২০১৮র ডিসেম্বরে চলে গেলেন মৃণাল সেন। যে তিন কিংবদন্তীকে বাংলা সিনেমার তিন স্তম্ভ বলা হত, তাঁদের শেষ প্রতিনিধিও বিদায় নিলেন।
এর আগে জুলাই মাসে চলে গেছিলেন রমাপদ চৌধুরী, প্রায় একই বয়সে। মৃণাল আর রমাপদর মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধন ছিল – রমাপদর কাহিনিভিত্তিক দু দুটি ছবি করেন মৃণাল – খারিজ (১৯৮২) আর একদিন অচানক(১৯৯০)। দুজনেই তাঁদের শিল্পীজীবন থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন বেশ কিছুদিন আগেই। তাও তাঁদের এরকম পরপর প্রস্থান বাংলার সাহিত্য শিল্প জগৎকে বেশ বিমূঢ় করে দিয়েছিল।
“তৃতীয় ভুবন” – বইটিকে কি মৃণালের আত্মজীবনী বলা যেতে পারে? নামটিও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। বইএর ব্লার্বে লেখা –
“গুজরাতের বালিয়াড়ি বা গ্রামবাংলার দুই অনুভূতিময় নারীর জীবন-সৌন্দর্য নিয়ে ভুবন সোম বা আমার ভুবন যদি মৃণাল সেনের ভাবনার দুটি ভুবন হয়, এ আত্মকথন তাহলে তাঁর তৃতীয় ভুবন।”
সুতরাং বইটিকে আত্মকথন বলেই ধরা যেতে পারে। আত্মকথনে কিন্তু কালক্রম যথাযথই রেখেছেন মৃণাল। ভূমিকাতেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, “সিনেমাই আমার ঘরবাড়ি”! কাজেই এই বইটির মূল উপজীব্য তাঁর সিনেমার পথচলা। সেই হিসেবেও বাংলা চলচ্চিত্রে এই বইটির একটি অনন্য ভূমিকা থেকে যাবে।
শুরুটাই বেশ চমকপ্রদ – ‘শেষপর্যন্ত সিনেমার জগতেই চলে এলাম’!
একদম সপাট আত্মসমর্পণ পাঠকের কাছে। তারপরেই শুরু হয় তাঁর কলকাতার প্রতি তীব্র ভালবাসার কাহিনী। বলতে দ্বিধা নেই, এখানেই আমি সত্যজিৎ ও মৃণালের মধ্যে এক ভীষণ মিল পাই। দুজনেই আদ্যন্ত কলকাতা প্রেমিক, নাগরিক শিল্পী। সত্যজিতের আত্মকথনেও কলকাতার শরীরী উপস্থিতি আছে, মৃণালের ‘তৃতীয় ভুবন’ বইটিতে তো কলকাতা প্রায় নায়িকার ভূমিকায়। পূর্ববঙ্গে জীবন শুরু করে তিনি কলকাতায় চলে এসেছেন ১৯৪০ সালে, চলে গেলেন ২০১৮ সালে। অর্থাৎ দীর্ঘ ৭৮ বছর তিনি এই শহরে কাটিয়ে গেলেন। চোখের সামনে দেখলেন অনেক পরিবর্তন। পরাধীন দেশ, স্বাধীন দেশ, কংগ্রেস শাসন, যুক্তফ্রন্ট, নকশাল আন্দোলন, বামফ্রন্টের উত্থান ও পতন! কিন্তু এইসব ছাড়িয়েও এই বইটিতে ধরা পড়ে তাঁর উত্তাল কলকাতা প্রেম। সত্যজিতের তুলনাতে এ ব্যাপারে তিনি অনেক বেশী সরব। বস্তুতঃ মনে হয়, এই প্রজন্মের বাঙালীরা, যাঁদের হয়তো কলকাতার প্রতি আকর্ষণ একটু হলেও কমেছে, এই বইটি তাঁদের হৃদয়কে আবার উদ্বেল করে তুলবে।
