Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
সারোয়ার রাফি-র

লেখা


ISSN 1563-8685




প্রসঙ্গে, আকিজুদ্দিন – সাহাবুদ্দিন


।। ১ ।।

'দুপ্রের খানাডা খাইয়া লই রে—আকিজুদ্দিন।’

'এহন কয়ডা বাজে?'

'তা, চাইরটা হইবো।'

'তাইলে আরো একঘণ্টা নিজের পেটের উপ্রে বালিশ থুইয়া ল--পাঁচটা বাজলে এক্কেরে বৈকালের খানাডাও খামু--লগে দুপ্রেরটাও হইয়া যাইবো'


এমন মেঘাচ্ছন্ন দিনে সাহাবুদ্দিনের পেটের বিপরীতে কিছু সময়ের জন্যে অবস্থান নিলো আকিজুদ্দিন। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো নয় কিন্তু ওটা কোনো বিষয়ই না কারণ সাহাবুদ্দিনের পেটে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। সাধারণত তার পেটকে মনমরা থাকতে দেখা যায় না কিন্তু আজ কি হলো? একেবারে সরাসরি প্রস্তাব। আজ যেন সাহাবুদ্দিন নয় পেট নিজেই কথা বলছে আর তার বদলে জবাব আসছে আর একঘণ্টা--বিকেল পাঁচটা! আকিজুদ্দিনেরও খিদে কিন্তু আরেকটু সময় অপেক্ষা করলেতো ক্ষতি হবে না।

আকাশ কালো হয়ে উঠছে ক্রমশ! একটু পরেই শোনা যাবে ঝমঝম শব্দ! সাথে কালো হয়ে উঠছে এই মশাই মেসের জীর্ণশীর্ণ ঘরের পরিবেশও। একবার বাতি গেলেই, 'ফুট!' অন্ধকারে কাটা চাবাতে হবে দুজনকে।

'আরতো থাকন যায় না রে'--আকি জ্জা। 'চল না, খাইয়া আহি--সেই বেগার খাটলাম আইজ-অই, ল না রে!'

'আরে বেডা, যামুইতো--এইতো চাইরটা পোনেরো'--আকিজুদ্দিন কোমলমাত্রায় জবাব দেয় আর সাথে সাথে বজ্রের ধ্বনি। 'ডুম, ডুম'--যেন সব আজ ধ্বংস করে দেবে, রাগান্বিত বাতাসও বইছে চারদিকে যার ফলস্বরূপ ঘরের প্রাগৈতিহাসিক সিরামিকের জগটি পড়ে ভেঙে গেলো। বজ্রের শব্দ ও জগ ভাঙার শব্দ যেন একাকার হয়ে গেলো যেমন আজ তারা খুব জোরে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকেছে ঠিক ঐ মিশ্রিত শব্দের মতই। আর দুজনে ঢকঢক করে পানি খেয়েছিল সেই ভাঙা সিরামিকের জগ থেকে।


চারিদিকে হল্লা, ইট-পাটকেল, টিয়ারশেলের আতঙ্কিত আঘাত, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ আর জনগণের সম্মিলন--মানে এক হুলস্থূল কাণ্ড!


সাহাবুদ্দিনের দোস্ত আকিজ্জা কিংবা আকিজুদ্দিনের দোস্ত সাহাইব্বাও আজকে ইট-পাটকেল মেরেছে ঘন বর্ষণের মত আর এখন আকাশ তাদের পেটের উপর মারছে।


'চাইরটা ত্রিশ'--আইজকা কি মাইরটাই না দিলাম!

'কি কসরে সাহাইব্বা?'--নিশ্চিত এগুলো মন ভোলানোর চেষ্টা আকিজুদ্দিনের।

'হ, রে--ঐ যে ঐ, হা হা হা মোরতো পেটে খিল ধইরা আইয়ে, হেতে রে যহন মারতে গেলাম, তহন কি মিনতিনাডাই করলো--হা হা হা হো হো--এক্কেরে ভইরা দিছি আইজকা--নেতামি না? --দিছি এক্কেরে'--সাহাবুদ্দিনের পেট যেন এখন ঘুমোচ্ছে তাই মুখের এবং মুখ দিয়ে কথা বলার এ শক্তি।



।। ২ ।।

'পট!'--এবার টিনের গ্লাসটাকেও জায়গা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করলো ঘাড়ত্যাড়া বাতাস।

'এক্কেরে হাচা কতা--কাউরেই আইজকা গণি নাই। যেমনে পারছি দিছি। ব্যাটা, আমাগো উপ্রে শিনাজুরি, না-বেতন দিবো না তার উপ্রে মাইর চালাইবো। মগের মুল্লুক নাকি'--ক্রমশ উত্তেজিত আকিজুদ্দিন। তাদের কথার মাঝেও আজকে ক্ষোভ যেন কোনো ভাষণের রির্হাসাল দিচ্ছে আর দিবেই বা না কেন?তিনদিন বাদে ঈদ। আজকে মঙ্গলবার বেতন দেবার কথা সাথে বোনাসও কিন্তু না তা নাকি ঈদের পরে তাছাড়া আকিজুদ্দিন ও সাহাবুদ্দিনের ওভার নাইটের টা? সেটাও তো পাওনা!


বৃষ্টির উৎপাত ক্রমশ বাড়ছে। এতোক্ষণে যতটুকু হয়েছে তাতে পুরো শহর সম্ভবত ডুবে গেছে আর শৌখিন নৌকাচালকেরা সম্ভবত তাদের তুলে রাখা নৌকাগুলোকেও নামিয়ে ফেলেছে। সেই জলে মাছও থাকতে পারে। ড্রেন থেকে উপচে পড়া মাছ। কেউ কি বঁড়শি কিংবা জাল নিয়ে বেরিয়েছে? তবে এক হিসেবে ভালো যে, রাস্তায় পড়ে থাকা ঘটনার ইট-পাটকেল, ভাঙা বাঁশ-টাশগুলো এখন জলের তলায় সাঁতার কাটছে। তাহলে? সাহাবুদ্দিন তার পেট আর আকিজুদ্দিন তার মাথা নিয়ে ভাবে যে, আবার যদি হামলা হয় তবে তাদের অস্ত্র কি দাঁড়াবে? তারা এবার কী ছুঁড়ে মারবে?


জল? নৌকা? জাল? বঁড়শি? নাকি নিজেদের পেট ও মাথা?--সাহাবুদ্দিনের পেট ফের মোচড় দিয়ে ওঠে।

'ল না রে-যাই, পেটডাদো এহন আমারেই খাওন শুরু কইরা দিবো'--সাহাবুদ্দিন মুমূর্ষু রোগীর মত বলে ওঠে। নিস্তার নেই।

'হয়, চাইরটা একান্ন'--সারাঘর এলোমেলো তারা দুজন উঠলো আর জংধরা ছিটকিনিটা টান দিলো।


ব্যাস—জলের তোড়ে তারা সাময়িক ডুবে গেলো। চৌচির ঘর এবার প্রাণবন্ত।


'ও, বাপরে--এইগুলান কি রে আকিজ্জা? এত্তো পানি! সাঁতরাইয়া কেমনে যামু? কেমনে খামু? পেটেদো খিদা!'

'হয়, আমারো'--আকিজুদ্দিন ভাসতে ভাসতে জবাব দেয়।

'এহন কি হইবো? কইছিলাম না আগে হুনলিনা! খিদা?'

'পানি খা গামলা দিয়া, খোদা পাঠাইছে'--আকিজুদ্দিন জবাব দেয়। বাইরে আওয়াজ শোনা যায় সাথে ডুম ডুম বজ্রের শব্দ।


'এই বৃষ্টি আমাগোরে ভইরা দিছে রে-আকিজ্জা'--সাহাবুদ্দিন পেটে হাত রেখে জবাব দেয়। হাবুডুবু খায়। একটি উজ্জ্বল মাছ তার পাশে চোখ টিপ দিতে দিতে ঘোরে!



(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)