Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তীর

আরো লেখা



ISSN 1563-8685




একটি নিছক প্রেমের গল্প

ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক আর লাল স্প্যাগেটি স্ট্র্যাপ টপ পরা মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের কাছে। গরমের দুপুর। কাছে দূরে একটাও মানুষ নেই। দূর থেকে মেয়েটা দেখলো, বাইকে চড়ে একটা ছেলে তার দিকেই আসছে। ছিপছিপে চেহারার ছেলেটাকে দেখতে, যাকে বলে একদম হিরো। মুখে হালকা অগোছালো কোমল দাড়ি গোঁফ আর তাতেই ছেলেটাকে আরও সুন্দর লাগছে। মাথায় হেলমেট পরেনি----চোখ দুটো যেন এ জগতের নয়। কম করে পুরো ছ'ফিট লম্বা হবে ছেলেটা। এমন একটা ছেলের বাইকেই উঠে বসতে ইচ্ছা হল দিশার। তারপর, তার সঙ্গে এই শহর ছেড়ে আরও অনেক দূরে চলে যেতে চায় সে। খারাপ মেয়ে হলেও তারও তো একটা ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে! তবে ধান্দা করতে বেরিয়ে নিজের মন মতো পুরুষ কোনওদিন কোনও বেশ্যা আবার পেয়েছে নাকি? বাইকটা থামল, দিশার একদম কাছে।

দিশার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। ছেলেটা কি এবার তাকেই ডাকবে? বাইকে উঠতে বলবে? না না, ছেলেটাকে তেমন মনে হচ্ছে না। চোখ দুটোতে এতটুকু কামনার ছোঁয়া নেই। এমন উদাসী দুটো চোখই খুঁজে চলেছে সে কতোদিন ধরে! ছেলেটা এক পলক তাকাল তার দিকে, তারপর কাছে এসে চাপা গলায় বলল,

'যাবে?' দিশা একটা হার্টবিট মিস করলো। তার পা কেঁপে উঠল। সত্যিই ছেলেটা তাকেই ডাকছে? আজ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ভুল সঙ্কেত দিয়েছে, ভাবল দিশা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে, বাইকের পিলিয়নে উঠে বসল।

বাইকে উঠে, প্রতিবারই কাস্টমারদের পিঠ জড়িয়ে বসে দিশা। শরীরে ছোঁয়া পেতেই চায় সবাই। যাকে বলে একেবারে মুখিয়ে থাকে। মুখটা তাদের পিঠের পিছনে গুঁজে সপাটে শরীর জড়িয়ে রাখে সে। এমনই দস্তুর। লাইনের ট্রেনিং। লাইনের মেয়েরা বলে, এতে প্রথম থেকেই, কবুতর একদম ঘায়েল হয়ে যায়। বাইকে উঠে ছেলেটার পিঠ জড়িয়ে বসতে হঠাৎ কেমন লজ্জা করে উঠলো দিশার। সে একটা গন্ধ পাচ্ছে। ঘাম আর সিগারেটের নিকোটিন মিশ্রিত পুরুষালী গন্ধ। দিশা প্রাণ ভরে গন্ধটা নিল। ভালোলাগছে তার। এ এক নতুন মুগ্ধতার অনুভূতি। এমনটা এতদিনে একবারও হয়নি তার।

ছেলেটা একেবারে গম্ভীর। খারাপ মেয়ে বলে, তাকে ঘেন্না করছে? তা করতেই পারে। সে ঘেন্নারই যোগ্য। তবে নিজেই যেচে এসে তাকে বাইকে তুলেছে কেন? দিশা মুখে একটা অবজ্ঞার ভঙ্গি করল। তারপর সহজ হতে সামান্য এগিয়ে বসল ছেলেটার দিকে। মুখে বলল,

আমার বাইকে উঠলে ভয় করে। বড্ড মাথা ঘোরে। ছেলেটার শরীর শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। কঠিন গলায় বলল,

'সরে বোসো। আমার জন্য তোমাকে নিতে আসিনি।'

'তো?'

