Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
রূপা মণ্ডলের

লেখা


ISSN 1563-8685




চা বাগানের আতঙ্ক

(১)

দু'হাজার নয় সালের শুরুর দিকের কথা বলছি। আমাদের কোম্পানি নর্থবেঙ্গলে একটা চা বাগান কিনতে উদ্যত হলো। অফিস থেকে আমাদের চারজনকে কাগজপত্র যাচাই, কথাবার্তা ইত্যাদির জন্য পাঠানো হলো সেখানে। কোম্পানির গাড়িতে করে কলকাতা থেকে যাওয়া। খুব ভোরবেলায় রওনা হয়ে ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেলো। আমাদের যাওয়ার ও থাকার সংবাদ আগেই সেখানে জানিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের গাড়ি ওখানে পৌঁছতেই বাংলোর কেয়ারটেকার হরেন একটা বড়ো ছাতা নিয়ে দৌড়ে এলো। ততক্ষনে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। নিম্নচাপের প্রভাবে দু'দিন চলবে। এতো শীত করছিলো যে গাড়ির ভিতরে কুঁকড়ে বসেছিলাম সকলে! তারপরে বাইরে বেরতেই যেন ঠান্ডা ছোবল মারলো! আমরা সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি বাংলোর বারান্দায় উঠে এলাম। ঘরের ভিতরে ঢুকতেই একটু উষ্ণতা অনুভব করলাম। দেখলাম, ফায়ারপ্লেস-এর আগুনে ঘরটা বেশ গরম হয়ে রয়েছে। দরজা বন্ধ করে আমরা চেয়ার টেনে বসে রুমাল দিয়ে গায়ে, মাথার জল মুছলাম।

হরেন আমাদের বললো, "বাবু কফি করে দেব?"

--তাই দাও।

হরেন শুধু কফিই আনলো না, তার সাথে বিস্কুট, সস্তার কেক ইত্যাদিও আনল। ক্ষিদে পেয়েছিলো বেশ! সকলে মিলে খুব তাড়াতাড়ি কফি, বিস্কুট আর কেক সাবাড় করে দিলাম। হরেন জিজ্ঞাসা করলো, "রাতে কি বানাবো বাবু? ভাত খাবেন তো সকলে?"

আমাদের মধ্যে তিনজন বাঙালি, একজন বিহারী আর একজন পাঞ্জাবি ড্রাইভার। আমাদের ভাত-রুটি আর মুরগীর মাংসে কোনো আপত্তি ছিল না। আমাদের কথা মতো হরেন ভাত, রুটি আর মুরগীর মাংস বানালো। অপূর্ব লেগেছিলো হরেনের রান্না সেই মুরগীর মাংস! রাতে আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম সকলে। বাংলোয় দুটি ঘর, একটা বসার ঘর আর তাছাড়াও একটি রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম আছে। একটা বাথরুম দুটি ঘরের সাথে সংযুক্ত। আমরা দুটি ঘরে দু'জন করে শু'লাম, আর ড্রাইভার হরদেব থাকলো বসার ঘরের সোফায়।

রাত তখন অনেক, হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ, অনেকটা কাঠচেরার মতো। আচমকা আওয়াজে ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো। আমি তড়াক করে বিছানার উপরে উঠে বসে হাতের কাছে রাখা টর্চটা খুঁজতে লাগলাম। আমার সাথে সাথে অনুব্রতও জেগে উঠেছিল। সেও ভয় পেয়েছে খুব! কিন্তু হাতের ইশারায় আমাকে বাইরে বেরোতে নিষেধ করলো। সে আমাকে ফিসফিস করে বললো, "এটা বাঘের ডাক! আমি জানি। আমি ছোটবেলায় দীর্ঘদিন আলিপুরদুয়ারে ছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা ফরেস্ট ছিল, ওখান থেকে মাঝে মাঝে বাঘ চলে আসতো লোকালয়ের কাছাকাছি। এখন কোনোমতেই বাইরে যেও না।"