প্রথম অধ্যায়েই আছে কলকাতা সম্পর্কিত অনেক কথা। আছে গুন্টার গ্রাসের কথা, আছে লুই মালের কলকাতা ভ্রমণের কথা, গুলজারের কথা, ব্রিটিশ সাংবাদিক জেমস ক্যামেরনের কথা। মনে হয় তিনি যেন জনে জনে ডেকে এক কিশোর ছেলের মত তাঁর কলকাতা প্রেমকাহিনী শোনাচ্ছেন! এতই মর্মস্পর্শী, এতই সজীব ধারাবিবরণী মনে হয় যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। তখনই স্মরণে আসে, তিনি একজন সফল চিত্রনাট্যকার। রয়েছে এক অনুপম স্বীকারোক্তি,
“এই শহর কলকাতা, ব্যস্ত, সৃষ্টিশীল, একবগগা। এখানে নৈরাজ্য দানা বেঁধেছে। কখনো কখনো এখানে জীবনযাত্রা পঙ্গু হয়ে যায় পুরোপুরি। কিছুটা অবিরাম ক্লান্তিহীন বৃষ্টিতে, কিছুটা রাজনৈতিক উত্তেজনায়, কিছুটা আবার নীরবতায়। তবু আমি এখনও কলকাতাকে এলডোরাডো বলে মনে করি। যেন আমি এই এনাটমির একটি অংশবিশেষ।”
কি অপূর্ব না! কাব্যিক অথচ ঋজু, রোমান্টিক আবার আদ্যন্ত বাস্তব। সম্ভবত এই ভালবাসার ক্ষমতাই শিল্পীর বৈশিষ্ট্য।
এরপরে শুরু হয় তাঁর পথচলা। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট কলকাতা শহরে রবীন্দ্র প্রয়াণের পরে তিনি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। সেই ঘটনা থেকেই তুলে আনলেন এক ছবি (২২শে শ্রাবণ) সম্ভবত যা থেকেই তাঁর নতুন পথচলার শুরু।
পুরো বইটিতেই সুন্দর সহজ ভাষাতে তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর জীবনের পদক্ষেপগুলিকে। অসম্ভব সুখপাঠ্য একটি বই, বইটির প্রত্যেক পাতায় যেন জুড়ে রয়েছে জীবনের প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা। এই ভালবাসাই তাঁকে তরুণ করে রেখেছে, অবিরাম কৌতূহল যেন তাঁকে এক চিরকালীন উৎসুক ছাত্র করে রাখতে পেরেছে।
১৯৭৯ সালে তিনি প্রথমবার জাপানে যান। সেখানে হিরোশিমা দেখেই স্তম্ভিত! কিন্তু জানতে উৎসুক কেন এই নৃশংসতা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ছেলের বন্ধু দীপঙ্কর হোমকে চিঠি লিখে ইতিবৃত্ত জেনে কৌতূহলের নিবৃত্তি। এই সময় তিনি প্রায় ষাটের কাছাকাছি, বিষয়টি পরমাণু বোমা সংক্রান্ত, সরাসরি তাঁর কাজের বিষয়ও নয়, তাও তিনি নির্দ্বিধায় পুরো ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত হতে চেয়েছিলেন।
তবে ব্যক্তিগত স্তরে আমার একটু আক্ষেপ থেকেই গেল। ঘটনাটি নীলস বোর ও হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত কোপেনহেগেন সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত। এখন এই ঘটনা নিয়ে একটি বিখ্যাত নাটক, কোপেনহেগেন, বিশ্বে খ্যাত। মৃণাল যদি সেই আটের দশকেই এই নিয়ে কোন কাজ করে ফেলতেন? মানছি বাংলা ফিল্মের যা বাজেট, তাতে কাজটি শক্ত ছিল কিন্তু একটু লেখালেখিও যদি করে রাখতেন? আমরা কি ওরকম একটি নাটক পেতাম না?
সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক সম্পর্কের চড়াই উৎরাই এই বইটির এক বিশেষ সম্পদ।
১৯৬৫ সালে মৃণালের ‘আকাশকুসুম’ ছবি নিয়ে বিশাল বিতর্ক পর্ব এই বইয়ের বেশ কিছু অংশ জুড়ে আছে। ব্যক্তিগত ভাবে ‘আকাশকুসুম’ আমার খুব পছন্দের ছবি, সত্যজিতের মতামতের সঙ্গে আদৌ একমত নই। নায়কের ভূমিকায় সৌমিত্র আমার মন জয় করেছিলেন। তাঁর ও অপর্ণা সেনের অসমাপ্ত প্রেম কাহিনী ভারি মনোগ্রাহী ছিল। এই বিশাল চিঠিপত্রগুলিও পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে। মৃণালের যুক্তি আমার কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। যাক সে কথা।
এই বইতে মৃণাল ভারী সুন্দর করে ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন, শেষ করেছেন,
“বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর কথাটি আবার মনে পড়লঃ Truth attains a quality only when it becomes controversial. বেশ মজা হল দুমাস ধরে!”
ভাবতে ভাল লাগে, কি এক অসাধারণ বিতর্কের ঐতিহ্য দেখে এসেছি আমরা। এত তর্কের পরও কোন তিক্ততা নেই, বরং তা যেন এক মধুর স্মৃতি। আজকের এই কাদা মাখামাখির সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য।
মৃণাল জানিয়েছেন সত্যজিতের সব থেকে আধুনিক ছবি তাঁর কাছে – ‘অপরাজিত’! এই বইতে ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত লেখা আছে। সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক সম্পর্কের অনবদ্য বর্ণনা। ১৯৮৩ সাল। তাঁর ছেলে কুণাল তখন থাকেন শিকাগোতে। কুণাল তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সাথে ‘অপরাজিত’ ছবিটি দেখেন। দেখে তাঁর আবার ভাল লাগে, কুণালের বন্ধুবান্ধবদেরও খুব ভাল লাগে। শুধু তাই নয়, ছবিটি তাঁদের ভাবায়। তাঁরা সকলেই নিজের মধ্যে অপুকে খুঁজে পাচ্ছিলেন। তাঁদের অনেকেই সে দেশে থাকবে বলে স্থির করেছে, প্রত্যেকেরই বাবা মার সঙ্গে কিছু না কিছু সমস্যা আছে। ওরা বলছিল সন্তানের কি কোন অধিকার নেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেবার? ছেলে কি কেবল মায়ের আঁচল ধরেই থাকবে?
মৃণাল লিখছেন,
“বিশের দশকের কাহিনি, তিরিশের দশকে লেখা হয়েছিল, সত্যজিৎবাবু ছবি করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে এসে, সেই ছবি দেখে একদল তরুণ তরুণী আশির দশকের মাঝামাঝি। কি আশ্চর্য! সমস্ত সময়ের সীমারেখা মুছে ফেলে ‘অপরাজিত’ হয়ে উঠেছে সমকালীন ভাষ্য, সাম্প্রতিকের চিহ্ন”।
সত্যি বলতে কি সমগ্র বইটির মধ্যে এই পংক্তিটি আমার কাছে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী লেগেছে। তাঁর সমসাময়িক পরিচালকের ছবি তাঁর আপন সন্তানকে এতটা স্পর্শ করেছে তা কিরকম মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নিলেন! এতটাই শিক্ষণীয় বিষয়টি।
অনুপ্রাণিত হয়ে আমি নিজেও এই পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলাম। নিজে প্রবাসী, তিন দশকের ওপর। ছেলেকে নিয়ে দেখতে গেলাম ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’। সেও দেখে জানালো, ‘পথের পাঁচালী’ সত্যিই ভাল, কিন্তু ‘অপরাজিত’ তাকে আপ্লুত করেছে। ঠিক সেই কুণালের বন্ধুদের মত। “ওরা বলছিল সন্তানের কি কোন অধিকার নেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেবার? ছেলে কি কেবল মায়ের আঁচল ধরেই থাকবে?” সেও বলছিল বাবা দেখ কতদিন আগের বই, অথচ এখনো কি আধুনিক! সত্যিই, দুই স্রষ্টাকে প্রণাম জানিয়েছিলাম।