'আছে একজন। আমার বস্। ভালো কাজ করলে, তোমার নম্বর নিয়ে রাখব ওনার জন্যে। মাঝে মাঝেই ডাকবো। দিশা হঠাৎ রেগে গেল। ঝাঁঝিয়ে উঠল,

'তাহলে তুমি দালাল! মেয়ে মানুষের দালাল?'

ছেলেটার শরীর আরও শক্ত হয়ে গেল। কথা বলল না। দিশা বলল,

'নাম বলবে না তোমার?'

'আমার নাম দিয়ে কী করবে?' মেয়েটা হাসল, ছেলেটাকে বলল,

ভয় পাচ্ছ বুঝি? আমি কিন্তু সত্যি নাম বলি। ফলস্ দিই না। আমার নাম দিশা আর এটাই আমার পেশা। ফলস্ দিয়ে কী হবে। আমার কোনও পিছুটান নেই। রাখঢাকও নেই। বদনামের ভয়ও করি না। ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়ে যেখানে এসে উঠেছিলাম, সেখানে দেখেছি এটাই সবার জীবিকা। আমাকে বড় করেছেন যিনি, মানে, আমি তাকে মা বলি। তারও পেশা এই। দিশা মিথ্যে না বলে পারল না। কে যেন গলা টিপে ধরলো তার। নিজের মা-ই যে একজন প্রস্ বলতে পারল না সে। আরও কথা বলে যায় দিশা। ছেলেটা মনোযোগ দিচ্ছে নাকি, কে জানে? তবুও কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলে সে,

'আমি কলেজে পড়তাম একবছর আগে। ছেড়ে দিয়েছি এখন। মায়ের ক্যানসার। টাকার দরকার।' ছেলেটা কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। সে বাধ্য হয়ে এমন করছে, যেন এ কথা বলতে চাইল সে ছেলেটাকে। এরমধ্যে অবশ্য কিছুটা সত্যি আছে। এই মুহূর্তে বাইকের সিটে বসে ভেতরে কেমন একটা কষ্ট পায় সে। কষ্টটা ঘুরপাক খায় তার বুকের ভেতর। জ্বালা ধরায়।

অনেকটা পথ পেরিয়ে যায় ওরা। দিশা জানে কাস্টমাররা অনেক সময় ঝামেলার ভয়ে, অনেক দূর থেকে মেয়ে আনতে চায়। নিজেরাও বেশ দূরে কোথাও ভাড়া কোনও বাড়ি বা ফ্ল্যাটেই মেয়ে আনে। এমন কিছুই হবে। ফুলবাগান ক্রসিং পেরিয়ে একটু এগিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ল তারা। বাইকটা একটা একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। দিশার দিকে তাকিয়ে, করুণ ভাবে অল্প হাসল ছেলেটা। বলল,

'ভেতরে যাও।' ছেলেটার করুণ হাসিটা মনের ভেতর গেঁথে গেল, দিশার।

'পার্টি কেমন?' প্রশ্ন করে সে।

ছেলেটা বাইক চালিয়ে চলে যায়, কথার উত্তর দেয় না। বাইকটা ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার সময় শুধু বলল,

'ফেরার সময় হলে, আবার আমি আসব। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। পার্টিকে বেশি করে সময় দিও, ফেরার চিন্তা কোরো না।'

দিশার মন কেমন করে ওঠে। সে অন্যমনস্কভাবে সামনে পা বাড়ায়।

মধ্যবয়স্ক একটা লোক, অদ্ভুত তার শখ। সারাদিনের জন্য কেবল তার সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। সেজন্য অবশ্য অনেক দাম পাবে সে। দিশা যদি রাজি থাকে, একেবারে রাতে এখান থেকে ছুটি পাবে সে। টাকার খুব দরকার দিশার। মায়ের কেমোথেরাপী চলছে। এক এক সিটিং এ অনেক খরচ। দিশা ভাবতে থাকে।


