‘একটু তাড়াতাড়ি চালাও ভাই—সন্ধে হয়ে গেল, এই ট্রেনটা মিস করলে মুশকিলে পড়ব।’
প্যাডেলে চাপ বাড়িয়ে ভ্যানওয়ালা বলে উঠল—‘বাবু তাড়া আমারই বেশি, স্টেশনে আপনাকে নামিয়েই ফেরৎ যাব। এই জনমনিষ্যিহীন জায়গাটা ভাল নয়। তা ডাক্তারবাবুরা হাসপাতালে এতক্ষণ লাগালো আপনাকে ছাড়তে, কি ব্যাপার?’
‘আরে ভাই—ওরা কি আর আমাদের মতো ওষুধের ফেরিওয়ালাদের পাত্তা দেয়? মেডিক্যাল রেপ্রেসেন্টাটিভ নামটাই যা গালভরা। যাকগে, এর পরে আর ট্রেন আছে কি কলকাতা যাবার?’
‘রাতের দিকে আছে বটে একটা কিন্তু—’ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল সে। স্টেশন এসে যাওয়াতে ওষুধের স্যাম্পেল ভরা ব্যাগটা নিয়ে দৌড়ে স্টেশনে ঢুকলাম।
যা ভয় করছিলাম তাই, দেখলাম কলকাতা যাবার ট্রেনটা একটুর জন্য মিস করেছি। দূরে ট্রেনের পেছনের লালবাতিটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অদ্ভুত নির্জন এই স্টেশনটা। একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। অন্যদিকে বিরাট বিল। ওপার দেখা যায় না। নিকটবর্তী গ্রাম এই মাঠ পার হয়ে প্রায় তিন চার কিলোমিটার। এখন ষ্টেশনের বাইরেও লোকজন বা যানবাহন কিছুই নেই। বেশ একটা ছমছমে ভাব চারপাশে।
স্টেশন-মাস্টারকে পরের ট্রেনের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন--‘মশাই, আজকে কি যেতেই হবে? আজ আমার সাথে গ্রামে ফিরে কাল সকালের ট্রেনে যাবেন না-হয়।’
‘দাদা, যত রাতই হোক, আমার আজকেই যেতে হবে। নাহলে কাল একটা ইন্টারভিউ আমি দিতে পারব না।’
মনে হল উনি একটু চিন্তিত হয়েই বললেন--‘পরের ট্রেন ঘণ্টা তিনেক পর এবং সেটাই শেষ ট্রেন। আমি এখন গ্রামে ফিরে যাব। আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন ঐসময় এসে পরের ট্রেন পাস করাবে। ততক্ষণ এখানে কেউ থাকবে না। ষ্টেশনের ওয়েটিং রুম অনেকদিন খোলা হয় না। কি অবস্থা, কে জানে? সাপখোপও থাকতে পারে। আপনাকে ওই প্লাটফর্মের বেঞ্চেই বসে থাকতে হবে একা একা।’
‘ঠিক আছে, আমার কোনো অসুবিধে হবে না।’
‘যতটা সহজে কথাটা বললেন, কাজটা তত সহজ হবে না। জায়গাটা সন্ধের পরে কিন্তু খুব একটা সুবিধের নয়।’
‘আপনি কি চোর ডাকাতের কথা বলছেন?’
‘আরে না না। মানুষজনই নেই, চোর ডাকাত এসে কি করবে?’
‘তবে, আর কি?’
‘আপনার ভুতের ভয় নেই তো? এখান থেকে শ্মশানও খুব বেশি দূরে নয়। অনেকে নাকি রাতে অনেক অলৌকিক ব্যাপার দেখেছে এখানে।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার ওসব ভয় নেই।’
‘তবু কালকে গেলেই ভালো করতেন। যাকগে। একটু সতর্ক থাকবেন।’
‘পরের গাড়ি আসবে তো?’ একটু বিরক্ত হয়েই বললাম।
‘হ্যাঁ। আসবে। আপের গাড়ি যখন গেছে, সেটাই ডাউন হয়ে ফিরবে।’
‘তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আমি ঠিক থাকব।’
স্টেশনমাস্টারের পুরনো সাইকেলের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ অনেক্ষণ মিলিয়ে গেছে। অন্ধকার এখন বেশ গাঢ়। অন্য ভয়ের থেকে দু-একটা মশার উপদ্রব বেশি ভোগাবে মনে হল। তবে বেশ লাগছে স্টেশনটাকে। একদিকে তেপান্তরের মাঠ অন্যদিকে যেন সাতসমুদ্র একসাথে। এই বিরাট বিলে মাছের ঘাই মারার আওয়াজ শুনছি মাঝে মাঝে। শীত এখনও পড়েনি, তবে সন্ধের সময় জলের ধারে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। এতবড় প্ল্যাটফর্মে দুটোমাত্র আলো একেবারেই অকুলান। একটা আধ-ভুতুড়ে পরিবেশ, সেটা মানতে হবে।
বসে বসে ঝিমুনি আসছিল। একটা পা টেনে টেনে চলার আওয়াজে সচকিত হলাম। দেখলাম আপাদমস্তক কালো চাদর ঢাকা একটা অবয়ব প্ল্যাটফর্মের একদিকের অন্ধকার কিনার থেকে এগিয়ে আসছে। পেছনে শুধু দেখা যাচ্ছে লাল সিগন্যালটা। ওদিক থেকে ঢোকার কোনো রাস্তা আছে কিনা খেয়াল করিনি। মানুষটা পা টেনে টেনে বেঞ্চে আমার পাশেই এসে বসল।
একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনদিকে যাবেন দাদা?’
