া নিদ্রা যাইতেছে। বোধ হয় নিদ্রার পূর্বে থাবাটি একবার চাটিয়াছিল।’

আহারপরিতৃপ্ত সুপ্তশান্ত ব্যাঘ্রটি ঐ-যে মুখের সামনে একটি থাবা উলটাইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, এই এক কথায় ঘুমন্ত বাঘের ছবিটি যেমন সুস্পষ্ট সত্য হইয়া উঠিয়াছে এমন আর-কিছুতে হইতে পারিত না। সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কৌতুহলের সহিত দেখিতেন এবং প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া তাঁহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাঁহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন”

এখানে শুধু অকুণ্ঠ প্রশংসাই করলেন না তিনি, বস্তুতঃ সকল ভ্রমণকাহিনি লেখকের (এবং পাঠকের) জন্য এক অসামান্য দিকনির্দেশ রেখে গেলেন। সার্থক ভ্রমণকাহিনি লিখতে গেলে তিনটি মূল বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে —

• বালকের ন্যায় সকল জিনিসে সজীব কৌতুহল
• প্রবীণ চিত্রকরের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন
• নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ

আমি নিজেই মাঝে মাঝে ভ্রমণকাহিনি লিখে থাকি। পড়ি তো প্রচুর। এই বাক্যটির মর্মার্থ খুবই উপলব্ধি করতে পারছি।

‘পালামৌ’ রচনার একটি আপাত অনালোচিত দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেটি নৃতত্ত্ব সংক্রান্ত একটি সুগভীর আলোচনার সূত্রপাত। পালামৌতে বেড়াতে গিয়ে সঞ্জীবচন্দ্র সেখানে ‘কোল’ উপজাতির সংস্পর্শে এসেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে উপনিবেশ ও সেখানকার আদিবাসীদের অবস্থান নিয়ে চিন্তান্বিত করেছে। তিনি সেই আলোচনায় ভাবতে বসেছেন নিউজিল্যান্ডের মৌরি (Maori — উচ্চারণ মাওরি) উপজাতির কথা। তারা লোপ পেতে বসলো কেন? সাহেবদের সংস্পর্শে? এরা বুদ্ধিমান, কর্মঠ ছিল, ১৮৪৮ সালে এদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ, ১৮৬৮ সালে কমে এসে মাত্র ৩৮০০০। তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায় ঠিক কথাই লিখেছেন সঞ্জীব। অবশ্য ১৯০১ সাল থেকে তাঁর মৌরি জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।১১ সঞ্জীব তখন পরপারে, তিনি জানতে পারেননি।

তবে ভাবলে আনন্দিত হতে হয়, তাঁর এতখানি অনুসন্ধিৎসা ছিল! তখন যদি কোন নৃতত্ত্বপ্রেমী বাঙালি ‘পালামৌ’ পড়ে এই বিষয়ে গবেষণায় ব্রতী হতেন, ১৮৮১ – ৮২ সালে, একটা দারুণ কিছু হতে পারতো। কিছু কিছু দিক উল্লেখও করেছেন। যেমন কানাডাতে আদিবাসীদের কিরকম যত্ন করা হয় তাই নিয়ে। তবে আলোচনা তিনি বেশি এগিয়ে নিয়ে যাননি, কারণ এই ভ্রমণবৃত্তান্তের মাধুর্য নষ্ট হত। তাঁর এই পরিমিতিবোধ সত্যিই তারিফযোগ্য।

আবার একটু পরেই আলোচনা করেছেন, মৌয়া (আসলে মহুয়া) থেকে প্রস্তুত দেশি মদের মাহাত্ম্য নিয়ে।

দেশী মদ নাকি হাত আর পা দুটিকেই কাবু করে। বিদেশি মদ নাকি পা কে পুরোমাত্রায় কাবু করলেও হাতকে পারে না। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ মেমসাহেবদের জিজ্ঞাসা করলেই পাওয়া যাবে। এমনকি আমাদের দেশের আধুনিক বাঙালি বিবিরাও এর স্বপক্ষে কিছু সাক্ষ্য দান করতে পারেন! আজকাল যা Domestic Violence নামে কুখ্যাত, সেকালে বিলিতি মদের প্রকোপে তা যে খুবই প্রচলিত ছিল তার সরস এবং সুলিখিত বিবরণ! প্রবাসে গিয়েও সবসময় মনে পড়ছে স্বজাতির কথা।

