শেষপর্যন্ত দিভাইয়ের অংশটা ওরা কিনেই ফেললে। ওরা মানে সেজর ঘরের ছেলে বৌ—দিলীপ রাতুলা।
তার জন্য অবশ্য কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি ওদের। দি-ভাইয়ের একটা স্বভাব একগুঁয়েমি ছিল বরাবর—ভেঙে পড়ুক ওর অংশ, কিছুতেই তা কাউকে বেচা চলবে না। কিন্তু শেষ অবধি সে জিদ টিঁকল না। দিলীপের বহু দিনের চেষ্টা, অনুরোধ উপরোধের ফলে দি-ভাই বেচে দিলে ওকে। আর দুটো অংশ একজনের হতেই ভাঙ্গাটাও সুবিধার হ’ল।
অদিতির কানে এসেছিল উঠোন, রান্নাশাল, ছাদ কিছুই আর নেই—ছোট আর নতুনের মাঝবাড়ির অংশ থেকে আলাদা করতে এক পাঁচিলও নাকি উঠে গেছে। অদিতির খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বাড়িটার যতটা আছে একবার শেষ দেখা দেখে আসে।
ডোভার লেনের ফ্ল্যাটে থাকে ও। গাড়িতে বসেই যেন চোখের সামনে দেখল এবড়ো-খেবড়ো উঠোনে একটা শ্যাওলা ধরা তুলসী মঞ্চ—একটা ভাঙ্গা বালতিতে সিঁদুর লেপা মনসার ডাল। পাকাচুলো মাথা ভরা সিঁদুর মাখামাখি একজন মহিলা ভিজে কাপড়ে মাথা ঠুকে চলেছে ওই মঞ্চে—মেজজেঠী। আরও যেন চোখে পড়ল শ্যাওলা ধরা জাল ঘেরা লাল মাছের গামলা। উঠোনের একপাশে বদ্রী পাখির একটা বড়সড় খাঁচা—পাখিরা দোল খাচ্ছে। খাঁচার ভিতর ছোট ছোট মাটির হাঁড়িতে দরজা কেটে পাখির বাসা—বড়জেঠুর শখ। ঠিক যেখানে উঠোন শেষ হয়ে ও জমিতে যাওয়া যায় খিড়কির দরজা খুলে তারই পাশ ঘেঁষে মাটি লাগোয়া প্রায় দেড় মানুষ উঁচু খাঁচা—বিহার থেকে আনা হরিণ থাকত ছোটকাকুর। তার আগে নতুন কাকুমণির ময়ূর থাকত নাকি! তারপর ময়ূর, হরিণের জমানা গিয়ে এসেছিল হাঁস মুরগি—সেজমার পোষ্যরা। কেন যে ও জমি বলা হ’ত অদিতির জানা হয়ে ওঠে নি—খুব ছোটবেলা সেখানে জামরুল আর টক আমড়ার গাছ ছিল। উড়ে বামুন সেই আমড়া দিয়ে রাঁধত দাঁত-টকে-যাওয়া টক আমড়ার অম্বল। বিলাতি আমড়ার গাছও ছিল—ও কেবল শুনেছে দেখা হয়নি।
সেই ও জমিতে থাকত বিহার থেকে আসা কিছু খেটে খাওয়া মানুষ (ওদের ধাঙড় বলার কারণটা অদিতি জানে না) যারা হোলীতে এক ধরনের কাঠের ফ্রেমে গাঁথা খঞ্জনি বাজিয়ে গাইত ‘সারা রারা রারা হোলী হ্যায়’। ওরা উঠে যেতে তৈরি হল অদিতির বাপি মানে বাড়ির সম্পর্ক ধরলে ন'কাকার কারখানা। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন সব মেশিন ছাই রঙের তেল রং করা হ’ত। মেশিনে কাশ ফুল গুঁজে সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে পুজো—তারপর বাতাবি লেবু, শিঙ্গাড়া, মিহিদানা প্রসাদ খাওয়া। সারা বছর তেল কালি মাখা শ্রমিকদের সেদিন ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে বেশ নতুন নতুন লাগত আর পাড়ার অন্যান্য কলকারখানায় লাগানো মাইক থেকে ভেসে আসত মনে ঢেউ তোলা প্রতিমাদির ‘কন্ঠে আমার কাঁটার মালা ফুলের মালা নয়’।