‘দিক? দিকের কি আর ঠিক আছে। তবে এখন কলকাতার দিকেই যেতে হবে। পারিবারিক কাজ।’ গলার বিষণ্ণ আওয়াজে কেমন একটা অনির্দিষ্ট ভাব।
‘তা আপনিও কি কোলকাতার দিকে?’ কিছুক্ষণ নীরবতার পর চাদরের ভেতর থেকে আবার স্বর ভেসে এল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু ট্রেনের দেরি আছে।’
‘দেরি আর কি। কোনো এক সময় এলেই হল। অপেক্ষা করছি। যতদিন না ডাক আসে, অপেক্ষা ততদিন। তা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে কে? মা না স্ত্রী? বয়স তো বেশি নয় মনে হচ্ছে।’
প্রশ্নটা একটু গায়ে-পড়া হয়ে গেলেও উত্তর দিলাম--‘ওসব পাট নেই। কলকাতায় মেসে একাই থাকি।’
‘আরে মশাই অপেক্ষা তো কেউ না কেউ করেই থাকে। কেউ না থাকলেও, ওদিকে অপেক্ষা করে মহাকাল, সব হিসেব চুকিয়ে নেবার জন্য।’
‘সে তো জীবনের পরে। সেসব চিন্তা এখনই করার দরকার কি?’
‘জীবনের পরে? হা: হা:। মৃত্যুর পরেও অনেক হিসেব মেলে না। তখন অপেক্ষা করতে হয়, মহাকালের কাছে হিসেব মেলাবার জন্য। জীবনের পরেও শেষ হয় না সব কিছু।’
লোকটাকে একটু দার্শনিক টাইপের মনে হল। এই আধো অন্ধকারে আলাপটাকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বললাম, ‘কি বলছেন? মৃত্যুই তো শেষ।’
‘জীবন আর মৃত্যুর কি আর কোনো সীমারেখা আছে মশাই? আছে এরকম একটা প্ল্যাটফর্ম। যেখান অপেক্ষা করতে হয়।’
‘আরে? মৃত্যুর পর কারা অপেক্ষা করে? জীবিত ও মৃত, ভেদাভেদ নেই?’
‘সময় তো আছে, কিন্তু ধৈর্য আছে কি একটা কাহিনি শোনার। তাহলেই বুঝবেন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই শুনবো। সময়টাও কাটবে।’
‘সময় তো কাটবে, তবে বিশ্বাসও রাখতে হবে। দয়া করে কাহিনির মাঝে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আপনার বয়স অল্প। আমি যার কথা বলব তিনিও আপনারই কাছাকাছি বয়সী তখন। দেশের উত্তর দিকের পাহাড়ি উপত্যকায় একটা সুন্দর শহরে চাকরি করেন। ওনার নাম ধরা যাক “নিমেষ”। আসল নাম থাক। আর কালের কাছে আমরা সবাই তো এক একটা নিমেষ মাত্র।’
বুঝলাম অত্যন্ত পটুতার সঙ্গে উনি কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
_________
‘নিমেষ একটা নামকরা বহুজাতিক সংস্থার বড় ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশুনোতে তুখোড় ছিল, এখন কাজেও একইরকম। অফিসে বেশ নামডাক ওর। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। বছর পাঁচেক বিবাহিত। স্ত্রী শিঞ্জিনী। সুন্দরী, শিক্ষিতা। সন্তানসম্ভবা। সেই কারণেই কলকাতায় যেতে হবে। নিমেষ ছুটি পায়নি বলে একাই যাত্রা করতে হবে শিঞ্জিনীকে। খুব সকালে ফ্লাইট। ভোর রাতে গাড়ি নিয়ে ওকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে নিমেষ। এখানেই কাহিনির শুরু।’
মুখবন্ধ দারুণ। মনে মনে বাহবা দিলাম। উনি বলতে লাগলেন--
*****
যাবার দিন ভোর রাতেই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। কোনোরকমে নতুন কেনা কালো এসইউভি-টা চালিয়ে শহর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরের এয়ারপোর্টে পৌঁছল নিমেষ আর শিঞ্জিনী। ভিজতে ভিজতেই মালপত্র সমেত শিঞ্জিনীকে ভেতরে চেক-ইনে ঢুকিয়ে, ফ্লাইট ছাড়া অবধি পারকিং লট-এ অপেক্ষা করতে লাগলো নিমেষ। ফ্লাইট এখান থেকে দিল্লী যাবে এবং সেখান থেকে অন্য ফ্লাইটে কলকাতা। মোবাইলে শিঞ্জিনীকে কন্টাক্ট করে জানল যে দিল্লী যাবার ফ্লাইট এখনও আসেনি কাজেই রি-শিডিউল্ড হবে। ওরা কিছুক্ষণ পরে জানাবে ‘এক্সপেক্টেড ডিপারচার টাইম।’ নিমেষ যেন ততক্ষণ অপেক্ষা করে। কোনো কারণে ফ্লাইট না গেলে ও নিমেষের সাথেই আবার বাড়ি ফিরে যাবে।
গাড়িতে অপেক্ষা করতে করতেই নিমেষ বুঝতে পারল যে আজ একটা বিরাট দুর্যোগের দিন। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো পারকিং জলে থই থই। মিউজিক সিস্টেমে ওর প্রিয় মল্লার রাগের সেতার বাদন চালিয়ে চোখ বুজে বুঁদ হয়ে শুনতে লাগল।
--দর্শকদের প্রচণ্ড চিৎকারে নিমেষের মনে হল মাঝ-মাঠ থেকে ফ্রী কিকে দারুণ একটা গোল করে ফেলেছে সে। কয়েকজন মাঠের মধ্যে ঢুকে তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। তখনই চোখে পড়ল, মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে সমস্ত হুল্লোড় উপেক্ষা করে একটা যেন আলোর বলয়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মুহু। মাঠের অনেকেরই নজর সেই মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে রাস্তায়। চার পাশের আলোর বলয়টা তার আগুনের মতো রূপের, তার রঙের, তার মরাল গ্রীবা আর তার হরিণ চোখের। রেফারী বাঁশি বাজাতে বাজাতে বলটা সেন্টারে বসাল। নিমেষকেই যেন ডাকছে বাঁশিটা। বার বার--