দ্বিতীয় দিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরে বেরোনো অসম্ভব। আমরা সমস্যায় পড়লাম। আজই সেই বিক্রেতা কোম্পানির কাছে কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করার কথা ছিল। তারপরে একটা রাফ এস্টিমেট বানিয়ে দরকারি কাগজপত্রগুলো অফিসে ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওখানে হেড অফ দা অথরিটি সেগুলো পরীক্ষা করে দেখার পরে এটর্নির কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে পারচেজ দলিল বানাবার জন্য। বোর্ড মিটিং ডেকে সকলকে জানানো হবে গার্ডেন পারচেজের ব্যাপারে এবং কাউকে দলিলের সাইনিং অথরিটি করা হবে। গার্ডেন পারচেজের পরে টি-গার্ডেনের জমির একটা রাফ স্কেচ করা হবে, কি পরিমাণ গাছ আছে আর নতুন গাছ কতটা কি বসানো হবে তার এস্টিমেট করা হবে। আমাদের এখানেই কয়েক দিন থেকে সব ফাইনাল করার কথা ছিল। বস আসবেন ফাইনাল ডিড সাইন হওয়ার ঠিক একদিন আগে।

কিন্তু এই বৃষ্টি আমাদের সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলো। তুমুল বৃষ্টিতে পাহাড়ি পথে গাড়ি চালানো অসম্ভব। কার্যতঃ সারাটা দিন আমরা গৃহবন্দী হয়েই রইলাম। সারাদিন গল্পগুজব করে আর তাস খেলে কাটালাম। আমি একটু ভাবুক মানুষ, দুটো কবিতাও লিখে ফেললাম ডায়রিতে। একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হলাম যে, গতকাল রাত্রে আমরা যে ডাকটা শুনেছি সেটা বাঘেরই। হরদেবও বললো, মধ্যপ্রদেশে ফরেস্টে থাকাকালীন ও একবার বাঘের ডাক শুনেছিলো, ঠিক কাল রাতের মতোই।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু কমলো, কিন্তু একেবারে থামলো না। শীতের বিকেল অকাল বর্ষার আগমনে একেবারে ঘন কালো হয়ে উঠলো। আচমকাই দিনের আলোর রেশটুকুও মিলিয়ে গিয়ে চারিপাশে নেমে এলো অন্ধকার। এখানে গতকাল রাত থেকেই ইলেকট্রিক নেই। আমরা বসার ঘরে মোমবাতি জ্বেলে বসে গল্পগুজব করছিলাম আর হরদেবের সাথে বিকাশ তাস খেলছিল।

সঞ্জয় ঘন ঘন সিগারেট খায়, ও ঘরের ভিতরে বায়ুদূষণ না করে বারবার বারান্দায় যাচ্ছিলো। হঠাৎ ছিটকে ভিতরে ঢুকে পড়লো, আমরা সবাই মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে। ও বললো, "একটা সাপ! বারান্দায় ওঠার চেষ্টা করছে!"

আমরা হরেনের নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকতেই ও রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলো। টর্চ জ্বেলে একটা লাঠি নিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো। বেশ বড়ো সাপ! ফণা আছে! ভাগ্যিস সেটা আর বারান্দায় না উঠে পাশের ঝোপে খসে পড়লো।

--কার্বলিক অ্যাসিড আছে?

