ISSN 1563-8685




নিদ্রারসের বাঙালিয়ানা

শিরোনাম পড়েই শিউরে উঠবেন পাঠকবর্গ। তবে ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমি এই রসটির উদ্ভাবক নই। এর উল্লেখ কিন্তু সেই ঋষিতুল্য আলখাল্লার কবিতাতেই আছে, কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গের সঙ্গেই। সেই যে,

“তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা, মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান”
হোক ব্যঙ্গ, ভারী চমৎকার ছবিটি কিন্তু।

                  

ঘুমের প্রতি আকর্ষণ আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমাদের গানে দেখা যায়, ‘ঘুমঘুম চাঁদ’ — আহা! আচ্ছা, রাতের আকাশের চাঁদ আমাদের খুব প্রিয়, কিন্তু তারও ঘুমন্ত মূর্তির কথা আর কে ভাবতে পারবে, বাঙালী গীতিকার ছাড়া?‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত’,--‘সন্ধ্যা কণ্ঠে, সুচিত্রা ওষ্ঠে’ গানখানি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।ওগো মায়া ভরা রাত (আর) ওগো মায়াবিনী চাঁদ— এ এক অপার্থিব সমন্বয়।

আবার ভাবুন, “মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর নমনম-” কি চমৎকার প্রণামের ভঙ্গী। “শিয়রে বসে চুপিচুপি / চুমিলে নয়ন / মোর বিকশিল আবেশে তনু / নীপসম নিরুপম / — বড্ড সুন্দর, তুলনাহীন, সত্যি, “নিরুপম”

একটি সরস গল্পে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ঘুমের অমোঘ শক্তির বর্ণনা করেছেন, বলেছেন, সেটি নাকি ‘বাতের মহৌষধ’। এই গল্পের মুখ্য চরিত্র পরেশ একটি বাতের ওষুধ বানিয়ে, মানে যাকে বলে ‘আবিষ্কার করে’ তার শ্বশুর, রিটায়ার্ড সাব জজের কাছে পাঠালো। পাঠালো কিন্তু নিজের নাম গোপন করে, বন্ধুর নাম করে। আশা যদি শ্বশুর মশাই একটি সার্টিফিকেট দেন, বিক্রির পক্ষে খুব সুবিধে হবে। এ সেই সময়ের কথা যখন সাব জজদের ও লোকে বেশ খাতির করতো। প্রত্যুত্তরে সার্টিফিকেট তো এল, কিন্তু তার সঙ্গে এল একটি তীব্র তিরস্কার পত্র! শ্বশুরমশায় লিখেছেন যে, ওষুধটি কোন কাজের নয় এবং জামাতা বাবাজি যেন এইরকম বন্ধুর সংসর্গ খুব তাড়াতাড়ি ত্যাগ করে। নাহলে তার বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। এর ওপর আবার শ্বশুর মশাই আবদার করলেন, তিনি শাশুড়িকে নিয়ে স্বাস্থ্যোদ্ধারে যাবেন। শাশুড়ি ও তাঁর, দুজনেরই শরীর খুব খারাপ। তাঁর জন্য একটি কর্মঠ চাকরের যদি ব্যবস্থা করেন জামাতা বাবাজি, খুব উপকার হয়। একে তিরস্কার তার ওপর চাকরের বায়না, -- পরেশ একেবারে জ্বলে উঠলো। তারপর তার নিজের চাকর, রামকানাইয়ের দিকে চোখ গেল। চাকরটি ভীষণ ঘুমকাতুরে, কুঁড়ের বাদশা। বাবুর চাকরের সন্ধান শুনে সে বলল, তার দাদা আছে। তাকে বাবু যদি নেন! “পরেশ কপালে চোখ তুলিল,” তোমার দাদা, তিনি বছরে কদিন চোখ খোলেন?” যাহোক কিছুটা নিরুপায় হয়ে, কিছুটা প্রতিশোধ স্পৃহায় সেই দাদাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হল। পরেশ অবশ্য হাল ছাড়লো না, আরো ক-বোতল ওষুধ তার সঙ্গে শ্বশুরকে পাঠালো, জানালো, সবুরে মেওয়া ফলে। একটু বেশীদিনের প্রয়োগে নাকি অব্যর্থ ফল অবশ্যম্ভাবী।

