"আমি আছি" — যেন আবার বলে উঠলো সে।
— মন্দিরার দিকে তাকিয়ে।
— ঠিক আগের মতোই।
— একদৃষ্টে।
কারণ আবার ছবিটা বাইরে এলো। মন্দিরার বিছানার পাশে। মাথার ধারের টেবিলটার উপরে। বাইশ বছর বাদে। মাঝরাতে।
"আমি আছি" — যেন একদৃষ্টে মন্দিরার দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলেছিলো সে। মন্দিরার শরীরে যেন একটা তীব্র শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিলো। যেন মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গিয়েছিলো তার সমস্ত দেহ। তখনই তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিলো সেই ছবিটা। সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে কুড়িয়ে নিয়ে তার খামে পুরে ফেলেছিলো মন্দিরা। আর খামটা রেখে দিয়েছিলো তার লোহার ট্রাংকটার সমস্ত জিনিসপত্রের নীচে। তারপর ট্রাংকটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো খাটের নীচে, একেবারে ভিতরের দিকে। এই সবকিছু যেন এক নিশ্বাসে করে ফেলে স্থির হয়ে বসেছিলো মন্দিরা, ওই ঘরের মেঝের কোনটিতে। অনেকক্ষণ ধরে।
রাত। ক্রমশ গভীর হচ্ছিলো। নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিলো। মন্দিরাকে ঘিরে। মন্দিরা ভাবছিলো — কি প্রয়োজন ছিলো তার? কি প্রয়োজন ছিলো এইভাবে এইঘরের সব কিছু এত তন্নতন্ন করে পরিষ্কার করার? কি প্রয়োজন ছিলো ঘরের কোনায় পড়ে থাকা ধুলোপড়া চামড়ার ব্যাগটার ভিতরে কি আছে দেখতে যাওয়ার? কি প্রয়োজন ছিলো সেই ব্যাগের মধ্যে রাখা দুমড়োনো মুচড়োনো কাগজগুলোর থেকে 'ইমেজ ফোটো' লেখা সবুজ খামটা খুলে তার ভিতর কি আছে দেখতে যাওয়ার? কি প্রয়োজন ছিলো সেই খাম থেকে ছবিটা বার করে তার উল্টো পিঠে 'সমীর রায়, ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৮০' লেখাটা পড়তে যাওয়ার? এই সমস্ত কথা মাঝরাতে যতোটাই তোলপাড় করছিলো মন্দিরার মাথায়, ততোটাই যেন পাথরের মতো স্থির হয়ে যাচ্ছিলো সে। এইভাবে মন্দিরা বসে রইলো গোটা রাত। ভোররাতে কি মনে করে ট্রাংকটাকে আবার বের করে দেখে নিলো ওই খামটা ট্রাংকের সমস্ত জিনিষপত্রের নীচে গুঁজে দেওয়া আছে কিনা। তারপর একটা ভারী তালা লাগিয়ে দিলো ওই ট্রাংকের আংটাটায়। এবার যেন প্রাণপণ শক্তিতে সেটাকে ঠেলে দিলো খাটের নীচে, যতদূর ভিতরে পাঠানো যায় ততদূর। এইভাবে যথেষ্ট নিরাপদ ব্যবধানে কিংবা উপযুক্ত অন্ধকারে চলে গেলো ছবিটা।
কিন্তু সমীর রায় রয়ে গেলো। মন্দিরার চোখে। অন্তত মাঝরাতে। আর নিরালায়। ভয়ানক ভাবে। প্রায়শই।