হরেন ঘাড় নাড়লো, আছে। কার্বলিক অ্যাসিড-এর শিশিটা ওর হাত থেকে নিয়ে আমাদের ড্রাইভার হরদেব বারান্দার সিঁড়ির আশেপাশে আর বাথরুমের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে বসার ঘরের কোনটায় শিশিটা রেখে দিলো। সাপটা সম্ভবতঃ লোকজনের পায়ের আওয়াজ কিংবা কার্বলিক অ্যাসিড-এর গন্ধ পেয়ে বারান্দার নীচে ঝোপের আড়ালে চলে গেছে।

আমরা ঘরের ভিতরে বসে থাকলেও মাঝে মাঝেই সাপের আতঙ্কটা ফিরে আসছিলো মনে।


(২)

সন্ধে ছ'টা নাগাদ আবার কিছুক্ষনের জন্য ইলেকট্রিক এলো। একটুখানি পরেই বসার ঘরে যে ফ্যাক্স মেশিনটা আছে তাতে হঠাৎ শব্দ করে ফ্যাক্স আসতে রইলো। বিক্রেতা কোম্পানির অফিস থেকে ফ্যাক্সে কাগজ পাঠালো। টি-গার্ডেন বন্ধ থাকার কারণে এখানে ওদের অফিসও বন্ধ। তাই মেন অফিস থেকেই কাগজ পাঠাচ্ছে। আমরা চারজনে সেই কাগজগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। কয়েকটা পেজ বেশ অস্পষ্ট। অনুব্রত ডিক্টেট করলো, আমি একটা কাগজে মূল বিষয়টা লেখার চেষ্টা করলাম। তারপরে সেই কাগজগুলো সমেত আমার লেখা কাগজটা কলকাতার অফিসে ফ্যাক্স করে দিলাম। জানি না, ওই ফ্যাক্স পড়ে কতটা বোঝা যাবে। কিন্তু আমাদের কোনো উপায় ছিল না। একটু বাদেই খোদ বসের ফোন এলো আমার সেলফোনে। কি লেখা আছে কাগজে পরিষ্কার বোঝা না যাওয়ার কারণেই ফোন। আমি যতটা বুঝেছি, বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বস খুব একটা স্যাটিসফাইড হলেন না, বললেন, আগামীকাল বৃষ্টি থামলেই যেন আমি গিয়ে মিস্টার দেবেশ ঝা-এর সাথে দেখা করি, ওনার বাংলো এখন থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই।

সাড়ে সাতটা নাগাদ আবার লোডশেডিং। আমরা মোমবাতির আলোয় ভুতের মতো বসে রইলাম। ইতিমধ্যে হরেন এসে আমাদের ডিমের বড়া আর কফি দিয়ে গেছিলো। সেদিনও রাতে মুরগীর মাংস দিয়ে ভাত আর রুটি খেয়ে আমরা শুতে গেলাম।

রাত দশটা নাগাদ বারান্দায় যেন কিসের একটা খসখস আওয়াজ হলো। আমার ঘুমটা বরাবরই পাতলা। ভেঙে গেলো। সতর্কভাবে টর্চটা হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। একটা ভারি কিছু দরজায় ক'বার আঁচড়ালো বলেই মনে হলো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো, কথা বলতে পারছিলাম না! অনুব্রতকে ডাকতেও পারছিলাম না। অনুভব করলাম, অনুব্রতর জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে, অর্থাৎ ও জেগে আছে, কিন্তু কথা বলতে পারছে না, আমার মতোই। দরজার কাছে খসখস আওয়াজটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। মনে হলো, কিছু একটা ফিরে গেলো। ভয়ে আমরা বিছানা ছেড়ে নামতেই পারলাম না!

অনেকক্ষন জেগে ছিলাম দু'জনে। বাকিদের কথা জানি না, তবে কেউ বাইরে বেরোনোর দুঃসাহস দেখায়নি।


(৩)

