বাংলা কমিকস (“দীপন” পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা); সংখ্যা-সম্পাদকঃ এন জুলফিকার ও মলয় মণ্ডল; প্রকাশনাঃ ‘দীপন’ পত্রিকা প্রকাশনা দফতর, বারুইপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, প.বঙ্গ. পিন-৭৪৩৬১০; ISSN 0975-4237
কতো ছোট হলে তাকে ‘লিট্ল ম্যাগ্’ বলা যায়, তার পরিমাপ তো কৈ আজও জানা গেলো না।
তবে, স্বল্পপ্রচার একটা নিরিখ, বোধহয়। এবং এই একটিমাত্র নিরিখেই ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মননশীল ত্রৈমাসিক পত্রিকা’ “দীপন”-কে ‘ক্ষুদ্রপত্রিকা’ আখ্যা দিলেও দেওয়া যেতে পারে, নৈলে কাজের দিক দিয়ে, যা নমুনা পাওয়া গেল, এ’পত্রিকা উচ্চ, সুউচ্চ! ‘বাংলা কমিক্স’ বিষয়ক এঁদের আলোচ্য সংখ্যাটি, জানা গেল, বিংশতিবর্ষের সংখ্যা, এবং এঁদের প্রাক্তন এ’হেন ‘বিশেষ সংখ্যা’-র মধ্যে রয়েছে ‘নঈ ধারা’-র বৈপ্লবিক হিন্দিকবি বাৎস্যায়ন ‘অজ্ঞেয়’জী (১৯১১ - ১৯৮৭), ‘লিমেরিক’, ‘সত্যপীর’ ইত্যাদি! জেনেই শিহরিত হয়ে উঠতে হয় না, কী বলেন পাঠক, যে এঁরা এমন এমন ‘বিশেষ সংখ্যা’-র কথা ভেবেছেন ও সাকার করেছেন সেসব? ‘কমিকস’ বিষয়ক এঁদের বর্তমান কাজটির চিন্তন, গঠন ও মান যা দেখলাম/পড়লাম, সত্যি, প্রাক্তনগুলি পড়বার তর সইছে না! (কোথায় পাই?) বিশ বছর ধরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বারুইপুর থেকে এই মানের কাজ হচ্ছে জেনে কুর্নিশ জানাই, আনত কুর্নিশ!
যে বিষয়ের তত্ত্ব-তালাশ কিসুই জানিনে, নিজে অঙ্কনশিল্পীও নই, ‘কমিকস’-হেন সেই লেখা-রেখার বিষয় নিয়ে হঠাৎ ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ করার সাহস পেলুম কী করে?
পাঠক-ক্রেতার কিছু স্বোপার্জিত ‘অধিকার’-এর কথা আমরা আগে আগেও বলেছি এই কলামে... আর... মুগ্ধ হতে তো বাধা নেই কোনো, এবং ভাগ করে নেওয়া সেই মুগ্ধতা ‘পরবাস’-এর সুধী পাঠককুলের সঙ্গে। অতএব, ধরো কলম, লেখো গ্র. স...
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের চিন্তনে-মননে তাঁর হাতের কলম যখন কবিতা কাটাকুটি করে করে চিত্র আঁকতে লাগলো তাতে লেখা ও রেখা দুই-ই থাকলেও তাকে তো আর ‘কমিকস’ আখ্যা দেওয়া যায় না, বলা যায় না ‘কমিকস’-এর শুরুয়াৎও, কোনোভাবেই। কেন? না, কমিকসের পাতা থেকে (১) এক শিশুকিশোর পাঠক যেন উঁকি দেয়ই, আর থাকে (বা, থাকতে হবে), (২) হাস্যরস। (যদিও টিনটিন-এসটারিক্সের মতো এডভেঞ্চার কমিকসও বহু)। সংজ্ঞা দিয়ে কি আর কমিকসের বর্ণনা হয় হে, বিশপৃষ্ঠা লিখে ময়দানী ফুচকার স্বাদ আনানো যায় জিভে? তাই পড়িঃ এই সাড়ে চারশতাধিক পৃষ্ঠার ‘বিশেষ সংখ্যা’-য় বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা, নণ্টেফন্টে থেকে সর্বভারতীয় বৃহত্তম কমিকস সিরিজ ‘অমর চিত্র কথা’-র যা যা ছবি দেখতে পাওয়া গেছে, এই পাঠকের বিশ-ত্রিশ বছর বয়স কমিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট তা। এর ওপরেও আছে ‘প্রাপ্তবয়স্ক কমিকসে’ ঘরের নীল আলোয় বিলোলচক্ষু নীহারিকা থেকে আজকের অতিচালু যৌন-কমিকস সবিতা ভাবি! ভাবুন!!