আচ্ছা এমন কেন হয়? প্রথমে তো সব কিছু একটা প্রলেপে ঢাকা থাকে, একটু নাড়ালেই ধুলো উড়ে যায় আর খোলে একটার পর একটা দরজা। —এমনি সব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেল অদিতি। বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখা গোপালদাদার সাথে, বড়বাজারের এক গদিতে সামান্য কাজ করে। অদিতিকে দেখে ‘কিরে ভাল আছিস তো?’ বলেই অদিতির ‘হ্যাঁ, এই চলে যাচ্ছে’ গোছের কিছু শোনার আগেই চলন্ত বাসে উঠে বেরিয়ে গেল, কাজে তো ঠিক পৌঁছতে হবে। এমনি কজন বাড়ির এ-ঘরে ও-ঘরে এখনো টিঁকে রয়েছে, প্রমোটরের তাগাদা পেয়েও দিশেহারা নতুন আস্তানার ঠিকানা না জানা থাকায়। অদিতির আশা ছিল আরো কজনের সাথে দেখা হবে, কিন্তু তখন বেলা এগারটায় সকলেই প্রায় রুজির টানে বাড়ির বাইরে। কিছু ঘরে তালা ঝুলছে, হয়তো আরও অবস্থাপন্ন কেউ নিজের অংশে তালা দিয়ে আধুনিক কোনো কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট নিয়ে আছে।
তিন ভাগে ভাগ করা মহলটা। বার বাড়ি —যেখানে কিছু অয়েল পেন্টিং, তক্তপোশে ফেলে রাখা কোল বালিশ, দেয়ালে ঠেকানো অর্ধচন্দ্রাকার মার্বেল টপের টেবিল আর ঝাড়বাতি সমেত অযত্নে পড়ে আছে বৈঠকখানা; এখনো রয়েছে অব্যবহৃত এক্সরে ঘর আর বহু পুরনো ডাক্তারখানা ও কম্পাউন্ডারের ঘর। সদরের দুপাশে রুগী বসার পিঠে হেলান দেওয়া লোহার বেঞ্চ। সেকালের দুটো ওষুধের কথাই অদিতির মনে এল—জ্বরের জন্য এক মিক্সচার পেটের অসুখের আর এক। নামগুলো বোধহয় স্যালিসিলিক আর কারমিনেটিভ—অন্তত বাড়ির কারো কিছু হলে ও দুটোই চলত। মধু কমপাউন্ডার দাঁত বার করে হেসে মিক্সচার বানিয়ে দিয়েই বাংলা কাগজে ডুব দিত। আর অদিতির দল মহোৎসাহে সাদা কাগজে দাগ কেটে ড্রয়ারে রাখা কালো কবেকার আঠা দিয়ে শিশির গায়ে জুড়ে নিত। পাঁচ ছয় দাগের লম্বা স্ট্রিপ কাটতে কে কতটা দক্ষ তা নিয়ে থাকত চাপা রেষারেষি।
বারবাড়ি থেকে সরু চলন রাস্তা—একপাশে পার্টিশন দেওয়া টেলিফোন ঘর, কাজের মানুষদের ঘর—তা ফেলে বাঁয়ে ঘুরলেই ঠাকুরমার বড় ঘর—মাঝেরবাড়ির লাল দালান, ঠাকুরঘর,—বলা হত পরদার ঘর। সেই দালানে বড় তক্তপোশে কত আড্ডা বাড়ির গিন্নীমাদের। দুবেলার কুটনো কুটে দিয়েই বাঙলা কাগজের সিনেমার পাতা খুলে বসে পড়া। কালি পড়া এক বড়সড় তোবড়ানো কেটলিতে সারাক্ষণ ফোটানো চা থাকত দুধ চিনি মেশানোই। সঙ্গে আলুর চপ। কেটলি হাতে ঐ তো যেন চা-পিসি, ডেকে ডেকে চা খাওয়াচ্ছেন, বারবাড়ি থেকেও হরবখত চায়ের ফরমাশ আসছে। চা পানের সাথে সাথেই ঠিক হয়ে যেত কি সিনেমা যাওয়া হবে। সপ্তাহে কম করে তিনটে তো বাঁধা ছিল। আট আনা, বারো আনা, দেড় টাকা—টিকেটের রেট—বারো আনাতেই বেশ ভদ্রভাবে বসা যেত হলে।
গিন্নীমাদের আর একটি কাজ ছিল—সপ্তাহের সাত দিন পালা করে রুটি বেলা ভাঁড়ার ঘরে বসে—আর উড়ে বামুন দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে রুটির দিস্তে রান্নাঘরে এনে সেঁকে ফেলত ঝপাঝপ। পঁচিশ জনের জন্য দিস্তে দিস্তে রুটি হ’ত বৈকি। ফি শুক্রবার সন্ধে রাতে বাড়িতে কান পাতা দায় হত—রুটি বেলার ভাঁড়ারে, গৃহভৃত্যের পার্টিশন ঘরে, উড়ে বামুনের রান্নাশালে—সকলের কানেই বাজত জোর ভলুমে আকাশবাণী প্রচারিত নাটক—সেটা ছিল ট্রানজিসটরের যুগ। তারও আগে সবার জন্য রেডিও—একটাই, ঠাকুমার ঘরে। শনি রবিবার দুপুর দেড়টা থেকে আড়াইটে অবধি অনুরোধের আসর আর মহালয়ায় বীরেন ভদ্রের চণ্ডীপাঠের কথাই বেশি মনে পড়ল অদিতির।
অদিতির ভাল মনে আছে কারখানায় যখন বেশ রমরমা তখন বাবা মাঝবাড়ির দালান লাল সিমেন্ট বাঁধাই করালেন। চায়ের আড্ডার তক্তপোশে ল্যামিনেট পাড়া হল, ঘরে ঘরে এল টিউব লাইট।
লাল দালানে অরন্ধনের দিন পাতা পড়ত অনেক মানুষের। চাপ চাপ মসুর ডাল, গোটা মশলা দেওয়া ইলিশের ঝোল, ইলিশের ডিম ভাজা। পাঁচ রকমের নিরামিষ ভাজার মধ্যে থাকত কুমড়ো, আলু, নারকেল, বেগুন, ওল,—কখনো শশাও। ছিল চিংড়ির টক আর চালতার গুড় অম্বল। সবই গোটা মশলার--কারণ অরন্ধনে ছিল শিলষষ্টী। চালতা কুটতে বসে গিন্নীমারা মুখিয়ে থাকতেন কার চালতায় নটা কোয়া বার হবে—তিনি হবেন রানী—অদিতি জানে না শেষ পর্যন্ত কেউ রানী হয়েছিল কিনা।
দালানে একটু ঘুর ঘুর করতেই অদিতির চোখে পড়ল উঁচু করে টাঙ্গানো বাড়ির কন্যা পুত্র নাতি পুতি সমেত ঠাম্মার বেশ বড়সড় দুটো বাঁধানো ফোটো। অযত্নে একপেশে হয়ে ঝুলছে, পড়েছে কালিঝুল, তবু তো রয়ে গেছে।
মাঝবাড়ির দালান আরো অনেক কিছুর সাক্ষী—সরস্বতী পুজোর কথা ভেবে অদিতির মনটা কেমন উতলা হল। এসবের নাটের গুরু যে ও নিজে। রাত দেড়টা অবধি আলপনা দেওয়া, দশ ইঞ্চি উঁচু প্রতিমার শাড়ী কেনা বিশ্ব ঘুরে, তার চুল মুকুট প্রতি বছর পালটানো, কোনও বার তার হাঁসের গাড়ি, কখনো ফুলের দোলনা, ফি বছর নতুন টুনি বলের আলো—সব উৎসাহের পিছনে বেশিটাই ছিল অদিতির।
ফুলকাকাই (ভালবেসে এই কাকুকে ওরা কাকাই-ই বলত) আর কাকী ভার নিয়েছিলেন সরস্বতী পুজোর রাতের খাবারে্র—কড়াইশুঁটির কচুরি আলুর দম আর ট্মেটোর চাটনি--বাঁধা মেনু। সকালে ছিল বিরাট ডেকচিতে খিচুড়ি, বাঁধাকপির মাখামাখা তরকারি আর কুলের টক।
আর অদিতির দল পুষ্পাঞ্জলি সেরেই সাজ করে বেরোত পাড়ার ছেলেদের সাথে ঠাকুর দেখতে। বাড়ির সবাই সেটা সঠিক জানত না, আঁচ করত। কিন্তু ভাবলে মনে হয় সম্পর্কগুলো নেহাতই নিরামিষ ছিল, কেউ কাউকে দিদি ডাকত কেউ ছিল ভাই, কিছু অনুরাগ গড়ব গড়ব করেও গড়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত।
দালান থেকে নামলেই উঠোন আর রান্নাঘর যা ভাঙ্গা হয়ে গেছে। সেখানে বসার জায়গাগুলো এক একজনের আলাদা ঠিক করা ছিল, কেউ কারো জায়গায় বসত না। এক কাকু বসতেন সিঁড়িতে, থালা থাকত রান্নাঘরের দাওয়ায়, যেন নীচু চেয়ার টেবিলে খাওয়া। রাঙাকা বসতেন রান্নাঘরের দরজার ঠিক পাশে। খাওয়ার সময়গুলোও ছিল অন্য অন্য সবার । ফুলকাকাইএর রাত আটটা বাঁধা, অদিতির বাপি নটা আর নতুনকাকুর সেই রাত দশটা। ছেলেদের সারা হলে গিন্নীমাদের পালা। কেউ খেতেন এত পরিষ্কার যে পিঁপড়ে কেঁদে যেত পাতে, কেউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে—কিছুই রুচত না তাঁর। আর ফুলকাকী সবার শেষে খেয়ে উঠতেন। দিনের বেলা হাতে রাখতেন ছোট লাঠিগাছ কাক তাড়াতে। নতুন কাকীমার বাঁধা ছিল এক বাটি সিদ্ধ ঝোল—গলস্টোনের রুগি ছিলেন যে।