দুই

আজও সেই মেয়েটা! মেয়েটাকে প্রথমবার এক সন্ধ্যায় শ্যামবাজার মেট্রোর কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিল অর্কজ্যোতি। দেখার পরই ওর মুখটা খুব চেনা চেনা লেগেছিল সেদিন। বেশ চড়া মেকআপ ও স্বল্পবাস মেয়েটি, হয়ত একজন এসকর্ট। কিংবা হয়ত নয়। কোনও এক অজানা কারণে মেয়েটি সম্পর্কে দ্বিতীয় কথাটাই অর্কজ্যোতির বেশি বিশ্বাস করতে মন চাইছে। কারণ এমন সাজ পোশাক এখন কলকাতার আল্ট্রামডার্ন মেয়েরাও করে থাকে। তারপর আশ্চর্যভাবে দুদিন মেয়েটাকে কলকাতার দুদিকে আবার দেখতে পেয়েছিল সে। মেয়েটার বয়স অল্প। রোগাটে গড়ন। চোখেমুখে একটা কেমন যেন অদ্ভুত বিষণ্ণতা মাখা আছে মেয়েটার এবং এটাই ওকে একধরনের বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। বলতে গেলে এইজন্যই অর্কজ্যোতির ওকে ভালো লাগছে। কিন্তু মেয়েটা কলকাতার সর্বত্র এমন ঘুরে বেড়ায় কেন? কী দরকার ওর? একটা কলেজপড়ুয়া মেয়ে দিবারাত্রি রাস্তায়ই বা থাকে কেন? দেখে তো ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে! তারপরেই একটা ছেলেমানুষি কাজ করে ফেলেছে সে। কী এক অমোঘ আকর্ষণে সে মেয়েটাকে ফলো করা শুরু করেছে। তবে আশ্চর্যভাবে কিছুদিনের মধ্যে এমন পরিস্থিতি হয়ে গেল যে এখন মেয়েটাকেই তার ভীষণ দরকার! কত মিরাকেল আজও ঘটে যায়! এই কয়েকদিনেই সে মেয়েটার সম্পর্কে অনেক তথ্যও সংগ্রহ করে ফেলেছে। সবথেকে যে তথ্য তাকে ভীষণ আঘাত করেছে, তা হলো মেয়েটা সত্যিই একজন এসকর্ট। এখন যে এই ফলো করা, তা নিজের পেশার কারণেই। বুকের ভেতর একটা কষ্ট দলা পাকায় তার মেয়েটাকে দেখলেই, তবুও এই কাজটা তাকে করে যেতেই হচ্ছে। এর থেকে তার নিস্তার নেই।

ছোট থেকেই একা মায়ের কাছে থাকে সে। বড় হয়েছে, উত্তর শহরতলির একটা আবাসনে। আত্মীয় পরিজন কাউকে দেখেনি সে ছোট থেকে। ছেলেটাকে যা সে বলেছে, তা সত্যি নয়। তবে আংশিক সত্যি। ছোট থেকে সে জানে, তার বাবা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, বর্ধমানে থাকেন। শুনেছিল, বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার ছোটবেলায়। একদিন দুপুরে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এল মায়ের নামে। মা বাড়ি ছিলেন না। মোটা খামটা খুলতেই অজস্র ছবি। মায়ের কুৎসিত এক অতীত এসে সামনে দাঁড়ালো দিশার। সেখানে ছবি আছে বাবারও। বাবা ছাড়াও অন্ততঃ আটটি পুরুষের সঙ্গে ছবি দেখলো দিশা। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে।

বেশ্যার মেয়ে সে? গণিত অনার্স নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারী কলেজে সবে একবছর আগে ভর্তি হয়েছে দিশা। অঙ্ক তার প্রিয় বিষয়। হঠাৎ করে তার জীবনের দিশা যেন হারিয়ে গেছে। স্তব্ধ দুপুরবেলা। তার হঠাৎ ভীষণ বমি পেল। কাঁদতে কাঁদতে বেসিনে গিয়ে বমি করে ফেললো দিশা। চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে তার। খামটা মায়ের খাটেই রেখে দিল। তার বন্ধু ব্রতীদের বাড়ি কাছেই। দুজনেই অঙ্কে অনার্স করছে, তবে কলেজ আলাদা। মাঝে মাঝে যায় সে ব্রতীদের বাড়ি। নিজের বাড়িটাকে দিশার এখন মনে হচ্ছে, তপ্ত এক ফার্নেস। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। ব্রতীরা গরীব। টাকা পয়সার অভাব থাকলেও, স্বচ্ছতা আছে সব কিছুতে। ব্রতীর মা তাকে খুব আদর করেন। বলেন,

'তুমি এত রোগা কেন দিশা?'