চমৎকার নির্মেদ একটি সম্পাদকীয়ের পরে (১) ইতিহাস, (২) প্রকরণ, (৩) সৃজক, (৪) নির্মাণ, (৫) ভাষ্য, (৬) বাংলাদেশ, (৭) কমিক্স, (৮) কথোপকথন ও (৯) তথ্যপঞ্জি/ জীবনপঞ্জি/ গ্রন্থপঞ্জি---এমন নয়টি প্রধান-বিভাগের মধ্যে ৪+৭+৫+৫+৪+৪+৪+৪+৫= ৪২-টি নিবন্ধ পড়া গেলো, যার বাইরে কার্টুন-কমিকস-ব্যঙ্গচিত্রের বোধহয় বাদপড়া আলোচনা আর কিছু হতেই পারে না। ‘লালমাটি’ প্রকাশনীর কার্টুন-কমিকস নিয়ে বেশ কিছু উন্নতমানের বই দেখেছিলাম আগে, আর বর্তমানেরটির তো পাক্কা ঠাঁই করে নেওয়া উচিত যে কোনো বইপ্রেমীর আলমারিতে।
নির্মাল্যকুমার ঘোষ মহাশয়ের ‘বাংলা কমিকসের ইতিহাস’ প্রবন্ধটি নিজমানেই সংকলনের প্রথম রচনার দর্জা পায়, যেখানে প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ী (কাফি খাঁ), প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈল চক্রবর্তীর মতো আদিযুগের মহীরুহের পাশাপাশি আজকের সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ মুখোপাধ্যায়রাও আলোচিত। বলাইবন্ধু রায়ের মানের চিত্রীকে তো আমরা আজকের দিনে ভুলেই গিয়েছি। নারায়ণ দেবনাথ মহাশয় বাঙলা কমিকসের এক মহীরুহ। তাই এটা মোটেই আশ্চর্য নয় যে তাঁকে নিয়ে একটি নিবন্ধ, এক একান্ত সাক্ষাৎকার ও শেষে জীবন-ও-গ্রন্থপঞ্জি থাকবে। কালেক্টরস আইটেম! ‘অমর চিত্র কথা’-র প্রায় সাড়ে আটশ’ টাইটেল আছে (এ’বই পড়েই জানলুম), শেষের পরিশিষ্টে সে দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, তদুপরি তাদের ‘রবীন্দ্রনাথ’ সংখ্যাটির উপর এক নিবন্ধের পরিকল্পনা করে সম্পাদক জুলফিকার সাহেব আমাদের বিশেষ ধন্যবাদার্হ হলেন এবং অদ্রীশ বিশ্বাস-কৃত এই রচনাটিকে সংকলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলতে ইচ্ছে করছে (যদিও পৃথুল এ’ গ্রন্থ যে গত সপ্তাহে কিনে ইতোমধ্যেই পুরোটা পড়ে ফেলেছি তা নয়। প্রবল ভালোলাগায় ও উৎসাহে এখনই পরবাসের পাঠকদের বলতে ইচ্ছে করলো এ’ বইয়ের কথা, তাই হাতে এ’কলম)। পরিশেষে আট পৃষ্ঠাব্যাপী বিশ্বকমিকসের এক দীর্ঘ সালতামামি রচেছেন কৌশিক মজুমদার। খেটে কাজ। (এটি যদিও ‘লালমাটি’-র বইটি থেকে পুনঃমুদ্রিত।) বাল্যে অরণ্যদেব-ম্যানড্রেক-গোয়েন্দা রিপ পড়েনি এমন মধ্যবয়সী বঙ্গসন্তান কদাচই পাওয়া যাবে। বর্তমান সংকলনের পরিশেষে সেই ‘ইন্দ্রজাল কমিকসের’ বাংলা প্রকাশনারাজির এক দীর্ঘ তালিকা পেলাম। সাধু সাধু! প্রায় পনেরজন লেখক-শিল্পীর দেড় বৎসরের এই অক্লান্ত কাজের ফল এত স্বল্পমূল্যে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া গেছে, এটা বড়ই প্রশংসার।
শেষে, একটা জিনিস খুঁজছিলুমঃ বঙ্গসন্তান শ্রীমান সারনাথ ব্যানার্জির ইঙ্গভাষায় লেখা গ্রাফিক-নভেলের কথা আমরা ৪৯ ও ৫৭ সংখ্যায় পড়েছি; আছেন আরেক ‘ভগীরথ’ বাঙালী অরিজিৎ সেন-ও। এঁরা ইংরিজিতেই লিখলেও বাঙলাভাষাতেও তো ‘গ্রাফিক-নভেল’ এসে গেছেঃ সত্যজিৎ-সুনীলের উপন্যাস এই ফর্মে হুদোহুদো আসছে, আবার সাহানা বাজপেয়ি-মনন দাসের মত নবীনরা মৌলিকও লিখছেন। ‘বাংলা গ্রাফিক নভেল’-এর ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে এক নিবন্ধ পড়তে পেলে মন্দ হতো না।
অতি চমৎকার প্রকাশনা। মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি। ছাপাই-বাঁধাই, অসংখ্য সাদাকালো ছবির মান অত্যুচ্চ।
এই বইকে দশে দশের একতিল নম্বর কম দিলে বলতে হবে এ’সমালোচক নেহাতই ...পক্ক!
আখতারনামা -- শামিম আহমেদ; অভিযান পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ জুলাই ২০১৭; ISBN 978-81-934630-3-1
অনন্তর আষাঢ়শেষের বেলায় প্রৌঢ় এক অবিশ্বাসী শ্বেত রুমালে মস্তক ঢেকে তার সহগামীর হাত ধরে প্রবেশ করলো সেই প্রাচীন উপাসনাগারে। সিবতায়নাবাদ ইমামবাড়াঃ মস্ত এক ‘জগন্নাথী রথে’র নিচে যেখানে শায়িত রয়েছেন ভারতের শেষ রাজা! রাজা, মানে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া...রাজার ছিলো তিন রাণী, বড়রাণীমা ছিলেন মুঘলজাদি... ...
— মানে, মুসলমান? তবে যে বল্লি, ‘রাজা’? নবাব বল্।
— সে তো ছিলেন তাঁর পারস্য থেকে লক্ষ্মৌ-আগত পূর্বপুরুষরা। তাঁর ঠাকুর্দার বড়ভাই ইংরেজদের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি পেলেন ঈশাই ১৮১৮তে... (শহর কলকেতায় তদ্দিনে ‘হিন্দু কালেজ’ বসে গেছে)।
এমন সময় সেই প্রায়ান্ধকার কক্ষের অধিবাসী এক দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ দ্বারী বলে উঠলেন, হে মহামান্য অতিথি, দীর্ঘদিনে রাজাকে দেখতে আসা দর্শকের মধ্যে আপনারাই প্রথম, নৈলে ঐ লক্ষীপ্যাঁচাটি ভিন্ন আর কেউ...
— লক্ষ্মীপেঁচা? নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের এই সমাধিকক্ষে?