তবে এবারে আমরা মনোনিবেশ করবো এক সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে। আমরা যতই রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, একটি অনুচ্ছেদকে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। সেটি ঐ গৃহিণীপনা সংক্রান্ত।

“ভালো গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে-স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায় অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে।”
আমাদের এখনকার আলোচনা এই নিয়েই। ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’। আজকের জগতে কিন্তু এই ‘গৃহিণীপনা’ শব্দটির যাথার্থ্য বেশিমাত্রায় অনুভূত হচ্ছে। এখন এর পরিভাষা হিসাবে বলা যেতে পারে — ‘Management’। ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’ — ‘Management of talent’ — প্রত্যেক সংস্থার অবশ্যকর্ম।

যদি বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ক্ষেত্রের কথা বলি, এই গৃহিণীপনা ছাড়া প্রতিভার বিকাশ অসম্ভব। তাই পৃথিবীর যে কোন বিজ্ঞানকেন্দ্র বা বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে এই দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিবিদ, অথচ তাঁদের জীবনে বা কর্মপদ্ধতিতে সংহতির অভাব — এরকম অনেক উদাহরণই দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সংস্থা তা পূরণ করার চেষ্টা করে।

কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে? ‘শৃঙ্খলা’ কি ‘শৃঙ্খল’ হতে পারে? আমরা তো বহু শিল্পীর কথা জানি যাঁরা জীবনে ও কাজে ছিলেন চরম অগোছালো, কিন্তু তাঁরা প্রতিভার দিক থেকে চরম সাফল্যের নিদর্শন রেখেছেন। পল গঁগা বা তাঁর বন্ধু ভ্যান গগ — এঁদের কথা ধরা যেতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক নতুন শিল্পীকেই তো নিয়ম ভাঙতে হবে, সেক্ষেত্রে এই গৃহিণীপনা কি বিরুদ্ধতা করবে না? এই নিয়ে খুবই চর্চা চলছে।

বর্তমানের একটি অত্যন্ত শিল্প সংক্রান্ত জনপ্রিয় বই হল - The War of Art লেখক - Steven Pressfield. বইয়ের বিষয়বস্তু হল নিজের সৃজনশীলতাকে আবিষ্কার – তার জন্য নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করা। এই বইটিতে লেখকের বক্তব্য — যে কোন শিল্পী যখন তাঁর শিল্পসৃষ্টির কাজে ব্যাপৃত হন, তিনি পদে পদে বাধার (Resistance) সম্মুখীন হন। এই বাধা কিন্তু বাহ্যিক নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আভ্যন্তরীণ। ক্রমাগত এই বাধার সঙ্গে যুদ্ধ করে উত্তীর্ণ হলেই শিল্পসৃষ্টি সম্ভব। এবং এই যুদ্ধে শিল্পীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার কি? রবিঠাকুরের ‘গৃহিণীপনা’। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য।

ঠিকই যে অত সহজে প্রতিভার জন্ম হয় না। তার জন্য অলৌকিক বা ঐশ্বরীয় স্পর্শের প্রয়োজন। কিন্তু সেই ‘কী অচেনা কুসুমের গন্ধে, কী গোপন আপন আনন্দে’ পরশ আসার পরে কী করণীয়? প্রয়োজন ‘যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান’ তবেই‘প্রচুর ফল’ পাওয়ার সম্ভাবনা।

Steven Pressfield এই মতের স্বপক্ষে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এদের মধ্যে একটি হল প্রখ্যাত নোবেলজয়ী লেখক সমারসেট মমের উদ্ধৃতি দিয়েছেন —

“I write only when inspiration strikes. Fortunately it strikes every morning at nine o'clock sharp.”

ভাবা যায়? প্রত্যেকদিন সকাল নটায় লিখতে বসা? চূড়ান্ত ‘গৃহিণীপনা’?

