--গুড মর্নিং, শশী বলে--কী করছ?
--চানে যাচ্ছি।
--কেন?
শশী সবেতেই প্রশ্ন করে, 'কেন?'
--কেন তোমার মুণ্ডু!
মামা, মামী, ও বাবান-দাদা সবাই হো হো করে গেসে উঠল। পুপলু গুবলু যবে থেকে মামার বাড়িতে আছে বাড়িতে সবসস্ময়েই হুলুস্থুলু লেগেই আছে। শশীও খুব চনমনে থাকে। সন্ধের পর শশীর খাঁচা একবার খুলে দেওয়া হয়। মামী তখন বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখেন। শশী মামীর পা বেয়ে বেয়ে কোলে উঠে বসে পড়ে। কখনো কখনো ছোটো ছোটো উড়াল দিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। গুবলু যদি কখনো মামীর কোলে বসেছে, শশী জোরে জোরে আওয়াজ করে ঠিক ওখানেই বসতে চাইবে। গুবলু তখন 'শশী, তুমি খুব দুষ্টু' বলে জায়গা ছেড়ে দেয়। মামা তখন বলেন--গুবলু, শশী থাক মামীর কাছে, তুমি আমার কাছে চলে এসো। শশীকে আমি একদম জায়গা দেব না।
গুবলু একদৌড়ে গিয়ে মামার কোলে উঠে পড়ে।
পুপলু, গুবলু ইস্কুলে গেলে শশী অসংখ্য বার 'মা, পুপলু কোথায়? গুবলু কোথায়?' বলে চিৎকার করতে থাকে। মামীও প্রতিবার উত্তর দেন, "স্কুলে গেছে"। গুবলু একদিন রেগে গিয়ে বলে, "মামী একবারের বেশি জবাব দেবে না তো; শশী খুব দুষ্টু। ও ইচ্ছে করে তোমাকে জ্বালাতন করে।" মামী খুব হাসেন গুবলুর কথা শুনে।
পুপলু, গুবলু ইস্কুল থেকে ফিরলে ওদের নাম ধরে ডেকে শশী খাঁচার ভিতর লাফাতে থাকে। ওরাও ঘুরতে ফিরতে ওর সাথে কথা বলে, ওকে নিয়ে কথা বলে। শশী, পুপলু, গুবলু--এই তিনজনকে নিয়েই মামা-মামী আছেন। বাবান-দাদা ও তিস্তা-দিদি বড়ো হয়ে গেছে; যে-যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবু রাতে ওরা বাড়ি ফিরলে মামী এই তিনজনের কীর্তি-কাহিনী সব গল্প করেন আর বাড়িতে দিনের শেষে আবার হাসির ফোয়ারা ওঠে।
সেদিন পুপলু বলছিল--জানো শশী, আমার না ইস্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না।
--কেন?
--বাড়িতে তো তোমরা সবাই আছ। ইস্কুলে আমি একদম একলা হয়ে যাই। ফ্রেন্ডস-রা জিগ্যেস করে তুই ইস্কুলে বাড়ি থেকে আসিস না কেন? ম্যাডামরা জিগ্যেস করেন তোমার বাবা কেমন আছেন? এসব শুনে মা-বাবার কথা বেশি করে মনে পড়ে আর চিন্তা হয়। বাবার জ্বর কমল কিনা কে জানে! বাবার না রক্তে কী গোলমাল আছে। এইজন্যেই তো জ্বর। আমি না, কাল স্বপ্ন দেখেছি মায়েরও জ্বর হয়েছে। কী হবে তাহলে?
শশী চুপ করে পুপলুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
--আজ মা ফোন করবে তো শশী?