তৃতীয়দিনে বৃষ্টি অনেকটা কমলো। মিস্টার দেবেশ ঝা আমাদের জন্য জিপ পাঠিয়েছিলেন। আমরা চারজন সেই জিপে চড়ে ওঁর বাংলোয় গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম নীল পাহাড় সাদা কুয়াশার ওড়নায় মুখ ঢেকে রয়েছে। মাঝবয়সী ঝা-জী এখানে একাই থাকেন। গোল ফুটবলের মতো চেহারা, মাথায় বেশ বড়ো একটা টাক। ওঁর বাংলো বেশ বড়ো, কাঠের তৈরি। একজন নেপালি মেড আছে, রান্না করে, বাসন মাজে, ঘর পরিষ্কার করে। আমরা যেতেই গরম গরম চা আর পকোড়া খাওয়ালেন। হরেনও আমাদের চা খাইয়েছিল, কিন্তু এ চায়ের স্বাদ আলাদা! কী সুন্দর ফ্লেভার, তা না খেলে অনুমান করা শক্ত! তারপর আমরা সবাই মিলে বসে কাগজপত্র খতিয়ে দেখা, আলোচনা ইত্যাদি করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। উনি আমাদের দ্বিপ্রাহরিক ভোজন না করিয়ে ছাড়লেন না। সবই নিরামিষ রান্না, তবে বেশ সুস্বাদু!

ঝা-জীর বাংলোয় বাঘের ছাল, হরিনের স্টাফড মাথা দেখলাম, শিংগুলো কী সুন্দর! ঠিক যেন গাছের আঁকাবাঁকা ডালের মতো!

বললেন, ওসব ওনার কালেকশন একজন শখের শিকারীর কাছ থেকে! বয়সকালে তিনি জুয়ার নেশায়, দেনার দায়ে অনেক কিছু বিক্রি করেছিলেন, তার মধ্যে এগুলোও ছিল।

ঝা-জী আমাদের দু'রাতের অভিজ্ঞতার কথা শুনে বললেন, কিছুই অসম্ভব নয়। এখানে প্রায়ই গভীর জঙ্গল থেকে বাঘ চলে আসে। সাবধানে থাকতে বললেন। প্রয়োজনে ওনাকে ফোন করতে বললেন। আর সন্ধ্যা থেকেই একদম বারান্দায় বা বাইরে বেরোতে নিষেধ করলেন।

যাতায়াতের সময় জায়গাটা ভালো করে দেখছিলাম। চা-বাগানটা প্রায় দেড়-কিলোমিটার বিস্তৃত, তার মধ্যেই রয়েছে ম্যানেজার বাংলো, যেখানে আমরা আছি, তাছাড়া টি-গার্ডেন অফিস, ঝা-জীর বাংলো, এবং একধারে রয়েছে কর্মীদের থাকার বাসস্থান। যারা চায়ের পাতা তোলে সেই শ্রমিকদের ঘরগুলো নিয়ে আছে একটা বস্তি। সেটা গার্ডেনের ভিতরে নয়। এখন এই চা বাগান বন্ধ। বছরখানেক বন্ধ থাকার পিছনে রয়েছে কোনো একটি রাজনৈতিক এবং শ্রমিক সমস্যা। যারা বাগানে কাজ করতো এখন তারা অনাহারে, অর্ধাহারে রয়েছে। একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওদের চাল, খাবার-দাবার, পুরোনো জামাকাপড় ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করে। যদি টি-গার্ডেন কিনে রাজনৈতিক সমস্যা ও শ্রমিক সমস্যার সমাধান করে আমাদের কোম্পানি এটাকে চালাতে পারে তাহলে শ্রমিকরাও উপকৃত হবে।

দুপুর থেকেই রোদ উঠে গেছে। আমরা এলাকাটা একটু ঘুরে দেখতে চাইলাম। ঝা-জীর ড্রাইভার খুশি মনেই আমাদের ঘুরিয়ে দেখালো। ফেরার পথে দেখলাম, একটা মেয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমাদের গাড়ির দিকে। মেয়েটা বোধহয় চা-বাগানের কোনো কর্মীর মেয়ে-টেয়ে হবে। কিন্তু ওর রূপে একটু চটক আছে।


(৪)