গেলেই জোর করে ভাত খাওয়ান মাসিমা। মাসিমার সামনে আসতেই চোখ থেকে অনর্গল জল পড়তে লাগলো দিশার। মিথ্যে! সবটা মিথ্যে তার জীবন। এই কলঙ্কময় অতীত নিয়ে সে কোথায় দাঁড়াবে? মাসিমা কিছু জানতে চাইলেন না। কেন কাঁদছে সে জিজ্ঞাসাও করলেন না। দিশা শান্তি পেল খানিকটা। ব্রতী আর তার দিদিকে ওই ঘর থেকে বের করে দিলেন। বললেন,

'কেঁদে যদি নিজেকে হালকা মনে হয়, তবে না হয় কাঁদো।'

না আর কাঁদবে না দিশা। তার সমস্ত শরীর থেকে আগুন বের হচ্ছে। রাত হতে, সে অবশেষে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছবিগুলো ছুঁড়ে দিল মায়ের দিকে। মা ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ মনে হয় নিজেকে গুছিয়ে নিল খানিকটা বললো,

'বিশ্বাস কর, আমি এসবের কিছু জানি না। আমাকে কেউ ফাঁসাচ্ছে।'

'তাহলে ছবিগুলো কি মিথ্যে মা? মা কিছক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর ভারী গলায় বলল,

'আমি আগে ব্ল্যাকমেইল করতাম। ওটাই আমার জীবিকা ছিল। একটা বড় দলের এজেন্ট হয়ে কাজ করতাম। আমার কাজ ছিল সারা ভারত জুড়ে। ছবিগুলো এখানে আমার শত্রুরা পাঠিয়েছে। এই লাইনে এমন হয়। অনেক দূরে পালিয়ে এসেও কিছুতেই নিস্তার পেলাম না।'

'তুমি ওই এতগুলো লোকের সঙ্গে শুয়েছিলে মা! তুমি একজন প্রস্টিটিউট?' মা সজোরে চড় মেরেছিলেন দিশার গালে। দিশা এখন জানে তার বাবা এখনও জানেই না, যে দিশা তার মেয়ে! সে বিখ্যাত বাঁড়ুজ্জে বাড়ির মেয়ে। দিশা ব্যানার্জী। কয়েকদিন পর দিশাদের বাড়ির সামনে একটা বিরাট সেডান গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে একজন মোটা মাড়োয়ারী ভদ্রলোক নেমে এল। তার পরনে সাফারি স্যুট। লোকটা নির্দ্বিধায় থপথপ করে তাদের ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় জমিয়ে বসল আর একদৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।


তিন

ঘটনার কয়েকদিন পর, কলেজের বাস স্টপে বাসের আশায় দাঁড়িয়েছিল দিশা। সেই সেডান গাড়িটা এসে থামল তার সামনে। মাড়োয়ারী লোকটা দরজা খুলে ডাকলেন তাকে,

'যায়েগি? দিশা নাম হ্যায় না তেরা?' দিশা পিচিক করে একদলা থুতু ফেলল, রাস্তায়। তারপর গাড়িতে উঠে এল। সে জানে তাকে যেতেই হবে। তার সামনে এগিয়ে চলার রাস্তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। গাড়িটা একটা বিলাসবহুল হোটেলে নিয়ে এল তাকে। একটা অফিস ঘর আছে দোতলায়। সেখানে যিনি বসেছিলেন, তিনি একসময় তার মায়েরও বস্ ছিলেন। নাম জয়জিৎ কাপূর। এখন থেকে তারও বস্ হবেন। ভদ্রলোক পাঞ্জাবী, কিন্তু দারুন বাংলা বলেন। বয়স অনেক হয়েছে, তবে এত গ্ল্যামার বোঝাই যায় না, বয়স কত! অনেকটা সিনেমায় দেখা কবীর বেদীর মতো দেখতে লোকটাকে। কাপূর বললেন,