বেশ কিছুদিন পরে শ্বশুরের চিঠি এল, সত্যিই অভূতপূর্ব ফল দিয়েছে। কিন্তু তার কারণ সম্পর্কে শ্বশুর মশাই সন্দিহান, ওষুধের গুণ না চাকরের? রামকানাইয়ের দাদা শুধু খাওয়ার সময় ছাড়া সব সময় ঘুমিয়ে থাকত। কাজেই শ্বশুর মশাইকে নিজের সেবা, স্ত্রীর সেবা, এমনকি সেই ভৃত্যের সেবা অবধি করতে হয়েছে। ফল অনির্বচনীয় — তাঁর নিজের ভাষায়, “ছাত্রজীবনে যে দৈহিক পরিশ্রম করিতে পারিতাম, এখন সেই শক্তি প্রায় ফিরিয়া পাইয়াছি।” ঘুমের এই মহাশক্তির কথা কে জানতো?





      

পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পে করণিক শ্যামনগরের বরদা মুখুজ্জে দুটোর সময়ে আফিম খেতেন। ঘুমিয়ে থাকতেন আড়াইতে থেকে সাড়ে চারটে। আর সে কি ঘুমের বাহার — ‘নড়ন চড়ন নেই, নাক-ডাকা নেই, ঘাড় একটু ঝুঁকল না, লেজার টোটালের জায়গায় হাতের কলমটি ঠিক ধরা আছে। দূর থেকে দেখলে কে বলবে খুড়ো ঘুমোচ্ছে’। একবার ম্যাকেঞ্জি সাহেব এসে তাঁর কাছে বেশ নিরীক্ষণ করে চিমটি কাটলেন। খুড়ো সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন, ‘সাঁইত্রিশের সাত নাবে তিনে- কত্তি তিন’। মুগ্ধ, উদার সাহেব এক কাপ চা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

আর সুরসিক তারাপদর গল্পের এক চরিত্র অফিসে আঘাত নিয়ে এলে সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করাতে তিনি উত্তর দিলেন— ‘ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছিলেন’ — সহকর্মীরা হতভম্ব, “আপনি বাড়ীতেও ঘুমোন?”

আর আমাদের জীবনে কৈশোর কালে যে ঘুম খুব প্রিয় ছিল তা হল পরীক্ষার সময়। উফফ, চোখ পুরো জড়িয়ে আসত কিনা — পরীক্ষার আগেই! পরীক্ষার জন্য একটু ছুটি পাওয়া যেত — আর সেই সুযোগে, দুপুরে ভাত খেয়ে বইটি হাতে নিলেই — ব্যস। আর বাঙালী কেন, বিদেশীরাও এর আকর্ষণ এড়াতে পারেনা না। “Siesta” কথাটির অর্থ সেই ঘুম যা আসে দুপুর বেলা, অর্থাৎ সকাল শুরু হওয়ার পর ঘণ্টা ছয়েক (six এসেছে ‘siest’ থেকে) পর এই সুখনিদ্রার আবির্ভাব। এই দুপুরের ঘুমের এক অনবদ্য বিবরণ পাওয়া যায় অক্ষয় বড়ালের ‘মধ্যাহ্নে’ কবিতায়,—

“নিঝুম মধ্যাহ্নকাল অলস স্বপনজাল
রচিতেছি আনমনে নীরবে বসিয়া।
দূর মাঠ পানে চেয়ে,
চেয়ে চেয়ে শুধু চেয়ে রয়েছি পড়িয়া।
হৃদয় এলায়ে পড়ে, যেন কী স্বপন ভরে
মুদে আসে আঁখিপাতা যেন কী আরামে।”