— হ্যাঁ। ঐ দেখুন, হে মেহ্মান ...এঁরা বংশপরম্পরায় রাজার সমাধিরক্ষক। রাজার অজস্র পোষ্যপ্রাণীর মধ্যে এঁরাই...। কিস্সা শুরু হয়ে যায় বৃদ্ধের।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে শঙ্খধ্বনি, পাশেই মগরিবের আজান। স্থানঃ কলিকাতা শহরস্থিত মেটিয়াব্রুজ, রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের সমাধিস্থল।
লক্ষ্মৌর শেষ নবাব বহুগামী লম্পট ছিলেন, না নাচাগানা বিরিয়ানী-পোষ্যজীবজন্তু নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন (সাহেবদের শেখানো পাঠ-মুতাবিক), না প্রকৃতই একজন ধর্মভীরু প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন সে-সব কূটকচালি পেশাদার ইতিহাসবেত্তারা করুন গে, আমরা সাধারণ পাঠক কেবল নালেঝোলে হই এই সুখপাঠ্য ও বিপুলায়তন ঐতিহাসিক-উপন্যাসটি পাঠ করে যার জুড়ি বাঙলাভাষায় খুব বেশি সংখ্যায় মিলবে না, গবেষণাঋদ্ধতায় তো একমেবাদ্বিতীয়ম্! অষ্টাদশপর্ব মহাভারতের জায়গায় দশপর্বের ‘আখতারনামা’ লিখেছেন এই তরুণ ঔপন্যাসিক, হয়তো সচেতনভাবেই ‘ভীষ্মপর্ব’ ‘দ্রোণপর্ব’ ‘কর্ণপর্ব’ ‘শল্যপর্ব’ রাখেননি, কারণ ওয়াজেদ আলি শাহ্ ইংরেজদের সঙ্গে কোনো সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হননি কখনও, তাঁর পূর্বপুরুষ শুজাউদ্দৌল্লার মতো (বক্সার, ১৭৬৪)। এ’গ্রন্থের ‘আদিপর্বে’ পাঠক উন্মুখ হয়ে ওঠেন উপন্যাসপাঠে--জমাট বাঁধতে থাকে কাহানি ‘সভাপর্ব’ থেকে শুরু হয়ে দশম ও শেষ ‘মৌষলপর্ব’ অবধি, যেখানে দুর্বাসা মুনি নন, পির হামিদ আলির কাছে বালকের দল কৃষ্ণপুত্র শাম্বের জায়গায় বকর মির্জাকে গর্ভবতী নারী সাজিয়ে নিয়ে যায় রঙ্গরস করতে। ফলঃ সর্বনিপাত। বস্তুতঃ, আজকের আধুনিক এক উপন্যাসে এ’হেন ‘পর্ব’ ধরে ধরে অধ্যায়ভাগ করা হয়েছে, সত্যই এক ক্লাসিকের তালে টানটান এগিয়ে চলেছে কাহিনি, সাড়ে চারশ’ পৃষ্ঠার উপন্যাস গোগ্রাসে গিলতে হেড আপিসের বড়বাবু ফ্রেঞ্চলিভ মারছেন... এমন বড়ো একটা দেখা যায় না এই SAS (Short Attention Syndrome)-এর যুগে। শেষবিচারে, এইটেকেই উপন্যাসটির সাফল্যের এক প্রধান নিরিখ মানতে হবে। তদুপরি মহাবিদ্রোহের মন্ত্রগুরু মৌলবি আহ্মাদুল্লাহ্ শাহ্ ফৈজাবাদীর মতো ইতিহাসপুরুষের গাথা শুনতে পাওয়া বা শেষের ঐ দীর্ঘ পরিশিষ্ট পেয়ে যাওয়া তো বইটিতে উপরি পাওনা। বঙ্গানুবাদে আব্দুল হালিম শারার্ সাহেবের ‘পুরনো লক্ষ্মৌ’ ছাড়া এ’সময়ের গপ্প আর কিস্যু পড়া ছিলো না, এখন পড়ে বড় ঋদ্ধ বড় তৃপ্ত হলাম ভাই রে!
জীবনীভিত্তিক ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের আবার মস্ত কিছু ‘অ’-স্বাধীনতাও (সীমাবদ্ধতা) থাকতে বাধ্য। তাই, পরমহংসদেব সকাশে ওয়াজিদ আলি, বা নটী বিনোদিনীর নবাবদর্শন বা নবাবী আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মতো ঘটনাবলীর বর্ণনায় ভালকুঞ্চন অস্বাভাবিক নয়, অতিপাঠসুখতা সত্ত্বেও। কিন্তু ঔপন্যাসিকের কল্পনাপঙ্খি তো বিনা ভিত্তিতে ওড়ে না, উড়ে এসে যে তাকে বসতে হবে বাস্তবেরই এক ডালে। ধর্মানুসন্ধী ওয়াজিদ (যাঁর নামের অর্থই ‘অনুসন্ধিৎসু’!) পরমহংসদেবের দর্শনাকুল ছিলেন; বিনোদিনীকে রাজা চেয়েছিলেন তাঁর নাটকের (‘রাহাস’) এক চরিত্রে; সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর নিয়মিত আসতেন রাজার কাছে যাঁর কাছে উনি রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন — এ’সকল তথ্য তো রয়েইছে ইতিহাসে। ১৩৮ পৃষ্ঠায় হিন্দুনেতা সাভারকারের উল্লেখ?! না, ইনি বিনায়ক দামোদর (১৮৮৩-১৯৬৬ খৃ.) নন, জানা গেলো, এখানে তাঁর প্রপিতামহ রঞ্জিত বিনায়ক সাভারকরের উল্লেখ এসেছে। লেখকের গবেষণাকে আনত কুর্নিস জানাতে হয়। অমিতাভ ঘোষ-মশাই ছাড়া আজকের আর কোন্ বঙ্গসন্তান এত গবেষণা করে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, কে জানে?
বহু বহু ঘটনার বহু বহুবার পুনরুক্তি ঘটেছে এ’ উপন্যাসে, তবু এর মস্ত অবয়বের কারণে তাতে বরং লাভই হয়েছে খেইটা বারবার খুঁজে পেতে। পড়তে পড়তে বারবার মনঃক্ষুণ্ণতা এই কারণে যে ওয়াজিদ আলি শাহের মানের কবি বা নাট্যকার বা নৃত্যকারকে সেকালের কলকেতার উন্নাসিক ইংরেজিনবিশ বাবুকুল পাত্তা দেননি (সে নিশ্চয়ই তিনি ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম ছিলেন বলেই)। গৈরিকবস্ত্রে রাজার বাৎসরিক ‘যোগীনৃত্য’ তো আর কলিকাতাবাসী দেখেনি, কৃষ্ণ সেজে কত্থক নৃত্য দেখলো একশ’ বছর পরে সত্যজিতের ছবিতে। ওয়াজিদের জ্যোতির্বিদ পরিচয়টি তো উহ্যই রয়ে গেলো; নৈলে ফোর্ট উইলিয়মে বন্দী থাকাকালীন এক নৃপতি ‘এলম্যানাক’ রচেন একাকীত্ব কাটাতে? ভাবা যায়? এ’বিষয়ে তাঁর একমাত্র তূল্য নৃপতি মহারাজ সওয়াই জয়সিংহ।
আর আলিপুরের চিড়িয়াখানা? ওয়াজিদ আলি শাহ্ কলকাতায় না এলে হতো?
কাহানীক্রমে এ’গ্রন্থে এসে গেছে বহু বহু উর্দু-ফার্সি কবিতার উল্লেখ, বঙ্গীয় অক্ষরে লিখিত, কিন্তু অর্থ প্রাঞ্জল করা নেই বলে আমা-হেন গোলা-লোক বোঝেনি, (বিশেষতঃ, সেই ‘রা নাই দেয় রাধা’-টির মর্মোদ্ধারের জন্যে তো আকুলিবিকুলি করেছি--পৃ. ৪০৪), যদিও চমৎকার প্রাসঙ্গিকতার কারণে পড়ার গতি রোখেনি এ’সবে। উপন্যাসটির গবেষণাঋদ্ধতার কথা বলছিলামঃ কার্যসূত্রে বিশবার গিয়েছি লক্ষ্মণাবতী নগরীতে, কিন্তু মৎস্যলাঞ্ছিত নবাবী নিশানের কারণ বুঝিনি; এখন জানলাম। রন্ধন, চিকনকারি, কাগজ, কবুতর, অশ্বাদির এতো এতো যে জাত-ভাগ-উপবিভাগ হয় তা-ই কি জানতাম রে কখনও? যদিও সমাধির ঐ তাজিয়াকে ‘জগন্নাথী রথ’ ভাবায় ক্ষেতি নেই, দোস্ত্ বলল, কারণ রাজা বড় একটা পরোয়া করতেন না হিন্দু-মুসলিম শিয়া-সুন্নিতে। পাঁচ ওয়াক্তের নমাযির পাশাপাশি নিজেকে কৃষ্ণভক্ত বলতে গর্বিত হতেন ভারতের শেষ রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ্, জীবনে যিনি আসব স্পর্শ করেননি। অতি ধর্মভীরু পবিত্র শিয়াপন্থী মুসলিম! তাই না সক্ষেদে কিন্তু সগর্বে গাইতে পারতেনঃ
‘হম্ তো মরকর ভি কিতাবোঁ মেঁ রহেঙ্গে জিন্দা।
গম উনহি কো হ্যায় জো মর জায়েঁ তো গুজার জাতে হেঁ।।'
নতুন প্রকাশনা হাউজের কাজ বেশ ভালো। মুদ্রণপ্রমাদ যদিও কিছু চোখে পড়েছে। এতোবার ‘ব্যাবসা’ লেখা হয়েছে কেন? প্রচ্ছদটি আকর্ষক।
এই শহর কলকাতার বুকেই এ’হেন এক ইতিহাস-পুরুষের অবহেলিত সমাধিক্ষেত্র তাই মনঃপীড়া দেয় বড়ই। তাঁর শাহী প্রাসাদ আজ সাউথ-ইস্টার্ন রেলের কার্যালয়, নিশ্চুপ গঙ্গাঘাট। টপ্পা-ঠুম্রি হারিয়ে গেছে আজ কোথায়, আলু-দেওয়া মাটন-বিরিয়ানির মধ্যে বেঁচে আছে আওয়াধি তহ্জীব! ‘শতরঞ্জ্’-এ’ সেই যে মীর্জা সাজ্জাদ আলি (সঞ্জীবকুমার) বললেন না মুন্সি নন্দলালকে (ডেভিড): ‘কেবল ভাষা নয়, ভারতীয় তহ্জীবও শেখা উচিত ইংরজদের’! কে আর কার কাছে শেখে ? পরাজিতের সংস্কৃতি কবে আর বিজয়ী গ্রহণ করেছে ?
আষাঢ় শেষের বেলায় অবশেষে সাশ্রুনয়নে ভাবি কোথায় গেলো সেই ভারতের মেলবন্ধনী সংস্কৃতি, পাশাপাশি সেই হোলি আর মুহররমের উৎসব, নবাবের ছাপাখানায় ছাপা কৃষ্ণলীলার পালা ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’, আর বসন্ত-পঞ্চমীতে ওড়ানো রঙবেরঙের পতং?
এই সমাধিকক্ষের এক সফ্রেম তীর্থচিত্র, সত্যিই দেখি, আজ এলিয়ে পড়েছে!!
পুনঃ- এ’ গ্রন্থের বহুল প্রচার হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করিঃ শাশ্বত ভারতবর্ষের স্বার্থে।
জাপান প্রবাস--লেখক মন্মথনাথ ঘোষ; (‘ভ্রমণ’ শারদীয়া ১৪২৪ সংখ্যার সঙ্গে বিতরিত )
একটি গ্রন্থের অবয়বের সঙ্গে তার মানের যে কোনোই সম্পর্ক নেই, সে-কথা বারেবারে এই কলামে আমরা বলেছিঃ রঙচঙে পৃথুলা কেতাব ভারমাত্র বাড়াতে পারে, মন ভরায় না—এমন উদাহরণ যেমন ভুরিভুরি, অপরদিকে তন্বী এক পুস্তিকার (বা, ছোট্ট বই) প্রশংসায় নালেঝোলে হতে হয়েছে কতবারই না (উদা: ৪৩-সংখ্যায় ‘জলার গাছ’, বা ৫০-সংখ্যায় ‘মাকড়সা’ বা, ৫৮-সংখ্যায় ‘নদীপথে’)! যেমন আজকের আলোচ্যটি।
এমন সরল-সাধারণ-নির্মেদ বই পড়তে বড়ই ভালো লাগে গো, বড়ই ভালো লাগে। বিশেষতঃ, তা যদি ভ্রমণকাহিনী গোত্রের হয়।
না, এতে কোন পাণ্ডিত্য ফলানোর প্রচেষ্টা নেই, নেই কোনো বিশেষ ভাব বা মতবাদ প্রচার বা চাপানোর চেষ্টা।
আজ থেকে শতাধিক বৎসর আগে (১৯০৬ খৃ.), তখনও কলকেতায় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন চলছে, মোহনবাগানের শিল্ডবিজয়েরও তখন বাকি আছে আধ-দশক, এক বঙ্গীয় নব্যযুবক জাপানদেশে চল্লেন, গেলেন, রইলেন সেখান তিন বৎসরকাল... কী করতে, না, বোতাম-তৈরি শিখতে (সহ আরও কিছু হাতেকলমে বিদ্যে)—আর (পরে) লিখলেন সেই অভিজ্ঞতামালিকা, দিনপঞ্জিকা ধরে ধরে! এ’হেন এক ভ্রমণলিপির কথা ভাবতেই পুলকিত হতে হয়, না? এ’ বাবদ প্রথম বধাঈ প্রকাশকের প্রাপ্য হয়, কারণ তিনি প্লেটে করে তুলে না ধরলে চামচে তুলে তুলে মুখে দিতুম কী করে এ’ উপাদেয় খানা (মনের)? আসবো, প্রকাশকের কথায় শেষে আসবো, এখন কেতাবখানির কথা বলি।
সেকালে যেসকল ভারতীয় বা বঙ্গসন্তানের উচ্চাশা আই.সি.এস. বা বরিস্টরী হইত না, তাঁহারা হাতেকলমে কাজ শিখিতে জাপানযাত্রা করিতেন—এ’টা শোনা ছিল। পরিচয় ছিলো না এ’হেন এক বঙ্গসন্তান যশোহরবাসী কায়স্থপুঙ্গব শ্রীমান মন্মথনাথ ঘোষ (১৮৮২-১৯৪৪ খৃ.) মহাশয়ের অনন্য এই ফার্স্টহ্যান্ড ভ্রমণকাহিনী-তথা-জাপানবাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাভাণ্ডারের সঙ্গে। ইহাও জানিয়া পুলকিত হওয়া যাইলো যে জাহাজে ওঁর সহযাত্রী ছিলেন রবিপুত্র রথী ঠাকুর মহাশয়, যিনি কৃষিবিদ্যার উচ্চতর পাঠ নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন, জাপান ছুঁয়ে। আর প্রথম প্যারাতেই এটা পড়ে পুলকিত হয়ে উঠতে হয়না কি, যে এ’হেন ষোলজনের এক যাত্রীদলকে কলকাতা জেটি থেকে যাত্রারম্ভকালে ‘বন্দে মাতরম্’ জয়ধ্বনি দিয়ে বিদায়-সম্ভাষণ জানাচ্ছেন সি-অফ্ করতে আসা আত্মীয়বন্ধুকুল?! মাভৈঃ!
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শুরু, অতঃপর। প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর যাত্রী, তাই নিচুক্লাসেই যাত্রা। তেমন ক্লাসের বর্ণনা তো বড় একটা পড়তেই পাওয়া যায় না; যেমন, রেঙ্গুন থেকে ইয়োকোহামার দীর্ঘ তিন সপ্তাহের যাত্রাকাল এক গবাক্ষবিহীন পোতঘরে গাদাগাদি করে থাকা। কাপ্তানসাহেবের কাছে কক্ষবদলের উপরোধ কল্কেই পেলো না (এঁরা রঈস যাত্রী নন কিনা)। কলকাতা-রেঙ্গুন-পেনাঙ-সিঙ্গাপুর-হংকং-ইয়োকোহামা—যাত্রাপথের কী মনোজ্ঞ নিরাভরণ বর্ণনা, কত কত সরল অভিজ্ঞতামালা! যেমন, রেঙ্গুনের ‘বেঙ্গলি ক্লাবে’ ঠেক্ (ব্রহ্মদেশ তখনও কিন্তু ভারতবর্ষের অন্তর্গত, কলকাতা থেকে শাসিত! ইন্ডিয়ান রূপিয়া সেখানেও চলে), ছিমছাম পেনাঙ-শহরে (মালয়েশিয়া) বৈদ্যুতিক ট্র্যামকার, সিঙ্গাপুরের নিকটবর্তী চীনসাগরে সাপ ও উড়ুক্কু মাছ, হংকঙে শিখ-পুলিশ (পাশের চীনা ক্যান্টন-শহরে নাকি সদররাস্তার ধারে খড়্গাঘাতে অপরাধীর মুণ্ডচ্ছেদ করে...ওরে বাবা রে!)। পহেলা এপ্রেল (লেখকের বানানে) কলিকাতা হইতে যাত্রারম্ভ ও ঠিক এক মাস জাহাজযাত্রা করিয়া ৩০শে জাপানে অবতরণ।
এরপর রয়েছে দীর্ঘ জাপানবাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, খাওয়ার কষ্ট থেকে জাপানিদিগের ভদ্রতা থেকে নিয়মানুবর্তিতা থেকে নারীপুরুষ সহস্নান...কী নেই? সে সব এই গ্রন্থ-সমালোচনায় বলে দেবার জো নাই, ভাই, নৈলে পড়ে দেখবেন কী? লেখকের সারল্য বারংবার মুগ্ধ করে, যেটা ভালো লাগেনি সাপ্টা বলে দিতে দেরি করেননি, আবার তাঁর কারখানার মালিকের মহানুভবতাও আটখান করে বলেছেন। বড়ই সুখপাঠ, বড়ই সুখপাঠ।
কলকাতার স্বর্ণাক্ষর প্রকাশনী আজ দীর্ঘ তিনদশক ধরে ভ্রমণ ও ভ্রমণসাহিত্যকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, দিয়ে চলেছেন, সমগ্র ভারতে অনন্য তা, কারণ হিন্দি-তামিল-গুজরাটি-হেন ভাষায় এ’হেন কোনো প্রচেষ্টা আছে বলে জানি না। সে-সব আলোচনা আমাদের বর্তমান নিবন্ধের পরিধির বাইরে, কিন্তু এরই ফাঁকে ফাঁকে এঁরা লুপ্তপ্রায় প্রাচীন বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনীকে (যেমন, বর্তমানেরটি) যে পরম মমতায় ও যত্নে উদ্ধার করে এনে এনে বাঙালিপাঠকের পাতে পরিবেশন করছেন, কেবল এরই জন্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকবে এই প্রকাশনা-হাউজের কাছে। এঁরা না থাকলে হারিয়ে যেত এমন এমন উপাদেয় বাঙলা ভ্রমণকাহিনীরাজি। এমনভাবেই, দেবেন ঠাকুরের ‘হিমালয় ভ্রমণ’ (অপরিবর্তিত বানানে মূল-সংস্করণ) পড়েছিলাম গত বৎসর।
লেখক জাপ-ভাষা না জেনেই সে দেশে গিয়েছিলেন, এবং গিয়েও সেই কঠিনভাষা শিক্ষায় বড় যে একটা সুবিধা করে উঠতে পেরেছিলেন তা নয় (অকপট স্বীকারোক্তিও রয়েছে তাঁর)। তাই ‘সান’ (মহাশয়/মহাশয়া)-কে ‘ছান’, ‘সেন্সেই’ (শিক্ষক)-কে ‘সেন্সে’ বা, ‘জিন্রিকশা’ (রিকশা)-কে ‘জিনরিক্ষা’ লেখা মেনে নিতে হবে। তবে, ১৮৮২-এ’ জন্মগ্রহণ করা মন্মথবাবুকে প্রকাশক-মহাশয় ‘তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশোহর জেলার...’ বলে কেন পরিচয় করিয়ে দিলেন, বুঝলাম না।
যদিও তাতে এই অমূল্যরতনের শান ঘাটে না একরত্তিও।
পুনঃ- প্রকাশনালয়ের কাছে অনুরোধ, এ’হেন গ্রন্থ ই-বুক ফর্মেও আনুন না, নৈলে স্থায়ীত্ব পাবে কী করে, আমপাঠক হাতে পাবেন কেমনে?
Barefoot to Boots: The Many Lives of Indian FootballL---Novy Kapadia (Foreword by Bhaichung Bhutia ); Penguin Books (Penguin Random House India); First published: September 2017; ISBN: 9780143426417
সৌমেন মিত্র, রণজয় সেন, বোরিয়া মজুমদার, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস মুখার্জি, শুভ্রাংশু রায়... ভারতীয় ক্রীড়া/ফুটবলের ইতিহাসকারগণ সবাই যে বাঙালি, এটা বোধহয় সম্পূর্ণ কাকতালীয় নয় (কলকাতাকে ‘ভারতীয় ফুটবলের মক্কা’ কি এমনি এমনি বলা হতো?)। নজরটা একটু ঘুরিয়ে, তাই, দিল্লিবাসী এক প্রবীণ পার্সি সাংবাদিকের কলমে নাঙ্গাপদ থেকে মণিপুরের উত্থান পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবলের গোটা এক ইতিহাস পড়তে পাওয়াটা পরম এক প্রাপ্তি, কারণ আমরা কলকেতাবাসী বাঙালিরা সদাই যে মোহন-ইস্টকেই শেষকথা ভাবি সেটাই তো শেষ নয়!
এই সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গীটাই বইখানির প্রাণভোমরা, সেটাই মূল আকর্ষণ।
ছাপ্পান্নর অলিম্পিক টিমের কথাই ধরুন না। টিম ম্যানেজার খলিফা জিয়াউদ্দিন সাহেব, কোচ কিংবদন্তীর সৈয়দ আব্দুল রহিম এর উপর আবার হায়দ্রাবাদ পুলিশের আজিজকেই যদি ক্যাপ্টেন করা হয় তো লোকে এটাকে পাকিস্তানী টিম ভেবে বসবে যে! তাই প্রবল পরাক্রান্ত মোহনবাগান লবির চাপে নবাগত বদ্রু ব্যানার্জীকেই অধিনায়ক করা হলো। বজায় থাকলো কলকাতার আধিপত্য। উপেক্ষিত হলো বাহান্নতেও অলিম্পিক খেলা হায়দ্রাবাদী আজিজ ও নূরের দাবি।
থিমেটিক্যালি, চমৎকার চমৎকার পর্ব ও অধ্যায়ে ভাগ করেছেন নোবি তাঁর এই অতিসুখপাঠ্য গ্রন্থটিকে। তিনটি পর্বের (১) প্রথমটিতে বাঙলা-গোয়া-হায়দ্রাবাদ-দিল্লি...কেন্দ্রিক ফুটবলের গল্প শোনাতে শোনাতে এসে থেমেছেন নবোদিত উত্তরপূর্বের ফুটবলে। (স্মর্তব্য, আজকের ভারতীয় ফুটবলে উঃ-পূর্বের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। ২০১৭র ‘১৭-নিম্ন ফুটবলে’ ভারতীয় টিমে আটজন মণিপুরী খেলোয়াড় ছিলেন!) (২) দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে কয়েকটি ঐতিহাসিক ম্যাচের গল্পঃ ১৯১১-র মোহনবাগানের শিল্ডজয় থেকে ১৯৪০-এ প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে মহমেডান স্পোর্টিঙের ডুরান্ড বিজয় (এ-ও এক পাক্কা বৃটিশ ফৌজিদলকে হারিয়েঃ ‘রয়াল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্ট’)...থেকে... ছাপ্পান্ন অলিম্পিক কো.-ফাইনালে হোস্ট অস্ট্রেলিয়াকে ৪-২-এ ধ্বংস (বম্বের নেভিল ডিসুজার হ্যাট্রিক সহ) ইত্যাদি ইত্যাদি। পড়লে, সত্যি, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! সত্যিই, এই সব কৃতিত্ব তো আমাদের এই ভারতবর্ষের মানুষই করেছিলো, বর্তমান বিশ্বফুটবলে যে দেশের র্যাঙ্কিং ১০৫ (পরশু-বছর তলানিতে ছিল ১৭১। গড় ১৩৩ )। (৩) তৃতীয় ও শেষ পর্বটিতে পজিশনভিত্তিক আলোচনায় মেওয়ালাল--টি আও--জার্নেল--থঙ্গরাজ---এমন এমন কয়েকজন কিংবদন্তীর ফরওয়ার্ড-মিড্-ব্যাক-গোলির গাথা গাওয়া হয়েছে।
বড়ই সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ।
ভারতের প্রথম ফুটবল নিয়ামক সংস্থা হিসেবে ‘আই এফ এ’-র জন্ম যদিও কলকাতাতেই (১৮৯৩ খৃ.), তার আগেই কিন্তু শিমলায় ডুরান্ড কাপ (১৮৮৯ খৃ.) ও বোম্বাইতে রোভার্স কাপ (১৮৯১ খৃ.) টুর্নামেন্ট খেলা শুরু হয়ে গেছে হৈ হৈ করে; আইএফএ শিল্ড (১৮৯৩ খৃ.) শুরু তার একটু পরে। ১৯১১র মোহনবাগানের শিল্ডবিজয় যে কতবড়ো এক রাষ্ট্রীয় বিজয় ছিলো সেটা বোঝা যায় সেই স্ফুলিঙ্গের পুরো উপমহাদেশ পেরিয়ে বালুচিস্তান-পেশাওয়ারে পৌঁছে যাওয়ায়। ১৯৪০-এর প্রথম ডুরান্ডজয়ী মহমেডানের অধিনায়ক হাফিজ রশিদ (আদতে আজমীঢ়বাস) ছিলেন অভিলাষ ঘোষের ‘একলব্য শিষ্য’, বিজয়ের সেদিনে (১২ ডিসেঃ ১৯৪০) উনি জুম্মা খাঁ-বাচ্চি খাঁ-ওসমান জান (গোলি)-এর মত তারকা-সাথীদের বারংবার মোহনবাগানের ১৯১১-র উদাহরণ দিয়ে দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন (এঁরা, আদতে, বালুচ-পাখতুন-দিল্লিবাসী মানুষ)। তবু, ফুটবল কিন্তু কখনই কলকাতা বা মোহন-ইস্টে আবদ্ধ ছিলো না, ছিলো/আছে সত্যিই এক সর্বভারতীয় গেম। নৈলে, সেই পরাধীন ভারতে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে ‘ব্যাঙ্গালোর মুসলিম’-এর ১৯৩৭-৩৮ উপর্যুপরি দু’বছর রোভার্স জয়ের কী ব্যাখ্যা হয়? রেঙ্গুন থেকে হায়দ্রাবাদ থেকে করাচিতে ফুটবল অতি জনপ্রিয় ক্রীড়া ছিলো ভারতবিভাগের অনেক আগে থেকেই। বিশেষতঃ, হায়দ্রাবাদের ফুটবল ইতিহাসকে ‘ভারতশ্রেষ্ঠ’ বলতে ইচ্ছা করে কারণ তেমন কোনো আর্থিক ও পরিকাঠামোর সমর্থন ছাড়াই এখানে রহিমসাহেবের মতো কোচ আর আজিজ-লতিফ-ইউসুফ-নূরের মতো ফুটবলার জন্মেছেন। কলকাতার এতো রমরমার পিছনেও বলরাম-থঙ্গরাজ-নঈম-হাবিবের মতো হায়দ্রাবাদীদের অবদান অল্প নয়, বিশাল।
এই বইয়ে হায়দ্রাবাদী ফুটবলের যে কাহানি শোনা গেল, অনন্য তা! ভারতের এতাবৎ শ্রেষ্ঠ বিশ্বফুটবল-পারফর্মেন্স ১৯৫৬-র মেলবোর্ন অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান লাভ, যে দলে হায়দ্রাবাদের খেলোয়াড় ছিলেন আট জন! ১৯৬০এর রোম অলিম্পিকদলে ছিলেন সাতজন। মাসিক চল্লিশ টঙ্কা বেতনের হায়দ্রাবাদ পুলিশের খেলোয়াড়রা কী খেলাটাই না খেলে গেছেন গো! ১৯৫০-৫৪ টানা পাঁচবারের রোভার্স চাম্পিয়ন হয়েছেন এঁরা, ইস্টবেঙ্গল ততদিনে একবার মাত্র রোভার্স জিতেছে, বাগান তখনও না! ১৯৭০ ডিসিএম ফাইনালে ১-০ এগিয়ে থেকেও তাঁরা শেষ পর্যন্ত হেরে যান। টিমের দশজন খেলোয়াড় মুসলিম। রমজান মাস সেটা। তাঁরা কিন্তু রোজা রাখা ছাড়েননি! হায়দ্রাবাদের এক কিংবদন্তী কোচ মো. ঘৌসুদ্দিন প্লেয়ারদের নিয়ে তিরুপতিতে আশীর্বাদ যাচ্ঞা করতে যেতেন!
ভারতের শ্রেষ্ঠ রেফারি সৈয়দ শাহিদ হাকিম (রহিমসাহেবের সুপুত্র)-ও ছিলেন হায়দ্রাবাদী।
মনকাড়া ফটো রয়েছে বহু। তাতে কোনোটায় সালগাঁওকারের (গোয়া) প্লেয়ারদের মাঝে নেহ্রুজী, কোনোটায় ইস্টবেঙ্গলের প্লেয়ারদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন দিলীপকুমার, বা সাদা ১০ নং জার্সি পরে পেলে নামছেন ইডেনে! জাতীয় দলের ছবি বহু। একটি ফটো ১৯৪৮-এর ভারতীয় টিমেরঃ এক ধনরাজ ছাড়া সকলেই বুটহীন, এঙ্কলেট পরিহিত। ভারত-অধিনায়ক ডাঃ তালিমেরান আও-কে লন্ডনে এক গোরা ‘তোমরা খালি পায়ে খেল কেন?’ শুধোলে তাঁর হাজির-জবাব ছিল, ‘এটা তো ফুটবল খেলা, বুটবল তো নয়’! টি আও সম্বন্ধে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামের এক আদিবাসি পাদ্রিসন্তান কলকাতার আর জি করে মেডিক্যাল পড়তে আসেন। সেখান থেকে মোহনবাগান অধিনায়ক থেকে ভারত-অধিনায়ক... যাত্রাটি বড় কম নয়। পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘ইন্ডিয়ানোবা’ (ভারতনেতা)। আজকের উঃ-পূর্বের ফুটবল-জাগরণের আদিপুরুষ এই আও-সাহেবই ছিলেন। আরেকজন, যেমন, জার্নেল সিং। চুনী-পিকে-বলরামের কালেও ভারতের এক জনপ্রিয়তম ফুটবলার ছিলেন জার্নেল। আটষট্টিতে মোহনবাগান ছেড়ে পাঞ্জাবে ফিরে জাগিয়ে তুললেন সেখানকার ফুটবলকে। ফলশ্রুতিঃ ’৭৫-এর তারকাখচিত বাঙলা দলকে ৬-০ হারিয়ে পাঞ্জাবের সন্তোষ ট্রফি জয়! নাঃ, এ’বই কি আর পড়ে শেষ করে ফেলা যায়? বারবার পড়তে হয়। নৈলে, ডুরান্ডকর্তা বঙ্গসন্তান উইংকমান্ডার কল্যাণ কুমার গাঙ্গুলি সম্বন্ধে জানতে পেতুম কোত্থেকে? নোবি-দা, ডুরান্ডের কিংবদন্তী রেফারি শৈলেন ভটচাজ সম্বন্ধেও দু’এক কথা শুনতে পেলে ভালো লাগতো।
তথ্যের আকর এ’ কেতাব! কত যে চমৎকার চমৎকার anecdote (ছুট্কাহানি) পড়তে পাওয়া গেছে, জানতাম না সে সব; কয়েকটা তার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ
১) আর্থিক সঙ্কটের কারণে মেলবোর্নে প্রায় যাওয়াই হচ্ছিল না ভারতীয় ফুটবল টিমের (১৯৫৬)। এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট পঙ্কজ গুপ্ত সাহেব তাঁর কলকাতার বসতবাটি মার্কারি ট্রাভেল্সের কাছে বন্ধক রেখে খেলোয়াড়দের জন্যে প্লেনের টিকেট কাটেন!
২) কিংবদন্তীর লেফট ইন অতি-সুদর্শন আমেদ খাঁ সাহেব খেলতেন ইস্টবেঙ্গলে। একবার অসুস্থ হয়ে হসপিটালাইজড হলে বাঙালি নার্স অঞ্জলী তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করে ভালো করে তোলেন। সেই থেকে প্রেম ও বিবাহ!
৩) পৃথিবীশ্রেষ্ঠ World Soccer পত্রিকা ইস্ট-মোহন ম্যাচকে বিশ্বের সেরা পঞ্চাশটি ডার্বির মধ্যে স্থান দিয়েছে (যদিও ২০১৬এ ভারতের ফিফা র্যাঙ্কিং ছিল ১৬৩... তা সত্ত্বেও!)
৪) ১৯৪০-এর ডুরান্ড ফাইনালে রেফারিঙের দায়িত্ব পান কাপ্টেন হরনাম সিং, কিন্তু দুই বৃটিশ লাইন্সম্যান তাঁর অধীনে খেলাতে অস্বীকার করলেন। বড়লাট লিনলিথগো ততক্ষণে মাঠে এসে গেছেন। খবর গেলো তাঁর কানে। সটান কোর্ট মার্শালের হুমকি দিলে তেনারা সুড়সুড় করে ফ্ল্যাগ হাতে মাঠে নামেন।
৫) ১৯৫১র প্রথম এশিয়ান গেমসের ফুটবল ফাইনালে সাহু মেওয়ালালের অসম্ভব এক ভলি থেকে এসেছিল ভারতের জয়সূচক গোলটি, যে ম্যাচটি তাঁর প্রায় খেলাই হচ্ছিল না, কারণ সেই সকালেই তাঁর পিতৃবিয়োগের টেলিগ্রামটি এসেছিল। নেহ্রুজীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বায়ুসেনার এক প্লেন অপেক্ষায় ছিলো, খেলা শেষেই মেওয়ালালকে নিয়ে কলকাতায় উড়ে যায়!!
এমন আরও কতো!!
‘অপছন্দ’ নয়, কয়েকটি ‘মতপার্থক্যের’ কথা বলিঃ তৃতীয় পর্বের আলোচনায় ‘কিংবদন্তী’-র মধ্যে ‘ব্যাকে’ মান্না-গোষ্ঠ পাল নেই, ‘মিডে’ রামবাহাদুর-কেম্পিয়া, বা ‘ফরওয়ার্ডে’ আমেদ খাঁ-সামাদ-ও নেই... এটা মানতে কষ্ট হলো। সেকালের স্টারটিম ‘ব্যাঙ্গালোর মুসলিম’-এর গল্প ছুঁয়ে চলে গেছেন, বেশি নেই... আর তাহলে কোথায় পড়তে পাবো এই অসাধারণ ফুটবল টিম সম্বন্ধে? প্রথম ইউরোপীয় ক্লাবে খেলা কলকাতার ছেলে মহম্মদ সেলিম (১৯০৪-৮০ খৃ.) সম্পর্কেও কিছু পড়ার ইচ্ছে ছিলো। মগন সিং মস্ত ফুটবলার হয়তো ছিলেন না, কিন্তু এমন এক ফুটবল-ইতিহাসে এই ভারত-অধিনায়কের নামোল্লেখ মাত্র নেই কেন? খেলার মাঠে শুধু জয়ের কথাই কেন? ‘উল্লেখ্যম্যাচে’র মধ্যে ১৯৫৫তে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ভারতের ১১-১ গোলে হারের গল্পও শুনতে চাই নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস জানার খাতিরে। কোথায় যে পাই পড়তে? আর শেষে বলি, সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার এই অসাধারণ ‘কালেক্টর’স আইটেম’ বইটির প্রচ্ছদটি সবচেয়ে অপছন্দের ও কল্পনাবিহীন মনে হয়েছে। ভারতীয় ফুটবলের দীর্ঘ বর্ণময় ইতিহাসের চিহ্নমাত্র নেই এতে, কেবল ২০১৫র এক আই.এস.এল ম্যাচের ফটো ছেপে দেওয়া হয়েছে।
যদিও তাতে গ্রন্থটিকে মাথায় করে রাখা আটকায় না।
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)