“আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা…” বিদ্রূপের সুরে গাইতে গাইতে অভি আমাকে কনুইএর একটা ঠেলা দিল, মুখে খোঁচা মারা একটা হাসি। বুঝলাম, কোন খোঁজ খবর না নিয়ে এই একদা ড্যাঞ্চিবাবুদের শহরে চলে আসা উচিত হয় নি। অভি অনেকবার বলেছিল, জীবনে নাম শুনিনি, একটু ভাল করে খোঁজখবর নাও। ও সবকিছু খুব প্ল্যান করে গুছিয়ে করতে ভালবাসে, আমার আবার “চাপল বাই তো কটক যাই”। আসলে আমি আর অভি স্বামী স্ত্রী হলে কি হবে, আমাদের ধরন-ধারণ সেই “ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি”, কিছুই মেলে না। অভি আজ অবধি যে কটা শেয়ারে পয়সা ঢেলেছে, প্রত্যেকটা চড় চড় করে উঠছে। ও শেয়ার বাজার নিয়ে রীতিমত পড়াশুনো করে, অনেক চিন্তাভাবনা করে ইনভেস্ট করে। আমি এপর্যন্ত ঝোঁকে পড়ে, এজেন্টদের চাপে, যে-সব জায়গায় ইনভেস্ট করেছি, সবগুলো ঝপ ঝপ করে পড়তির দিকে, কখনও আর মাথা তুলবে বলেও মনে হয় না। অভি অসম্ভব দায়িত্বসচেতন, কি অফিসে কি সংসারে। নিজের কর্তব্যে কখনও অবহেলা করে না। ওর প্রিয় প্রবাদ হল “এ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন।” আমি আবার কোনোটাই ঠিক আঁকড়ে ধরতে পারিনা, কেবল পালাই পালাই মন। আমাদের বিয়েটা হয়েছিল ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট দেখে, গার্জেনদের তত্ত্বাবধানে বছর পাঁচেক আগে। ছেলে মেয়ে হয়নি আসলে অভির আপত্তিতে, ওর মতে এখনও সময় হয় নি। কবে সময় হবে কে জানে! আমার বেশ লাগে একটা মোটাসোটা গাবলু গুবলু বাচ্চা হেলেদুলে ঘরময় বেড়াবে। অফিস থেকে ফিরে শূন্য ফাঁকা ঘরে তালা খুলে ঢুকতে হবে না। যাইহোক, ধান ভানতে শিবের গীত। যেটা বলছিলাম, ফেসবুকে একটা ভ্রমণগ্রুপে পড়েছিলাম এই জায়গাটার সম্বন্ধে। এত সুন্দর বর্ণনা ছিল, এত সুন্দর ছবি, কাছাকাছি, খরচও খুব বেশি নয়, লোভে পড়ে গেলাম। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সুবোধ ঘোষ, বিমল কর – এনাদের দাক্ষিণ্যে পশ্চিম নিয়ে বাঙালির নস্টালজিয়ার আর শেষ নেই। গ্রুপেই খোঁজ করেছিলাম থাকার জায়গা। তেমন কোন হোটেল বা হোম স্টে নেই বটে তবে সেকালের বাঙ্গালী বাবুদের বানানো বিশাল বিশাল বাংলো খালি পড়ে আছে । কেয়ারটেকারের সঙ্গে একটু ভাব জমালেই ওরা সব ব্যবস্থা করে দেবে, খুব অল্প খরচ। অভিকে শুধু সারপ্রাইজ দেওয়াই নয়, আমিও যে চাইলেই সব ম্যানেজ করতে পারি সেটা দেখানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। একটা লম্বা উইকএন্ড পেয়েই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম। সাধারণত বেড়ানো প্ল্যান প্রোগ্রাম অভিই করে, খুব স্বল্প নোটিশে একদম পেশাদারী ট্যুর অপারেটরের মত যথাযথ সব ব্যবস্থা করে ফেলে। কিন্তু এবার সব দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। এবং ফেসবুক পড়ে ভেবেছিলাম প্ল্যাটফর্মেই বুঝি এজেন্টরা ঘোরাফেরা করে, আগন্তুক দেখলেই কাড়াকাড়ি করে কোন ডেরায় নিয়ে যায়। কিন্তু এখন এই বুনো গাছে ঘেরা নীচু প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখছি, এমনকি টিকিট চেকার অবধি একটা নেই, কুলি তো দূরের কথা। এদিকে সূর্য ডুবতে চলেছে, আমরা কাল অফিস থেকে ফিরে রাত দুটো অবধি প্যাকিং করে কাক ভোরে ট্রেনে উঠেছি, এখন সন্ধে হতে চলেছে। কোথাও একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। দুজনে দুটো ট্রলি ব্যাগ লাল মোরামে গড়াতে গড়াতে স্টেশন ছাড়িয়ে বাইরে এলাম। রাস্তায় টিম টিম করছে আলো, দু চারটে দোকানঘর, এর মধ্যেই ঝাঁপ টেনে দিয়েছে, এখনও সন্ধে সাতটা বাজে নি চার দিক শুনশান। একট কালো সরু ভাঙা পিচের রাস্তা গড়িয়ে গেছে অন্ধকারে, ধূ ধূ মাঠ, বুনো আগাছা ঢাকা জমি, দূরে ময়ূরকন্ঠী আর লালের মিল মিশ আকাশ ছুঁয়ে ঝুপসি কাল কাল পাহাড়। বাসায় ফেরা পাখিরা কিচমিচ করছে, কতরকমের ডাক, মাঠের ওপর জোনাকির আলো জায়গায় জায়গায় ঝাঁক বেঁধে আছে। সবমিলিয়ে কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তখন এসব কাব্য করার সময় নেই। অভি প্রথমে ঠাট্টা করলেও এখন বেশ রেগে গেছে। ভাবছি কি করা যায় । এভাবে অজানা অচেনা খোলা প্ল্যাটফর্মে সারারাত কাটাতে হলে অবস্থা সঙ্গিন হবে। এবারে একটু বেশিই হঠকারিতা হয়ে গেছে। এমন সময় দেখি কপাল ভাল, একটা সাইকেল রিক্সা বোধহয় সওয়ারী নামিয়ে স্টেশনের দিকে আসছে। অভি হাত দেখিয়ে তাকে থামাল। তাকেই জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি, একটা থাকার জায়গা দেখে দিতে পারো?” খুব একটা ভরসার কথা শোনাতে পারল না সে। এখানে নাকি এখন মাওবাদীদের ভয়ে এমন করে কেউ অজানা লোককে বাংলো ভাড়া দেয় না। মালিকের অনুমতি আনতে হয়। আর বাংলোগুলোও আর তেমন ভাড়া দেবার অবস্থায় নেই, লোকজন তেমন আসে না, তাই ব্যবস্থাপত্র ঠিকঠাক নেই। এ বাবা, এতো ভাল ঝামেলায় পড়া গেল, এখন এই সন্ধেবেলা কি হবে! একমাত্র ভরসা ওই লোকটাকেই মিনতি করে বললাম, একটা উপায় করো ভাই, এসে পড়েছি, এখন তো ফেরাও যাবে না, খোলা আকাশের তলায় তো আর রাত কাটাতে পারি না। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর সে একটু দোনামোনা করে বলল, একটা পুরোনো বাংলো বাড়িতে একরাতের মত ব্যবস্থা হতে পারে, কেয়ারটেকার ওর চেনা, তবে কাল সকালে চলে যেতে হবে। এক কথায় রিক্সাতে উঠে বসলাম আমরা দুজনে ব্যাগপত্তর নিয়ে। গোধুলির ক্ষীণ আলো তখনও একেবারে মিলিয়ে যায় নি, যদিও সন্ধ্যার কালো ছায়া মাঠের কোল ঢেকে জঙ্গলের গাছ গাছালি কালো চাদরে মুড়ে, দূরে পাহাড়ের চূড়ো শীর্ষদেশ ছুঁয়ে ফেলেছে। সেই প্রায়ান্ধকার মফস্বলের পথে, লাল মাটি আর ভাঙা পিচের উঁচুনীচু রাস্তায় দুলে দুলে চলতে চলতে, দিন শেষের ঝিরঝিরে হাওয়ায় কপালে লেগে থাকা ঘামের ফোঁটাগুলোকে আরাম দিয়ে, পশ্চিমের আকাশে টিপের মত উজ্জ্বল, শান্ত, স্নিগ্ধ সন্ধ্যাতারাকে দেখতে দেখতে জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলাম। অভি সমানে ভুরু কুঁচকে গজগজ করে যাচ্ছে – “মোবাইলে সিগনাল নেই, নেট নেই, কত জরুরী মেসেজ পড়ে থাকবে উত্তর দেওয়া হবে না। এই অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ আসে! তোমার প্র্যাকটিক্যাল সেন্সটা একেবারে নেই!” আমি আর অভি প্রায় সমবয়সী হলেও ও অফিস আর বাড়ি দু জায়গাতেই এত রাশভারী, হিসেবী, সব সময় জ্ঞান দেবার এমন বদ অভ্যাস যে মাঝে মাঝে ওকে আমার নিজের বর নয়, বরং খিটখিটে শাশুড়ি মনে হয়। তবে স্বামী হিসেবে বিরক্তিকর হলেও অভি ছেলেটাকে আমি ভালবাসি। যখন ও ঘুমিয়ে পড়ে - কড়া, নিয়মনিষ্ঠ, রাগি মুখোশটা ওর মুখ থেকে খসে পড়ে তখন কে জানে কেন খুব মায়া হয় ছেলেটার জন্য। জানিনা কে অভিকে শিখিয়েছিল জীবনে শুধু জিততেই হয়, জিতেই যেতে হয়, হারতে নেই। সংসারে প্রতিটি ক্ষেত্রে ও প্রাণপণ শুধু জেতার চেষ্টা করে চলেছে। সারাক্ষণ রণসাজে সেজে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে কামান গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্ত থেমে একবার বুক ভরে শ্বাস নিতে হলেই ভাবছে সর্বনাশ হয়ে গেল। আমার কথা একটু শুনলে ওকে বোঝাতাম, মাঝে মাঝে হেরে গেলে কিছু যায় আসে না। ভালবাসার মানুষের কাছে দুয়েকবার ইচ্ছে করেই হারতে হয়, ভাল লাগে । বউ যদি দুয়েকটা মানুষী দুর্বলতা জেনেই যায় তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। অভি আমাকে ভালবাসে না তা নয়, কিন্তু সেটা কর্তব্য বোধে, আইনসিদ্ধ স্ত্রীকে ভালবাসতে হয় তাই। আমাকে, মানে এই উড়নচণ্ডী, ছিটিয়াল, দায়িত্বজ্ঞানশূন্য বৃন্দাকে ও ভাল করে চেনেই না।
এসব দার্শনিক ভাবনা ভাবতে ভাবতে চলেছি, সরু পথটার দুদিকে অনেক বিশাল প্রাসাদের মত বাংলো সেকালের আভিজাত্য ও সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দিচ্ছে। আধঘন্টা মত রিক্সা চালিয়ে যখন চারপাশের অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে আমাদের রথ এসে থামল এক পুরোনো জীর্ণ বিশাল সিংহ দরজার সামনে, দেখেই ভক্তি হয়, ভয় ও করে। ভেতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো একতলা বাংলো, প্রায় ভেঙে পড়েছে। ঝুপসি অন্ধকার। ওখানে মানুষ থাকে বলে তো মনে হয় না। চারপাশে বিস্তৃত বাগান ছিল এককালে। এখন শুধু দীর্ঘ, ঝাঁকড়া মহীরুহ ও বুনো ঝোপঝাড়। শীতকাল এখনও আসে নি, কার্তিক মাস। সাপ নেই তো? বন্ধ দ্বারে একটা আধমনী ওজনের তালা ঝুলছে, তবে চারপাশের ভাঙা পাঁচিল দিয়ে যে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে। আমাদের সারথি রক্সা থামিয়ে হাঁক দিলেন “চৌবে জি, চোউবে জি।” বেশ মিনিট পাঁচেক হাঁকাহাঁকি করার পর এক স্থবির বৃদ্ধ হাতে একটা মান্ধাতার আমলের ভূষোপড়া হ্যারিকেন নিয়ে বেড়িয়ে এল। সারথি ও দ্বাররক্ষকের বেশ খানিকক্ষণ বাদানুবাদ হল, আমাদের দিকে আঙুল তুলে তুলে কিসব বলতে লাগল তারা। সারথি বার বার মিনতি করছে কাল সুবহা তক, কাল সুবহা তক। এদিকে অভি অধৈর্য হয়ে উঠছে, ওকে দোষ দেওয়া যায় না, সেই ভোর চারটের সময় উঠে ট্রেন ধরতে হয়েছে, এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা, শরীর আর চলছে না। যাইহোক, ওরা কিছু একটা সহমতে এসে আমাদের ট্রলিদুটো ঝপাঝপ নামালো রিক্সা থেকে, বুড়ো কাঁপা কাঁপা গলায় জানালো, বিদ্যুৎ নেই, রাতে মোমবাতি ভরসা । ইঁদারার জল, বালতি করে তুলে দিতে পারে। কাছেপিঠে কোন দোকান বাজার নেই। আমরা চাইলে ও ফুলকা, ডাল আর আলুর চোখা বানিয়ে দিতে পারে কিন্তু সে সাধারণ নিরামিষ খাবার বাঙালিবাবুদের মুখে রুচবে কিনা জানা নেই, ইত্যাদি। ভিখিরিদের আবার পছন্দ, শুধু একটাই মুশকিল, বাথরুমটা বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকে, রাতে উঠতে হলে মোমবাতি নিয়ে অতটা যাওয়া একটু চাপের হয়ে যাবে। আমি ভয়ে ভয়ে অভির দিকে তাকালাম, ও কিন্তু ক্লান্ত গলায় বলল, যাকগে একটা রাতের তো ব্যাপার, ম্যানেজ হয়ে যাবে। একটু গরম জল পাওয়া যাবে? চা খেতাম একটু। বুড়ো বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাদের ট্রলিব্যাগগুলো তুলে নিয়ে ভাঙা লণ্ঠনটা দোলাতে দোলাতে নিয়ে গেল একতলায় ডানদিকের একটা একটেরে বড় ঘরে। পুরোনো বাড়ির পুরোনো ঘর যেমন হয়, নিরেট অন্ধকার, একটা লন্ঠনের সাধ্য কি তাকে আলোকিত করে! চায়ের সরঞ্জাম, মশার ধূপ, বিছানার চাদর, টর্চ এসব আমাদের কাছে থাকেই । পাওয়ার ব্যাঙ্ক পুরো চার্জ করা আছে, মোবাইল নিয়ে সমস্যা নেই। কাছে গিয়ে দেখলাম একটা নৌকার মাপে পালঙ্ক, ফুল লতা পাতার অপূর্ব কাঠের কাজ, এখনও মেহগনীর পালিশ যায় নি সম্পূর্ণ, মোমের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে। । সেই রাজশয্যার ওপর দুটো ছেঁড়া তোষক ও দুটো চিট ময়লা বালিশ। একধারে একটা বেশ প্রাচীন বয়সী ধুমসো পায়াভাঙা লেখার টেবিল, সম্ভ্রম জাগানো অভিজাতদর্শন, আগেকার দিনে যাকে বলা হত ডেক্সো, সঙ্গে হালের তৈরি আম কি কাঁঠাল কাঠের দুটো চেয়ার বসানো। ওদিকে জানলার ধারের দেয়াল ঘেঁষে পেল্লায় এক আলমারি, মাথায় কাঠের খোদাই দুই শঙ্খ লাগা সাপের মুকুট, নির্ঘাত বেলজিয়াম কাচ, এখনও কি উজ্জ্বল। এছাড়া আছে ঘটোৎকচের মাপমত বানানো এক বৃদ্ধ আরামকেদারা, তার ভগ্ন হাতায় সিংহ কি ড্রাগনের মুখ খোদাই করা। অবস্থা যেমনই হোক, এইসব প্রাচীন আসবাবপত্র এখনও অবশিষ্ট আছে সেটা আশ্চর্যের ব্যপার, চৌবেজি লোকটা সত্যিই সৎ। চাইলে শুধু কাঠের দামেই বড়লোক হয়ে যেতে পারত।
চৌবেজি শুধু সৎ নয়, এক কথার মানুষও বটে। কথামত গরমজল দিয়ে গেছে সঙ্গে মোটা মোটা দুটো মোমবাতি। গরমজলের বালতি আর মোমবাতি নিয়ে সাহস করে বাথরুমে ঘুরে এলাম একবার। ফিরে এসে কাগজের কাপে টি ব্যাগ ডুবিয়ে আমি চা খেতে বসেছি সেই আরাম কেদারার রাজাসনে, অভি কাপ হাতে এককোণে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। কথা আছে, এক ঘন্টার মধ্যে রুটি, অড়হর ডাল আলুর চোখা এসে যাবে। ঠান্ডা পড়েছে কি ভাগ্যিস, চান করার দরকার নেই, রাতের পোশাক পরে নিলেই হবে একেবারে। কাল সকালে উঠে সবার আগে একটা ডেরা খুঁজে বার করতে হবে, এই মোমবাতি আর ইঁদারার জলের ভরসায় চৌবেজির আলুর চোখা খেয়ে থাকা যাবে না। ভাঙা বাড়িতে সাপ আছে নির্ঘাত, কার্বলিক অ্যাসিড পাওয়া যাবে কি? ভদ্র গোছের একটা থাকার জায়গা না পেলে প্রথম যে ট্রেন পাবো ধরে দেওঘর চলে যাবো, বদ্যিনাথ দর্শনের পুণ্য যদি কপালে লেখা থাকে খণ্ডায় কে! এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অভিকে বললাম চলো না, চৌবেজি লোকটাকে একটু কালটিভেট করি, এমন পুরোনো বাড়ি, কেউ ত্রিসীমানায় থাকে না, এর নিশ্চয় একটা গল্প আছে, আর ভূত তো থাকতেই হবে দু একটা। অভি বিরক্ত হয়ে বলল এই শুরু হল তোমার উর্বর মস্তিকের কল্পনা, গল্প আবার কি থাকবে? যেতে হয় তুমি যাও, আমি দেখি যদি নেট আসে, কাল কলকাতা ফেরার কোনো ট্রেনের রিজার্ভেশন পাই কিনা।
চৌবেজি বারান্দার এককোণে একটু দরমা ঢাকা জায়গায় তোলা উনুনে রুটি সেঁকছিল। আমি আলাপ করার জন্য মুখরা ছাড়লাম “সুক্রিয়া, গর্ম পানিকে লিয়ে। আপ কো থোড়া তকলিফ উঠানা পড়া।” মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভেজে, এতো মানুষের মন। মুখের শক্ত রেখাগুলো আস্তে আস্তে নরম হচ্ছে দেখলাম। আমি একটা পাঁচশ টাকার নোট বাড়িয়ে বললাম, এটা এখন রাখুন, বাকিটা পরে দেব। “কেয়া জলদি থা, বাদ মে দেনে সে ভি হোতা।” খুশি হয়ে টাকাটা কোমরে গুঁজে রাখল। আমি এবার একটু আবদারে গলায় বললাম, “আমাদের একটা থাকার জায়গা খুঁজে দিন না দুদিনের জন্য, পরশু রাতে চলে যাব, টিকিট কাটা আছে।” মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “দেখব দিদি, আজকাল কেউ রাজি হয় না, তবু, এখানে চৌবেজিকে লোকে মানে, ভক্তি করে, সকাল হোক, কিছু এ্কটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
যাক, বাঁচলাম। এবার পরের কাজ। বললাম, “বাড়ির গল্প তো কিছু বলুন। কত পুরোনো এই বাংলো? কারা থাকতো এখানে?” চৌবেজি দেখলাম বেশ গপ্পে মানুষ। রান্না করতে করতে ঠেঁট হিন্দিতে গুছিয়ে গল্প বলতে বসল। ঘটনা হল এরকম। একশ বছরের বেশি বয়েস এই বাংলোর। কোন জমিদার বাবু বানিয়েছিলেন, পশ্চিমে প্রতি বছর হাওয়া খেতে আসবেন বলে। তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়েছিল অল্পবয়সে। বিয়ের পর ছেলে-বউকে নিয়ে প্রায়ই আসতেন তাঁরা এখানে, খুব প্রিয় ছিল এই জায়গাটা। শোনা যায় খুব অভিমানী ছিল সেই পুতুল বউ, কথায় কথায় মান করত। পুতুল বর খেলনা দিয়ে, কাঁচা আম পেড়ে বউএর মান ভাঙাতো। আর পুতুল বর ছিল খুব রাগি, তাকে পুতুল বউ ছাড়া কেউ সামলাতে পারত না। মোটকথা দিব্যি ভাবসাব ছিল দুজনের। বয়েসকালে অনেক প্রলোভন সত্ত্বেও বারনারীর কাছে যায় নি কখনও সে জমিদারনন্দন। তখনকার দিনে এমনটি দেখা যেত না। দুর্ভাগ্যক্রমে বিয়ের দশ বছর পরেও তাদের সন্তান হল না কোন। যা হয়, অবিলম্বে বউকে বন্ধ্যা আখ্যা দিয়ে একমাত্র বংশধরের পিছনে উঠে পড়ে লাগলেন গুরুজনেরা, জোরাজুরি করতে লাগলেন অন্যত্র বিয়ের জন্য, নয়তো বংশলোপ পাবে। তা সে ভদ্রলোকের হিম্মত ছিল বলতে হবে, কিছুতেই রাজি হলেন না, লড়ে যেতে লাগলেন সকলের সঙ্গে। এই নিয়ে প্রচণ্ড অশান্তি বাঁধল সংসারে। সেবারে ছুটি কাটাতে এসে জমিদার গিন্নি একেবারে আড় হয়ে পড়লেন । মেয়ে দেখা আছে এখানকারই অভিজাত সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। একেবারে ছেলের বিয়ে দিয়ে তবে যাবেন। শেষ উপায় হিসাবে ঠাকুর ঘরে নির্জলা হত্যে দিয়ে পড়লেন, ছেলে রাজি না হলে সেখান থেকেই গঙ্গাযাত্রা করবেন । অশান্তি যখন চরমে, আত্মীয় পরিজন সবাই বলছে কুলাঙ্গার ছেলে বউ-এর মন রাখতে গিয়ে এবার মাতৃঘাতী হবে, তখন একদিন ছেলে বউএর মধ্যে এইসব নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। বউটি সেই রাতে গলায় শাড়ির ফাঁস জড়িয়ে আত্মহত্যা করে। ছেলে আর বিয়ে করে নি, মা বাপ ছেড়ে এই বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন আজীবন। জমিদার গিন্নিও শেষ অবধি আত্মঘাতী হন নি, ননদের ছেলেকে পুষ্যি নিয়ে বংশরক্ষা করেন। সেই বংশের হাতে অবশ্য এখন আর সম্পত্তি নেই, এক স্থানীয় ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছেন, রিসর্ট বানাবেন। আগেই হয়ে যেত, কিন্তু এই মাওবাদীদের ঝামেলায় লোক তেমন আসছে না। কাজ বন্ধ আছে।
গল্প শেষ হলে কৌতূহলে জানতে চাইলাম, “তা এত পুরোনো বাংলো, ভূতপ্রেত নেই?” চোবেজি বলল, “আমি কখনও দেখিনি দিদি। আজ আপনাদের জন্য আমি এত রাত অবধি আছি, নয়তো কখন বাইরে গেটের ধারে আমার ডেরায় চলে যেতাম। এই বাংলোতে কেউ তো থাকে না। ভুত থাকলেই বা দেখবে কে?” মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহারে, দশ বছর বিয়ে হলেও পুতুল বউএর আর কতই বা বয়স হয়েছিল? বাইশ, চব্বিশ ? অনেক সময় পড়ে ছিল মা হওয়ার। হয়তো সে বন্ধ্যা ছিলই না, জানা তো হয় নি। তখন তো তাবিজ মাদুলি ছাড়া কোন ঠিকঠাক চিকিৎসাই ছিল না। হয়তো তার স্বামীই – কিন্তু তখন তো সে কথা ভাবাও ছিল পাপ। একটা প্রাণ শুধু শুধু ... বংশরক্ষা! কতবড় বংশ রে!
রাতের ডালটা ছিল বিস্বাদ, নুন হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করেছে শুধু, কোনো সম্বর দেয় নি। রুটিটা শক্ত, এমন চাপাটিই খায় এরা এখানে, আলুর চোখা অসম্ভব ঝাল, জিভে ঠেকানো যাচ্ছে না। অভি আবার খারাপ খেতে পারে না, বুঝতে পারছি ওর রাগ চড়ছে। আমার মেজাজও ভাল ছিল না, নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছিল। অভি বিছানায় শুয়ে বলল “এখানে অসম্ভব মশা, মশারি আনা উচিত ছিল একটা।” আমি অতি কষ্টে চুপ করে রইলাম।
- মোবাইলে সিগনাল লাগছে না, নেট তো ছেড়েই দাও।
আমি মাথা ঠান্ডা রেখেই বললাম “ কোন জরুরী ফোন আসার আছে? আমরা তো ছুটিতে এসেছি না?”
- তোমার মুশকিলটা কি জান? তোমার কল্পনার পক্ষীরাজ একেবারে আকাশ ঘেঁষে ওড়ে। মাটিতে পা পড়ে না। ফেসবুকে কে কি কাব্য করেছে তাই দেখে বেরিয়ে পড়লে । একটু খোঁজ অবধি নিলে না। কি করে অফিসে কাজ করো জানিনা।
কাটার ঘায়ে নুন ছড়াতে অভির জুড়ি নেই, আর বকতে শুরু করলে থামতে জানে না। উত্তর দিতে গেলে এখুনি তুমুল অশান্তি বাঁধবে, ছুটিটাই বরবাদ। ঝগড়া করবো না পণ করে আমি বিশাল ঘরটার এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি, এই ঘরটা নাকি ছিল বাড়ির কর্তার নিজস্ব শোবার ঘর। ছুটিতে বেড়াতে এলে এখানেই থাকতেন। অন্যমনস্ক ভাবে আলমারির ভাঙা পাল্লা ধরে দিলাম এক টান। ওঃ বাবা, কি ধুলো রে। আবার আমায় একপ্রস্থ হাত মুখ ধুতে হবে। গত পঞ্চাশ বছরে বোধহয় এই দেরাজে কেউ হাত ঠেকায় নি। আমার মোবাইল টর্চটা জ্বেলে দেখতে লাগলাম ভেতরটা ফাঁকা একেবারে। কিছু ছেঁড়া কাগজপত্র ছাড়া কিছু নেই। পুরোনো দিনের চুলের কাঁটা একতাড়া, ফিতে, শুকিয়ে যাওয়া আলতার শিশি, খালি সিঁদুর কৌটো, খবরের কাগজ এই সব হাবিজাবি। ওমা, একটা পুরোনো শনিবারের চিঠি, আগে পিছে পাতা উধাও। এটা নিয়ে যাব, কালেক্টর’স আইটেম হবে। বউটা পড়তেও জানত? একটা বিবর্ণ বিয়ের কার্ড, সিঁদুরলেপা, রঙ জরি সব উঠে গেছে। তবু টর্চের আলোয় মনে হল লালের ওপর বেশ বাহারি ডিজাইন ছিল। কার্ডটা খুলে পড়তে গেলাম, অর্ধেক অক্ষর পড়া যাচ্ছে না, তবু প্রথমেই চোখ পড়ল মাথার ওপর বড় করে লেখা বিয়ের তারিখ – ১৭ই ভাদ্র ১৩২০ সন। আশ্চর্য, আমাদের বিয়ে হয়েছে ১৭ই ভাদ্র, ১৪২০ সাল, ঠিক একশ বছর পরে। আর কিছু পড়া যাচ্ছে না, শুধু আবছা করে পাত্র পাত্রীর নাম ছাড়া। ভাল করে কাছে এনে দেখি, ছেলের নাম অভয়াচরণ আর মেয়ের নাম বৃন্দাবনী। তার মানে? সেই জমিদার পুত্রের নাম ছিল অভয়াচরণ, সংক্ষেপে অভি আর হতভাগ্য বউটার নাম ছিল বৃন্দাবনী, মানে বৃন্দা? কি সাংঘাতিক সমাপতন! মাথা আমার ঝিম ঝিম করে উঠলো। আজ থেকে একশ বছর আগে এই ঘরেই কি বৃন্দা শাড়ির ফাঁস জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছিল নাকি? ওই পালঙ্কে তারা প্রেম করত? ঝগড়া করত? হতাশায় কাঁদত? দুজন দুজনকে সান্ত্বনা দিয়ে, আগলে রেখে ভালবাসত? আচ্ছা ওদের মধ্যে কে আসলে বন্ধ্যা ছিল? বৃন্দা আত্মহত্যা করে স্বামীর দোষ, যদি থাকে, ঢেকে দিয়েছিল। আবার অভিও সারা জীবন বিপত্নীক থেকে বৃন্দাকে বাঁচিয়ে গেছে, প্রমাণ হয় নি কিছু। সেই যেমনটি বিয়ের সময় স্ত্রী আচার কালে সরা দিয়ে মাটির ঘটের মুখ ঢাকতে ঢাকতে ওরা একে অপরকে কথা দিয়েছিল, দুজন সারাজীবন দুজনের দোষ ঢাকবে, সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল তারা। আচ্ছা ওরা কি এ জন্মেও অভি আর বৃন্দা হয়ে এই বাড়িতে, এই ঘরে এসেছে? ওরাই কি আমাদের টেনে এনেছে নিজেদের জন্ম জন্মান্তরের অপূর্ণ সাধ মেটাতে।
বুঝতে পারছি আমার কল্পনা ঝোড়ো হাওয়ায় ডানা মেলছে। কিন্তু অসম্ভব বুকচাপা কষ্টে চোখ ভরে যাচ্ছে জলে। ভীষণ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে সেই তরুণী বৃন্দা, যার ইচ্ছেগুলো পালকের মত এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে, অবিন্যস্ত, সে আমাকে ফিস ফিস করে বলছে কানে কানে, কি করতে হবে। কি করলে ওর ইচ্ছের পালকে ঢাকা পড়ে ও বরাবর শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারবে। ভয় করছে না, বরং অভিকে বড্ড ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। পালংকে উঠে ঘুমন্ত অভির পাশে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে অভি আমাকে ভালো করে কাছে টেনে নিল। বাচ্ছা শিশুর মত ওর সরল, নরম মুখটা আমার বুকে গুঁজে দিল, তারপর একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগল আগের মতই। আধো ঘুম আধো জাগায় ওর মাথায় বিলি কাটতে কাটতে মনে মনে বললাম, “অভি আমি কিন্তু এ জন্মে তোমায় এত সহজে ছাড়ছি না, তুমি বকবে আর আমি গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ব, সে সব গল্প ভুলে যাও। আমি সমানতালে বরাবর তোমার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে যাবো।” আমি যেন অনুভব করছিলাম আজ রাতে প্রেম আসবে আমাদের ঘরে, হয়ত বা বিয়ের পর পাঁচ বছর পরে এই প্রথম। প্রেমের বন্ধু আনন্দ, তার চিঠি বিলি করে যাবে আজ হাতে হাতে। আজ আমরা সারা রাত ধরে অনেক ভালবাসব। অভিকে খাঁকুনি দিয়ে বললাম, “শুনছো অভি, আজ একজন দুর্লভ অতিথি আসবে, সে তোমার ঐ গোমড়া খিটখিটে মুখোশটা হ্যাঁচকা টানে খুলে দেবে।” অভি ঘুম চোখ খুলে এক অপূর্ব প্রসন্ন হাসি হেসে আমাকে কাছে টেনে ডাকল, “পুতুল বউ”।
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)
অলংকরণঃ আবোল-তাবোল থেকে