কি অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনা! নদীকূলে বসে থাকা কবির সেই অলস মুহূর্তের এক অনবদ্য ছবি। আসলে ঘুমিয়ে পড়লে তো হয়েই গেল, কিন্তু তার আগের সেই স্বপ্নিল মুহূর্ত, —“মুদে আসে আঁখিপাতা যেন কী আরামে” — আহা, আহা! রাত্রিকালীন ঘুম তো আবশ্যিক, কিন্তু “দ্বিপ্রাহরিক ঘুম” — আসলে যে ঠিক প্রয়োজন তা নয়, একবারে “উচ্চ দরের কাব্যকলা”!

বাঙালীর দুর্গাপুজো শুরু হয় মহালয়া দিয়ে। আমাদের ছোটবেলা ছিল সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। সেসময় ভোরবেলা উঠে রেডিওতে মহালয়া শোনার আলাদা আকর্ষণ ছিল। তখন এত টেপ বা রেডিও চ্যানেল বা সিডির প্রচলন ছিল না, কাজেই ঐ দিন, ঐ সময়ের আলাদা তাৎপর্য ছিল। তখন বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, আর বীরেন ভদ্রর মন্দ্রমধুর গলার স্তোত্রপাঠ, “আজ দেবীপক্ষের প্রাক্‌প্রত্যূষে জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-‌বার্তা আকাশে-‌বাতাসে বিঘোষিত.‌.‌.‌' শুনলেই অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগে। তার সঙ্গে সেই সব অনবদ্য গান। কিন্তু আমাদের ছোটদের মাঝে মাঝে চোখ জুড়িয়ে আসত, ভোরে ওঠার অভ্যাস না থাকার দরুন। কিন্তু আবার চোখ খুলে যেত, তখন শোনা যাচ্ছে, ‘বেজে উঠল শঙ্খ ---” হাল্কা করে কোন একটি গান, হয়তো ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ বা ‘তব অচিন্ত্য, রূপ মাধুরী’ -- আবার আমরা ভেসে যেতাম ঘুমের জগতে। কি মধুর সে ঘুম, যে না উপভোগ করেছে তাকে লিখে বোঝানো যাবে না। “শুধু যাওয়া আসা, শুধু (ঘুমের) স্রোতে ভাসা”!! তবে হ্যাঁ, দ্বিজেন যখন — ‘জাগো, তুমি জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী, অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো’ বলে হাঁক দিতেন, আমরা চোখ, মুখ ঘসে উঠে পড়তুম। বড্ড মধুর ছিল সেইসব দিনগুলো।

আর কবিগুরু নিজে যতই আমাদের “নিদ্রারসে ভরা” বলে গালাগাল করুন না কেন, তিনিই কিন্তু এক অপূর্ব সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন, “দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া / ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ!” কবিতাটি মনোহরণ করেছিল পঙ্কজ কুমার মল্লিকের, নিজেই সুর করে শুনিয়েছিলেন কবিগুরুকে। ‘ডাক্তার’ ছবির জন্য গানটি ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে। সানন্দ অনুমতি তো দিয়েই ছিলেন, এমনকি একটু আধটু পালটেও দিয়েছিলেন গানের শব্দ — পঙ্কজ নিজেই জানিয়েছেন তাঁর “আমার যুগ, আমার গান’ আত্মজীবনীতে —

ছিল — “ফুলের বার নাইকো আর, ফসল যার ফলল না— /
চোখের জল ফেলতে হাসি পায়”-


হল — “ফুলের বাহার নাইকো যাহার, ফসল যাহার ফলল না-- /
অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি পায়”-

আবার কবির আবদারও ছিল, শ্রোতার কাছে, পাছে ঘুমিয়ে পড়েন গান গাওয়ার আগে, “তোমায় গান শোনাব, তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ, ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া, বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক'!! আবদার না দাবি! যাই হোক, ভারী মর্মস্পর্শী কিন্তু।

রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
    স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
    আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
রূপনারান অবশ্য ঠিক নদী নয়, এ যেন অনেকটা সংসারের রূপক। এতদিন তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন, ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন। ঠিক মৃত্যুর আগে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কবি সত্যের সন্ধান পেলেন। “নদীর পারে খেলা” উপন্যাসে সুনীল লিখেছেন,

“ওপারে কোলাঘাট। ইলিশমাছ ধরা জেলেডিঙিগুলো ভাসছে নদীতে। সেই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মল্লিকা আবৃত্তি করছিল, ‘রূপনারানের কূলে / জেগে উঠিলাম, / জানিলাম এ জগৎ / স্বপ্ন নয়’ অথচ স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকারই দিন ছিল তখন। কি বিশুদ্ধ আনন্দের দিন, বাদল নিজেই সে জীবন হারিয়েছে।”

আচ্ছা মনুষ্যেতর প্রাণীরা কি ঘুমোবে না নাকি? — মোটেই তা নয়। তাদের, বিশেষত ভ্রমরের ঘরেতে গুনগুনিয়ে আসা যেমন রোমান্টিক, তার ঘুমিয়ে পড়াও তাই- । এই ঘটনা আমাদের সোনার বাংলাতেই ঘটে। বিশ্বাস না হলে দ্বিজু রায়ের শরণাপন্ন হচ্ছি,

“পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী;
কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি
পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে
ফুলের মধু খেয়ে।”

কি অসামান্য ছবিটি না! ভাবা যায়, ভ্রমরেরা দলে দলে এসে, ভরপেট মধু খেল। ব্যস, আর নড়ার ক্ষমতা নেই, হাজার হোক তারাও বাঙালী ভ্রমর। ফুলের নরম বিছানা দেখে আর পারে না, ঘুমিয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য, অন্ততঃ আমি তো কোনদিনফুলের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ভ্রমর দেখিনি। তবে কবিদের ছাড় আছে, যা দেখি বা যা ঘটে তা নাকি সব সত্য নয়, ঋষিবাক্য হল ‘সেই সত্য রচিবে যা তুমি’ ----!! আর একটি জবরদস্ত নাম আছে, “আর্ষ প্রয়োগ”!

প্রেমহীন জীবনে ‘নিদ্রাহারা রাতের এ গান বাঁধব আমি কেমন সুরে ’ বলে কবিগুরু যেখানে হাল ছাড়লেন, ঠিক সেখানেই হাল ধরলেন তাঁর প্রিয় এক মানুষ, ভক্ত শ্রী অতুলপ্রসাদ সেন। খুব দুঃখের জীবন কেটেছিল তাঁর। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন নিজের মামাতো বোন, হেমকুসুমকে। মেনে নেননি কেউ, বিশেষত অতুলপ্রসাদের মা। অতুলপ্রসাদের মা তাঁর সঙ্গে থাকতে এলেই গৃহত্যাগ করতেন স্ত্রী। শুরু হত বিরহ দহন। এই বিরহেই তাঁর হাত থেকে বার হয়েছিল, ‘নিদ্রাহারা রাতের’সেই বিখ্যাত গান —

“বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে।
আমিও একাকী, তুমিও একাকী
আজি এ বাদল রাতে,
নিদ নাহি আঁখি পাতে।”

        ----

কাঁদিছে রজনী তোমার লাগিয়া,
সজনী তোমার জাগিয়া।
কোন্ অভিমানে হে নিঠুর নাথ,
এখনও আমারে ত্যাগিয়া?