শশী আওয়াজ করে। যেন পুপলুকে আশ্বাস দেয়।
দুদিন হয়ে গেল। মায়ের ফোন এলো না। পুপলুর চোখটা ছলছল করে উঠল। পুপলু বলে গুবলুটাও এত ছোটো না, ওকেও সব কথা বলা যায় না। মামীকে কি বলবে একটা ফোন করতে? মামীর এত কাজ! পুপলু করুণ মুখে শশীর খাঁচার পাশে গিয়ে বসল। শশীর লাফালাফি বেড়ে গেল।
--আঃ, শশী! আস্তে, আওয়াজ আমার একদম ভালো লাগছে না। বাবার কি বাড়াবাড়ি হলো? এতদিন ধরে তো মা রোজ সন্ধের পর ফোন করে এসেছে। দুদিন ধরে ফোন নেই কেন? শশী, তুমি তো উড়তে পার, তুমি কি গিয়ে দেখে আসবে আমার মা-বাবাকে? চেন্নাই তো কাছেই, বেশি সময় লাগবে না। প্লেন তো দু'ঘন্টায় পৌঁছে যায়!
শশী আবার লাফাতে থাকে।
--তুমি যাবে তাহলে? যাবে?
শশী আওয়াজ করে জোরে জোরে।
--শশী, বাবা না কুমারণ হসপিটালে আছে। তুমি তো আমার মা-বাবা দুজনকেই চেন? বাবাকে খুঁজে নিতে একদম অসুবিধে হবে না। বাবা-মা ওরাও তো তোমাকে অনেকবার দেখেছে। তবু যদি চিনতে না পারে, তো বলবে পুপলু খুব কাঁদছে। মা ফোন করেনি কেন? ওদের সব খবর নিয়ে আসবে।
শশী ডানাটা একটু নাড়ে।
--ওদের বোলো, আমি আর গুবলু খুব ভালো আছি। ট্রেনে যেতে যেতে আমি দেখেছি রাস্তায় প্রচুর ফলের গাছ আছে। খিদে পেলে ফল খেও। এখন এই ছোলাগুলো খেয়ে নিয়ে জল খাও। তারপর আমি তোমার খাঁচা জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে খুলে দেব। তুমি কিন্তু বাবাকে দেখে সোজা বাড়ি ফিরে আসবে। অন্য কোত্থাও যাবে না। তুমি না ফিরে এলে আমাদের সবার খুব দুঃখু হবে। শশী তুমি অন্য কোথাও যাবে না তো? পথ হারিয়ে ফেলবে না তো? আমি কিন্তু তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।
শশী আবার জোরে জোরে ডেকে ওঠে।
পুপলু এবার জানালার কাছে খাঁচাটাকে নিয়ে গিয়ে খাঁচার দরজাটা খুলে দিল। শশী বেরিয়ে এল বাইরে। পুপলু ওকে হাতে নিয়ে জানালার বাইরে ছেড়ে দিল। শশী উড়তে পারছে না। বার বার পড়ে যাচ্ছে আর আবার উঠে ওড়ার চেষ্টা করছে। এবার উড়তে পারল। পুপলু দেখছে শশী উড়ে যাচ্ছে দূরে নাগালের বাইরে। একটু একটু করে বিন্দু হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
******
--মামী, আমি শশীকে ছেড়ে দিয়েছি মা-বাবার খবর আনার জন্যে। ও উড়ে উড়ে চলে গেল। ও কি চেন্নাই যেতে পারবে? ও যদি রাস্তা হারিয়ে আর ফিরে না আসে? পুপলু জোরে কাঁদতে থাকে।
--কোথায়? শশী তো কোথাও যায়নি! ওই তো মনে আনন্দে বসে ভুট্টা খাচ্ছে। দেখবে এসো। তুমি স্বপ্ন দেখেছ পুপু, কাঁদে না। এই বলে মামী পুপলুকে জড়িয়ে ধরলেন।
--পুপু, মা-বাবার জন্যে মনকেমন করছে? চলো, আমরা মাকে এক্ষুনি একটা ফোন করি।
(পরবাস-৭১, ৩০ জুন ২০১৮)