কোমর থেকে খসে পড়া হাফ প্যান্টটাকে প্রাণপণে একহাতে ওপরে টানতে টানতে পুকুরের দিকে যাচ্ছিল বুধো। কালকেই দেখে এসেছে পুকুর পাড়ের বাতাবি গাছটার ডগার দিকে একখানা বাতাবি পেকে এসেছে। তাড়াতাড়ি না গেলে আর কেউ দখল করে নিতে পারে। যদি বাতাবিটা পায়, অনেকদিন পরে আজ ভাতের পাতে একটু টাকনা হবে। নইলে শুধু নুন-ভাত খেতে খেতে জিভ হেজিয়ে গেছে। অবশ্য এখন মাসের সাতাশ তারিখ। প্রতিবার মাসের শেষটা এরকমই যায়। তারপর মাস পয়লায় মা কাজের বাড়িগুলো থেকে মাইনে পেলে ভাতের সাথে আর কিছু একটা জোটে। ওর তো এখনো ইস্কুলে যাবার বয়েস হয়নি। নইলে নয় মিডডে মিল থেকে দুপুরের খাবার পেত। আপাতত মা বেরিয়ে গেলে এদিক সেদিক খুঁজে এগাছ কি সেগাছের কলা মুলোটা জোগাড় করে রাখে মায়ের জন্য। মাও গেছে পুকুরে চান করতে। বাতাবিটা পেলে মায়ের সাথে একসাথেই ফিরবে।
বাতাবির চিন্তাতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল বুধো তাই পাশ দিয়ে আসা জিপ গাড়িটাকে একদম খেয়াল করেনি ও। হঠাৎ চমক ভাঙল একটা ডাকে, "এই ছোঁড়া, এদিকে শোন।"
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বুধো। গাড়িতে একটা আস্ত সায়েব বসে। ওরে বাবারে। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, "আমি কিছু করিনি গো।"
"আহা, তুই কিছু করবি কেন? সেজন্য কে ডাকছে? বলছি, কাজ করবি?" সাহেববাবুর পাশে বসা প্যান্ট শার্ট পরা বাঙালিবাবুটা বলল।
এতক্ষণে বুধোর বুকে একটু সাহস ফিরে এল। ও, তাহলে এরা কাজ করতে ডাকছে। তা কাজ পেলে ভালোই হয়। টাকা দেবে তো? তাহলে আজকে সন্ধেবেলা মাকে চমকে দিতে পারবে, বাজার থেকে কিছু কিনে।
"কাজ করব, তা তোমরা টাকা দেবে তো কাজ করলে?"
"তোর তো দেখি বড্ডো টাকার খাঁই। কাজের আগেই টাকার খোঁজ? বলি বয়েস কত তোর?"
"মা বলেছে এই আশ্বিনে পাঁচ পুন্ন হবে।"
"এ বয়েসেই এতো টাকা চিনেছিস রে?"
"টাকা না দিলে কাজ করবনি।"
সাহেব এতক্ষণ কিছু বলেনি, এবার ভাঙা বাংলায় বললো "টোমায় আমি টাকা ডিবে। টুমি আমার সাটে কাজ করবে?"
পট করে এবার ঘাড় নাড়লো বুধো, "কি কাজ করতে হবে?"
"আমরা টোমার ছবি তুলব। যেরকম বলব, ডাঁড়াবে। পারবে?"
