[ফি শনিবারের মত সেদিনও সন্ধ্যার দিকে স-বাবুর বাড়িতে বৈঠক জমতে শুরু করেছিল। কমপিউটর নিয়ে বসে থাকলেও স-বাবু আসলে বন্ধুবান্ধবদের আসার পথ চেয়েই বসেছিলেন। একে একে সবাই ঢুকতে—]
স-বাবু— মধুছন্দার এবারের লেখাটা পড়েছেন?
নি-মাসি— [হেসে] ‘লম্বা হাত’ তো? হ্যাঁ, বেশ লাগল। আরও এইজন্যে যে ছোটবেলায় প্রায় এমনি একটা গপ্পো পড়েছিলাম।
ছ-দি— আরে হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও পড়েছি। বিষয়টা ওই একই, তবে সেটিং ও পাত্রপাত্রী আলাদা। কিন্তু নামটা পেটে আসছে মুখে আসছে না—
নি-বাবু— এত ভাল লেগেছে আপনাদের! তাহলে তো পড়তেই হয়। কি নিয়ে গল্প লিখলে মধুছন্দা?
নি-মাসি— ভূতের গপ্পোই, হাল্কা গা-ছমছমে, তবে বেশ জম্পেশ। আমার ছেলেবেলায় (এই তখন এইট নাইনে পড়ি বোধহয়), প্রায় এমনি একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা এক জামাইকে নিয়ে। কথাই যখন উঠল তখন ছোট করে গল্পটা বলি আপনাদের, কি বলেন? আমার যেমন মনে আছে, তেমনি বলছি। আসল গল্পটা খানিক অন্যরকমও হতে পারে। এক গ্রামে মড়ক লেগে সকলে মারা যায়। সে গ্রামের এক জামাই কিন্তু এ খবর পায়নি। সে অনেকদিন পরে সেই গ্রামেই তার শ্বশুরবাড়ি যায়। গিয়ে দ্যাখে কি সাংঘাতিক ব্যাপার! শ্বাশুড়ি-মা রান্না ঘরে বসেই লম্বা হাত বাড়িয়ে বাগানের পাতিলেবু পাড়ছেন, শ্বশুরমশাই ওই একভাবেই উঠোনে বসে পাড়ছেন ডাব জামাই বাবাজীবনের জন্য। জামাইয়ের তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! শেষে বোধহয় পা-গাড়ি প্রাণপণে ছুটিয়ে তবেই ছাড়ান! তবে কি জানেন গল্পটা ছোটদের ভূতের গপ্পো হলেও একটু ঘুরিয়ে দেখলে জামাই আদরের ঘটাও চোখে পড়ে।
নি-বাবু— কি রকম কি রকম?
নি-মাসি— দেখুন ভূত তো আর সকলে নয়, কিন্তু জামাই বাড়ি এলে যেন লম্বা হাতে (দরাজ হাতে) কত কি যে আয়োজন করেন বাংলার মানুষ! এই ধরুন না জামাইষষ্ঠীর দিনের কথা। কত প্যাঁচ কষে বিধান দেওয়া আছে জামাই বাবাজীর জন্য, কি এলাহি রান্নাবান্না! কিন্ত বাড়ির মেয়েরা সেদিন ষষ্ঠী মেনে খাবে শুধু দই চিঁড়ে মুড়কির ফলাহার। এখন কি হয় জানি না, তবে আমাদের কম বয়সে শ্বশুরবাড়িতে তাই চল ছিল— ননদ নন্দাই আসবেন; আমরা বৌমারা রেঁধে মরে গন্ধ শুঁকেই ক্ষান্ত!
স-বাবু— [ঠাট্টা করেই বললেন] নি-মাসি আজও ক্ষোভ পুষে রেখেছেন, তা কোথায় বিধান দেওয়া ছিল?
নি-মাসি— ওই মুখে মুখেই বোধহয় চলে এসেছে —ওই বলে না— এটা করতে নেই, ওটা করতে আছে — সেই পর্যায়েই পড়ে ওই বিধান। আর ক্ষোভ বলছেন? ঠিক ক্ষোভ নয়। কিন্তু কি জানেন, সবেতেই এই মেয়েদের মেরে রাখা — দুঃখ হয় না কি বলো ছ-?
ছ-দি— হয়ই তো, খুব খুউব হয়। তবে এক জায়গায় পড়ছিলাম, ওই তোমার ঠিক এবারের জামাইষষ্ঠীর আগেই বোধহয়, লেখিকা জামাইদের টিপস দিচ্ছেন শাশুড়ি-মাকে কি উপহার দিয়ে সারপ্রাইজ দেওয়া যায়। শেষে স্থির হল ওঁনার ছেলেবেলার ফোটো সংগ্রহ করে ল্যামিনেটেড এ্যালবাম।
নি মাসি— তাই সই। ওই একটু একটু করে চোখ ফুটছে, চক্ষুলজ্জাও জাগছে, কি বলেন আপনারা?
স-বাবু— পুরুষমানুষ হয়ে জন্মেছি —এ-হেন সমাজ-প্রথায় ভারি লজ্জা পাই।
নি-বাবু— আরে রাখেন মশায় লজ্জা-টজ্জা! ওই গানটা মনে পড়ে? ‘বলি ও ননদি আর ক মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে/ ঠাকুরজামাই এল বাড়িতে’— প্রথা যাহাই হউক, অনেক সময় তাহাকে ঘিরিয়াই কল্পনার ফুল ফোটে!