'আমাদের হাত অনেক লম্বা। পালানো যাবে না। প্রস্টিটিউসান এখন পুরোমাত্রায় কর্পোরেট ব্যবসা। আমি এই ব্যবসায় অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি। আমাকে টাকা তুলে তো নিতেই হবে, তা সে যেভাবেই হোক না কেন। বয়সে তুমি আমার মেয়ের মতো। এই লাইনে বাপ মেয়ের সেন্টিমেন্ট নেই। এখানে বাপও মেয়েকে খায়। কথার শেষে হা হা করে হাসলেন জয়জিৎ।

আমাদের কাজ করলেই, ব্যাঙ্কে ফটাফট ক্যাশ। বাকি সময় এক্সট্রা করলেও কিছু বলবো না। না হলে, জান, মান কিছুই থাকবে না। বাড়িতে গিয়ে সেদিন বুঝিয়ে এলাম এত করে। তোমার মা শুনতেই চাইছে না। আরে আমরা তো কবে থেকে ওর বাড়ি কোথায় জানি! আমাদের কাছ থেকে পালানো এত সহজ নাকি? তুমি স্মার্ট। দেখতে সুন্দর। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই তো ডেকে পাঠালাম! আজকে আমিই তোমার ফার্স্ট মেহেমান! আমাকে খুশি করে দাও!' লোকটা হাসছে। তার মুখ থেকে উগ্র মদের গন্ধ আসছে।

সেইরাতে তাকে নিয়ে, দীঘা চলে গেল লোকটা। অনেক টাকা দিয়েছিল তাকে। সেই শুরু। মা জানত না, তখনও। কলেজ থেকে সে বাড়ি ফেরেনি বলে, তার মা থানা পুলিশও করেছিল। সে কথা জানতে পেরে জয়জিতের লোকেরা তাদের বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল মাকে। তার মেয়ে পার্টি নিয়ে বাইরে গেছে। মা মনে নিতে পারেনি। কেঁদেছিল হাউহাউ করে। তারপর এইখানে আসতে যেতে আরও অনেক মেয়েদের চিনেছে দিশা। মাঝে মাঝে পার্টির ছবি তোলে, সে। তাকে যেমন নির্দেশ দেওয়া হয়, বা বলা হয়। মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে ভিডিও করতে হয়। টাকা আসতে লাগল হু হু করে।

কেবল তার মা দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছিল। মেয়ের এই জীবন মেনে নিতে পারেনি কিছুতেই। মাকে ক্ষমা করে দিয়েছে দিশা। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। সংসার খরচ বেড়ে গেল অনেক। আজ তাই এক্সট্রা আয়ের আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল দিশা। এখন এমন করছে সে অনেকদিন ধরে। তার এখন টাকার খুব দরকার। পড়াশুনো আর হলো না তার। একটা সহজ সুন্দর জীবন থেকে, কিছু মানুষ তাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছে, নরকের অন্ধকারে।


চার

পুরো পাঁচ হাজার লাগবে ঘন্টায়। দিশা মোবাইলে টাইম দেখতে দেখতে বলল। মধ্য পঞ্চাশের লোকটা বিছানায় আধশোয়া। টেবিলের উপর মদের খালি গ্লাস পড়ে আছে। লোকটার হাতে একটা দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট জ্বলছে, অনামিকায় ওয়ান পিস ডায়মন্ডের আংটি থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। বিদেশি তামাকের হালকা সুগন্ধ বাতাসে। খাটের উপর একটা ভদকার খালি বোতল পড়ে আছে। লোকটার চোখ দুটো দেখে দিশা বুঝল, লোকটার ভয়ানক নেশা হয়েছে। পার্টি কেমন কে জানে! পরে টাকা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। এমনিতেই সে রেট বেশ বেশিই চেয়েছে। দিশা বলল,