এরপর থেকে প্রায়শই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতো মন্দিরার। ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পেতো কে যেন একজন ঝুলছে সিলিং থেকে। আর তার ঝুলে থাকা শক্ত হয়ে যাওয়া পায়ের আঙুলটা থেকে থেকে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার মুখটাকে। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসতো সে। ভয়ে ভয়ে তাকাতো সিলিংটার দিকে। নাহ। অবশ্যই— সেখানে কেউ ঝুলছে না। মন্দিরা চোখ নামিয়ে নিতো। ফের চোখ বুজলেই দেখতে পেতো — একমাথা কোঁকড়া চুল—টিকালো নাক —বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকা সেই ছবির মুখটিকে—যার তলায় মুক্তোর মতো অক্ষরে লেখা —'সমীর রায় — ১৮ই সেপ্টেম্বর'। তখনই মন্দিরার মনে হতো যেন কি মারাত্মকভাবে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওই সমীর রায়। বাকি রাতটা কিছুতেই ঘুম আসতো না তার। পাঁচ বছরের ঘুমন্ত শিশুপুত্রকে আকঁড়ে ধরে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে যেত একসময়ে।
একসময়ে কিন্তু মন্দিরা বাণীপিসির হাতে পায়ে ধরেই এ বাড়ির ওই ঘরে এসেছিলো। বাণীপিসি বলেছিলেন — "আমার আপত্তি আছে। আর তার কারণ তো তোমায় খুলেই বললাম।" মন্দিরা বলেছিলো — "আমার কোনো উপায় নেই। আমায় বাঁচতে হবে। আমার ছেলেটার জন্য। বাণীপিসি বলেছিলেন — "তা বলে এভাবে? তোমার কি কোনো ভয়ডর নেই?" মন্দিরা বলেছিলো — "মানুষের চেয়ে ভয়ের আর কিছুই নেই। অনেক কষ্টে আজ বুঝেছি এ কথাটা। তারপর নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বলেছিলো — "এই বাচ্চাটার মুখ চেয়ে যদি..." বাণীপিসি আর না বলেন নি। অতএব স্বামী পরিত্যক্তা উত্তর তিরিশের এই হতভাগ্য মহিলা তার শিশুপুত্রটিকে নিয়ে বাণীপিসির একতলার পিছন দিকের সেই ঘরটিতে এসে উঠলো। যে ঘর বন্ধ ছিলো বহুকাল।
"বহুকাল আগে ওই দিকটায় থাকতেন সুধীরবাবুরা। ওদের কোনো ছেলেপুলে ছিলো না। ওরা চলে যাওয়ার পর ওদের ভাইপো সমীর এসে উঠলো ওইখানে। তোমার পিসেমশাই তখন গত হয়েছেন। আমি আর আমার ছোটোছেলে এখানেই থাকি তখন। কারণ বড়োছেলে সেইসময়..."— বাণীপিসিমার কথার দীর্ঘসূত্রতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো মন্দিরা। সারা দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম। মাথার উপরে সমস্যার পাহাড়। আর কোলে রুগ্ন বাচ্চা। কিন্তু সে নিরুপায় — যেহেতু তার দুশ্চরিত্র লম্পট স্বামী ফেরার হয়েছে কিছুকাল আগেই — শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকে যাকে ছিঁড়ে খেতে চায় — যার বাপের বাড়ি বলে কিছু নেই — যে বাপ-মা মরা মেয়ের বড়ো হওয়া গলগ্রহের মতো তার মামার বাড়িতে — যারা তাকে বিয়ের নামে তাকে ঘাড় থেকে নামিয়েছে কোনোক্রমে — একটা সামান্য চাকরির জোরেই যাকে শিশুসন্তান নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে — এক চিলতে ঘরের সন্ধানে — তাকে তো শুনতে হবেই — তার আশ্রয়দাতার হাজার গল্প কথা।