আমাদের বাংলোয় ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো। ফিরেই দেখলাম হরেন আমাদের জন্য ফুলকপির চপ আর আলু পকোড়া বানিয়ে রেখেছে। আমাদের দেখে বললো, "বাবু, ঠান্ডা হয়ে এলো। খেয়ে নিন।"

চা-পকোড়া খাওয়ার পর আমরা কাগজ পেন নিয়ে বসলাম। আজ ইলেকট্রিক আছে। ঝা-জীর দেওয়া কাগজগুলো বের করে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছিলো। অনুব্রত, আমি, বিকাশ আর সঞ্জয় বসে সেগুলো শর্টিং করে নিলাম। কোনটা বেশি দরকারি সেই হিসাবে। তারপরে সেগুলো ফ্যাক্স করে কলকাতার অফিসে পাঠানোর পরে আমরা একটা হিসাব লিখতে শুরু করলাম --

কতটা জায়গা জুড়ে গাছ আছে, বছরে কত আয় হয়, নতুন গাছ কতটা জায়গা জুড়ে লাগানো হবে, তার কস্টিং, শ্রমিকদের পাওনা-গণ্ডা কতটা বাকি আছে, অন্য আউটস্ট্যান্ডিং ডিউজ কত আছে, কোথায় কত টাকা ইনভেস্ট করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদির একটা রাফ এস্টিমেট বানিয়ে ফেললাম। ফোনে বসের সাথে কথা বলার পরে সেটাও ফ্যাক্স করা হলো।

আমাদের আজ মাথা থেকে বোঝা অনেকটাই নেমে গেছে, তাই সবাই মিলে বেশ খোশগল্প করছিলাম। হরেন আর এক রাউন্ড চা দিতে এসে বলে গেলো, আজ রাতের মেনুতে খিচুড়ি আর ডিমভাজা। সবাই মিলে হৈ হৈ করে আনন্দ প্রকাশ করলাম। রাত্রে আজ আর কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু দূর থেকে হায়না বা বাঘের ডাক-- কিছু একটার শব্দ শুনেছিলাম গভীর রাতে।


(৫)

রোজই সকাল-সন্ধ্যায় দু'বার করে বাড়িতে মেয়েকে আর বৌকে ফোন করি। আজও সকালে সেলফোনটা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। মেয়েটা ছোট্ট, সাত বছরের। রোজ জিজ্ঞাসা করে, "বাবা, তুমি কবে বাড়ি আসবে?"

--কাজ শেষ হলেই আসবো মা।

--কাজ শেষ হতে আর কত দেরি?

--আর কয়েকদিন লাগবে মা।

অনুব্রত খবরের কাগজ পড়ছিলো, বোধহয় গতকালের। রোজ এখানে কাগজ পৌঁছায় না। হঠাৎ কোথাও কান্নার আওয়াজ আর হৈ চৈ শুনতে পেলাম। তবে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিলো। হরেন বাজার থেকে ফিরে বললো, গতকাল রাতে কুলি-বস্তির কাছে একটা ছেলেকে বাঘে মেরে টেনে নিয়ে গেছে জঙ্গলে। এখানে বহুকাল নাকি বাঘের উপদ্রব ছিল না। হঠাৎ বাঘের আবির্ভাব হওয়াতে সবাই আতঙ্কিত। খবর গেছে লোকাল থানাতে এবং ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেও।

কিছুক্ষন বাদে ঝা-জীর ফোন এলো। উনিও খবর পেয়েছেন। আমাদের সাবধান করলেন এবং বললেন, "বাইরে বেরোতে হলে আমার জীপ ছাড়া একদম হেঁটে বেরোবেন না! সন্ধে থেকে ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ রাখবেন।"