'আমাকে এ্যাডভান্স দেবেন। টাইমটা দেখে নিন।' লোকটা হাসল হা হা করে।

'টাইম?' বলে আবার হাসি।

'ঘণ্টায় তো মোটে পাঁচ চাইছো! যদি ঘণ্টায় এর ডবল্ দিই?' তোষকের নিচ থেকে একমুঠো নোট দিশার হাতে ধরিয়ে দিল। সবগুলোই দুহাজারের নোট। মদ ফুরিয়ে গেছে, বলতে বলতে লোকটা কাঁপা হাতে কাকে যেন ডায়াল করল। দিশার দিকে তাকিয়ে হাসল মাতালের মতো। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। পেটে টায়ারের মতো ফ্যাট দুলছে। টাকাগুলো নাচিয়ে বলল,

'এতে চলবে? না আরও দেব?' লোকটার স্বর জড়ানো। তারপর দিশাকে খাটের দিকে ইশারা করলো। দিশা খাটের কাছে আসতেই লোকটা তাকে টেনে বুকের কাছে নিয়ে এসে ঠেসে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে গুঁজে দিল ওর খসখসে পুরু ঠোঁটদুটো। উৎকট মদের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল দিশার।

হ্যাঁ। তার অভ্যাস হয়নি। এখনও তার মদের গন্ধে ভীষণ বমি পায়। কান্নাও পায়। দিশার বাইকের ছেলেটার মুখটা একবার মনে পড়ল। কেন? সে জানে না। বুকের ভেতরটা হঠাৎ হু হু করে উঠল তার। চোখের কোণদুটো জলে ভরে গেল। লোকটা তার ভেজা চোখ দুটোও ঠোঁট দিয়ে চেটে নিতে লাগল।

তারপর হালকা ধাক্কা দিয়ে দিশাকে বিছানায় ফেলে দিল। মুহূর্তে তার গা থেকে লাল রঙের টপটা খুলে নিয়েছে। সরু স্ট্র্যাপ দুটোর বাঁধন খুলতেই টপটা আপনাআপনি খসে পড়েছে দিশার শরীর থেকে। তার উপর চড়ে বসার আগেই হঠাৎ বিছানার উপরেই হড়হড় করে বমি করে ফেলল লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠে বসেছে দিশা। বিকট দুর্গন্ধ! লোকটা বমি করেই বেহুঁশ হয়ে গেছে। কিছু হয়েছে নাকি কে বলবে? দিশা নিজের গুটানো পাকানো টপটা পরতে যায় তাড়াতাড়ি। টপটা লোকটার বারমুডার সঙ্গে গুটিয়ে পাকিয়ে খাটের এককোণায় পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে বাইকের সেই ছেলেটা ঢুকে পড়েছে তখন। হাতে একটা মদের বোতল। ওকেই লোকটা ফোন করে ডেকেছিল তাহলে!

তাড়াতাড়িতে দিশার হাতে টপটা জড়িয়ে যায়। দিশার মুখ আশ্চর্যভাবে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। পুরুষ দেখলে তার এতদিন একটুও লজ্জা হতো না। পুরুষদের সে ঘেন্না করত এতদিন। সব পুরুষকেই তার জন্তু ছাড়া আর কিছু মনে হত না। ছেলেটা তাকে না দেখার ভান করে, অন্যদিকে তাকায়। তা দেখে দিশার ভালো লাগে। পুরুষের লোলুপতা দেখেই সে অভ্যস্ত। দিশাকে ঘরের বাইরে ডাকে, ছেলেটা।

'ও এখন ঘুমাবে। তুমি টাকা পেয়ে গেছ তো?'

'হ্যাঁ। দিশা টাকাগুলো দেখাল।'

'চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। একটু চা খাবে?'

'এখানে?'

'হ্যাঁ আমি বানিয়ে দেব। এই কিচেনে কী কী কোথায় আছে স-ব আমি জানি।'

'বানাও।' দিশা গালে টোল ফেলে হাসল। বলল,

'চা খেতে পারি, যদি নাম বলো, তবে।'

'আমার নাম এখন বলতে পারবো না। আমি কিছু রেকর্ড নিতে এই লোকটার সঙ্গে আছি বেশ কিছুদিন। আমি একজন সিআইডি অফিসার। অবশ্য এখন পরিচয় ওঁর বিশ্বস্ত ড্রাইভার। তোমাকে আমি চিনি। তোমার সব হিস্ট্রিও জানি। আমাদের অনেক খবর জানতে হয়। আজ সকাল থেকে আমি তোমাকে ফলো করছিলাম। অবশ্য শুধু আজ নয়, অনেকদিন ধরেই তোমাকে ফলো করছি। সবটা কিন্তু শুধু এই কেসের স্বার্থে নয়!'