গল্প হলেই ভালো হতো ব্যাপারটা। কিন্তু এটা ঘটনা। এবং মর্মান্তিক ঘটনা। যার জের চলেছিলো অনেকদিন। পাড়ায় এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে। বাণী সেন ঘরটি বন্ধ করে রেখেছিলেন বহুদিন। শেষপর্যন্ত বাধ্য হলেন খুলে দিতে। মন্দিরার জন্য। সে ঘরে প্রায় পাঁচ বছর বাস করেছিলো সমু অর্থাৎ সুধীরবাবুর ভাইপো সমীর। যে ঘরে সে রাতের পর রাত জেগে সে ছবি আঁকতো — কবিতা লিখতো — গুনগুন করে গাইতো রবীন্দ্রসংগীত — আর মাঝেমাঝে চুপচাপ বসে থাকতো একটা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা — সেই ঘরেই কোনো এক মহালয়ার সকালে সিলিং-এর ফ্যান থেকে গলায় দড়ি বেঁধে মরে কাঠ হয়ে ঝুলছিলো সে। আর এই ঘরেই বিছানা— তক্তপোশ পাতলো মন্দিরা — তার পাঁচ বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে — কোনো এক রোববারের সকালে — আরেক আশ্বিনের সকালে।
আশ্বিনে আশ্বিনে মন্দিরার একবছর পেরিয়ে গিয়েছিলো ওই ঘরে। অসম্ভব মনের জোরে মন্দিরা সরিয়ে রেখেছিলো তার সমস্ত আতংক। বাণী পিসির কাছ থেকে সমীর রায়ের আত্মহত্যার কথা শুনেও এই ঘরেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো সে। নাহ। ভয় পেয়ে আঁৎকে ওঠার মতো কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটেনি এই এক বছরে। হঠাৎ কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় নি। কোনো ছায়া দেখা যায় নি। অলুক্ষণে কিছুই ঘটে নি। কিন্তু একটা চাপা আতংক তো ছিলোই সর্বক্ষণ। তাছাড়া বাচ্চাটার কোনো বোধ হয়নি সেটাও রক্ষে। কিন্তু সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো ওই ছবিটা দেখার পরমুহূর্তেই। বিশেষ করে ছবির পিছনে "সমীর রায় ১৮ই সেপ্টেম্বর" লেখাটার জন্য।
এই আতংক নিয়েই দিন কাটতে শুরু করলো মন্দিরার। কিন্তু বাস্তব যাকে প্রতি মুহূর্তে একের পর এক সংকটের উপর আছাড় মারে, কল্পিত আতংক তার থেকে অজান্তেই দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়। তাই সমীর রায়ের ওই ছবি — ওই মুখ — ওই দৃষ্টি বাস্তবের ঢেউয়ে অনেক দূরে চলে গেলো মন্দিরার মন থেকে। কি ভাবে দিনগুলি মাসগুলি বছরে গড়িয়ে গিয়ে বিশটা বছর পার করে দিলো তা যেন টেরই পেলো না মন্দিরা। তাই ওই সেই ছবিটবির কথা সময়ের এক পুরু ধুলোর নীচে চলে গেলো — যাকে আমরা বিস্মৃতি বলে থাকি।
সময়ের আরেক হিসেবে মন্দিরা আজ একা হয়েও একা নয়। তার সেদিনের পাঁচ বছরের শিশু সন্তান আজ পঁচিশ বছরের প্রখর যুবক হয়ে বিরাট চাকরি-সূত্রে রাজস্থানে। আর সেদিনের সহায়সম্বলহীন মধ্যযৌবনের মেয়েটি আজ পুত্রের সাফল্যে এক উজ্জ্বল প্রৌঢ়া। যদিও ওই বাড়িতেই আছে সে। কেবল ওই বাণীমাসিমার(?? বাণীপিসিমা?) জন্য। বাণীপিসি অতিবৃদ্ধা হয়েছেন। এখন তিনিই যেন এক সহায়সম্বলহীন মানুষ। ফলত মন্দিরার উপর অতি নির্ভরশীল। সুখ স্বাচ্ছন্দ আর আসন্ন সৌভাগ্যের আলো যেন মন্দিরাকে ঘিরে আছে সর্বক্ষণ। তাই মন্দিরা আজ একা হয়েও একা নয়।
এখন মন্দিরা প্রায়শই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাচ্ছে। আর অক্টোবর মাসের পাতাটা বারবার দেখছে। ছেলের আসার কথা অষ্টমীতে। অর্থাৎ ৯ই অক্টোবর। তার মানে এখনো উনিশ দিন। তার পরেই আসবে তার বহুকাঙ্খিত সুখের সময়টি। আর তার মাঝে দুটো শনিবার। এই শনিবার গুলির অপেক্ষায় থাকে মন্দিরা। কারণ ছেলের ফোন আসে। প্রতি শনিবার রাতে। আজও সেই শনিবারের রাত। অতএব মন্দিরা ঠায় বসে আছে। রাতের খাওয়া সেরে। টেলিফোনটির পাশে। দেওয়াল ঘড়িটার সামনে।
ঘড়ির কাঁটা হিসেব মতো এগিয়ে চললো। যথাসময়ে ফোনও এলো। মন্দিরা জানলো যে তার ছেলে আসতে পারছে না। এবং তা অনির্দিষ্টকালের জন্য। কারণ তার এই চাকরিতে এখন বিরাট দায়িত্ব। তার হাতে এখন প্রচণ্ড কাজের বোঝা। তাই তার উপরওয়ালারা বলেছেন... ইত্যাদি ইত্যাদি। ফোন কলটি দীর্ঘায়িত হলো না। মন্দিরা যখন ফোনটা রাখলো তখন রাত এগারোটা। গোটা রাতটা মন্দিরা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো টেবিলটার পাশে।
পরদিন সকালে কি মনে করে কে জানে, মন্দিরা ঘর পরিষ্কার করতে বসলো। সমস্ত পুরনো তাক, আলমারি, সুটকেস, ট্রাংক এইসব গোছাতে শুরু করলো সে একে একে। সে এক এলাহি কাণ্ড। তার ছেলের ছোট্টবেলার জামাপ্যান্ট বইখাতা খেলার সরঞ্জাম সব ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। কেমন যেন আনমনে সে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো তার সন্তানের শৈশব কালের জিনিসগুলি। দরকারি অদরকারি কাগজপত্র সব একাকার হয়ে গেলো। মন্দিরা যেন এক ঘোরের মধ্যে তৈরি করতে লাগলো এইসব অজস্র জিনিসের স্তূপ। এবং এরই মাঝে বেরিয়ে এলো হলুদ হয়ে যাওয়া একটি খাম। যার উপর লেখা — ইমেজ ফোটোগ্রাফার। মন্দিরা সেই একই রকম অন্যমনস্কতায় খামটি খুললো। তারপর আস্তে করে বের করে আনলো খামের ভিতরকার জিনিসটাকে। তারপর সেটিকে হাতে নিয়ে দেখতে থাকলো আনমনে — একটি ছেলের মুখ — একমাথা কোঁকড়া চুল — বড়ো বড়ো চোখ — টিকালো নাক — কতো বয়স হবে? বাইশ? পঁচিশ? যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মন্দিরার দিকে। ছবির পিছনে সবুজ কালিতে লেখা "সমীর রায় ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৮২'' কথাগুলি হাল্কা হয়ে গেছে অনেকটাই।
অনেকক্ষণ কেটে গেলো মন্দিরার। ওই ছবিটাকে হাতে নিয়ে। কিন্তু নাহ। শরীরে কোনো আতংকের বিদ্যুৎস্পর্শ নয়। কোনো ভয়ের শীতল স্রোত নয়। হৃদ্যন্ত্রে কোনো অশ্বক্ষুরের প্রবল ধাক্কা নয়। মন্দিরা খুব আস্তে করে আঙুল বোলালো ওই হলুদ হয়ে যাওয়া ছবিটার উপরে। তারপর ছবিটাকে আলতো করে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলো খাটের পাশের টেবিলে রাখা ডেট ক্যালেন্ডারটার গায়ে।
এরপর রাত দ্রুত ঘন হয়ে এলো। মন্দিরা তার ক্লান্ত দেহটাকে একসময় নিয়ে ফেলে দিলো ওই বিছানার উপরে। সারাদিনের জমা হওয়া সমস্ত কষ্টক্লেদ ডুবে গেলো ঘুমের গাঢ় অন্ধকারে।
আর সেইসময় ওই ঘরের নিজস্ব আঁধারে — "আমি আছি" — কথাগুলি অব্যক্ত রেখে মন্দিরার মাথার কাছে স্থির হয়ে রইলো ওই তথাগত মুখশ্রীটি।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)