বইটির আরেকটি বড় অধ্যায় ‘ভুবন সোম’ সংক্রান্ত। মনে রাখতে হবে সত্যজিতের মত মৃণাল কিন্তু অত বেশী সাহিত্যকেন্দ্রিক সিনেমা করেননি। কিন্তু যে সিনেমাকে ভারতীয় সিনেমার এক বাঁক নেওয়া বলে স্বীকার করা হয় তা বাংলা সাহিত্যের এক বিখ্যাত সাহিত্যিক বনফুল বিরচিত। এটি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।
এই বইয়ে তিনি বিশদ ভাবে জানিয়েছেন এই কাহিনির প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা। কাহিনিতে শুধুই ভুবন সোমের কথা। বিপত্নীক এই আমলাটি কঠোর, নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। কাজে ত্রুটি হলে কারুকে রেয়াৎ করেন না। নিজের ছেলের ক্ষেত্রেও তিনি ক্ষমাহীন। ফলে মানুষটি বড় একলা। তাঁর পৃথিবী তাঁর অফিসঘর আর সেখানে ভর্তি ফাইল। এই সোম সাহেব একবার বেরিয়ে পড়লেন পাখি শিকারে। সেখানে গিয়ে জীবনের অন্য এক রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন, আবিষ্কার করলেন সভ্যতার বাইরে এক অন্য ভারতবর্ষকে। সেই আবিষ্কারে তাঁর সাথী হয়েছিল একটি দেহাতী মেয়ে, নাম ‘বৈদেহী’ – যাকে বিদিয়া বলেই সকলে ডাকে। এই বিদিয়া একাধারে যেন রবিঠাকুরের ‘ক্যামেলিয়ার সেই সাঁওতাল মেয়ে, সেই যে – “বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া, / সাঁওতাল মেয়ের কানে,/ কালো গালের উপর আলো করেছে।” – আবার একই সঙ্গে জীবনানন্দের বনলতা সেন, ‘কূল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’ সেই ভুবন সোমকে সে ‘দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল’।
এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে অনেক কথা হয়েছে। মৃণাল এই বইতে লিখেছেন, সত্যজিৎ রায় এই সিনেমার প্রশংসা করেও শেষে লিখেছিলেন একটি বাক্য – “Big bad bureaucrat tamed by rustic belle”! এই বাক্যটি তিনি মেনে নিতে পারেননি, খুবই লঘু মন্তব্য বলে মনে করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও দেখি ‘তৃতীয় ভুবন’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখছেন,
“আর ‘ভুবন সোম’ তো উপমারহিত। অবসিত গরিমা আমলাতন্ত্রের প্রতি এমন ঠাট্টা আমাদের ছায়াছবিতে আর নেই। পুতুলনাচের ইতিকথা যেমন গ্রাম নিয়ে লেখা কোনও উপন্যাস নয়; আদ্যন্ত শাহরিক। তেমন ভাবেই ‘ভুবন সোম’ আশিরপদনখে একটি নাগরিক সমকালীনতা প্রবর্তন করে ভারতীয় সিনেমায়। সুহাসিনী মুলে, প্রায় বনলতা সেনের মতো দেহলতা থেকে হয়ে উঠেছেন স্থির দামিনীর মতো শরীর! ভুবন সোম কোনও ট্র্যাজেডির নায়ক নয়, বরং একটি সম্ভ্রান্ত বিদূষক।”
তাই কি? মৃণালের নিজের ভাষ্য সম্পূর্ণ অন্য। তা কাহিনি রচয়িতা বনফুলের রচিত চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত।
“আমাদের এই ডাকসাইটে আমলাটিকে আমি সংশোধন করবো না।, করার প্রয়োজন দেখিনা, কারণ এই মহাশয় ব্যক্তিটির মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি এক বিশিষ্টকে। তিনি রাগী ও কটুভাষী অথচ আড়ালে আবডালে নিঃসঙ্গ ও দুখী।”
আমারও তাই মনে হয়েছে। এখানে ছবিটি এক মানবিক দলিল, কোন তন্ত্রের প্রতি বিপ্লব বা বিরোধিতা করার সে প্রয়োজন বোধ করে না। অন্য একটি প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করেছি, কিভাবে এটি সাহিত্যানুসৃত সিনেমার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে। - ২