অনেক অনেক আগে রান্নাঘরের পাশে ছিল বিশাল এক চৌবাচ্চা, তারপর এল ঘেরা চানঘর। রান্নাঘরের দাওয়া সিঁড়ি ভেঙ্গে হল ক্যান্টিনের মত ঘেরা এক খাওয়ার ঘর। রেলিঙ দেওয়া জানলা বসল। ঠিক তার নীচেই কালো সিমেন্ট বাঁধানো টানা টেবিল আর তার লাগোয়া বসার কাঠের বেঞ্চি।
এবড়ো-খেবড়ো উঠোনে বাড়ির মেয়েদের গায়ে হলুদও দেখেছে অদিতি। ভিয়েনও বসেছে ও উঠোনে।
মাঝবাড়ির লাল দালানের ওপর দোতলার টানা বারান্দা, তাতে দেড় মানুষ উঁচু বড় বড় জানালা। তার কাছে বসে নীচের উঠোনে কি হচ্ছে দেখা যেত। আবার রোম্যান্টিসিজম ভর করলে নারকেল গাছের ফাঁকে চাঁদ তারার হাতছানিও ছিল।
বাড়ির সবাই নানান মতের, নানান রুজিরোজগারের মানুষ হলেও ভিতরে ভারি একটা মিল দেখা যেত। ওইতো অদিতি যেন ওপর দালান থেকে দেখতে পাচ্ছে কাঁকড়া এসেছে বাজার থেকে, ঢেলে ফেলা হয়েছে কাদা মাখা কাঁকড়া, এবার তাদের মারার পালা। রান্না হবে রাতে—এসব রাঁধতে পারদর্শিনী ফুলকাকী। আর তারপর রাতে সেই নীচের লাল দালানে হাতে ছোট নোড়া, পাথর, হাতুড়ির মাথা নিয়ে বসে ঠুকে ঠুকে কাঁকড়ার দাঁড়া ভেঙ্গে খাওয়া।
বাড়িতে তখন অদিতিরা চার কন্যা। বসন্তের দমকা হাওয়া বেশ কবারই ধাক্কা মেরে কাত করেছিল কজনকেই অল্প বিস্তর। (আর বসন্তের ডাকে সাড়া দেওয়াই তো স্বাভাবিক।) তার মধ্যে সে হাওয়া কজনকে বিয়ের পিঁড়ি অবধি টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কেউ সে হাওয়া চিরকালের মত মনে বন্দী করেছিল। আবার বসন্তের মতই দামাল বেপরোয়া স্বভাবের কেউ আরো ভীষণ ঝড় তুলেছিল নিস্তরঙ্গ রোজকার জীবনে। অদিতি তখন মাঝবাড়ির ওপরতলায়, যেখানে তিনটে দেড় মানুষ উঁচু গরাদ দেওয়া জানলা, যার ফাঁক দিয়ে গলে আসত দুপুরের রোদ আর রাতের চাঁদের আলো। জানলাগুলো ওই সব প্রথম মন তোলপাড়, পরের মন খারাপের সাক্ষী। ওদের সামনে দাঁড়াতেই বোধহয় অদিতির এত কথা মনে এল। তবে কি চাঁদের আলো দেখে নিশ্বাস ফেলা ছেলেমানুষ মেয়েগুলো আজ সফল গৃহিণী, কেউ দিদা, কেউ ঠাম্মা, তাই জানলাগুলোই সাক্ষী থাক সে সবের। আর কদিন বাদে পুরো বাড়িটাই ভাঙ্গা হলে স্মৃতিরাও চাপা পড়ে যাবে ইঁটের নীচে।
পঁচিশজনের মন পঁচিশ রকমই ছিল। ফুলকাকাই ডাক্তারি পাশ করতে পারেননি, কিন্তু প্রেশার মাপার যন্ত্র বগলে রোজ বেরতেন রুগী দেখতে। অবস্থাও তাই ভাল ছিল না। কাকীর অভিযোগ সেই অনুপাতে ভালোই ছিল। তবে কাকাই মনের মাপে বড় ছিলেন--মাকে তীর্থ করানো তার শখ ছিল, আর অদিতিকে বলতেন ‘মায়ের সেবা করা, পুরানো আশ্রমের পুনরদ্ধার, গাছপালার দেখভাল--এ' তিনেই সমান পুণ্য।’ আজও অদিতি দেখতে পায় ভাঙ্গা উঠোনের চৌবাচ্চা থেকে কনকনে ঠান্ডা জল তুলে মাথায় ঢালতে ঢালতে কাকু চেঁচিয়ে বলছেন, 'বীর বাঙালি বলতে মাত্র দুজন—নেতাজী আর এই আমি—দ্যাখ ঠান্ডা জলকে কেমন ভয় পাই না।’ গরম জল জোগাড় করতে না পারাকে এমন করেই হাসি দিয়ে জব্দ করতেন।