চটকা ভেঙে গেল। রেফারীর বাঁশি নয়, মোবাইল ফোন। শিঞ্জিনীর ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছে। পরের ফ্লাইটে এই যাত্রীদের যাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে বটে তবে সেটা ছাড়তে আরো ঘণ্টা তিনেক। নিমেষ যেন ফিরে যায়। কারণ ওকে তো অফিস করতে হবে। দিল্লী থেকে কানেকটিং ফ্লাইট-এর ব্যবস্থা এরাই করে দেবে।
ঘড়ি দেখে বুঝলো প্রায় পৌণে এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। যদিও তেজ অনেক কম। এইরকম একটা স্বপ্ন কেন দেখল? পাড়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলে ছিল সে। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যানেজমেন্ট করে এখন দারুণভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তার প্রেম নিবেদনে কখনও সাড়া দেয়নি মুহু। ভূগোলের অধ্যাপিকা মুহুর মা মেয়ের নাম রেখেছিলেন ছোট্ট দেশ ‘এস্তোনিয়া’র গায়ে লাগা এক নির্জন সুন্দর দ্বীপের নামে। সুন্দরী মুহুও একা থাকতেই পছন্দ করত। বন্ধুরা ভাবত রূপের দেমাক। নিমেষের প্রস্তাবে মুহু সাড়া না দেওয়াতে খুব ভেঙে পড়েছিল ও। মুহুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অন্য কারো সাথে। এমন অবস্থাতেই কোনো বিষণ্ণ মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কলেজের বন্ধুর বোন শিঞ্জিনী। নিমেষের কাছে তা যেন ছিল এক ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’। মুহুর সাথে তারপর আর দেখাও হয়নি কখনও। যদিও নিমেষের নিজের সাংসারিক জীবনে কোনো বিপন্নতা বা প্রেমহীনতা নেই তবুও মাঝে মাঝেই ভাবতে ভাল লাগে যে মুহু তার পাশে থাকলে বেশ হত। কিন্তু আজকে এভাবে কেন ওর কথা মনে এল বুঝতে পারল না নিমেষ।
গাড়িটা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় আসতেই আবার ঝেঁপে এল বৃষ্টিটা। ওয়াইপার চালিয়ে, হেডলাইট, ফগলাইট ইত্যাদি জ্বালিয়েও রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশে কোথাও দাঁড়াবে কিনা ঠিক করতে করতেই একটা জোর শব্দ। গাড়িটা একটা প্রচণ্ড টাল খেয়ে পাশের একটা জল-ভরতি নালায় পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে গেল। পাশ দিয়ে তীব্রবেগে চলে গেল একটা বড় ট্রাক। নিমেষের মনে হল স্টিয়ারিংটা মাথার খুব কাছে চলে এসেছে, বৃষ্টির শব্দ কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। কয়েকটা মুহূর্ত কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কতক্ষণ কে জানে--সম্বিৎ ফিরলে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সে অবাক। গাড়িতে কোথাও একটা দাগ পর্যন্ত নেই। এত জোরে শব্দটা কিসের হল তাহলে? গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। বেশ কিছুটা চলার পর আবিষ্কার করল, শহরের দিকে না গিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে অনেকটা চলে এসেছে সে। সামনে একটা ছোট্ট স্টেশন। একটা মাল-গাড়ি থেমে আছে। ষ্টেশনের বাইরের চায়ের দোকানে এক কাপ চা খাবে বলে বেঞ্চে বসল সে। বৃষ্টি ধরে গেছে। প্রকৃতি অনেকটা আলোকিত।
‘আরে নিমেষদা, এখানে কি করছ?’
ঘাড় ঘুরিয়ে ভীষণ চমকে উঠল সে। মুহু না! আরে, মুহুই তো! একটা সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুহু। পরনে কালো সালোয়ার কামিজ। চোখের কোণে নির্ঘুম রাতের দাগ। হাতে সোনার কাঁকন, গলায় হাল্কা সোনার চেন। হাতের আঙুলে একটা দারুণ সুন্দর হীরের আংটি। আপাত-অবিন্যস্ত চুলের সিঁথিতে সিঁদুরের উপস্থিতি একেবারেই স্পষ্ট নয়। গায়ের রঙটাও যেন উজ্জ্বলতা হারিয়েছে একটু। তবে সেই আলোর বলয়টা এখনও অটুট আছে।
‘তুমি এখানে?’
দুজনে চা খেতে লাগল। নিমেষ জানতে পারল, মুহুর স্বামী এখানকার বনবিভাগের একজন বড় কর্তা। বছর দেড়েক হলো এখানে পোস্টিং হয়েছে ওদের। মুহু এখন ট্রেনে দিল্লী থেকে ফিরছে। এখানে নেমে জঙ্গলের একটা বনবাংলোতে যাবে। গাড়ি নিয়ে তার স্বামীর আসার কথা ছিল কিন্তু বৃষ্টিতে শহরে কোথাও বিচ্ছিরিভাবে ফেঁসে গেছে সে। পৌঁছতে পারবে না এখন।
নিমেষও বলল তার নিজের কথা। বউকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দেবার কথা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এবারে বল, তুমি আছ কেমন?’
‘কেমন দেখছ?’
‘দেখে কি আর সব কিছু বোঝা যায়? বিশেষ করে যে সাড়া দেয় না তাকে?’
‘আওয়াজ দিচ্ছ?’ একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলল কি মুহু? ‘সে ভাবে কি চেয়েও ছিলে তুমি? কেড়েও তো নিতে পারতে আমাকে, আমারই কাছ থেকে?’
‘সবকিছু কি কেড়ে নেওয়া যায়? যাকগে আগে বল তুমি কোথায় যেতে চাও। কত দূর? আমি পৌঁছে দিতে পারি। গাড়ি আছে আমার সাথে।’
‘আরে এ তো নতুন গাড়ি! অভিনন্দন। যাই হোক, আমি যাবো “ঝুমঝুমা” বনবাংলোতে। দূর আছে।’
‘কিন্তু তোমার স্বামী?’