মৃণালকে বোম্বের একটি ট্যাক্সি ড্রাইভারও বলেছিল, “ঐ একটি মেয়ের কাহিনি তো? সুন্দর ছবি। আমি দেখেছি।” আর এক ফরাসী মহিলাও তাঁকে বলেন, “একটি সহজ গ্রাম্য মেয়ের সঙ্গে এক আমলার কথাবার্তা---- একটি মনোমুগ্ধকর কাহিনি এবং ভীষণ মানবিক কাহিনি। ব্যস, ঐ পর্যন্তই।” সম্ভবত এগুলি উল্লেখ করে মৃণাল আমাদের জানাতে চাইছেন যে এই ছবিটি সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের মতামতই তাঁর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।
বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে তাঁর জীবনের ভিন্ন ভিন্ন চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমার মনে হয় এত মনিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে সারা বইটিতে, যে কোন আধুনিক বাংলা পরিচালক লাভবান হতে পারেন, তাঁর সঙ্গে এক তরুণ শিল্পনির্দেশকের আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘খারিজ’ ছবির সময় তাঁর জিজ্ঞাস্য ছিল, ঐ দম্পতির বিবাহ কি প্রেমঘটিত না বাবা – মার পছন্দ? মৃণাল কারণ জিজ্ঞেস করলে নীতিশ রায় বলেন প্রেমঘটিত বিবাহ হলে ফ্ল্যাটের সাজসজ্জা একটু বেশী ফ্যাশনেবল হওয়ার সম্ভাবনা। কি সুন্দর না? মনে হয় তিনি নিজে যেন নির্দ্বিধায় জানাচ্ছেন কিভাবে তিনি তরুণ বন্ধুদের দ্বারা শিক্ষিত হয়েছেন।
জানিনা এটি ঠিক রিভিউ হল কিনা। যে বই মুগ্ধ করে তার পাঠ প্রতিক্রিয়া এরকমই হয়। একমাত্র একটি বিষয়ে আমার খটকা আছে। সেটি জানাতে চাই।
সকলেই জানেন যে প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ নিয়ে মৃণাল সিনেমা করেছিলেন হিন্দিতে, নাম ছিল ‘খন্ডহর’। এই সিনেমার ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত জানিয়েছেন, প্রেমেন্দ্র মিত্রর সঙ্গেও আলাপচারিতার কথা রেখেছেন। কিন্তু দুজনের কথাতেই মনে হয় তাঁরা ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ অবলম্বনে পূর্ণেন্দু পত্রী কৃত আগের সিনেমাটি, ‘স্বপ্ন নিয়ে’, সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত। এটা আমার খুবই আশ্চর্য লেগেছে। সিনেমাটি বেশ কিছুদিন আগের, খুব বেশী দর্শক হয়তো দেখেননি, কিন্তু এটি একটি অন্যধারার সিনেমা ছিল যে ধরনের সিনেমার জন্য পূর্ণেন্দু খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ছবিটি ইউটিউবেও আছে। তাহলে?
অসম্ভব সুখপাঠ্য এই বইটি বাংলা চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িত সকলের জন্যই অবশ্যপাঠ্য। আমি সত্যজিৎ ও ঋত্বিকেরও কয়েকটি বই পড়েছি। সত্যজিতের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’, ‘অপুর পাঁচালী’, ‘একেই বলে স্যুটিং’, ঋত্বিকের সুরমা ঘটক প্রণীত “ঋত্বিক”, “চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরো কিছু”। এইসবগুলি চলচ্চিত্র গ্রন্থ হিসেবে বাংলা ভাষার সম্পদ। আমার মনে হয় এই বইকটি যদি কোন নবীন পরিচালক বারংবার পড়েন, বইতে যে সিনেমাগুলির কথা বলা আছে তা দেখেন, তা নিয়ে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের সঙ্গে মনে মনেই বাদানুবাদ করেন, তাহলে তাঁর পক্ষে মোটামুটি একজন সফল বাঙালী পরিচালক হয়ে ওঠা সম্ভব। প্রকৃত সিনেমাবোদ্ধারা হয়তো বলবেন এই কথা খুবই সরলীকরণ, কিন্তু এ আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা। অন্ততঃ আমার চলচ্চিত্রভাবনাকে এই বইগুলি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)
ছবিগুলি সবকটিই ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত