ইরানে যাবার নাম তুললেই সবাই বলে ওঠে “ইরান? ইরানে যাচ্ছ কেন? ওখানে আবার শখ করে কেউ যায় নাকি?” যেন ইরান দেশটা বোর্নিওর জঙ্গলের চেয়েও দুর্গম ও বিপজ্জনক!
অথচ এই দেশটির সঙ্গে আমাদের কত গভীর রক্তের যোগাযোগ। পুরনো যুগে কত শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও রাজনীতির দেওয়া নেওয়া চলেছে এই দুই দেশে। আর এখন? আমার চেনা জানা একজনও আত্মীয় বা বন্ধু নেই যিনি গত পঞ্চাশ বছরে এদেশে পদার্পণ করেছেন। সবাই যায় সৌদি ও এমিরেট দেশগুলিতে কিন্তু ইরানে কেউ যায় না। আজ থেকে কিন্তু ৮৬ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারস্য দেশে (ইরানের পুরনো নাম) বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার ইরান যাত্রার প্ল্যানটাও কাকতলীয় ভাবেই রবীন্দ্রনাথের যাত্রার সঙ্গে মিলে গেল। ঠিক তাঁর মতই আমরাও শিরাজ থেকে গাড়িতে চড়ে পার্সিপোলিশ ও ইসপাহান হয়ে তেহরান গেছিলাম। সঙ্গে কয়েকটা ছোটখাট শহরেও উঁকি দিয়েছিলাম। যাত্রার সময় কবিগুরুর বয়সও ছিল আমারই মতন তবে মিলের শেষ সেইখানেই। আমার জন্য কোনো সংবর্ধনা সভা ছিল না। কোনো রাজা উজীরের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
ইরান মোগল সম্রাটদের মাতৃভূমি। বাবর থেকে নাদির শাহ পর্যন্ত কত বীরপুরুষ খাইবার পাস হয়ে ভারতে এসে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন বা লুটতরাজ চালিয়েছেন। তখনকার দিনে ভারত আর ইরান তো একরকম পাশাপাশিই ছিল। আফগানিস্তান অনেকটাই ইরানের দখলে আর পাকিস্তান তো ভারতেরই অংশ ছিল। আধুনিক জেনেটিক্সের তুলনা করলে উত্তর ভারতের প্রত্যেকের ধমনীতে ইরানী রক্ত পাওয়া যাবে। ফার্সী ভাষা আমাদের উর্দু ও হিন্দীতে মেশানো। এদের বিরিয়ানী, কাবাব, পোলাও এখন আমাদেরও ঘরে ঘরে। এদের মুখচোখ, লম্বা নাক, ঘন ভুরু, গায়ের রং — সবই আমাদের পরিচিত। এখানকার মসজিদ, প্রাসাদের স্থাপত্যই আমাদের তাজমহল, রেডফোর্টের প্রেরণা জুগিয়েছে। আধুনিক ইরানেও তেহরানে রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে যেন মুম্বাই শহরে ফিরে গেছি। (শুধু রাস্তাঘাট এখানে অনেক পরিচ্ছন্ন আর গাড়িও নি:শব্দ) ইরানের সঙ্গে ভারতের এই সাদৃশ্য আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল। কেন জানি, ভেবেছিলাম পেট্রল ধনী ইরান ও দুবাই বা আবুধাবির মত ঝাঁ চকচকে আকাশচুম্বী বিলডিঙে ভরতি। কিন্তু এদেশটা অনেক শান্ত, ছিমছাম ও নম্র।
আমেরিকায় খবরে শুনি শুধু ইরানের বিরুদ্ধে স্যাংশন। এখানে সবাই মনে করে ইরান শুধু উগ্রপন্থী শিয়া মুসলমানে ভর্তি, সারাক্ষণ ঝান্ডা হাতে আমেরিকার মুণ্ডপাত করে চলেছে। আসলে এ সবই চূড়ান্ত মিথ্যে — ফেক নিউজ যাকে বলে। আমি রাস্তায় একটিও বন্দুকধারী গার্ড, মিলিটারী বা পুলিশ দেখিনি, একজনও দাড়ি-পাগড়ীওয়ালা মোল্লা দেখিনি যারা মেয়েদের পোশাকের খবরদারি করছে। এটা সত্যি যে ইরানে প্রধানত: শিয়া রাজ্য। চারপাশে সুন্নি আরব দেশগুলির সঙ্গে সদ্ভাব নেই। শিয়া-সুন্নির এই বিবাদ ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চলে আসছে — আরব-ইজরায়েল থেকেও এ বিবাদ গভীর ও কঠিন। শুধু এই জন্যই অন্য মুসলিম দেশের লোকেরাও ইরানে বেড়াতে আসেন না।
এটাও সত্যি যে মেয়েদের গাড়ী চালাবার বা কর্পোরেশন ম্যানেজ করার অধিকার আছে। কিন্তু পোশাক ঢিলে ও পুরো ঢাকা হতে হবে ও মাথায় অন্তত: আধঘোমটা জরুরী। আমাদের প্লেন লুফতহানসা তেহরানে নামবার ঠিক আগে ঘোষণা করে দিয়েছিল যে আয়াতোল্লার দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী ৯ বছর বা তার বেশি বয়সী সব মহিলাদের মাথা ঢাকতে হবে। একমাত্র বাথরুম ও বেডরুম ছাড়া অন্য কোথাও ঘোমটা খোলা চলবে না। আসলে কিন্তু নিয়মের খুব একটা কড়াকড়ি নেই। আমাদের গাইড অথিনার ঘোমটা থেকে থেকেই খসে পড়ে — কেউ দেখেও না বা মন্তব্যও করে না। ট্যুরিস্ট মহিলাদের ওপর এরা আরও ক্ষমাশীল। আমি অনেককেই শুধু নামমাত্র চুল ঢাকতে দেখেছি।
এত সব কড়াকড়ি সত্ত্বেও ইরানী মেয়েরা ফ্যাশন করে সাজতে ও দেখাতে ওস্তাদ। মুখচোখের মেকআপ, ঝকমকে জুতো, নেল পালিশ, ঢোলা কোট ও মাথার স্কার্ফেরই কত রং। চোখের কাজল তো খুবই জরুরী। নাহলে এসে জিগ্যেস করবে “শরীর ঠিক আছে তো?” ইদানীং একটা ফ্যাশন হয়েছে — মেয়েরা লম্বা নাক ছোট করে প্লাস্টিক সার্জারী করে। বাজার-ঘাটে আমি অনেক মেয়ের নাকে ব্যান্ডেজ দেখেছি।
ইরানে মেয়েরা দেখেছি খুব স্বাধীন আর রাস্তাঘাট, খুব নিরাপদ। আমেরিকার মত কথায় কথায় কেউ গুলি ছোঁড়ে না। ভারতের মত ছেলে ছোকরাও উক্তক্ত্য করেনা, রেপ-টেপ তো দুরের কথা। মাঝরাতেও মেয়েরা একা চলাফেরা করে।
ইরানে বেড়াবার সময় আমরা শিরাজ থেকে এক ইরানী সংস্থার সাহায্য নিয়েছিলাম। ওরাই হোটেল, গাড়ি, গাইড ইত্যাদির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। দলে শুধু আমি ও আমার স্বামী আমরা বেশ প্রাইভেট গাইড ও গাড়ির সুবিধা পেয়েছিলাম। দুজন গাইডই খুব ভাল মিলেছিল। আমি পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘুরেছি, নিমার মত এত ভাল গাইড আমি কোথাও পাইনি। আমরা এখন সবাই ফেসবুকে বন্ধু।
আমার ইচ্ছা ছিল প্রথমেই শিরাজ যাওয়ার। কিন্তু প্লেনে সুবিধামত যোগাযোগ না পাওয়ায় প্রথমে তেহরান-এ নামতে হল। তারপর স্থানীয় প্লেনে শিরাজ। তেহরান শহরটি বেশ ছিমছাম, প্রকাণ্ড স্কাই স্ক্রেপারের ভিড় নেই। রাস্তায় গাড়ির ভিড় কিন্তু হর্নের শব্দ নেই। রাস্তায় কোনো আবর্জনা, নেই কোনো এঁড়ো কুকুর, বেড়াল বা গরু ছাগল। এখানে আমি দুএকটা বেওয়ারিশ বেড়াল দেখেছি কিন্তু একটিও কুকুর নয়। মুসলমানরা কুকুর হারাম মনে করেন। একমাত্র এয়ার পোর্টে আফিম শোঁকা কুকুর দেখেছি। আফগানিস্তান থেকে প্রচুর আফিম চোরা আমদানি হয়।
তেহরান ইরানের অন্যান্য শহরের তুলনায় একেবারেই নতুন। বেশ সাজানো, বড় বড় রাস্তাগুলির দুধারে ঘন চেনার গাছের সবুজ সারি। কুখ্যাত আমেরিকান এমব্যাসিটি এখন একটি মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। দেখার ইচ্ছা হল না। রাস্তায় গাড়িগুলি সব জাপানী বা ইওরোপীয়। কিন্তু হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে দেখা দিল একটা বিরাট লম্বা ট্রেলার ভর্তি ডজনখানেক আমেরিকান ফোর্ড ও জেনারেল মোটরস গাড়ি! আমাদের মতই, আমাদের গাইডও হতভম্ব। নিশ্চয়ই স্যাংশনে অনেক ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে।
তেহরান শহরটি ইরান দেশের উত্তর কোণে, আর শিরাজ একেবারে উলটোদিকে দক্ষিণে। জাগরোস পর্বতমালার মাঝখানে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই শিরাজ সুন্দর আবহাওয়া, কাব্য, গোলাপ ফুল, শিল্পকলা ও পর্যাপ্ত দ্রাক্ষারসের জন্য বিখ্যাত। কয়েকশ বছর আগে ইরানের রাজধানীও এখানেই ছিল। তখনকার সুলতানরা বিরাট বিরাট বাগানে শহরটি সাজিয়েছিলেন। সেগুলি এখনও UNESCO স্বীকৃত হয়ে অক্ষত অবস্থায় শোভা পাচ্ছে চেনার, তুঁত আরও অন্যান্য ফল ও ফুলের গাছ, রাশি রাশি গোলাপের গুচ্ছ, আর বিরাট জলাশয় ও ফোয়ারা। জল ছাড়া এখানে বাগান সম্পূর্ণ হয় না। সাধারণ গৃহস্থও বাড়ির উঠানের বাগানে দুটো গোলাপের চারা ও একটি ছোট্ট ফোয়ারা রাখবেনই। এই শুকনো মরুভূমির দেশে জল ও সবুজ গাছপালা মহার্ঘ। স্বর্গ বলতেও এরা সাজানো বাগান ও ফোয়ারা মনে করে।
শিরাজের অপূর্ব প্রাসাদ ও মসজিদের মধ্যে — আমার মতে — সবথেকে সুন্দর মসজিদ নস্র-আল্-মুল্ক। গোলাপী-নীল টাইলে মোড়া বলে অনেকে গোলাপী মসজিদও বলেন (Pink masque)। এখানে লম্বা প্রার্থনা হলটির পূর্বদিকের পুরো দেয়াল রঙিন কাঁচে (stained glass) তৈরি। রোজ সূর্যোদয় থেকে দুপুর পর্যন্ত রঙিন আলো ছড়িয়ে থাকে নরম শিরাজী কার্পেটের ওপর। অনেকেই ঐ রঙিন আলোয় ডুব দিয়ে প্রার্থনা করেন বা একে অন্যদের ফোটো তোলেন।
মদিরা ও গোলাপ ছাড়াও শিরাজের খ্যাতি কবির শহর বলে। এমনিতে সারা ইরান দেশটায় কবির ছড়াছড়ি, ফেরদৌসি থেকে ওমর খৈয়াম, রুমি, সাদী, হাফিজ--এদেশের লোকেরা কথায় কথায় কবিতা আওড়ায়। সাদীর কবিতা এদের ১০০০ রিয়ালের নোটে আঁকা, হাফিজের বুলি শিরাজী কার্পেটে বোনা; দিওয়ান হাফিজ (মৃত্যু ১৩৮৯) শিরাজীদের অতিপ্রিয়। প্রত্যেক ইরানী ঘরে কোরাণের পাশেই হাফিজের কবিতার বই দেখা যাবে। সাদী ও হাফিজ দুজনেরই কবর (ফার্সীতে বলে ‘আরামগাহ্’- বা বিশ্রামস্থান, সুন্দর ভাষা, তাই না?) এই শিরাজে। রবীন্দ্রনাথও হাফিজের আরামগাহে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে মেরামত চলছিল। চারিদিকে লোহার রেলিং ও সশস্ত্র প্রহরী দেখে কবি ব্যথিত হয়েছিলেন। এখন চারপাশে সুন্দর গোলাপের বাগান। প্রতিদিন দলে দলে ইরানীরা এখানে এসে শ্রদ্ধাস্থাপন করে। দেখে ভাল লাগল যে এদের মধ্যে বেশীর ভাগই অল্পবয়সী।
রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও কবিতাপ্রেমী ছিলেন। ছোটবেলায় ছেলেকে হাফিজের কবিতা পড়ে শোনাতেন। শোনা যায় যে হাফিজের জীবৎকালে বাংলার নবাব তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন কিন্তু হাফিজ যেতে পারেন নি। বাংলার কবিগুরু শিরাজে এসে সেই ক্ষোভটা মিটিয়ে দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের মতই দেশ বিদেশ থেকে কবিপ্রেমীরা শিরাজে আসেন — হাফিজের কবরে দু আঙুল ছুঁইয়ে প্রার্থনা করেন।
ভারত থেকে এসেছিলেন আরেকজন জনপ্রিয় কবি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। আমাদের গাইড তাঁর দেখভাল করেছিল। আসার আগে তাঁর এক হাঁটুর সার্জারী হয়েছিল। বাজপেয়ীজী হাঁটুর ব্যথায় কাতর ছিলেন। তাঁর মন ভোলাতে গাইডরা তাঁকে একটি স্থানীয় প্রবাদ বলেছিল যে মনে কোনো গোপন ইচ্ছা নিয়ে চোখ বুজে হাফিজের কবিতার বই খুললে যে কবিতা দেখা যাবে তাইতে সেই ইচ্ছা সম্পর্কিত ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। হলও তাই। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থিত কবিতাটি পড়ে এত অভিভূত হয়ে পড়েন যে তিনি সব গাইড, সহকর্মী ইত্যাদিদের সরিয়ে একা হাফিজের কবরের পাশে বসে চোখের জল ফেলেন। আমরা শুনে নিমাকে বললাম প্রধানমন্ত্রীর কবিতার কথা আর কিছু ব্যক্তিগত তথ্য। শুনে সে-ও খুব মনখারাপ করেছিল। সরকারী পক্ষ থেকে অটলবিহারী একটি স্কোয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নামে চিহ্নিত করেন। সেই স্মৃতিফলক এখনও দেখা যায়।
শিরাজ থেকে আমরা গাড়ী ও গাইড নিয়ে উত্তরে চললাম। শিরাজ থেকে একটু দূরেই বিশ্ববিখ্যাত পার্সিপোলিস। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ কাহিনী পড়ে জানলাম তিনিও ঠিক ঐ পথে আমাদের মতই ইসপাহান হয়ে তেহরান পর্যন্ত গিয়েছিলেন। অবশ্যই ছিয়াশী বছর আগে রাস্তাঘাট এত সুগম ছিল না। গাড়ীও এত আরামদায়ক ছিল না। তাই অসুস্থ, দুর্বল কবিকে মরুভূমির গরম ও রাস্তার ঝাঁকুনি সহ্য করতে হয়েছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো এয়ার কন্ডিশন আধুনিক গাড়ী পেয়েছি ও সুন্দর, পরিষ্কার হোটেলে থেকেছি। আমাদের গাইড নিমা উৎসাহী, করিৎকর্মা, ভালো ইংরাজী বলে, গান গায়, কম্পিউটার ও ক্যামেরাতেও সমান দক্ষ। সারা রাস্তা আমাদের গল্প ও জোক শুনিয়ে, গান গেয়ে ও রাস্তার ধাবায় নানারকম খাবার খাইয়ে আপ্যায়িত করে রেখেছিল। আমি অনেক দেশে অনেক গাইড দেখেছি, নিমাকে আমি সহজেই প্রথম দুজনের একজন বলব।
আপনাদের হয়ত প্রশ্ন আছে ভিসা, কাস্টমস ইত্যাদি বিষয়ে। ইরান ও ভারতে ইদানীং খুব সদ্ভাব। এয়ারপোর্টেই ভিসা পাওয়া যায়। অ্যালকোহল বা পর্নোগ্রাফিক বই-ভিডিও না থাকলে কাস্টমস বা ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা নেই। সমস্ত হোটেলে আমরা ফ্রী Wi-fi পেয়েছিলাম। তবে ফেসবুক, Twitter, YouTube ইত্যাদি সরকারিভাবে বন্ধ কিন্তু আড়ালে সবাই VPN ইত্যাদির সাহায্যে যোগাযোগ করে নেয়। আমি সেরকম কোনো চেষ্টা করিনি। ই-মেলই যথেষ্ট ছিল।
শহরের বাইরে ইরান দেশটির অনেকখানিই শুষ্ক মরুভূমি। রবি ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিলাম — “শূন্য, শুষ্ক ধরণী গেরুয়া চাদরে ঢাকা তার নিরলংকৃত নিরাসক্তি”। এমনকি উঁচু নীচু পাহাড়গুলোও ন্যাড়া — সবুজের নাম গন্ধও নেই। অনেকটা আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমের রুক্ষতা মনে করিয়ে দেয়। এখানে সেখানে গাঁ-শহরে মানুষের পোঁতা গাছপালা একটু সবুজের ছোঁয়া দেয়। প্রাকৃতিক সবুজ শুধু দেশের উত্তরভাগে — কাস্পিয়ান সমুদ্রের আশেপাশে। এই জন্যই বোধহয় এদেশের লোকেরা বাগান ও জলের এত ভক্ত।
এমনিতেই জমি শুকনো। তার ওপর গত কয়েক বছর নাকি বৃষ্টি হয়নি ভাল করে। নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। শিরাজের বাইরে কৃষিজমিও খটখটে শুকনো। অনেক চাষীরা খেতখামার ছেড়ে শহরে চলে এসেছেন — রোজগারের আশায়। মনে হয় শিগগীরিই পেট্রলের বদলে জল নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। আমাদের পালাও এল বলে।
শিরাজ থেকে ঘন্টাখানেক উত্তরে আমাদের প্রথম স্টপ — বিশ্বখ্যাত পার্সিপোলিস। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে — সেই মিশরীয় ফারাওদের কালে — ইরানের স্বর্ণযুগে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তাদের রাজত্ব ছিল। প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট সাইরাস, দারিয়ুস, ইত্যাদিদের প্রাসাদ ছিল এইখানে। ৩৩০ খ্রীষ্টপূর্বে আলেকজান্ডার এসে সব তছনচ করে দিল। প্রাসাদগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিল। ছাদ পুরো ধ্বংস হওয়ার পর স্তম্ভগুলিও আর বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।
এখন ভাঙাচোরা থাম, দেয়ালের অংশ, তোরণ, সিংহদ্বার ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষই শুধু দেখা যায়। তবু তারই কী শোভা! একটি লম্বা পাথরের প্যানেলে সম্রাট ও তার পেছনে রক্ষীরা। সামনে লাইন দিয়ে নানা প্রতিবেশী দেশ বিদেশ থেকে উপঢৌকনবাহী দূতের দল — আশ্চর্য যে প্রত্যেকটি দেশের বেশবাস, কানের গয়না, মাথার চুল, দেশীয় পশু পাখী সবই নিখুঁত ভাবে খোদাই করা — ভারতীয় দূতের পরণে খাটো ধুতি, কাঁধে লম্বা বাঁশের দুদিকে ঝোলানো থলি,
চীনের দূতের হাতের দড়িতে বাঁধা ব্যাকট্রিয়ান উট। এত হাজার বছর পরেও সব অমলিন। দেখে অবাক হতে হয়। সাইরাস ও দারিউস প্রমুখ এই সম্রাটরা সারা দেশে জরাথুষ্ট্রের বাণী প্রচার করেছিলেন। দক্ষ হাতে মঙ্গোল দস্যুদের দাবিয়ে রেখেছিলেন। ইরানের সীমানা তখন তুর্কী থেকে চীন পর্যন্ত।
পার্সিপোলিস জায়গাটা মরুভূমির মধ্যে, বিরাট ছড়ানো, দুপুর রৌদ্রে নির্দয় ছায়াহীন। খুব ছোট শিশু, বুড়ো বয়সের লোক বা প্রতিবন্ধীদের পক্ষে খুবই কষ্টের। রবীন্দ্রনাথকেও চেয়ারে বসিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। এত বছরেও রাস্তাঘাটের বিশেষ উন্নতি হয়নি। বেবি ক্যারেজ বা হুইলচেয়ার চালানোও ভীষণ মুশকিল এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার জন্য। দু একটি বাথরুম ও পানীয় জলের জায়গা আছে কিন্তু বেশ দূরে দূরে। ইরান সরকারের উচিত এই জায়গাটি আরও সুগম করা। ভারতের মতই ইরানে ট্যুরিজমের উন্নতির অবকাশ আছে।
শিরাজ থেকে ইসফাহানের রাস্তায় পড়ে আরেকটি ঐতিহাসিক শহর — ইয়াজ্দ। UNESCO এক্সপার্টদের মতে সবথেকে পুরনো শহরের একটি যেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার বছর ধরে লোকেরা বসবাস করে এসেছে। আধুনিক ইয়াজ্দ শহরের মাঝখানে উঁচু গেরুয়া মাটির দেয়ালে (মাটির সঙ্গে খড় ও গোবর) ঘেরা মধ্যযুগীয় শহর। বাড়িগুলি উঁচু দেয়ালে ঢাকা, আঁকাবাঁকা গলি এত সরু যে গাড়ি ঢোকে না।
রক্ষণশীল বাড়িগুলির ছাতে উইন্ড টাওয়ার দেখা যায় — যা এই গরমের দেশে এয়ার কন্ডিশনের কাজ করে। বেশিরভাগ বাড়ি ১৬-১৭শ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি। এখানে ওখানে দুই-তিনশ খ্রীষ্টাব্দের ধ্বংসাবশেষ আছে। গলিগুলিতে গোলকধাঁধার মত সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়। মাঝেমাঝে গেরুয়া দেয়ালের কোণে কালো বোরখার ঝিলিক। দিনেদুপুরেও বেশ গা ছমছম করে। এই মধ্যযুগীয় শহরের মধ্যে আছে বিরাট মাটি-লেপা পানীয় জলের ট্যাংক ও দুদিকে দুটি পুরনো মসজিদ। কয়েকটি আধুনিক কফিশপ ও স্যুভেনিরের দোকান, রেস্তরাঁগুলি বাড়ির ছাদে শামিয়ানার নীচে, নীচু রেলিং লাগানো তক্তপোশের ওপর ফরাস ও তাকিয়া বিছিয়ে বসার জায়গা। চেয়ার টেবিলের বালাই নেই।
ইয়াজ্দ-এর কাছেই আছে একটি বহু পুরনো জরাথুস্ট্রীয় মন্দির। জরাথুস্ট্র প্রায় ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বে তাঁর অগ্নিভিত্তিক ধর্ম প্রচার করেছিলেন। দারিয়ুস, সাইরাস ইত্যাদিদের শাসনকালে এই ধর্ম সারা দেশে ছড়িয়েছিল। পরে ইসলামের হাতে পরাজিত হয়ে দেশের কোণে-কানাচে লুকোয় ও বেশিরভাগই ভারতে পালিয়ে আসেন। এঁরাই মুম্বইয়ের পার্সি সম্প্রদায়। এঁরা আগুনকে পবিত্র মনে করেন তাই মৃতদেহ পর্যন্ত আগুনে পোড়ান না। ইয়াজদের মন্দিরে সংরক্ষিত আছে ৪০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ক্রমাগত: জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা।
ইসফাহানের রাস্তায় পড়ে অনেক ছোট ছোট দ্রষ্টব্য জায়গা যা গাইডবইয়ের পাতায় লেখা নেই। নাইন নামক একটি ছোট্ট গ্রামে দেখলাম দু তিন’শ বছর পুরনো মসজিদ — যার ঘরদোর বেশিরভাগই মাটির নীচে। দেখে জেলের অন্ধকার কুঠুরী মনে হয় কিন্তু গরমকালে মাটির নীচেই বেশ ঠান্ডা।
হঠাৎ বড় রাস্তার ঠিক পাশেই মরুভূমির মধ্যে উদিত হল একটা ক্যারাভান-সরাই। সেই পুরনো কালের সিল্ক রুট, পথে যাত্রীদের বিশ্রাম ও লেনদেন, বেচাকেনার জায়গা। কাছে গিয়ে দেখি একদম ফাঁকা — লম্বা ঘরের সারি, পেছনে ঘোড়া ও উটের আস্তাবল। সামনে বন্ধ গেটের মাঝে এক প্রৌঢ় মাটিতে বসে, পাশে একটি সাদাকালো বেড়াল। আমাদের দেখে খুব গর্বিত ভাবে বলল, “আমিই এই সরাইয়ের মালিক”। তারপর একটু থেমে “আমি আর আমার বেড়াল। হ্যাঁ।” মনে হল বেচারার মাথার গোলমাল। এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।
ইসফাহান থেকে কয়েক মাইল দূরে আরেকটি মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট্ট গাঁ। সেখানে নিমার বন্ধু এক ছোট্ট হোটেল (Bed and Breakfast) বানিয়েছে। সস্তা কিন্তু সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, ঘরে-বানানো খাবার, আট-দশটি ঘর ঘিরে আছে মাঝখানে একটি ছোট্ট বাগান ও ফোয়ারা। একতলা বাড়ি, ওপরে ছাদে উঠে চমৎকার সূর্যাস্ত উপহার পেলাম। হোটেলের মালিক আদর করে বসালেন। ইরানীরা ভারতীয়দের মতই অতিথি-পরায়ণ ও খুব সহজে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নেয়। আমাদের যত্ন করে চা, মিষ্টি খাওয়ালেন। চা এখানে প্রিয় পানীয়। সারা দেশে কোনো কোকাকোলা, পেপসি, পিৎজা হাট বা ম্যাকডোনাল্ড-এর দেখা পাবেন না। কিন্তু চা ও কফির দোকান প্রতি রাস্তার মোড়ে। আর চায়েরই কত বাহার — বসরাই গোলাপ থেকে জাফরানি সুগন্ধে ভরপুর। জাফরান (saffron) তো এদেশে এত সুলভ যে এর ব্যবহার সর্বত্র। পোলাও, বিরিয়ানী থেকে চা, শরবৎ, এমন কী আইসক্রীম পর্যন্ত।
অবশেষে ইসফাহান। পারস্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক শহর, অতীতের রাজধানী, শিল্প, স্থাপত্য, ধর্ম ও রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। আমরা যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যার অন্ধকার হয়ে এসেছে। সঙ্গে শুরু হল তুমুল ঝড়বৃষ্টি। দূর থেকেই দিগন্তসীমানায় ঘন কালো মেঘ ও বিদ্যুৎ দেখেছিলাম কিন্তু নিমা উড়িয়ে দিচ্ছিল — এরকম মেঘ প্রায়ই হয় কিন্তু বৃষ্টি মাত্র দু ফোঁটা। ওকে ভুল প্রমাণ করে দাপিয়ে নামল কালবৈশাখী। নিমা অবাক, রাস্তায় লোকেরা ভীষণ খুশী। এরকম বৃষ্টি এখানে অনেক দিন হয় নি। আমরাও তক্ষুণি সমস্ত কৃতিত্ব আমাদের সৌভাগ্যের ওপর নিয়ে নিলাম!
বৃষ্টির মধ্যেই সে রাত্রির খাওয়াদাওয়ার পালা সারলাম। আমার প্রিয় চেলো কাবাব — মুরগী বা ভেড়ার মাংসের কাবাব ও সঙ্গে ইরানী ভাত যার নীচের তলাটা ভাজা ভাজা কুড়মুড়ে, একবার খেলে কখনো ভুলবেন না। ইরানে নানা ধরনের নান ও রুটি পাওয়া যায় কিন্তু এরা ভীষণ ভাত ভালবাসে। আমরা অর্ডার দিয়েছিলাম বিরিয়ানীর কিন্তু এল যখন দেখি ভাতের বদলে বিরাট পাতলা রুমালী রোটির ওপর মশলাদার মাংস ইত্যাদি! ভাতের নামও নেই। আমরা আপত্তি তুললাম ভাত ছাড়া বিরিয়ানীই হয় না! ওদের তর্ক এটাই অরিজিনাল ইস্ফাহানী ‘বেরিয়ানী’। এখান থেকেই ভারতে পৌঁছেছে আর আমরা ভাত-টাত দিয়ে একেবারে বদলে দিয়েছি জিনিষটা। কি জানি, হয়ত হতেও পারে। এ নিয়ে নিশ্চয়ই তর্কের অবকাশ আছে। এরকম নামবিভ্রম আমার আরও হয়েছে — কিনলাম সমোসা — রাস্তার ধার থেকে — পেলাম যা সেটাকে চাইনীজ এগ্রোল বলা যেতে পারে। ভারতীয় তেকোনা সমোসা বা সিঙাড়া মোটেই নয়।
মিষ্টির ব্যাপারে আমার কিন্তু কোনো নালিশ নেই। উত্তর ভারতের বরফি, গজ্জক-এর মত হরেকরকম রঙ বেরঙের মিষ্টি, পেস্তা বাদামে (আরেকটি সুলভ বস্তু) ভরা। বাদামের পরিমাণ অনুযায়ী মিষ্টির দাম। আর খেজুরের তো তুলনা নেই — এমন নরম মিষ্টি, বিরাট বড় খেজুর আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। দুধ বা ছানা দিয়ে তৈরি বাঙালি মিষ্টির মত পদ দেখিনি কিন্তু। রবীন্দ্রনাথ খাবার-দাবারের বিষয়ে বিশেষ কিছু লেখেননি। হয়ত অসুস্থ শরীরে ওসবে রুচি ছিল না।
তবে মুসলমান দেশ বলে খোলাখুলি অ্যালকোহল পাওয়া যায় না কিন্তু তলায় তলায় সব চলে। রেস্টুরেন্টে বিনা অ্যালকোহলের বীয়ার পাওয়া যায়। স্বাদও মন্দ নয়।
ইসফাহান শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে একটি বিরাট নদী — জই আন্দেরুদ। এই নদী নিয়ে পুরাকাল থেকেই অনেক গান, কবিতা রচনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর স্মৃতিলিপিতে এই নদীর বর্ণনা দিয়েছেন। লিখেছেন নদীর ওপর ১৫০০ সালে তৈরি ঐতিহাসিক আলিবর্দী খাঁ ব্রীজ যার আধুনিক নাম সিও-সেপোল। আরও একটি পুরনো খাজু ব্রীজ — দুটিই প্রশস্ত, গম্বুজ ও মিনারে শোভিত। ব্রীজের ওপর পায়ে চলার রাস্তা আছে। ওপরে বসে নদীর সৌন্দর্য দেখা, চা-পান, গল্পগুজব ইত্যাদিও করার জায়গা আছে।
কিন্তু হায়! আজকে সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। ব্রীজ দুটি একেবারে সুনসান। কেউ আসেনা নদীর শোভা দেখতে। আসবে কী? নদীটাই নেই যে! একেবারে অদৃশ্য। বছর বছর জল কমতে কমতে গত তিন বছর ধরে নদীটা পুরো শুকিয়ে কাঠ! এত বড়, এত পুরনো ঐতিহাসিক নদীর এই দুরবস্থা দেখে ভীষণ দু:খ হয়, আর ভয়ও করে। আগামী দিন আমাদের গঙ্গা-যমুনারও এই অবস্থা হতে পারে। শুনেছি জলাভাবে নদীর ধারে ও ব্রীজের ওপর লোকজনের মেলামেশাও কমছে ও সেই সঙ্গে বাড়ছে নানাধরনের ক্রাইম ও ডিপ্রেশন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পারস্যযাত্রায় বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে, সংক্ষেপে ইরানের অতি জটিল ৪০০০ বছরের ইতিহাস বুঝিয়ে দিয়েছেন। বোঝা যায় ইতিহাসেও তাঁর কতখানি দখল ছিল। আমার সে ক্ষমতাও নেই, সে পাণ্ডিত্যও নেই, তাই তার চেষ্টাও করলাম না। তেহরানের পরেই সব থেকে বড় শহর ইসফাহান। কিন্তু তেহরানের থেকে অনেক পুরনো, ঐতিহাসিক ও রক্ষণশীল। এখানে আমি অনেক মহিলাকে পুরো বোরখা পরতে দেখেছি। তেহরানের মত যখন তখন মাথার ঘোমটা খসে পড়তে দেওয়া চলে না।
ইসফাহানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান নক্শ-এ জহান ময়দান। আয়তনে বেইজিং-এর তিয়ান-আন-মেন স্কোয়ারের পরেই এর স্থান। সে বিরাট চত্বর — শুনেছি এককালে এখানে পোলো খেলা হত। এর এক প্রান্তে আছে বিখ্যাত নীল পাথরে সাজানো নক্শ্-এ-জাহান মসজিদ। রবিঠাকুরের বইতে এই দুয়েরই উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু ময়দান-ই শাহ ও মসজিদ-ই শাহ নামে। শাহের রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই এই নাম দুটিও লুপ্ত হয়েছে।
ময়দানে খোলা জায়গার পাশেই আছে লম্বা সারিতে নানা রঙের গোলাপের ঝাড়। আর আছে কমলালেবু ও ডালিমের গাছ। অবশ্যই বাগান থাকলে জলও থাকবে। আছে দুটি বিরাট ফোয়ারা সংযুক্ত জলাশয়। আছে প্রমোদভ্রমণের জন্য ঘোড়ার গাড়ি। নরম ঘাসে পিকনিকের জায়গা, খেলাধূলা, ফেরিওয়ালা, ম্যাজিক প্রদর্শনী ইত্যাদি তো আছেই।
রবিঠাকুরের পারস্য যাত্রায় আমি ইরানের বিখ্যাত ও অতুলনীয় সুন্দর মসজিদগুলির কোনো বর্ণনা পাই না। মসজিদ-ই শাহের দু'লাইন বিবরণ ছাড়া আর কোনোও প্রাসাদ বা মসজিদের সম্বন্ধে কিছু লেখা নেই। এমনকি শিরাজে UNESCO নির্বাচিত সেই অপূর্ব সুন্দর পিংক মসজিদও নয়। এটা কী তাঁর ধর্মসংস্থান সম্পর্কে অনীহা না শরীরের অসুস্থতা ও দৌর্বল্যের প্রভাব?
নক্শ্-এ-জহান ময়দানের চারপাশ ঘিরে নানারকমের রেস্টুরেন্ট, কুটিরশিল্প ও হস্তশিল্পের দোকান ও প্রদর্শনী। ট্যুরিস্টদের ভীড়ও বেশ। দুই প্রান্তে আছে নক্শ্-ই-জহান মসজিদ ও জামে মসজিদে ও মাদ্রাসা। দুই-ই অপূর্ব শিল্পকলায় ভরা।
দেখে দেখে চোখের আশ মেটে না। পুরো দেয়াল ও ছাত হাতে আঁকা ছোট ছোট নীল টাইল দিয়ে ঢাকা। প্রতিটি টাইলে সূক্ষ্ম কারুকার্য, জটিল কিন্তু নিখুঁত জ্যামিতিক ডিজাইন বা অলংকৃত কোরানের বাণী। শোনা যায় নক্শ্-ই-জহান মসজিদের কাজ শেষ হতে ২৬ বছর লেগেছিল। পুরো মসজিদটা যেন সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা আকাশী নীল তাজমহল। ভেতরে যেখানে মোল্লারা বক্তৃতা দেন, সেখানে acoustics এত ভাল যে কোনো শব্দ বারোটি জায়গায় এক সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়। মাইক্রোফোনের দরকারই পড়ে না।
মসজিদের ভেতর দিকে অবশ্য বাগান, ফোয়ারা, মাদ্রাসা ও ছাত্রদের বিশ্রামস্থান। ময়দানের উল্টোদিকে আছে আরও একটি বিশাল বাগান ও সম্রাটের বিশ্রামের প্রাসাদ। এই প্রাসাদে আছে অনেক দর্শনীয় অয়েল পেন্টিং — ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত ঝোলানো। একটিতে দেখা যায় নাদির শাহের ভারত জয় (বা লুট — খাইবার পাসের দুই দিকে দুই মত)। ইরানী ঘোড়ার দল ভারতীয় হাতীদের ছত্রভঙ্গ করছে। আরেকটি পেন্টিংয়ে মোগল সম্রাট হুমায়ুন ইরানী সম্রাটের দরবারে আর্জি পেশ করছেন, কোনো আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সাহায্যের আশায়। এই সব ছবিগুলি আবার মনে করিয়ে দেয় ভারত ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধনের কাহিনী।
ইস্পাহানে আরেকটি মজার জায়গা আছে — Shaking minar বা কম্পিত মিনার। প্রায় ৩০০ বছর আগে তৈরী একটি ছোট সৌধের ওপর দুটি মিনার। একটিতে চড়ে ভিতর থেকে কাঠামোতে ঝাঁকানি দিলে অন্য মিনারটিও কেঁপে ওঠে ও গায়ে বাঁধা ঘন্টিগুলি বাজতে থাকে টুংটাং। বেশ মজার ব্যাপার। শুনেছি আহমেদাবাদেও আছে এইরকম কম্পিত মিনার, কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
ইসফাহান ছাড়ার আগে একটি ছোট্ট মিউজিয়ামে গেছিলাম। নানারকম বাজনার সংকলন। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত গানের ও বাজনার কী রকম বিবর্তন হয়েছে সেটা বেশ বোঝা যায়। আছে পুরনো আদিবাসীদের বাজানো ঢোলক, মাদল, বাঁশী। প্রতিবেশী ভারতের সেতার ও তবলাও দেখলাম; একটা ঐতিহাসিক বেহালার মত বাজনা নাকি ঘোড়ার মাথার কংকাল দিয়ে বানানো হত। এখন অবশ্য কাঠের সাহায্যে ঐ আকারেই বানানো হয়। মিউজিয়ামে সংলগ্ন কারখানা আছে সেখানে কারিগরেরা সযত্নে হাতে করে এইসব বাদ্যযন্ত্রগুলি তৈরী করেন। কয়েকজন বাদ্যকার ঐ পুরনো যন্ত্রে সুর তুলে আমাদের একটি অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে শোনালেন পারসী ক্ল্যাসিকাল মিউজিক। রবি ঠাকুরের ভ্রমণের সময় প্রতি শহরে তাঁর সংবর্ধনায় গানের আসর বসেছিল। আমার ভাগ্যে এই একটাই।
ইসফাহান থেকে আবার তেহরানে ফিরলাম। কবিগুরু তেহরান হয়ে পশ্চিমে ইরাকে গেছিলেন — বাগদাদে। আমরা বাড়িমুখো। ইরাকে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই আপাতত:।
তেহরানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম শাহ রেজা পহলবী দেখা করেছিলেন — আজ থেকে ৮৬ বছর আগে। তখন ইরান সদ্য বিদেশী শাসন ছেড়ে একটি স্বাধীন, আধুনিক দেশ গড়া শুরু করেছে। প্রায় দশ বছর পর ভারতও ঐ পথে পা দেবে, তবে কোনো রাজা বা শাহের অধীনে নয় — একটি গণতন্ত্র হিসাবে। তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল চল্লিশ বছরের মধ্যে চাকা কেমন ঘুরে যাবে!
তেহরানে ইসফাহান বা শিরাজের মত পুরনো মসজিদ নেই কিন্তু দুটি প্রাসাদে - গুলস্তান ও সাদা-আবাদ — দুই পহলবী শাহের রাজত্বের চিহ্ন সংরক্ষিত আছে — বেলোয়ারি ঝাড়বাতি, দামী আসবাবপত্র, অমূল্য সিল্কের কার্পেট ইত্যাদি।
এটা ভাল যে এরা রাগের মাথায় সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দেয় নি। দ্বিতীয় শাহ কোন ঘরে প্রেসিডেন্ট কার্টারকে ডিনার খাইয়েছিলেন--তা-ও কাঁটা চামচ প্লেট সুদ্ধ রাখা আছে। সাদ-আবাদ প্রাসাদের বাগানে অবশ্য আছে একজোড়া দশফুট উঁচ ব্রোঞ্জের বুট-জুতো। এটা নাকি দ্বিতীয় শাহের মূর্তির অবশিষ্ট। বাকী মূর্তিটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল।
এই আয়াতোল্লার রাজত্ব এখন আপাত দৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ, কিন্তু কতদিন টিকবে বলা যায় না। পশ্চিম দেশগুলি স্যাংশন চাপিয়ে সাধারণ লোকের জীবনই অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সহজে পাওয়া যায় না। গরীব ও মধ্যবিত্তদেরই বেশি কষ্ট। দলে দলে শিক্ষিত জোয়ান ছেলেমেয়েরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে (বেশিরভাগই আমেরিকায়)। নিমা ও অথিনা দুজনেই দিনরাত খাটছে কিন্তু উপার্জন এত কম যে ইচ্ছা থাকলেও বিয়ে বা ছেলেপুলের কথা ভাবতেও পারে না। এটা খুবই দু:খের ব্যাপার। আশা করি এই অবস্থার উন্নতি হবে। সাধারণ লোকেরা অন্তত খেয়ে পরে থাকতে পারবে। ইনসাল্লা!
(ভ্রমণকাল--অক্টোবর ২০১৮)
(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)