একগাল হেসে ঢক করে ঘাড় নাড়লো বুধো। পারবে না মানে? খুব পারবে। ওই ক্যামেরাতে ফটো তুলতে পারা বুধোর বহুদিনের শখ। গত বছর শীতে সিনেমাপাট্টি এসেছিল। ওদের শুটিনের জন্য কত্ত বাচ্চাকে নিল। বুধোকে ছোট বলে ভাগিয়ে দিল। সব্বাইকে একশো করে টাকা দিয়েছিল। তারপর গরমকালে বই বেরোলে ওরা সব্বাই দল বেঁধে মেলার মাঠে দেখতে গেছিল বইটা। বুধো গল্পটা কিছু বোঝেনি বটে কিন্তু মেলা দেখানোর সময় যখন গাঁয়ের বাকি বাচ্চাদের দেখাচ্ছিল ওর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠেছিল।
"কি করতে হবে বলো।"
"ব্রেভ বয়। নাম কি টোমার?" বলতে বলতে সাহেব এবার গাড়ি থেকে নেমে এল। কাঁধে আবার ওটা কি? বন্দুক নাকি? বন্দুক অবশ্য সামনাসামনি কখনো দেখেনি বুধো। কিন্তু মেলার মাঠের সিনেমায় অনেক দেখেছে।
"তোমার কাঁধে কি এটা বন্দুক?"
বাঙালিবাবুটা খ্যাক খ্যাক করে উঠলো। "এটা ক্যামেরা। আর তোর অত কথায় কাজ কি? সাহেব দাঁড়াতে বলেছে, দাঁড়া।"
সাহেব গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে খ্যাচর খ্যাচর করে ছবি তুলতে লাগল। কখনো বুধোকে দাঁড়াতে বলে বা কখনো বসতে। ছবি তোলে নিজের মনেই কিসব দেখে আর মাথা নাড়ে।
খানিক পরে সাহেব হঠাৎ ইঞ্জিরিতে বাঙালিবাবুকে কি সব বলতে থাকে।
বুধোর বুকটা ঢিবঢিব করতে থাকে। সাহেব মাথা নাড়ছে কেন? ছবি পছন্দ হয়নি? টাকা দেবে না?
বাঙালিবাবুটা হঠাৎ হাতছানি দিয়ে ডাকল বুধোকে, "এই ছোঁড়া এদিকে আয়।"
"কি বলছ?"
"বলছি এদিকে কোনো মেয়ে আছে?"
"আমার মতন? ক্যানে আমায় দিয়ে হবে না?"
"আরে তোর বয়েসী না। তোর মায়ের বয়েসী, সাহেবের শখ হয়েছে মায়ের সাথে বাচ্ছার ছবি তুলবে।"
"আমার মা-ই তো ওই পুকুরে চান করতিছে। ডেকে আনি?"
দুজনের অনুমতি পেয়েই বুধো এক ছুট লাগায় পুকুরের দিকে,
"হেই মা, মা, শোন না--"
"বুধো, তোকে কতবার বলেছি না ওই ছোটলোকগুলার লাগান তুইতোকারি করবি না। আর প্যান্টটা তোল হতভাগা। কোমর থেকে পড়ে যাচ্ছে তো।"
"মা, ওমা, একটা লালমুখো সায়েব ছবি তুলবে, টাকা দেবে বলছে।" উত্তেজনায় কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে বুধোর।
"কি বলছিস টা কি? ঠিক করে, আস্তে আস্তে বল।"
কথাগুলো আরেকবার শুনে ভুরুটা একটু কুঁচকোল মানসীর। হঠাৎ একটা বিদেশী লোক ওদের ছবি তুলে ওদের টাকা দেবে কেন?
চানটা করা হয়েই গেছিল। ভিজে গামছাটা মাথায় জড়িয়ে শাড়ি-ব্লাউসটা গায়ে জড়াল মানসী। তারপর ওদের ভাতের হাঁড়িটা কাঁখে তুলল। আজ চান করতে গিয়ে কটা গেঁড়ি গুগলি পেয়েছে। ভাতের পাতে সেদ্ধ দেবে।
বুধো ততক্ষণে ওর হাত ধরে টানাটানি লাগিয়েছে। "ও মা তাড়াতাড়ি চলো না। নইলে সায়েব অন্য কারোকে নিয়্যা নিবে।"
ছেলের তাড়াতেই খানিক মানসী দেখতে গেল ব্যাপারটা কি। তাছাড়া সত্যি যদি কটা টাকা পায় মন্দ হয় না।
"কি গো সাহেব? কিসের ছবি তুলবে?"
মানসীকে দেখেই সায়েবের চোখটা চকচক করে উঠলো। উত্তেজিত ভাবে বাঙালিবাবুর সাথে ইঞ্জিরিতে কিসব কথা বলতে থাকে। সেসব বোঝার ক্ষমতা বুধো বা মানসীর নেই. তাই ওরা চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
একটু পরে বাঙালিবাবু বলল, "এই যে মেয়ে, এই সায়েব অনেকদূর থেকে ভারতের গ্রাম দেখতে এয়েছেন। তোমার আর তোমার ছেলেকে দেখে সায়েবের ভালো লেগেছে। তোমাদের ছবি তুলবেন আর তার জন্য উনি তোমাদের দুশো টাকা দেবেন। কী ভাবছ? চটপট দাঁড়িয়ে পড়, এ সুযোগ আর পাবেনি।"
দুশো শুনেই মানসী মনে মনে রাজি হয়ে গেছিল, তাও একটু চাপ দেবার জন্য বলল "না বাবু, পাঁচশো চাই।"
বাঙালিবাবু শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠছিল, সায়েবটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল "প্যাংশ ডেবে।" বলেই একটা পাঁচশোর নোট মানসীর হাতে দিল।
এবার সায়েব ইশারায় মানসীকে বলল বুধোর পাশে দাঁড়াতে।
দুপুর রোদ, গাছের ফাঁক দিয়ে হালকা রোদের কুচো ভেসে আসছে। বাঙালিবাবু বলল "মনে করো, তুমি চান সেরে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরছ। সেভাবে দাঁড়াও।"
সেরকম আবার হয় নাকি? ও আবার কবে মায়ের হাত ধরে চান করে ফিরেছে? কথাটা ভেবেই হাসি পেয়ে গেলো বুধোর। কিন্তু পাঁচশো টাকাটার কথা মনে পড়তেই আবার হাসি মুছে চট করে মায়ের হাতটা ধরে ফেলল। আরেক হাতে প্যান্টটা মুঠো করে ধরা।
সায়েব কিন্তু ইতিমধ্যে ক্যামেরাতে খচর খচর করেই চলেছে। আবার কিসব দেখে বাঙালিবাবুকে ইঞ্জিরিতে কিসব বলল।
বাঙালিবাবু বলল, "বলছি, ও মেয়ে তোমার ব্লাউজটা খোলো। সায়েবের মনে হচ্ছে তাতে ভালো ছবি হবে। আর ছোঁড়া তোর প্যান্টুলটা খোল।"
মানসী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "না বাবু, আব্রু বেচতে পারবনি।"
"আহ, আব্রু কে চাইছে তোর, শুধু ব্লাউজটা খোল আর ছেলের প্যান্টুল।"
সাহেব এবার নিজেই এগিয়ে আসে বেগতিক দেখে।
"টুমি প্লিজ এটা করো, টোমাকে বেশি টাকা ডিবে।"
কাঠ হয়ে যাওয়া মানসীর হাত ধরে সায়েব নিজেই সেখানে আরো একটা পাঁচশোর নোট গুঁজে দেয়।
ধরা গলায় মানসী বলে--
"বুধো, হাপ্প্যান্টটা খোল।"
বুধো এইবারে পুরো হতভম্ব হয়ে যায়।
"প্যান্টু খুইলে দেব? তুমি যে নাগাড়ে বলো প্যান্টু না পরলে লোকে ছোটোলোক, অসভ্য বইলবে।"
"কথা না বাড়িয়ে হাপ্প্যান্টটা খোল বলছি।" ঠাস করে বুধোর মাথায় একটা চাঁটি মেরে নিজের ব্লাউজ খুলতে খুলতে উপচে আসা চোখের জল আটকে কথাগুলো বলে মানসী।
প্যান্টটা খুলে বুধো কোনদিকে তাকাবে বুঝতে পারে না।
জ্ঞান হওয়া অবধি এক চান করার সময় ছাড়া মা কখনো ন্যাংটো থাকতে দেয়নি। এখন এই বাইরের দুটো বিদেশী লোকের সামনে হঠাৎ করে নেংটু হয়ে গিয়ে ভারী লজ্জা লাগছিল ওর। একটা হাত তো মায়ের হাতে। অন্য হাতটা বারবার নিজের ঘুনসির সামনেটায় চলে যাচ্ছিল।
সায়েব ফটো তুলতে তুলতে আবার এগিয়ে এলো। এবার হাতে একটা কচুপাতা। "বয়, এটা ঢোর।"
হঠাৎ করে কচুপাতাটা দেওয়ায় হতভম্ব হয়ে গেছিল বুধো।
সায়েবের ক্যামেরায় মুহূর্তে বন্দি হলো বুধোর ক্ষণিকের হতভম্বতা আর মানদার রাগ, দুঃখহতাশা মেশানো মুখ আর ঠোঁট টিপে চোখের জল আটকানোর জন্য সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা।
এতক্ষণে ছবি পছন্দ হয়েছে।
সায়েব বুধোর গাল টিপে আদর করে ওর হাতে কটা চকোলেট গুঁজে দিল, আর মানসীর হাতে থ্যাঙ্ক ইউ বলে দুটো পাঁচশোর নোট। তারপরে জিপে উঠে পড়ল সায়েব আর বাঙালিবাবু। ধুলো উড়িয়ে জিপটা নিমেষে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে গেল।
বুধো হাতে ধরা চকোলেটগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ভাবার চেষ্টা করছিল এগুলো গেরামের মুদিখানায় দেখেছে কিনা। এগুলান সেরকম দেখতে না। হঠাৎ ওর চমক ভাঙল মায়ের কান্নার শব্দে। তাড়াতাড়ি গিয়ে আধ খসা প্যান্টুলটা কোমরে জড়িয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরল বুধো।
"ও মা, মা আর কান্দিস না। এই দেখ প্যান্টুল পরেছি। আর কখনো খুলব না মা। এবার পুজোয় একটা বোতামওয়ালা প্যান্টুল দিস। তাইলে আর কেউ প্যান্টুল খুলতে বলবে না।" নিজের দুটো ছোট ছোট হাতে প্রাণপণে মায়ের চোখের জল মোছাতে লাগলো বুধো।
গাড়ির সামনের সিটে বসে কমলের তখন আনন্দে বত্রিশপাটি বেরিয়ে গেছে। উফফ, সাহেবকে গরিবদের গ্রামবাংলা দেখাবার ঝক্কি কি কম। কে বোঝাবে আজকাল গ্রামের দিকেও লোকে জামাকাপড় পরে, এরকম গরিব হয় না। মুখে ফেনা উঠে গেছিল সাহেবের পছন্দমতো গরিব লোক খুঁজতে। ভাগ্যিস বাচ্ছাটাকে দেখে বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। নয়তো টালিগঞ্জের মামনিদের ধরলে কমিশন দিয়ে ওর আর কোনো টাকা বাকি থাকত না নিজের জন্য। যা হোক আজকের ছবিটার জন্য কমসে কম পাঁচ হাজার টাকা নেবে সাহেবের থেকে।
পেছনের সিটে বসে ছবিগুলো দেখতে দেখতে তখন জনের মুখেও চওড়া হাসি। খুব ভালো ফটো পাওয়া গেছে। মেয়েটার মুখের রাগ, দুঃখ, হতাশা, প্রাণপণে আটকে রাখা কান্না আর বাচ্চাটার হতবাক ভাব সব মিলিয়ে দারিদ্রের ক্যান্ডিড ছবি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। গ্রামবাংলার এই "অথেন্টিক" ছবিটা বিক্রি করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে কমসে কম হাজার দুই ডলার পাবে ও। কপালে থাকলে পুলিৎজারটাও লেগে যেতে পারে বৈকি।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)