এই গানটি অতুলপ্রসাদ মামলার কাজে লখনৌ থেকে সীতাপুরে গিয়ে কর্মব্যস্ত একটি দিন কাটাবার পরে রাতে লিখেছিলেন। ব্যারিস্টারের সঙ্গী ছিলেন জুনিয়র হেমন্ত কুমার। জোর বৃষ্টি নেমেছিল রাতে, তিনি বাংলোর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখেন অতুলপ্রসাদ খুব মনোযোগের সঙ্গে কী যেন লিখছেন আর গুনগুন করছেন। একটু পরেই গেয়ে উঠলেন সদ্যরচিত ‘নিদ নাহি আঁখিপাতে।’ অতুলপ্রসাদ আর হেমকুসুম মাঝে মাঝে আলাদা থাকতে যখন বাধ্য হতেন তখন নিঃসঙ্গ, বিনিদ্র, হেমকুসুমও অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে গাইতেন ‘নিদ নাহি আঁখিপাতে।’

অনেকের আবার চট করে অল্প করে ঘুমিয়ে নেবার ক্ষমতা থাকে। তাতেই নাকি তাদের মস্তিষ্ক আবার ক্ষুরধার হয়ে যায়। আমাদের ফেলুদার যেমন, একটু অল্প করে ঘুমিয়ে নিলেই মগজাস্ত্রে শান দেওয়া হয়ে গেল, তোপসে একবার জানিয়েছিল যে, “ফেলুদার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ও চট করে ঘুমিয়ে নিতে পারে। শোনা যায় নেপোলিয়নের ও নাকি এরকম ক্ষমতা ছিল”।

তবে ঘুম যেমন রোমান্টিক, তেমনই প্রয়োজন। ঘুমহীনতা বা অল্প ঘুম হল আধুনিক মানুষের অসুস্থতার বা শারীরিক দুর্বলতার এক মূল কারণ। দিনে ৭-৮ ঘন্টার ঘুম খুব প্রয়োজন, একথা স্বীকার করে থাকেন বিশেষজ্ঞরাও। তবে একটানা না হলেও হয়। দু –তিন দফার ঘুম নাকি বেশী সহায়ক। চিন দেশে নাকি দুপুরে ঘুমিয়ে নিয়ে কর্মীরা তাঁদের কর্মক্ষমতা বাড়ান, এমন তথ্য খুব সুলভ।

তবে সব শেষে এক অদ্ভুত রসস্রষ্টার কথা না বললে ঠিক মন ভরছে না। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জীবনকাল খুব কম, তাঁর সাহিত্যজীবনও মাত্র ক-বছরের। কিন্তু এই ‘ক্ষণিকের অতিথি’ দুহাত ভরে সেবা করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের। আমাদের রোজকার ‘পথে চলে যেতে যেতে’ রবিঠাকুর ছাড়া আর যদি ‘কাহারো পরশ লাগে’ তবে তাঁরই। “হেড অফিসের বড়বাবু”, “হুঁকোমুখো হ্যাংলা”, “ষষ্ঠীচরণ”, “পাগলা দাশু” কে তিনি আমাদের শিরায় শিরায় ঢুকিয়েছেন। জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি আসন্ন মৃত্যুর কথা বুঝে গেছিলেন, খোদ রবিঠাকুর এসে তাঁর মৃত্যুশয্যাতে গান শুনিয়ে যান। তাঁর প্রথম বই ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশের আগেই তিনি চলে যান, ‘ঘুমের দেশে’। বইয়ের শেষ কবিতাতে যেন সেই আসন্ন মৃত্যুকে দেখেছিলেন, লিখেছিলেন —

“মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে,
রামধনুকের আব্‌ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠ পুরে।

------------------

আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর”।
সুকুমার রায়ের প্রতি পুত্র সত্যজিৎ যখন শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন, ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে এমন রসিকতা আর কোন রসস্রষ্টার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই” তখন আমরা শুধু একবাক্যে মেনেই নিই না, মুগ্ধ হই এই অনির্বচনীয় অনুভূতিতে।


(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)



ছবি- ??