‘ও-ই ফোনে আমাকে বলল ওদিকে যাবার কোনো গাড়ি পেলে যেন চলে যাই। ফরেস্ট-এর জীপ সবসময় এদিক দিয়ে যাতায়াত করে। যে-কেউ পৌঁছে দেবে।’
‘ঠিক আছে আমিই পৌঁছে দেব। তোমার সাথে সময় কাটাবার সুযোগও পাব।’
সুন্দরী পুরনো প্রেমিকার জন্য নিমেষ ভুলে গেল ওর অফিসে যাবার কথা।
এদিককার বেশিরভাগ জঙ্গলই নিমেষের দেখা কিন্তু ঠিক এখানটায় আগে আসেনি বলেই মনে হচ্ছে। বৃষ্টি এদিকেও হয়েছে খুব। প্রচুর জল জমে রয়েছে কাঁচা রাস্তায়, দুপাশে ইউকালিপ্টাস আর শালের জঙ্গলে। পড়ন্ত বেলায় আকাশের গায়ে লেগে রয়েছে একটা মরা আলোর রেশ। ক্রমশঃ গভীর হয়ে আসছে জঙ্গল। রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছে কয়েকটা মাইলফলক আর মুহু নিজে।
‘বাব্বা, অনেকটা দূর তো? এ সব জায়গায় বেড়াতে আসতে ভালই লাগে কিন্তু দিনের পর দিন থাকা মুশকিল। তোমাদের কোনো অসুবিধা হয় না?’ গাড়ির মিটার দেখে নিমেষ বুঝল শহর থেকে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেছে তারা।
‘আরে না না, আমরা থাকি শহরেই। এদিকে একটা জঙ্গলের রেঞ্জ অফিস আছে। জঙ্গল মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বাড়াতে এদিকে কিছুদিন এসে থাকতে হচ্ছে ওকে। আমি আসছি বেড়াবার জন্য। দারুণ সুন্দর জায়গা।’
কথায় কথায় নিমেষ জানতে চাইল সেই পুরোনো কথাটা--‘আচ্ছা, আমাকে প্রত্যাখ্যানের কারণটা কি ছিল জানতে পারি?’
‘পাগলামি বলতে পারো। তুমি সব দিক থেকেই আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিলে। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, আমার বর আমার থেকে রূপে গুণে কম হবে এবং আমিই তাকে চালাব, ডমিনেট করব। সেকারণেই ভালবাসার বোধ আমার মধ্যে জাগেনি। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল বাবা বা ঠাকুমা কেউই তোমার আমার অসবর্ণ বিয়েতে মত দেবেন না। এটা হয়ত আমারই ভুল ছিল। আমার নিজের বিয়েটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় ভুল।’
নিমেষ আর ব্যক্তিগত প্রশ্ন না করেও জানতে পারল--মুহুদের কোনো ইস্যু নেই। বিবাহিত জীবনও কেমন যেন রহস্যময়। ভদ্রলোক ব্যস্ত জঙ্গল নিয়ে আর মুহু নিজের মতো। ভালবাসা তো নেইই, বরং একটা সম্পর্কের বোঝা যেন দুজনকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
‘আমরা প্রায় এসে গেছি।’ মুহুর কথায় অন্যমনস্কতা ভেঙে গেল। নিমেষ দেখল লাল সুরকির রাস্তা একটা টিলার ওপরে গিয়ে শেষ হয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমেই চোখ জুড়িয়ে গেলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। চারদিকে ঘন জঙ্গল। মাঝখানে টিলার ওপরে একটা বন-বাংলো। বহুদিন সংস্কার হয়নি মনে হচ্ছে। কেয়ারটেকারের পাত্তা নেই। বোঝা গেল, সাহেব সকালে জীপে কেয়ারটেকারকে নিয়ে বেরিয়েছিল মেমসাহেবকে আনার জন্য। মেমসাহেব পৌঁছে গেলেও সাহেব এখনও পৌঁছোয়নি।
আকাশে মেঘের ঘটা দেখে মনে হলো রাতে আরও বৃষ্টির তোড়জোড় চলছে। মুহু আর নিমেষ বাংলোর বসার ঘরে এল। বাংলোর দুটো ভাগ। মূল ভাগে তিনটে ঘর। মাঝখানের বড় ঘরটা বসবার ঘর। দুপাশে দুটো বড় বেডরুম। বসার ঘরে আসবাব বলতে একটা বড় সোফাসেট, সেন্টার টেবিল। একটা বুক-কেস। তাতে ফাইল পত্তর রাখা আর ওপরের তাকে রয়েছে বেশ কিছু বই। বইগুলো সবই জঙ্গলের গাছপালা বা জন্তুজানোয়ার সম্পর্কিত। লনের অন্যপ্রান্তে একটা অফিস আর দুটো কেয়ারটেকারের ঘর। লনটাতে বেশকিছু ভেজা গাছের ডালপালা আর পাতা পড়ে আছে। কোথাও চাবি রাখা ছিল। মুহু ইতিমধ্যে তালা খুলে ওর মালপত্র নিজের বেডরুমে রেখে দিয়েছিল।
নিমেষ বলল, ‘আমি আর বসবো না মুহু। আবার বৃষ্টি আসছে। অন্ধকার হয়ে যাবে। এখনই বেরিয়ে না পড়লে পৌঁছোতে মুশকিল হবে। জঙ্গলের মধ্যে রাস্তাও হারিয়ে ফেলতে পারি।’
‘কি বলছো তুমি। এখান থেকে লোক না দিলে তুমি জঙ্গল থেকে বের হতেই পারবে না। আর ও না ফিরলে লোকও তুমি পাবে না। লেপার্ড, বুনো হাতি অন্যান্য হিংস্র জানোয়ার প্রচুর আছে এদিকে। তাছাড়া---’ মুহু জানলা থেকে ঘুরে নিমেষের দিকে তাকালো, ‘ফেরার এত তাড়াই বা কেন তোমার। বৌ তো আজই চলে গেছে। একটা রাত আমার সাথেই কাটিয়ে যাও না হয়। সঙ্গিনী হিসেবে আমি কিন্তু খুব ফেলনা নই। আরে ভয় পাচ্ছো নাকি। হা হা।’
আধো আলোছায়াতে মুহুকে কেমন রহস্যময়ী মনে হল নিমেষের। কোনোরকমে বলল--‘সে সৌভাগ্য কি আমার হবে। হলে অনেক আগেই হত। তবে তোমাকে এখানে একা ফেলেও যেতে পারবো না। দেখি আরো কিছুক্ষণ।’
‘পুরোনো কথা ভেবে আজকের সুযোগ অস্বীকার করা বোকামো। দেখো ভেবে। যাওয়া তোমার হচ্ছে না আজ।’
আবার সেই রহস্যময় হাসি উপহার দিয়ে মুহু ওপাশের বেডরুমে গেল বোধ হয় ফ্রেশ হবার জন্য।