রাঙাকা ছিলেন সফল ডাক্তার, দেখতে নাকি কন্দর্পকান্তি, তবে অদিতির মনে পড়ে না--সেই দম্ভে বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। অপরাধ? তিনি সুশ্রী নন। ডাক্তারি ছেড়ে শুরু করলেন ওষুধের ব্যবসা—দেদার রোজগার। বাড়ির অনেক খরচই বহন করতেন, তার সাথেই এসে পড়েছিল দাদার বিধবা স্ত্রী ও কন্যার ভার। সবটা ঠিক অদিতি আজও বোঝে না। সব যেন জট পাকানোই ছিল, তা থাক, অতীতের জট ছাড়ানোয় খুব তো কিছু লাভ হয় না।
সেজ গিন্নীমা বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীলা--তখনকার দিনের কলেজে পড়া মেয়ে, কিন্তু বিবাহিত জীবনের সুখ ছিল ভারি ক্ষণস্থায়ী, মাত্র দেড় বছরের। তাই পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন স্পর্শকাতর জটিল এক ব্যক্তিত্ব যাকে ভালমন্দের হিসাবে ফেলা দায়। এতসব ভাবতে ভাবতে অদিতি ওপর দালান থেকে নীচে নামছিল। দেখল দুই বড় জানলার মাঝে দেয়াল ঘড়িটা তো টক টক করেই চলেছে। তার ঢং ঢং করে ছটা বাজানো পড়তে বসার সংকেত যেন মাথার কোষে কোষে গিঁথে গেছে। সেই ঘড়ি ধরেই তো শনি রোববার দুপুরে চুপি চুপি অনুরোধের আসর শুনতে নেমে আসা, তার রাত নটাতে রাতের খাবার বাঁধা--তখন যে হবে ছায়াছবির গান। আর দালানের একপাশেই তো সেজমায়ের ছোট ছোট দুটি ঘর, কত সুখ দুঃখ খুনসুটিতে ভরা।
তেল জল দিয়ে চার কন্যার রোজের চুল বাঁধা, বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ এলে তাদের সাজগোজের ভারও ছিল সেজ-মায়ের ওপর। কত মেক আপের নাম জানতেন, মেয়েরা অবাক হয়ে সমীহ ভরে তা শুনত। প্রথমে ক্রীমে মুখ ভিজিয়ে তা তোলার পালা—ম্যাক্সফ্যাক্ট্রর পাউডারের পোঁচ, কাজল টিপ, কত কি। তার ফাঁকে ফাঁকেই চলত সবে পড়া নাটক নভেলের চর্চা, সদ্য দেখা সিনেমার সমালোচনা। মেয়েদের মধ্যে যে সব চাইতে বিদ্রোহী স্বভাবের তার সাথেই ছিল মতামতের বেশী ঠোকাঠুকি।
সেজমায়ের ঘরের পাশে, যেখানে কোনা ঘুরে গিয়ে পিছন মহল শুরু সেখানেই নীচের ভাঁড়ারের ঠিক ওপরে অদিতির বাপির ঘর। কিন্ত ও যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল, অত কাছের মানুষটার কত জিনিসই হয়ত ছড়ানো আছে সে ঘরে। থাক সেসব যেমন আছে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই কি যেন ঠং করে অদিতির পায়ে লাগল—ওমা এযে সেই পানের ডাবরটা। হাঁটু গুটিয়ে খুব গুটি সুটি মেরে বসে ওই তো যেন ছোটকাকীমা পান সাজছেন। আর অদিতিরা যেন সিঁড়ির নীচের ধাপগুলোয় বসে ওঁর সাথে গল্প মারছে। আধ ফালি পানে চূণ খয়ের দিয়ে সযত্নে সুপুরি কুচিয়ে সারা দিনের পান গড়ে রাখছেন কাকী। অদিতির মনে পড়ে গেল ঠাম্মার আধ চিবনো পান খেতে ও বড় ভালবাসত, আজ গা গুললেও সেদিন তা ছিল অমৃত। পানের ডাবরটা গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখে মনটা কেমন হয়ে গেল। অদিতি ভাবলে ওটা কারো না লাগলে নিজের জন্য চেয়ে নেবে কি?
সিঁড়ির তলায় জালের দরজা দিয়ে ঘেরা ছোট এক ঘর ছিল, সে কারণেই জালের ঘর নাম। নেমে এসে উঁকি দিতেই মনটা বিষাদে ভরে গেল। কত কি আবর্জনা ভরা ঘরে, ভাঙ্গা কুলো ডালা, বাঁটহীন ছাতা--ওটা কি নকুড়মামার ছাতা? হতেও পারে। আগে থাকত বিশাল এক মাটির জালায় খাবার জল—সোজা রাস্তার টিউবওয়েল থেকে ধরা--জালা কি ধোওয়া হ’ত? মনে পড়ে না, তবে পেটের রোগ লেগেই থাকত। আর থাকত সেখানে ও-বেলার রান্নার কাটা কুটনো, পানের সামগ্রী, বিয়ে শাদীর তত্ত্বের মিষ্টি, আচার।
জালের ঘর বাঁয়ে ফেলে একটু এগোলেই সেই মাঝবাড়ির দালান, যার সামনে ছিল ঠাম্মার ঘর যেখানে ছিল রেডিও—পঁচিশ জন এক মন হয়ে বীরেন ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনার একমাত্র সাক্ষী। আর ছোট এক অর্ধচন্দ্রাকার তাকে ছিল হাতির দাঁতের খুদে এক দুর্গা প্রতিমা ফি বছর যাকে পুজো করা হ’ত পুজোর সময়। নকুড়মামা তখন রাত থাকতে জগন্নাথ ঘাট থেকে আনত মার জন্য একশ আট পদ্ম।
দালানের শেষ প্রান্তে সেই পরদার ঘর। আদতে একটি পার্টিশন ঘর। নানান দেব-দেবীর ফোটো ছিল সেখানে। ইতু পুজো হত সে ঘরে, পড়া হত মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত কথা। বৈশাখে তুলসী মঞ্চে ঝারা বাঁধা হলে ঠাকু্রবাড়ি থেকে আসা নানান ফল, সাদা মাখন, মিছরি—সব রাখা হত পরদার ঘরে। ঝুলনে ঠাকু্রবাড়ি থেকে আসা সোলার নানান খেলনাও থাকত ছোটদের মাঝে বিতরণের আগে—বড় সাদা কাকাতুয়া, শিকেয় বসা হনুমান,—খুব ইচ্ছে থাকলেও অদিতি কোনোবারই সাদা কাকাতুয়া চাইতে পারেনি। ঠাকুর ঘরই যেন মনে করিয়ে দিল চিঁড়ে দই আম কলা ফলারের লোভে অদিতি খুব ছোট বেলাতেই মা কাকীমাদের মঙ্গলচণ্ডী ব্রতে সামিল হয়েছিল।
দুটি মজাদার ঘটনা রয়েছে ওই লাল দালান আর বাড়ির ভিতর থেকে বড় রাস্তা বরাবর সরু চলন পথ ঘিরে। বারবাড়ির সদর দরজার ছিল সটান ভিতর বাড়ির সাথে যোগাযোগ আর সারাদিন খোলাও থাকত।
উঠোন পেরিয়ে শেষ প্রান্তে সেই রুটি বেলার ভাঁড়ার যেখানে কাঠের সিন্দুকে থাকত বোঝাই করা কাঁসা পিতলের বাসন। একবার বাঁধাধরা রাঁধুনি ছেদী বামুন (নাকে কানে ফুটো তাই নাম ছেদী) দেশে যাওয়াতে এল কদিনের জন্য আর এক তিন ফুটে ঝাঁকড়া চুলো উড়ে বামুন। —রান্না কি জানত বলা শক্ত কিন্তু বাড়ির গিন্নীমারা হাত পোড়াতে হবে না বলে ভারি খুশি। রান্না বলতে তো বিশাল হাঁড়িতে ভাত, স্কুল অফিসের মাছের ঝোল (তাতে কেমন যেন সাবান সাবান গন্ধ পেত অদিতি সদাই), কখনো চচ্চড়ি। রাতে মাছের ঝাল নিরামিষ তরকারি আর রুটি। তবে পঁচিশজনের রান্না, খুব সহজ ব্যাপার ছিল না।
সে যাই হোক, উড়ে বামুন তো দিব্যি ছিল। প্রমাদ ঘটল যখন ছোটোকাকীমা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন বাসনের সিন্দুকে কেবল একটি কাঁসার গ্লাস ছাড়া বাকি ফাঁকা।
দুপুরের দিকে বামুন ঠাকুর বোধহয় হেঁসেল গোটাচ্ছিলেন। দুপুরে ঘুমের অভ্যাস না থাকায় কাকী এদিক ওদিক করছিলেন। খালি সিন্দুক কদিন আগেই চোখে পড়েছিল, বামুনকে ভাঁড়ারে ঘোরাফেরা করতেও বোধহয় দেখেছিলেন। আনমনে জিগেস করায় সে সেই যে দৌড় মেরে খোলা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল আর কোনোদিনও ফিরে আসে নি। এত সত্ত্বেও বড় রাস্তার ওপর সদর দরজা যে-কে-সেই খোলাই থাকত।
এবার লাল দালানের কথা। দালানের কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো দোলনাতে থাকত বহু পুরনো লেপ কম্বল, কোল বালিশ। অদিতি কাউকে সেসব নামাতে দেখেনি। নকুড়মামা বাইরে থেকে এসে বাঁশের ছাতাটি ওই শিকে থেকে ঝুলিয়ে রাখতেন।
একদিন সন্ধে সাতটার দিকে বাড়িতে চোর চোর রব ওঠায় মামা মনে করলেন চোর ধরা পড়লে ছাতা পেটা করবেন, কিন্ত ছাতা আর নামাতে পারলেন না। এক হাতে লুঙ্গির খোঁট অন্য হাতে ছাতায় টান—সেদিনের সেই দৃশ্যে কেউ হাসি চেপে রাখতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত চোর বলতে কাজ ছেড়ে যাওয়া এক পুরনো ভৃত্য ধরা পড়েছিল, তাই ছাতা পেটা, থানা পুলিশ কিছুই আর হয়নি।
এই ফিরে দেখায় সামিল হয়ে অদিতি বকুল বীথি দিদির কথা ভোলে কেমন করে? ফুটফুটে সাত বছুরে বকুল দিদি, এসেছিল বিহার থেকে এ বাড়িতে লেখাপড়া শিখতে। সাথে আনত জামাকাপড়, পুতুল খেলনা আচারের শিশি বোঝাই এক বড়সড় টিনের ট্রাঙ্ক। বাড়িতে ঢুকেই ট্রাঙ্কে বসে খানিক কেঁদে নিয়ে চোখ মুছে অদিতিদের সাথে খেলায় মাততো। সেদিনও অদিতির মনে হত, আজও হয়, সাত বছুরেকে মা-বাপ ছাড়ানোর খুব কি যুক্তি ছিল? পুজো এলে বাক্সে মার নতুন শাড়ী, কটা নারকেল নিয়ে ধেই ধেই করে বাড়ি পালাত, খুদে দিদি আরও খুদে বোনের জন্য গল্পের বইটা ভুলত না। ফিরে এসে বাক্সে বসে কেঁদে আবার সব ভুলত।
বাড়ির কেউ নয় আবার আশ্রিতের মত রয়ে গেছের আওতায় নকুড়মামাও এসে পড়ে। নকুড়মামা বড়জেঠীর ভাই--মানিকতলার কাছে বলদিয়া পাড়া ঘুরে গিয়ে যেখানে সরিয়া তুল্লা লেনে পড়ে ঠিক সেই মোড়েই ওদের ভেঙ্গে পড়ব পড়ব আস্তানা। নকুড়মামা আর বড় জেঠীর বাবাকে খুব মনে পড়ে অদিতির। সাদা খাটো হাতা, হাঁটু ছাড়ানো লম্বা শার্ট পরতেন ধবধবে ধুতির ওপর। শামলা শামলা রোগাটে লম্বা গড়ন, চোখে থাকত সোনালি রিমলেস চশমা। দাদুর অল্প জমি ছিল মগরাহাটে। আর ছিল বেলেঘাটার কাছে শুঁড়া থার্ড লেনে পড়তি ঝড়তি এক সারের দোকান, যা সবসময় যেন বন্ধ হওয়ার মুখে। দাদু জমি দেখতে গেলে কতবার নিয়ে গেছেন অদিতিদের মগরায়। সাধ্য একেবারে ছিল না। তবু বড়জেঠীর কাছে এলে ছোট চ্যাঙারিতে আনতেন অল্প ছানার মুড়কি, কখনো কটা গজা। দাদুর সাথে কেউ ভালো করে কথা বলত না, তাই জেঠী মরমে মরে থাকতেন, কিন্তু সেই অল্প কটা মিষ্টি নিজের ঘরে রাখতেন না। পঁচিশ জনের হেঁশেলে তা পৌঁছে যেত বরাবর।
চার কন্যা যেন ছিল চারটি লক্ষ্মী। এক এক করে বিয়ে হতে লাগল, বাড়িটাও যেন কেমন শ্রীহীন হয়ে পড়তে লাগল। দাদুরা চলে গেলেন। স্বাভাবিক পরিণতিতে গিন্নীমারাও। বৌদিরা এল, তাদের সাথে নতুন এক গোছা নিয়ম--নতুন মনের সব কত টানাপোড়েন। কেউ চায় এত বড় বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হোক, কেউ নিজের অংশ গুছিয়ে নিয়ে থাকতে চায় আবার কেউ তড়িঘড়ি অন্যের অংশ কিনতে উদ্গ্রীব।
এতসব ভাবতে ভাবতে অদিতির তো বাড়ি পরিক্রমা প্রায় শেষ। তবু কি শেষ হয়? আগাছা ভরা বাগানটাতে ভাঙ্গা কাঁচের বোয়েমটা যেন চেনা চেনা লাগছে—হ্যাঁ শুকদেবের আচারের জালাই তো। কি ভাল বিহারী আমের আচার বানাত ও—বামুনের রান্না না রুচলে সবাই ওর আচার চেয়ে নিত, কখনো না তো করে নি ও। অত জন জেঠু কাকুদের ফাই ফরমাশ খাটার জন্য বাড়িতে এমনিতেই গৃহভৃত্যদের পল্টন তো মজুত থাকতই। আর ছিল ছাই মাটি দিয়ে বাসন মাজার জন্য সেই অনেক দূরের কাঁথি এলাকার পানিপারুল গ্রাম থেকে আসা হারির মা তারির মা। ওরা গ্রামের বেলে মাটি ভাল না কাদা মাটি তাই নিয়ে কাঁসার চায়ের গেলাস হাতে লড়ত, টিভি তো ছিল না, গ্রামের দু পাশ থেকে আসা দুটি মানুষের ওটাই ছিল বিনোদন!
সদরের দিকে এগোচ্ছিল অদিতি। ‘কি দিদিমণি, কখন এলি? মোর সাথে দেখা না করি চলি যাচ্ছ যে বড়?’ ডাকে অদিতি চমকে ফিরে দেখে গোঁসাই বাবা—সেদিনের সেই তরতাজা গৃহভৃত্য আজ নুয়ে পড়া প্রায় বৃদ্ধ!—ভারি ভাল লাগল ওর। সেই আপন করা ডাকে সুর মিলিয়ে ভিতরে কোথাও হাতুড়ির আওয়াজের সাথে বাড়ি যেন মৃদু হেসে বললে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?’
আধো অন্ধকারময় চলন পেরিয়ে অদিতি সোজা সদর দরজায় পৌঁছাতে দমকা ধুলো উড়িয়ে বাস বেরিয়ে গেল। রোদে খানিক চোখ ধাঁধাল। সড়কের ওপারে অর্দ্ধনির্মিত অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট বাড়ি, জুয়েলারী শো-রুম;—বাড়ির ভিতর যেন এর সাথে মিল খায় না। অদিতি ভাবছিল হয়তো টেনেটুনে মাত্র একশ বছরের কথা কিন্তু বাড়ির অভ্যন্তর যেন কোন জ্যুরাসিক যুগের এক অতিকায় সরীসৃপ। শ্যাওলা ধরা ইঁট—মরচে লেগে ফেঁপে ওঠা কড়ি বরগা যেন ডাইনোসরের খসখসে চামড়া—মানুষ যারা ছিল তারাও যেন সেই ফ্রেন্ডলি ডাইনোসর—ভালবেসেছিল নিজেদের চার পাশকে তারপর জ্যুরাসিক যুগের মত ওরাও প্রকৃতির নিয়মে লুপ্ত।
(পরবাস-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)
অলংকরণঃ পরবাস আর্কাইভ থেকে