নি-মাসি— তাই যদি বলেন তবে রবীন্দ্রনাথের ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’–এর কথা একটু না বললে নয়, কি বলেন?
সকলে— হ্যাঁ হ্যাঁ বেশ তো!
নি-মাসি— স-বাবু, ওই তো গল্পগুচ্ছটা দেখতে পাচ্ছি আপনার বুক-শেলফে। দিন তো, কোলে রাখি, মাঝে একটু পড়ে শোনাই। যজ্ঞেশ্বর লম্বা হাতে (দরাজ হাতে) জামাই বাড়ির লোকেদের যত্ন করতে পারেনি তাই তাঁর কত হেনস্থা! আসলে পাত্র বিভূতি নিজের মতে বিয়ে করাতে গৌরসুন্দরের মনে সে রাগও পোষা ছিল। কিন্ত সত্যিই কি পারেনি যজ্ঞেশ্বর? এবার একটু পড়ছি-- ‘যজ্ঞেশ্বর তাহার স্বল্পাবশিষ্ট যথাসর্বস্ব পণ করিয়াছে। নূতন আটচালা বাঁধিয়াছে। পাবনা হইতে ঘি ময়দা চিনি দধি প্রভৃতি আনাইয়াছে। ... এমন সময় ... বিবাহের দুইদিন আগে হইতে প্রচণ্ড দুর্যোগ আরম্ভ হইল। ... দ্রব্যসামগ্রী কতক পাবনা হইতে পথের মধ্যে কতক-বা ভগ্নপ্রায় পাকশালায় গলিয়া গুলিয়া উনান নিবিয়া একাকার হইয়া গেছে। ... দুর্গতি দেখিয়া বাথানপাড়ার গোয়ালারা বলিয়াছিল, "ভয় কী ঠাকুর, ছানা যিনি যত খাইতে পারেন আমরা জোগাইয়া দিব।" কিন্তু — 'যজ্ঞেশ্বর যেমন-যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরযাত্রগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ্টপ্ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। ... [যজ্ঞেশ্বর] কহিলেন, "আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই।" একজন শুষ্কহাস্য হাসিয়া উত্তর করিল ‘মেয়ের বাপ তো বটেন, সে অপরাধ যায় কোথায়।"'
কিন্তু বিভূতির মাধ্যমে লেখক এর যোগ্য উত্তর দিয়েছেন — ‘এমন সময় ভোজনশালায় অসময়ে বর আসিয়া উপস্থিত। ... বিভূতি রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন "বাবা, আমাদের এ কীরকম ব্যবহার।" গোয়ালাদিগকে বলিলেন, "তোমরা পশ্চাৎ দাঁড়াও, কাহারও ছানা যদি পাঁকে পড়ে তো সেগুলা আবার পাতে তুলিয়া দিতে হইবে।" ... ছানা যথাস্থানে পৌঁছিতে লাগিল।’
স-বাবু— কবির দরদী মনের এমন কত পরিচয়ই যে আমরা গল্পগুচ্ছে পাই।
ছ-দি— আরে, আরে, আরো যে মনে পড়ে যাচ্ছে। শ্রী সত্যজিৎ রায়ের তিন কন্যার শেষ গল্প ‘সমাপ্তি’তে পাত্র মেয়ে দেখতে গেছেন। মেয়ে দেখিয়ে থালাভরা মিষ্টান্ন দিয়ে চলছে হবু জামাইয়ের আপ্যায়ন। এর মাঝে মৃণ্ময়ীর হাত ফস্কে জানলা দিয়ে কাঠবেড়ালি চরকির ঘরে ঢুকে পড়ায় হুলস্থূল কাণ্ড! এক বিশাল মানুষের লেখা আরেক বড় মাপের নির্দেশকের হাতে পড়লে যে কি হয় তারই নমুনা। লম্বা হাতে জামাই আদরের মজাদার উপস্থাপনাও বটে।
নি-বাবু— জামাই আপ্যায়ন নিয়ে তো অনেক শুনছি। কিন্তু একটু চা হলে তো মন্দ হত না, কি বলেন ছ-দি?
স-বাবু— [শশব্যস্ত হয়ে অন্দরমহলে হাঁক দিলেন] কানাই-ও কানাই! মাকে বল হাত খালি হলে একটু চা হবে কি? সংগে একটু—
[ওদিক থেকে সাড়া এল ‘খানিক রও, আর কটা রুটি ফুলিয়ে কানাই যাচ্ছে।’]
নি-মাসি— [যেন নিজের মনেই বলতে লাগলেন] ‘মন বোধহয় সত্যিই এক স্ট্রীম অফ কনশিয়াসনেস। আর ঘটনাগুলো যেন পাতা। কখনো এগোয় কখনো পেছোয় জলের টানে। কোন টানে কোথায় যাবে বলা মুস্কিল। নইলে ওই ‘লম্বা হাত’ কি এতো কথা টেনে নিয়ে আসত?
নি-বাবু— সবার অলক্ষ্যে চোখ টিপে নীচু স্বরে টিপ্পনী কাটলেন — ‘নি-মাসি নিজের প্রিয় বিষয়ে পৌঁছে গেছেন’।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)