কেন কে জানে একটু ভয় ভয় করতে লাগল নিমেষের। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে। শিঞ্জিনী নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। মোবাইলটা বের করে দেখল সিগ্নাল নেই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সেই সঙ্গে চলছে ঝড়ের মাতামাতি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এইরকম ঝড়বৃষ্টির আভিজ্ঞতা ওর আগে কখনও ছিল না। সোঁ সোঁ হাওয়ার আওয়াজ। কোথাও কোথাও গাছের ডালপালা ভাঙ্গার শব্দ। মুহুর্মুহু কড়াত কড়াত বাজ পড়ছে। আজই কি পৃথিবীর শেষ দিন? কে জানে।
ঘরে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে গেছে মুহু। দরজা জানলা বন্ধ থাকাতে আলোর শিখা একেবারে স্থির। বন্ধ জানলার বাইরে দুর্যোগের রাত দৈত্যের মত ফুঁসছে। কিছুক্ষণ আগে চা বিস্কুটও দিয়েছিল মুহু। বেশ বিস্বাদ চা, এক চুমুকের পর আর খেতে পারেনি। চা আর এক কামড় খাওয়া বিস্কুট পড়ে আছে টেবিলে। বৃষ্টির তেজ একটু কমল মনে হল। মুহুর স্বামী এখনও ফেরে নি। আজ বোধহয় এখানেই থাকতে হবে। ভাবতেই গা ছমছম করে উঠল নিমেষের।
হঠাৎ দপ দপ করতে করতে হারিকেনটা নিভে গেল। চারদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কি হল? ঘরে তো হাওয়া নেই। নিভল কি করে? তবে কি তেল শেষ হয়ে গেল? অন্ধকারে বাইরে গিয়ে মুহুকে ডাকবে কি করে? মোবাইলের টর্চটা জ্বালাবে ভেবে পকেটে হাত ঢোকাতে যাচ্ছে নিমেষ, ঠিক সেই সময় ঘাড়ের ওপর কারো নিঃশ্বাস পড়ল। বেশ গরম নিঃশ্বাস। কার নিঃশ্বাস? এঘরে তো আর কেউ নেই। অন্ধকারে কেউ কি ঘরে ঢুকল? কিন্তু দরজা তো বন্ধ। সেটা খোলার কোনো আওয়াজ তো পায় নি সে? ভাবতেই হাত পা হিম হয়ে গেল। শির শির করে উঠল সমস্ত শরীর। কে এল এই ঘরে? কিভাবে এল? অথবা সে কি এঘরেই ছিল? নিমেষ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। এমন সময় মনে হল হাল্কা পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরময় কারো চলে ফিরে বেড়াবার শব্দ। কখনও শব্দটা কাছে আসছে কখনও দূরে চলে যাচ্ছে। টের পেল মুহুকে ডাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরোনো বনবাংলোতে ঝড়বৃষ্টির রাতে, অন্ধকার ঘরে কার পায়ের আওয়াজ শুনছে সে? গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। হৃদয়যন্ত্র কি চলছে?
কে জানে কতক্ষন এভাবে কাটল।
দরজায় একটা ‘ক্যাঁচ’ শব্দ করে ঘরে ঢুকল মুহু। হাতে একটা জ্বলন্ত হারিকেন।
‘এ কি, তোমার হারিকেনটা নিভে গেছে? ডাকো নি কেন?’
ওকে দেখে ধড়ে প্রাণ এল যেন নিমেষের। এতক্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিঃশ্বাসটা আবার চলতে শুরু করল।
‘হ্যাঁ, হঠাৎ নিভে গেল। দেখো তো তেল-টেল ফুরিয়ে গেলো কিনা?’
ও দেখেশুনে বলল, ‘তেল তো ঠিকই আছে। তবে নিভল কি করে?’
ঘরের মধ্যে আলো আসাতে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে সে দেখল, চায়ের কাপটা একেবারে খালি। এবং বিস্কুটটাও নেই। আলো নিভে যাবার আগেও দেখেছিল চায়ের কাপে প্রায় পুরো চা-ই ছিল আর প্লেটে ছিল আধখানা বিস্কুট। সত্যি তাহলে ঘরে কেউ ছিল, যে চলাফেরা করেছে আর চা বিস্কুট খেয়েছে? ভাবনাটা আসতেই শরীরে সেই শিরশিরানি ভাবটা ফিরে এলো।
মুহু আসাতে ঘর যেন আরও আলো হয়ে গেছিল। ইতিমধ্যে চেঞ্জ করে নিয়েছে। একটা ফ্যাশনেবল নাইটিতে ওকে খুব আকর্ষণীয় লাগছে। মনে হচ্ছে সেই পুরনো মুহু। সেই হাসিটাও ফিরে এসেছে। অজান্তেই কি একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার? মনের ভয় ভয় ভাবটা চলে গেছে। ঠিক তখনই মুহু যেন অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো--‘আরে তুমিও জিম করবেট পড়? আমার হাসব্যান্ডও এই বইটা প্রায়ই পড়ে। এখানকার সব বাংলোতেই এক কপি করে এই বইটা রাখা আছে।’
আশ্চর্য হয়ে সে দেখল, বইয়ের তাকের ডালাটা খোলা আর সেন্টার টেবিলে ওর ঠিক সামনেই খোলা রয়েছে ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন।
বইটা এখানে কি করে এলো? বইয়ের তাকের ডালাটাও তো বন্ধ ছিল। কি হচ্ছে এসব? সত্যি কি কেউ এই ঘরে এসেছিল? কে সে? মুহুর হাসব্যান্ড তো এখনও ফেরেন নি। আজকে তার ফেরা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।
‘হাল্কা কিছু খাবার আজকে বানিয়ে নেব রাতের জন্য। ও তো ফিরতে পারবে না আজ মনে হচ্ছে।’
‘উনি আজ ফিরবেন না? তবে আমি কি করে ফিরব?’
‘আরে তুমি এখনও ফেরার কথা ভাবছ? এই রাতে জঙ্গলের লোকেরাও সাহস করবে না বের হতে। কোথায় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে কে জানে। যা ঝড়বৃষ্টি হল! আমার হাসব্যান্ড নিশ্চয়ই অন্য কোনো বাংলোতে রাতটা কাটিয়ে কাল ফিরবে। ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ও অভ্যস্ত।’
এখানে রাত কাটাতে হবে ভাবতেই আবার শিউরে উঠল নিমেষ। কোনো একজনের অশরীরী উপস্থিতি আছে এই ঘরে। সে কি ওকে থাকতে দেবে?