'মানে?’

ছেলেটা হাসছে। হাসি দেখে দিশার বুক ঢিপঢিপ করে ওঠে। ছেলেটা বলে চলে,

'মানে আজ সকালে প্রথমে যখন আরজিকর থেকে বের হলে তখন থেকে তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছি। অবশ্য এর আগে বহুবার বহুদিন--আমি যা জেনেছি এতদিনে তা মোটামুটি শর্টে বলছি, তোমার মা এখন আরজিকর-এর ইমার্জেন্সীতে ফিমেল ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। ওঁর গলায় ক্যানসার হয়েছে। তুমি বাধ্য হয়ে কিছুদিন ধরে এসকর্টের কাজ করছো। তোমার বস্ কাপুরের বস্ও হলেন ইনি। মানে এই লোকটা।

এর নাম অনিল মেহেতা। অনিলবাবুর কাপুরের মতো এমন অনেক সাব এজেন্ট আছে। এদের সংস্থা ব্ল্যাকমেইল করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। তার সঙ্গে এদের আছে নারী পাচার ও এসকর্টের ব্যবসা। তোমাকে আজ থেকে এই নোংরা কাজ আর করতে হবে না। আজ সকালে মিঃ কাপুরও গ্রেফতার হয়েছেন। মেহতাকেও আজকের কিছু ভিডিও ক্লীপিংস দেখিয়ে, আমরা কথা আদায় করে নেব। তবে ওকে গ্রেফতার করা বোধহয় যাবে না। এদের হাত খুব লম্বা হয়। দেখি কতটা কী করা যায়! আমি চেষ্টা করব। এই কাজটা একটা বড় প্রজেক্ট। দিল্লীর সিবিআই আর রাজ্যের গোয়েন্দা দফতর একসঙ্গে কাজ করছে। সারাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে এদের ব্যবসা।'

দিশাকে নিয়ে বাড়ির দিকে বাইকটা এগিয়ে এসেছে। ঠিকানা বলতে হয়নি, দিশা দেখল, ছেলেটা আগে থেকেই সবই জানে। দিশার বারবার জল আসছিল চোখে। সে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিল। আজ থেকে সে মুক্ত। সত্যিই মুক্ত? ছেলেটা রিয়ার গ্লাসে তাকে দেখেছে। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে এগিয়ে দিল দিশার দিকে। বলল,

চোখ মুছে নাও। হাসল সামান্য। আমার নামের ফার্স্ট লেটারটা আছে ওটাতে। রেখে দাও। আবার দেখা হলে চেয়ে নেব। দিশা দেখলো রুমালের এক কোণায় 'এ' লেখা আছে।

বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে দিশাকে। বাইকটা ঘুরিয়ে নিয়ে, চলে যাওয়ার আগে একবার থামল।

'আমার নামটা তোমাকে বলেই যাই। তুমি জানতে চেয়েছিলে! আমি অর্কজ্যোতি সেন। সিআইডি অফিসার। আমার তোমাকে ভালোলেগেছে। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। বোধহয় সব প্রশ্নের সবসময় উত্তর হয় না। যদি তোমারও মত থাকে, একবার আমার মা বাবাকে তোমাদের বাড়িতে আনব। আজ রাতে তোমাকে একবার ফোন করব। তখন তোমার মত আছে কিনা আমাকে জানিয়ে দিও। লজ্জা করলে শুধু ফোন তুলে বলবে, হ্যাঁ কিংবা না। আই য়োন্ট মাইন্ড।'

বাইকটা ঝড়ের মতো সামনে থেকে বেরিয়ে যেতেই দিশার মনটা হঠাৎ বৃষ্টির পরের ভেজা মাটির মতো নরম হয়ে গেল। সে ছেলেটা চলে যেতে নীরবে খানিকটা কাঁদল, তবে এই অশ্রু বিষাদের নয়।




(পরবাস-৭৪, ৩১ মার্চ ২০১৯)