আজকে খবর পেলাম আগামী পরশু আমাদের ফাইনাল ডিল হবে। বস আগামীকাল ফ্লাইটে আসছেন। আমাদের আজ নতুন করে কিছু করার ছিল না। মোটামুটি কাগজপত্র, হিসাবপত্র - সবই কলকাতার অফিসে পাঠানো হয়ে গেছে। এটর্নি অফিস থেকে আগামীকাল পারচেজ ডিডের কপি পাঠাবে এবং ডিম্যান্ড ড্রাফট বানানো হবে।

দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে আমরা বাইরের বারান্দায় বসে নরম রোদের ওম নিচ্ছিলাম। অনুব্রত একটা স্টীল ক্যামেরায় ছবি তুলছিলো। ওর ফটো তোলার নেশা আছে। হঠাৎ আমাদের বাংলোর বাগানের বাইরে একটা জীপগাড়ি এসে থামলো। তাতে চারজন নেপালী লোক ছিল আর একজন ড্রাইভার। দু'জন লোক লাফ দিয়ে নেমে উঠে এলো বারান্দার উপরে।

--আপলোগ ইয়ে গার্ডেন পারচেজ কর রহে?

--হ্যাঁ।

--মত করিয়ে। ইহা পে বহত খতরা হ্যায়! জান চলা য্যায়গা! ভাগ যাইয়ে ইহা সে!

--তুমলোগ কৌন হো?

--যো ভি হুঁ। আপলোগ যাইয়ে ইহা সে। নেহি তো মুসিবত মে ফাঁস যাওগে!

বলেই লোকগুলো আর দাঁড়ালো না। যেমন আচমকা এসেছিলো, তেমনি গাড়িতে চেপে চলে গেলো!

এটা সাবধানবাণী না হুমকি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবাই বেশ চিন্তিত হয়েই পড়েছিলাম। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে গিয়ে দেখলাম হরদেব আমাদের মধ্যে নেই। সে কোথায় গেলো খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সেই কুলিবস্তির মেয়েটার সাথে কি যেন কথা বলছে বাংলো থেকে একটু দূরে গিয়ে। আমি চেঁচিয়ে ওর নাম ধরে ডাকতেই ও ফিরে এলো।

--ওকে কি বলছিলে?

--ও হামাকে জিজ্ঞাসা করছিলো হামলোগ দারু পিই কি না। হামি না বোলাতে উস্কো দুখ পঁহুচা। বোলা, ও দারু বানাতে হ্যায়, ঘর মে। আর উস জীপ মে যো লোগ আইথা, উন লোগকো উও জান্তা হ্যায় - এক পার্টি লীডার কা লেড়কা ওর উস্কা দোস্তলোগ।

বিকেলে সূর্যের আলোর তেজ আরো কমে এলো। এখন পাহাড়ের রং ঘন ঘন বদলাচ্ছে। পাহাড়টাকে এখন শুধু আর নীল নয়, বেগুনী লাগছে। সূর্যের আলো পড়ে মাথাটা উজ্জ্বল সোনালী, পিছনের আকাশটা কমলা হয়ে গেছে! অনুব্রত ছবি তুলেই চলেছে। তবে ওরা হুমকি দিয়ে যাওয়ায় আগের থেকে উৎসাহ কম। আমরা কলকাতার অফিসে ফোন করে ব্যাপারটা জানাবো কি না ভাবছিলাম। আজ রবিবার। অফিস ছুটি। সরাসরি বসকে ফোন করার আগে নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করে নিচ্ছিলাম, কিভাবে বলবো ব্যাপারটা। ঠিক সেই সময়েই তিনজন পাজামা-পাঞ্জাবী পরা লোককে আমাদের বাংলোর দিকেই আসতে দেখা গেলো।

আমরা আলোচনা থামিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বাগানের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে হাতজোড় করে নমস্কার জানালো। আমরাও প্রত্যুত্তরে হাতজোড় করলাম। একজন জানালো, সে এই চা-বাগানের একটি শ্রমিক সংগঠনের সেক্রেটারী। ওদের সংগঠন চায় আমরা চা-বাগানটা কিনে নিয়ে আবার কাজ শুরু করি। কিন্তু তার আগে, শ্রমিকদের যে পুরোনো পাওনা-গণ্ডা বহুদিন ধরে বাকি পড়ে আছে, সেগুলো মিটিয়ে দিয়ে তবেই আমরা গার্ডেন পারচেজ করি। আমরা ওদের আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, আমাদের কোম্পানি সেই চেষ্টাই করছে।

হরেনকে ওদের চা-বিসকুট দিতে বলা হলো। আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম এই চা-বাগানের পরিস্থিতি সম্পর্কে। ওরা যা বললো, তা হলো, আগে এই চা বাগানে উৎপাদন ভালোই হতো। শ্রমিকরা বেতন কম পেলেও তারা সময় মতো বেতন পেত। ২০০৭ সালে একটা নতুন সংগঠন গজিয়ে ওঠে এবং তারা শুধু এই চা-বাগান থেকে নিজেদের ফায়দা তোলার চেষ্টা করে, ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে বটলিফ কারখানাগুলোকে চা বেচে দিতো, বাধা দিতে গেলে গাছ নষ্ট করে দিতো, শ্রমিকদের মারধরও করতো। শ্রমিকরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে ওদের লিডার খুন করার হুমকি দিতো। কোম্পানি একজন নতুন ম্যানেজারবাবুকে কলকাতা থেকে নিয়োগ করে পাঠিয়ে দেয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য - কিন্তু তাকে ওরা টিকতে দিলো না। সাতদিনের মধ্যেই তাকে খুন হতে হয় এই বাংলোতেই! রাতের অন্ধকারে তাকে ওরা কুপিয়ে মারে। কিন্তু সবাই জানতো, ম্যানেজারবাবুকে বাঘে খেয়েছে! জঙ্গলের ধারে তার দেহটা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছিলো। শুনে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো!

ওরা চা খেয়ে চলে গেলো। আমরা বারান্দা থেকে বসার ঘরে চলে এলাম। ঝা-জীর নির্দেশ মতো দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। সেলফোনে কথা বললাম আমাদের বসের সাথে। উনি আমাদের চিন্তা করতে বারণ করলেন এবং বললেন, লোকাল থানাকে উনি ইনফর্ম করে দেবেন যাতে আমাদের সমস্যায় পড়তে না হয়। সে রাতটা আমাদের নির্বিঘ্নেই কাটলো।


(৬)

ভোরবেলায় উঠে দেখলাম ঝকঝকে রোদ! ঠান্ডাটা যেন আরো জাঁকিয়ে পড়েছে। সোয়েটারের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে চা খেতে খেতে দেখছিলাম একজন মালি বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা করছে। দূরের পাহাড়টা ঘন নীল, তাতে সবুজের আঁকিবুকি, আর একেবারে চূড়াটা সাদা বরফে ঢাকা, রোদ পড়ে ঝলসাচ্ছে! আজ হরেন আমাদের দেখালো এখন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বেশ ভালোই দেখা যায়। নীল আকাশের গায়ে জেগে উঠেছে তার চূড়াগুলো, কে যে সেগুলোয় সোনালী মুকুট পরিয়ে দিয়েছে!

আজ বস আসবেন। তাই আমাদেরও ব্যস্ততার শেষ নেই। আমরা ওঁকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যাবো, তারপর ফিরে এসে ঝা-জীর বাংলোয় যাবো। সকাল সকাল জলখাবারে লুচি-আলুর তরকারি খেয়ে নিয়ে স্নান সেরে রেডি হয়ে আমাদের অফিসের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দু'ঘন্টা লাগলো বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছতে। ১টা ১০-এ ফ্লাইট ল্যান্ড করলো। আমরা ওখান থেকে সোজা ঝা-জীর বাংলোয় গেলাম। গাড়িতেই অনেক দরকারি আলোচনা হয়ে গেলো। ঝা-জী আমাদের সবার জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আজ আর মেড নয়, কোনো শেফ দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করানো হয়েছিল। আমরা লাঞ্চ ভীষণ তৃপ্তি সহকারে খেলাম। রাত্রে ওঁর বাংলোতেই আমাদের বসের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমরা ম্যানেজার বাংলোয় ফিরে এলাম।

তখন রাট ন'টা, সাড়ে ন'টা হবে বোধহয়। আমরা খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। দরজায় কে যেন ধাক্কা দিলো! একটু ভয় পেয়ে বললাম, "কে?" কোনো উত্তর এলো না। আবার ধাক্কা! আমরা এবারে চেঁচিয়ে উঠলাম, "কে? কে?" করে। সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছি। সঞ্জয় এই শীতেও রীতিমতো ঘামছে! এবারে কারা যেন বললো,

--দরওয়াজা খোল, নেহি তো তোড় দেগা!

--কি চাও?

--তেরা লাশ!

--কে তোমরা?

--কেঁউ ইহাঁসে গ্যায়া নেহি?

সেগুন কাঠের মজবুত দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ভাঙতে সময় লাগবে। আমার হাত অটোমেটিক সেলফোনে চলে গেছে। ঝা-জীর মোবাইল সুইচ অফ। কালবিলম্ব না করে সোজা লোকাল থানায় কল করেছি। আমাদের অবস্থান আর আসার কারণ সংক্ষেপে জানিয়েছি। বস সত্যিই জানিয়ে রেখেছিলেন। পুলিশ আস্তে পাঁচ মিনিটও সময় নেয়নি। তারা মোবাইল ভ্যানে কাছাকাছি কোথাও ডিউটিতে ছিল। হয়তো বিপদ হতে পারে জেনেই। পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে দুষ্কৃতিরা পালিয়ে গেছে!


(৭)

পরদিন আমাদের দু'পক্ষের এটর্নির উপস্থিতিতে ডিল ফাইনাল হয়ে গেলো। বিক্রেতা কোম্পানির তরফেও মালিক পক্ষের দু'চারজন উপস্থিত ছিলেন। শ্রমিক সংগঠনের লিডার ও তার দলবল, যারা আমাদের ভয় দেখিয়ে গিয়েছিলো, তারা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল অনেক। আমাদের তরফেও বাড়তি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই বিশেষ কোনো সমস্যা হয়নি। টাকা-পয়সার লেনদেন ও সইসাবুদের পর দিনের আলো থাকতে থাকতে আমরা সোজা বাগডোগরার পথ ধরলাম। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম। এবারে সোজা বাড়ি যাবো! ওহ, কি আনন্দ যে হচ্ছিলো! মনে হচ্ছিলো, আমি আজ মুক্ত! মেয়ের ফোন এলো, "বাবা, তুমি কত দূরে?"

--এই তো মা, আমি আর কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছবো!

--মা আজ রাতে মাংস রান্না করবে বলেছে!

--তাই? খুব ভালো হবে তাহলে!

--আমার জন্য আইসক্রিম আনবে তো?

--হ্যাঁ মা, আইসক্রিম-চকোলেট - সব আনবো!

ট্যাক্সি চলে এসেছে ডানলপে, আজ রাস্তা জ্যাম মুক্ত! এক্ষুনি বাড়ি পৌঁছবো। মনে হচ্ছে, কত যুগ পরে বাড়ি ফিরছি! ওদিক থেকে অনুব্রত আর সঞ্জয় ফোন করলো - ওরাও বাড়ি পৌঁছে গেছে। শুধু বিকাশ এখনো রাস্তায়। বসকে একটু তেল দিয়ে চলা অভ্যেস তো! তাই সে কিছুক্ষন বসের সাথে সময় কাটিয়ে বাড়ি যাবে আর যথাসম্ভব নিজের ক্রেডিট বর্ণনা করবে!



(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)