ওর মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করলো মুহু--‘কেন? তোমার কি সত্যি ভয় হচ্ছে এখানে রাত কাটাতে? কিসের ভয়? কার ভয়? আমাকে নয়ত? হা হা। বউ নেই সাথে--’
‘ভয় তো একটু হচ্ছে বইকি। একজন অত্যন্ত সুন্দরী যুবতীর সাথে সারারাত এই জঙ্গল-বাড়িতে একা। যার সাথে সারাজীবন কাটাতে পারতাম সে এখন পরনারী হয়ে আমার সাথে সারারাত থাকবে। হা: হা:। একটু লোভও যে হচ্ছে না তা নয়। সবচেয়ে ভয় হচ্ছে নিজেকে। আমার কাছ থেকে তোমাকে যদি আজ বাঁচাতে না পারি তো দোষ কার হবে?’
‘যে নিজেই শিকার হতে তৈরি তাকে নিয়ে ভয় কি?’
মুহুর হেঁয়ালি ধরা গেল না ঠিকমতো। এইসব কথাবার্তার মাঝে সে তার নিজের ভয় পাবার কথাটা মুহুকে বলতে পারল না। হয়তো ওকে ভীতু ভাববে মুহু।
মাঝে একবার বারান্দায় বেরিয়ে বিদ্যুতের চমকে দেখা গেল টিলার নীচে বাংলোর গেটের বাইরের কাঁচা রাস্তায় কয়েকটা বড় বড় গাছ ঝড়ের দাপটে উপড়ে পড়ে আছে। মুহু বলল, ওগুলো না সরালে কেউ বাংলোতে আসতে পারবে না। কাজেই বাইরের পৃথিবী থেকে আপাতত ওরা বিচ্ছিন্ন।
রাত এখন অনেক। প্রহরে প্রহরে নাকি শেয়াল ডাকে। এখানে তাদের ডাক অনেকবার শোনা গেছে। ঝড়-বৃষ্টির পর পৃথিবী একেবারে শান্ত। জঙ্গলের নিজস্ব কিছু আওয়াজ রাতকে আরও গভীর করে দিচ্ছে। বেডরুমের খাটে শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছে নিমেষ। অন্য বেডরুমে আছে মুহু। বেড-সাইড টেবিলে হারিকেনটা জ্বলছে। হঠাৎ আলোটা দপ দপ করতে করতে নিভে গেল। ঠিক সন্ধেবেলার মত। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর অপরিসীম শূন্যতা গ্রাস করল ঘরটাকে। তবে কি আবার কেউ এলো ঘরে? যাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু পরেই ঘরের মধ্যে পাওয়া গেল সেই পায়ের আওয়াজ। কেউ চলাফেরা করছে। নিমেষ আদতে খুব ভীতু নয়, কিন্তু সন্ধেবেলার ঘটনায় বেশ ভয় পেয়েছে সে। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। কি হয় শেষ পর্যন্ত কে জানে। নিমেষ সন্তর্পণে গায়ের চাদরটা মাথা অবধি টেনে নিল। পায়ের শব্দ একবার দূরে যাচ্ছে একবার খাটের কাছাকাছি চলে আসছে। এমন সময় মনে হল, ঘরের লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা খোলার আওয়াজ হল। কেউ যেন নিঃশ্বব্দে ঘরে ঢুকল। সেই দিক থেকে অন্য একটা পায়ের শব্দ খাটের কাছে এল। খাটটা নড়ে উঠল। কেউ মনে হল খাটে উঠে ওর পাশের জায়গাটায় শুয়ে পড়ল। একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল ঘর, তার সাথে কাঁকনের শব্দ। কোনো মহিলা কি? চাদরের ভেতর থেকে মাথা না বার করেই জিজ্ঞেস করল--‘ক্কে ক্কে কে আপনি?’
‘আমি, মুহু। তুমি যাকে ভালবেসেছিলে। কিন্তু পাও নি নিজের করে।’
‘মুহু?’ মনে মনে সে ভাবল, তবে আগের পায়ের শব্দটা কার? কে নেভাল হারিকেন? সে কি এখনও ঘরেই আছে?
‘আজ মিটিয়ে নাও তোমার না পাওয়ার খেদ। আমি আজ ধরা দিতে এসেছি।’ মুহুর কন্ঠস্বরে উত্তেজনা স্পষ্ট।
মুহুর গলার আওয়াজ এরকম হাশকি ছিল কি? একটা কিছু গায়ে মেখে এসেছে ও। যার গন্ধ ক্রমশঃ বশীভূত করে ফেলছে তাকে। এটাকেই কি মৃগনাভি বলে?
কাঁকনের শব্দটাও যেন জাদু করে ফেলছে।
‘তুমি কি করে এলে এই ঘরে?’ অনেক কষ্টে চেতনার পার থেকে বলতে পারল নিমেষ।
রিন রিন করে হাসল মুহু। ‘ওয়াসরুমের পেছনে একটা সুইপার ডোর আছে। সেটা সন্ধেবেলায় খুলে রেখে গিয়েছিলাম।’
‘কি চাও তুমি আমার কাছে?’
‘তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে একসময়। আমি তার মর্ম বুঝিনি। কিন্তু আমার বিয়েটাই একটা ভীষণ ভুল হয়ে গেল তারপর। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো আমার জীবন।’
‘কেন? কি হয়েছিল?’