আমাদের দেশের প্রতিভাদের খোঁজ খবর নিলে ব্যাপারটা একটু বেশি পরিষ্কার হবে কারণ তাঁদের সম্পর্কে আমরা অবহিত।

প্রথমজন নিঃসন্দেহে রবিঠাকুর। ‘আপনি আচরি ধর্মে’র চূড়ান্ত উদাহরণ। তাঁর এত বিস্তারিত কাজ সম্ভবই হত না যদি না তাঁর স্বভাবে এই গৃহিণীপনা থাকতো। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রায় সৃষ্টিশীল ছিলেন, তাঁর বেশ কিছু উঁচুমানের আধুনিক কবিতা রচিত হয় একেবারে জীবনের শেষপ্রান্তে। ছবি আঁকা শুরু করলেন অনেক বেশী বয়সে এবং সেই ছবিগুলি উচ্চমাপের কারুকলার দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

তুলনাতে যদি মাইকেল মধুসূদনকে দেখি, আমাদের মনে হতে পারে তাঁর জীবনে যে ছন্দের অভাব ছিল তা তাঁর সৃষ্টিকর্মকেও প্রভাবিত করেছে। এ নিয়ে বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা থেকে আমরা বিরত থাকলাম কারণ তা আরো অনেক বিস্তারিত গবেষণা ও পরিসরের দাবিদার।


কর্মরত দুই যুগপুরুষ – প্রতিভার ‘গৃহিণীপনা’কে যাঁরা উচ্চমার্গে স্থাপন করেছেন

রবিঠাকুরের পরেই শিল্পক্ষেত্রে দুর্দান্ত ‘গৃহিণীপনা’র উদাহরণ হিসেবে যাঁর নাম মনে আসে তিনি নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ জীবন শুরু করেছেন অঙ্কন ও প্রচ্ছদ শিল্পী রূপে। ধীরে ধীরে তিনি হলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালক। একই সঙ্গে পুনর্বার শুরু করলেন পারিবারিক ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজ। ধীরে ধীরে তাঁর রচিত কিশোর সাহিত্যের জনপ্রিয়তা খুবই বেড়ে গেল। এমনকি তাঁর জীবন নির্বাহ হত বইবাবদ প্রাপ্ত টাকার থেকে। আজও সেই কিশোর সাহিত্যের আকর্ষণ ও চাহিদা গগনচুম্বী। এটা সম্ভব হয়েছে কিন্তু তাঁর অসামান্য ‘গৃহিণীপনা’র জন্যই।

তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের আলাপচারিতায় জানা যায় এই কথা। শুধু নিজের প্রতিভা নয়, অন্য সহশিল্পীদের প্রতিভার বিকাশেও তাঁর ‘গৃহিণীপনা’র চূড়ান্ত অবদান থেকেছে।

তুলনায় তাঁর সমসাময়িক ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে সেই কথা ভীষণভাবে প্রযোজ্য যা সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পর্কে বলা হয়েছে —

‘তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিণী নহে।’
সাহিত্যের বদলে চলচ্চিত্র আর সঞ্জীবের বদলে ঋত্বিক লিখলে বাক্যটি খুবই মানানসই হবে।

ঋত্বিকও যুক্ত ছিলেন বাংলার নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে। প্রায় একই সময়ে চিত্রজগতে পা রেখেছেন। তিনিও বিফলতার স্বাদ পেয়েছেন। আবার সাফল্যও পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর বহু ভাল কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, অনেকটা তাঁরই দোষে। এ শুধু তাঁর দুর্ভাগ্য নয়, এ দুর্ভাগ্য তাঁর অসংখ্য অনুরাগীর। তাঁর ঐশ্বর্যময় প্রতিভার অনেক কিছুই‘ফেলাছড়া’ গেল। তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত সত্যজিৎ বিজয়া রায়কে বলেছিলেন, ‘গুণী লোকের এত অভাব আমাদের দেশে, আর একটা এরকম ট্যালেন্টেড লোক চলে গেল, খানিকটা নিজের দোষে, এটা ভারী আক্ষেপের বিষয়।’

একই সঙ্গে বিজয়া রায় আমাদের জানাচ্ছেন নিজের প্রতিভা যাতে ফলদায়ক হয় তার জন্য কতটা সতর্ক থাকতেন সত্যজিৎ।