‘আমার স্বামী একদম জংলী। বনবিভাগের কর্তা, কিন্তু পশুত্বই অধিকার করে রেখেছে তাকে। সে চেনে শুধু শরীর। তাতে কোনো ভালবাসার মিশেল নেই। যা যখন দরকার ছিনিয়ে নেয়। যখন তখন লুণ্ঠিত হয়ে যাই। আজ আমি ক্লান্ত খুব। ভালবাসা পাবার জন্য আমি পিপাসার্ত নিমেষদা।’
‘কিন্তু মুহু, আমার তো আজ তোমাকে তেমনভাবে দরকার নেই। আমার ভালবাসা আজও তোমার জন্য আগের মতই আছে। কিন্তু তাকে পাবার বাসনা আমার আর নেই। আমার ছোট্ট সংসারে আমি সুখী।’
‘সুখী কি মানুষ হতে পারে কখনও? তোমার হাহুতাশ কিন্তু তুমি লুকোতে পারোনি আজ। গোপনে কোথাও সুখ পাবার, আমাকে পাবার বাসনা তোমার আজও রয়ে গেছে।’
‘কিন্তু মুহু। সে সুখ পাওয়া আর তো সম্ভব নয়।’
‘কেন নয় বল তো? জানো, প্রথম প্রথম স্বামীকে শুধরোবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে হবার নয়। এর পর আমি প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করলাম তাকে। তাতে আরও কঠিন হয়ে উঠল পরিস্থিতি। ঘরের নারী না পেয়ে বাইরের দিকে ঝুঁকল সে। বেশিরভাগ রাতে ফিরত না। অথবা কখনো কখনো বাইরের নারী নিয়ে এসে বাড়ির আউট হাউসে রাত কাটাত। বলে বলেও কোনো কাজ হয় নি। আজ আমাদের মধ্যে ঘৃণা ছাড়া কিছু বেঁচে নেই।’
মুহু কি কাঁদছে? এই সমস্ত কথার মধ্যেই নিমেষ টের পেল তাদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব কমে আসছে। ওই মৃগনাভির গন্ধ তাকে মাতাল করে দিচ্ছে। তার মন আর শরীরে শুরু হয়েছে চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব।
শেষ প্রতিরোধের চেষ্টা করল সে, ‘কিন্তু তুমি যা চাইছ তা তো অন্যায়, বিশ্বাসঘাতকতা।’
‘তুমি এখন জঙ্গলের রাজ্যে নিমেষদা। এখানে শহরের নিয়ম চলে না। যা পাচ্ছ তা না নিলে অভুক্তই থেকে যেতে হয়। এখন শুধুই ভালোবাসো। তোমার ভালবাসার ছোঁয়ায় এক অপূর্ণ নারীকে পূর্ণ করো। ভালবাসা পাপ নয়। এটা পুণ্য। এসো, সাড়া দাও, সাড়া দাও। গ্রহণ কর এই ভালবাসার নৈবেদ্য।’
শেষের দিকের আওয়াজ একবারে হিসহিসে। কানের কাছে গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে সে। একটা নরম হাত তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ঘন হয়ে আসছে দুটো শরীর। অদ্ভুত একটা ভালবাসার বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে তার মনের মধ্যে। ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে নিমেষ। অদ্ভুত একটা নরম উষ্ণতায় ভরে উঠছে শরীর। ঘন নিঃশ্বাস, কাঁকনের শব্দ আর সেই গন্ধটা। এটাই কি ভালবাসা? আগে তো কখনও পায় নি সে মিলনের এই স্বাদ। স্ত্রীর সাথে মিলন কি তাহলে রোজকার অভ্যেসই ছিল তার? সমস্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ওরা দুজন। ক্ষতবিক্ষত হতে হতে তূরীয় আনন্দের দিকে এগিয়ে চলেছে দুটো শরীর, ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে।
হঠাৎই ঘরের মধ্যে জ্বলে উঠল দেশলাই কাঠি। অভ্যস্ত হাতে কেউ ধরিয়ে ফেলল নিভে যাওয়া হারিকেনটা। ঘরে তো আর কেউ নেই। তবে কি সেই অশরীরী আবার এসেছে? আরও অবাক হয়ে দেখল। হারিকেনটা এখন আর বেডসাইড টেবিলে নেই। সেটা এখন আছে সেন্টার টেবিলে, সোফার কাছে। ওটা কি করে ওখানে গেল? মাথা কাজ করছে না তার। শুধু আরও অবাক হয়ে দেখতে পেল, টেবিলের ওপর খোলা আছে একটা বই। জিম করবেটের ‘ম্যান ইটারস অফ কুমাউন।’ বইটার পাতা উলটে যাচ্ছে একটার পর একটা। বইটা ড্রয়িং রুম থেকে এখানে কি করে এলো? হারিকেন কে জ্বালালো? কেউ কি বইটা পড়ছে এই মুহূর্তে? এসব প্রশ্ন মনের মধ্যে সে গুছিয়ে নেবার আগেই কানের পাশে থেকে কেউ বিষাক্ত চিৎকার করে উঠলো। এতক্ষণের মদির আওয়াজের থেকে একদম আলাদা।
‘দেখেছ? এই লোকটা আমাকে একমুহূর্তের জন্যও সুখী হতে দেবে না। কিছুতেই না।’
কথার সাথেই দুপদাপ পায়ের আওয়াজ। মুহু উঠে গেলো বিছানা ছেড়ে সেন্টার টেবিলের দিকে। ও কাকে বলল এ কথা? নিমেষ শুধু দেখল হারিকেনটা আগুনশুদ্ধ ও আছড়ে ভাঙল সোফার ওপর। একবার নয়। বার বার। সোফা, টেবিল, বই সব গ্রাস করে নিচ্ছে আগুন তার লেলিহান শিখায়। এবারে মেঝের কার্পেট জ্বলে উঠল। নিশ্চিত লক্ষ্যে এগিয়ে আসছে বিছানার দিকে। ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে সারা ঘর। কিছু দেখা যাচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। খাট থেকে নামতে গিয়ে নিমেষ পড়ে গেল মেঝেতে। জ্বলন্ত কার্পেটে। কেউ কোথাও নেই। দরজা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কি এসে উদ্ধার করবে তাকে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে? প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে সে শুনতে পেল কেউ ফিস ফিস করে চেতনার ওপার থেকে বলছে--‘সাড়া দাও, সাড়া দাও’। পাপ পূণ্যের দোলায় দুলতে দুলতে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
শিঞ্জিনী যখন কলকাতা বিমানবন্দরে নামল তখন অনেক রাত। মাঝে দিল্লীতে অনেক দেরি হয়েছে ফ্লাইটের। অনেক চেষ্টা করেও নিমেষের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। জেনেছে নেটওয়ার্ক-এর বাইরে আছে ও। নিমেষের বন্ধুদের ফোন করে জেনেছিল যে ও অফিসেও যায়নি। সন্ধে অবধি কোনো খবর না পেয়ে ওরা পুলিশে জানিয়েছে। পুলিশ খুঁজছে। পুরো শহর জলমগ্ন। নিশ্চয়ই ও কোথাও আটকে আছে। কোনো খবর পেলেই জানাবে। বাড়ি পৌঁছে দেখল সবাই খুব চিন্তা করছে। শিঞ্জিনীকে কাল ডাক্তার দেখাতে হবে কাজেই ঘুমোতে পাঠানো হল তাকে।
খবরটা এল একেবারে ভোরের দিকে। নিমেষের এক বন্ধু ফোনে জানাল--গতকাল সকালেই প্রচণ্ড দুর্যোগের মধ্যে একটা কালো এসইউভি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই। একটা বড় ট্রাক পেছন থেকে ওই গাড়িটাকে ধাক্কা মেরে রাস্তার থেকে নীচে পাশের নয়ানজুলিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে। গাড়িটা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল, আগুনও ধরে গিয়েছিল। ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছে একটা আধপোড়া দেহ। কাল অনেক রাতে থানা থেকে খবর পেয়ে গাড়ির আরোহীকে নিমেষ বলে সনাক্ত করা হয়। কলকাতা থেকে যেন ওর কোনো আত্মীয় আজই চলে আসে। গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেছে মহিলাদের একটা দামী হীরের আংটি। তাতে লেখা আছে কারো নামের আদ্যক্ষর ‘এম’।
পরের দিন ওই এলাকার স্থানীয় খবরের কাগজে বেরিয়েছে জঙ্গলের অতি গভীরে ঝুমঝুমা নামের একটি বনবাংলোতে ভয়াবহ আগুন লেগে বনবিভাগের একজন বড় কর্তার নৃশংস মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসনের সন্দেহ এটি জঙ্গল-মাফিয়াদের কাজ। বনের গাছ কাটা বা জীবজন্তু শিকার এই কর্তা নাকি কঠিন হাতে দমন করেছিলেন। রাতে যখন আগুন লেগেছিল তখন উনি নাকি বাংলোর শোবার ঘরের সোফাতে বসে বই পড়ছিলেন। কিছুদিন আগে ওই কর্তার শহরের বাসভবনে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ওনার স্ত্রী।
----------------------------------------
এই পর্যন্ত বলে থামল মানুষটি। চাদরের ভেতরে বিষণ্ণ আওয়াজ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছিল। তাই আর থাকতে না পেরে বললাম--‘কয়েকটা কথা জানতে পারি কি?’
‘নিশ্চয়ই পারেন। বলুন।’
‘আচ্ছা, যদি নিমেষ আর মুহুর মৃত্যু আগেই হয়ে থাকে তবে বনবাংলোতে গেল কারা? আর জিম করবেট পড়তে পড়তে বন-কর্তা যদি আগুনে পুড়ে মারা যান তবে উনিই কি ঘরে হারিকেন জ্বালিয়েছিলেন? কারণ কাহি্নি অনুযায়ী বন-কর্তা তখনও জীবিত। তাহলে মুহু কি করে পুড়িয়ে মারবে তাকে? আর আপনিই বা এই কাহিনি জানলেন কার কাছ থেকে? চরিত্ররা তো কেউ বেঁচে নেই।’
‘হা: হা:--’ হাসির পর একটু সময় নিলেন তিনি।
‘বলেছিলাম না। জীবন আর মৃত্যুর সীমানা বড় সূক্ষ্ম। কে এপাশে আছে আর কে ওপাশে, তা জানেন শুধু মহাকাল। যাকগে, ঐ দেখুন আপনার ট্রেন আসছে।’
দেখলাম দুদিকের সিগন্যালই ডাউন হয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশনমাস্টার ও আরও একজন এসেছেন গাড়ি ক্রসিং করাবার জন্য। আমাকে দেখে বললেন--‘আরে একা একা বসে আছেন? এত রাতে এখানে সচরাচর যাত্রী থাকে না। বিশেষ করে একা তো নয়ই।’
‘না না, আমি কি একা ছিলাম নাকি? এই ইনি একটা দারুণ কাহিনি আমাকে—’ বলতে বলতে পাশে তাকিয়ে দেখি ওখানে কেউ নেই।
‘কার কথা বলছেন? এখানে তো কেউ নেই। কাউকে কি দেখেছেন? একার পক্ষে জায়গাটা ভাল না।’
আপনার ট্রেন এসে গেছে তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ুন। খুব বেঁচে গেছেন এ-যাত্রা।’
‘কিন্তু, কিন্তু--’ বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। সত্যিই তো। কোথায় গেলেন তিনি? তবে কি?
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম একরাশ অন্ধকার ভেদ করে জোরালো আলো নিয়ে দুদিকের ট্রেনই ঢুকছে। ট্রেনে উঠতে উঠতেই লক্ষ করলাম কেউ নামল না ট্রেন থেকে। ষ্টেশনের ভদ্রলোক দুজন তাড়াহুড়ো করে সিগন্যাল দিয়ে দিলেন। ট্রেন চলতে শুরু করল। চলন্ত ট্রেনের জানলার কাচের মধ্য দিয়ে একঝলক দেখলাম প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে অন্ধকারের মধ্যে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ বসে আছে। আরে ওই তো উনি। ট্রেনে উঠলেন না তো? উনি তো যাবেন বলেছিলেন। কি যেন-- হ্যাঁ, ওনার পারিবারিক কাজে উনি কলকাতা যাবেন বলছিলেন। কাজটা বউয়ের ডেলিভারি নয়তো? মনে পড়তেই সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা একটা কালো এসইউভি গাড়ি আর তার মধ্যে একটা আধপোড়া মৃতদেহ। যার স্ত্রী কলকাতায় পৌঁছে গেছে ডেলিভারির জন্য। আমি নিশ্চিত চাদর সরলেই দেখা যাবে ওর বীভৎস পোড়া শরীর। ট্রেন চলতে শুরু করল। ট্রেনের জানলার ওপারে বেঞ্চে বসা অবয়বটি ক্রমশ আবছা হয়ে এলো।
নির্জন অন্ধকার প্লাটফর্মে একজন অপেক্ষা করছে মহাকালের কাছে হিসেব দেবার জন্য।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)