“মানিক আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, মানুষের জীবনটা একটা অসামান্য গিফট, আর অতি অল্প সময়ের জন্য। এত অল্প সময়ের মধ্যে কত কি করার আছে। তাই যখন দেখতেন কীভাবে মানুষ অমূল্য সময় নষ্ট করছে, তখন উনি স্থির থাকতে পারতেন না। উনি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতেন না, সকাল থেকে রাত অবধি কিছু না কিছু ক্রিয়েটিভ কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতেন।”১২
প্রতিভার গৃহিণীপনার এতবড় উদাহরণ চোখের সামনে দেখে আমরা মুগ্ধ হই। আবার অন্য দুজনের ব্যাপারেই আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে পারি।

১৮৮১-৮২ সালে বাংলা ভাষার যখন প্রায় নাবালক অবস্থা, তখন সেই ভাষাতেই এমন অপূর্ব ভ্রমণকাহিনি লিখছেন সঞ্জীবচন্দ্র যা আমাদের আজও মুগ্ধ করে। তাঁর অনুসন্ধিৎসা এবং কৌতূহলের সজীবতাও বিস্ময়কর।

আর মাত্র ৩১-৩২ বছর বয়সের এক যুবক শিল্পী (রবীন্দ্রনাথ) উনবিংশ শতাব্দীতে, এক পরাধীন অনগ্রসর দেশে বসে, ‘প্রতিভার প্রয়োগপদ্ধতি’ সম্পর্কে এমন একটি অনুচ্ছেদ রচনা করে যাচ্ছেন যা একবিংশ শতাব্দীতে মনোজ্ঞ গবেষণার বিষয়বস্তু।

শুধু গবেষণাই বা বলি কেন? এই বিষয়টি তো আমাদের জীবনেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষতঃ সত্যজিতের ঐ কথাটি— ‘মানুষের জীবনটা একটা অসামান্য গিফট’!

তাঁর একটি গানেও রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর নিজের শক্তিকে তুচ্ছজ্ঞান না করে তাকে সুসজ্জিত করে যতটা সম্ভব কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত করে জগতের আঁধার দূর করার কথা বলেছেন,

“তুমি আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ / তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো / জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক'রে ফেলেছ”
আমাদের জীবনে এর থেকে বড় অনুপ্রেরণা আর পাথেয় কি হতে পারে?


তথ্য সূত্রঃ

১) মেঘনাদবধকাব্য – রবীন্দ্ররচনাবলী, দশমখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গসরকার, মার্চ, ১৯৮৯, পৃঃ - ১৮

২) মেঘনাদবধকাব্য – রবীন্দ্ররচনাবলী, দশমখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গসরকার, মার্চ, ১৯৮৯, পৃঃ - ৭৩

৩) সাহিত্যসৃষ্টি – রবীন্দ্ররচনাবলী, দশমখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গসরকার, মার্চ, ১৯৮৯, পৃঃ - ৩৪৯

৪) সঞ্জীবচন্দ্র – রবীন্দ্ররচনাবলী, দশমখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গসরকার, মার্চ, ১৯৮৯, পৃঃ - ২৩৮

৫) http://www.abasar.net/bhromon_ShekharBasu.htm

৬) পঞ্চাশোর্ধে – নারায়ণ সান্যাল – দে’জ পাবলিশিং – চতুর্থ সংস্করণ আগস্ট ২০১২ –পৃঃ - ৬৬

৭) পালামৌ – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ষষ্ঠ সংস্করণ দশম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১২ – পৃঃ – ৯ -১০

৮) http://www.abasar.net/bhromon_ramkrishna.htm

৯) সঞ্জীবচন্দ্র, রবীন্দ্ররচনাবলী, দশমখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গসরকার, মার্চ, ১৯৮৯, পৃঃ - ২৪২

১০) https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/10108

১১) https://nzhistory.govt.nz/media/photo/maori-and-european-population-numbers-1838%E2%80%931901

১২) আমাদের কথা – বিজয়া রায় – আনন্দ পাবলিশার্স - পৃঃ – ৩৮৪ - ৩৮৫

পালামৌ সংক্রান্ত উদ্ধৃতিগুলি সমস্তই ‘পালামৌ – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ থেকে গৃহীত।




(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)



ছবিগুলি সবকটিই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত