যখনই ভদ্রলোককে দেখতাম, পুরনো এক সাইকেল চেপে চলেছেন। দেখা হলেই সাইকেল থেকে নেমে মুখে একগাল হাসি নিয়ে দুটো ভালোমন্দ সুখ-দুঃখের কথা বলে তবে যাবেন। তবে কথার মধ্যে একবার তাঁর বাজনার কথা থাকবেই। এটাই ছিল তাঁর পরিচিত ছবি।
কবে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল, সেকথা আজ খুব কষ্ট করে মনে করতে হবে। আমরা যখন এ-পাড়ায় আসি, অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে কোন এক গানের আসরে, ঘরোয়া কি বাইরের তা আজ আর মনে নেই, হয়ত পরিচয় হয়েছিল। তখন বিভিন্ন গানের আসরে যেতাম। নিজেও গান-বাজনা ভালোবাসি, পাড়াটাকে চিনতে, মানুষজনকে চিনতে এটাও আমার একটা মাধ্যম ছিল। তখনই কোন আসরে হয়তো পরিচয় হয়েছিল। তবে ওনার সঙ্গে আলাপ করতে বেশি বেগ পেতে হত না কাউকেই। সদালাপী উন্মুক্ত মনের মানুষ। উনিও গানবাজনার গন্ধ পেলেই খুঁজে খুঁজে, মৌমাছি যেমন ফুলের কাছে পৌঁছায়, ঠিক সেখানে পৌঁছে যেতেন। কাজেই ওনারও বন্ধুসংখ্যা ছিল অনেক। তবে বেশিরভাগই ওই গানবাজনার লাইনে। এই লাইনের বাইরে যাঁরা ওনার বন্ধু ছিলেন তারা নিছকই মানুষটা ভাল বলে ওনাকে ভালবাসতেন। ওনাকে ভালবাসতে বাসতে কবে যেন ওনার পরিবারেরও বন্ধু হয়ে পড়েছিলাম, সেটাও আমার আজ আর মনে পড়ে না। তার ফল এই দাঁড়িয়েছিল যে আমি বা আমার পরিবারের সঙ্গে ওনাদের পারিবারিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল।
পরিচিত মহলে সবাই ওনাকে ডাকত ভানুদা বলে। আসল নাম যে কি ছিল অনেকেই তা জানত না। এমনকি মঞ্চবাঁধা আসরেও ঘোষণা হত পরবর্তী শিল্পী, 'আমাদের অতি প্রিয় ভানুদা'। উনিও এ নিয়ে কখনো আপত্তি করেন নি, কাজেই কারোর ও ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। আসলে এই 'ভানুদা' নামটাই হয়ে গিয়ে ছিল ওনার ব্র্যান্ড নেম। ওহো, বলতেই ভুলে গেছি, হ্যাঁ, শিল্পীই তো। ভানুদা ছিলেন এ অঞ্চলের বিখ্যাত গীটার শিল্পী — হাওয়াইয়ান গীটার। তখনকার অনেক নামী গুরুর ছাত্র ছিলেন, যখন বটুক নন্দী, কাজী অনিরুদ্ধ-রা মধ্য গগনে। তবে গুরুর নাম জিজ্ঞাসা করলে চট করে বলতেন না। কানে হাত ঠেকাতেন আর নমস্কার করে বলতেন আমি তো অযোগ্য ছাত্র, ওনাদের কাছে কিছুই শিখতে পারিনি। কাজেই আমার অযোগ্যতা দিয়ে গুরুর বদনাম করতে চাই না। আবার এটাও ঠিক, নাম পাবার জন্য যে সমস্ত অযোগ্য শিল্পীরা গুরুর নামে প্রসিদ্ধি চায় আমি তাদের দলেও নেই। কাজেই আমার অযোগ্যতা আমারই থাক, এতেই যদি লোকের ভাল লাগে তো সেটাই আমার গুরুপ্রণামী। এমনই বিনয়ী আর নিরহংকারী ছিলেন ভানুদা। অথচ লোকে বলত, ভানুদার গীটার কথা বলে। সত্যিই তাই। কোনো আসরে নির্দিষ্ট সংখ্যক গান বাজিয়ে চলে এসেছেন এটা দেখিনি কখনো। শ্রোতাদের অনুরোধে বাড়তি সময়ে বাড়তি গান শ্রোতাদের শোনাতেই হত। শেষে কর্মকর্তাদের এসে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে হত, এবার দয়া করে ওনাকে ছেড়ে দিন, পরবর্তী অন্যান্য শিল্পীরা অপেক্ষা করছেন। এরপর অন্য আসরে উনি নিশ্চয় আপনাদের দাবী মেটাবেন। ভানুদাও লজ্জিত মুখে শ্রোতাদের হাতজোড় করে নমস্কার করে আসর থেকে বিদায় নিতেন।
ভানুদা মাঝেমাঝেই আমাদের বাড়ি চলে আসতেন। আমার স্ত্রীর সাথে ছিল ওনার ভাই-বোনের সম্পর্ক। বাজার থেকে ফেরার পথে বা কোন টিউশনি যাওয়া বা আসার পথে ঢুকে পড়তেন আমাদের বাড়ি, "বুলবুল আছ নাকি? চা খেতে এলাম।" কোন সময় অসময়ের ধার ধারতেন না। মনে হয়েছে, চলে এলেন, ব্যস। নানা কথা — তবে তার মধ্যে নিজের সংসারের কথা বেশি না, থাকত কোন ছাত্র বা ছাত্রীর কথা, কোন আসরের কথা এইসব। সবচেয়ে আনন্দ করে বলতেন কোন ছাত্র বা ছাত্রীর যদি কোন ভাল খবর থাকতো। তা সে একটা আসরে বাজিয়েছে বা পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে কি সে চাকরি পেয়েছে ইত্যাদি যাই হোক না কেন। একবার একটি ঘটনা ঘটেছিল। একটি আসরে ভানুদার এক ছাত্রীর বাজানোর কথা ছিল। উনি কয়েক দিন আগে এসে খবর দিলেন, আমার ছাত্রী বাজাবে, অবশ্য যেয়ো। সেদিন আমার একটা বিশেষ কাজ ছিল। তবু যেহেতু ভানুদা অত করে অনুরোধ করেছেন, একটু তাড়াতাড়ি করেই গেলাম। কি জানি ছাত্রীর অনুষ্ঠান আগে দেবে নাকি পরে। যাক অনুষ্ঠান তো হল। কথায় কথায় মেয়েটি তার গুরুর কথা বলল। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে ভাল করে শুনলাম, ভানুদার নাম এক বারও বলল না। সে অন্য এক নামী গুরুর কথা বলল। আমি পরে ভানুদাকে বললাম, আপনার ছাত্রী তো আপনার নাম বলল না। সে তো অন্য একজনের নাম বলল। ভানুদা একটু লজ্জিত মুখে বললেন, আমি তো আগে ওকে শেখাতাম। এখন ও বড় গুরুর কাছে শিখছে তো তাই আমার নামটা আর করেনি। সত্যি কথা কি, আমি আর একটা কথা আর ওনাকে বললাম না। হলে সেদিন ওনার পাশ দিয়ে যাবার সময় ছাত্রীটি ওনাকে চিনতেও পারেনি। এটা যে আমি লক্ষ্য করেছি, তা আর ওনাকে বললাম না। এমনি ছিল তাঁর স্বভাব। ছাত্রী তাঁকে চিনতে পারুক আর নাই পারুক, ওনার ছাত্রী এতেই তাঁর আনন্দ। সম্প্রতি উনি বেশ কিছুদিন বলছিলেন, সুরটা আরো একটু ভাল করে ধরতে হবে। বেশ গভীর ভাবে শুনছিলেন আসল গান, গানের সুর আর ধ্রুপদী সঙ্গীত। এতেই ডুবে থাকত তাঁর মনপ্রাণ।
আমাকে একদিন বললেন, ধীরে ধীরে হাতটা পড়ে আসছে তো একটু সিডি করে রাখলে হত। আমি তো জানি না, কোথায় কিভাবে সিডি করতে হয় । এখানে ওখানে অনেককে বললাম। কিন্তু কেউ ঠিক করে বলতে পারল না কিভাবে করা যাবে। দু-একজন সন্ধান দিয়েছিল, বেশ বড় বড় কয়েকটা কোম্পানির। তা সেখানে করানোর মত অত খরচা করার সাধ্য ভানুদার ছিল না। কী আর করি, আমি বললাম, এক কাজ করা যাক, আমি ঘরে কম্পিউটারে রেকর্ড করে সিডি বানিয়ে দিচ্ছি। তাতে কোয়ালিটি খুব ভালো হবে না। তবে ঐ আর কি মোটামুটি হবে। উনি তাতেই খুশী।
বললেন তা হোক, কিছু না হওয়ার থেকে তো কিছু হওয়া ভাল। তাই ব্যবস্থা হল। নির্দিষ্ট দিনে ভানুদা গীটার এনে ঠিক সময়ে হাজির। আমিও আমার পরিচিত একজন তবলচীকে বলে রেখেছিলাম। আমার ঘরে দরজা বন্ধ করে যতটা সম্ভব সাউন্ডপ্রুফ করে রেকর্ড করলাম। হয়ে যেতে ভানুদা কী খুশী। সেদিন যে পরিতৃপ্তির উজ্জ্বল আলো দেখেছিলাম ভানুদার মুখে সে আমি কোনদিন ভুলব না। এর পর যখন সিডিটা করে দিলাম আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওনার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। উনি বললেন, আমার শেখা আমার কাজ আমার ভালবাসা তবু একটা জায়গায় পাকাপাকি রইল। কোন দিন কোন বড় জায়গায় স্বীকৃতি না পাওয়ায়, আগামী দিনে হারিয়ে যাওয়ার যে কষ্ট ভানুদা মনের মধ্যে এতদিন পুষে রেখেছিলেন তা যেন তাঁর চোখের জলের সাথে বরফের মত গলে গলে বেরোতে লাগল। তারপর থেকে উনি যত চেনা জানা মানুষ ছিল, সবাইকে আমার এই রেকর্ড করার কথা বলতেন আর তাদের সেই সিডি নিয়ে বাজিয়ে শোনাতেন। আমার খুব খারাপ লাগত। এমন কিছু কাজ তো করিনি, এমন কিছু ভালো মানেরও হয় নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না। তবু সেই নিয়ে ওনার গর্ব ছিল চোখে পড়ার মত।
সম্প্রতি অনেকদিন আর ভানুদার কোন অনুষ্ঠান চোখে পড়ে নি। আসলে কি হয়েছে, কেন জানি না এই হাওয়াইয়ান গীটারর প্রচলনটা কেমন যেন আজকাল খুব কমে গিয়েছে। আগে, সহজে কি শেখা যায়, বলতেই বাবা-মায়েরা মেয়েদের অন্ততঃ বিয়ের কারণেও, যার গলায় গান নেই তাকে গীটার শেখাতেন। মেয়েরাও দু চারটি গান তুলে নিত, একটু কষ্ট করে, বিয়ের পরীক্ষায় পাশ করার জন্য। তখন মাঝে মাঝেই দেখতাম রাস্তায় ছেলে মেয়েরা সব কাঁধে গীটার নিয়ে চলেছে। আর জানতাম ওদের এই চলার পথ ভানুদার দরজায় গিয়েই শেষ হবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই যন্ত্রটা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনলাম সম্মানীয়া শ্রীমতী কল্যাণী কাজীও এই ব্যাপারে দুঃখ করছিলেন যে, এত সুন্দর একটা বাদ্যযন্ত্র চোখের সামনে কেমন হারিয়ে যাচ্ছে — এটা নিয়ে সবাই যদি একটু ভাবনা-চিন্তা করেন। কিন্তু আমার মনে হয় যুগের হুজুগে বহু পুরনো জিনিসই কেমন যেন হারিয়ে যায়! তার আর কোন কারণও জানা যায় না, কিছু করার ও থাকে না। এই ডিটিপি প্রযুক্তি আসার ফলে কত আর্টিস্ট বেকার হয়ে পড়ল। নতুন যুগ আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুন যুগের ছেলেমেয়ে, তাদের চাহিদা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন রুচির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে কত পুরনো জিনিসই যে হারিয়ে যাচ্ছে কে তার খেয়াল রাখে? আমাদের পুরনো দিনের রেডিও, কলের গান, গল্প-কবিতা, যন্ত্রপাতি, বাজনা, সব এক এক করে কখন যে যাদুঘরের সামগ্রীতে পরিণত হচ্ছে কারোর খেয়ালই থাকছে না। ভানুদার সেই ছাত্রের রমরমা দিন দিন যেন কমে আসছিল। ইদানিং তাঁকে একটু চিন্তান্বিত দেখতাম। একদিন আমাকে দুঃখ করে বলছিলেন, কী করা যায় বল তো? আমি বললাম, বোঝালাম ব্যাপারটা, যে এক কাজ করুন, আমি একজন নামী স্প্যানিশ গীটারিস্টের কথা জানি। ওনার সাথে আমার জানাশোনা আছে। আপনি ওনার কাছে চলে যান। আমি বলে দেব। তাড়াতাড়ি স্প্যানিশটা শিখে নিয়ে আপনি ছাত্রদের স্প্যানিশও শেখান। আজকাল ও বস্তুটার খুব চাহিদা — দেখবেন জমে যাবে। উনি চুপ করে সব শুনলেন, বুঝলেন বলে মনে হল। পরে একদিন আমাকে বললেন, তুমি যে স্প্যানিশ মাষ্টারের কথা বলেছিলে, তার ঠিকানাটা দাও তো। তবে আমি যে ওখানে যাই এটা কাউকে বোলো না। আমি বললাম, না না বলব কেন? বুঝলাম, এই বয়সে যে শিখতে যাচ্ছেন উনি সেটা ছাত্রদের কাছে গোপন করতে চাইছেন।
তারপর কিছুদিন বাদে উনি বললেন, জান তো এখন আমি স্প্যানিশও শেখাচ্ছি। আমি বললাম, ভালই। হতেই পারে, তৈরি কান, অন্য ছাত্ররা যেটা দশদিনে শিখবে সেটা উনি একদিনে শিখতেই পারেন। তারপরে শেখানো কিছু কঠিন নয়। কদিন তারপর আর দেখা হয় নি। আমি দু-একজন ছাত্রকে ওনার কাছে পাঠালাম। তার বেশ কিছুদিন পর, তা প্রায় বছর খানেক হবে একদিন দেখা হতে বললেন, জান তো এখন আর স্প্যানিশ শেখাচ্ছিও না, নিজেও আর শিখছি না। জিজ্জাসা করলাম, কেন? উনি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, সারাটা জীবন সৎ ভাবে থেকে জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে আর পেটের দায়ে ছাত্র ঠকাতে ভাল লাগল না, মনটাও সায় দিল না।
বললাম, কেন? কি ব্যাপার?
—আসলে কি জান তো, শিখতে গেলাম। মাষ্টার মশায় আমার থেকে বয়সে বেশ ছোট, তা হোক জ্ঞান আছে, হাতও ভাল, ব্যবহারও ভালই।
— তবে?
— ওসব সুর তাল নিয়ে তো আমার অসুবিধা নেই সে তো তুমিও জান। আসল ব্যাপার হল দুটো। প্রথমতঃ এতদিনের হাওয়াইয়ানের হাত তো--স্প্যানিশে বসতে বেশ কষ্ট। অসুবিধা হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ স্প্যানিশ যে ধরনের গানের সাথে বাজে মনটাকে সেই জায়গায় নিতে পারছিলাম না। আর তার চেয়েও বড় কথা কী হল জান, আমার মনের যিনি দেবতা তিনি যেন অসন্তুষ্ট। বার বার মনের কাছ থেকে বাধা পাচ্ছি। এতদিন যে দেবীর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছি আজ অন্য বাজনার সাধনা করাকে মনে হল তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা করা। এটা আমার কাছে দ্বিচারিতা। এটা আমি পারলাম না ভাই, আর যেটা আমি শিখলামই না মিথ্যে বলে পেটের জন্য সেটা শেখাই বলে ছাত্র ঠকাতে আমি পারব না।
বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন।
আমি ভানুদার আর এক মনের রূপ দেখলাম। মানুষটাকে নতুন করে চিনলাম। একজন প্রকৃত শিল্পী, প্রকৃত সাধক, এবং প্রকৃত শিক্ষকের স্বরূপ আমার চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল।
আমাদের বাড়ীতে ভানুদা তো মাঝে মাঝেই আসতেন, আমাদেরও ভীষণ ভাল লাগত ওনার এই আসা। কখন যেন নিজেদের লোক হয়ে গিয়েছিলেন। একবার হয়েছে কি, আমার ছেলে মাধ্যমিক পাসের পর ঝোঁক ধরল, একটা বাজনা শিখবে। আমি বললাম, চিন্তা কী? গীটার শেখ, বাড়িতেই তো মাস্টারমশাই রয়েছেন। ভানুদাকেও বললাম। শুনে ছাত্র আর মাস্টার দুজনেই ভীষণ খুশী। ঠিক হল, পরদিনই গীটার কেনা হবে। ভানুদা পরদিন সকালেই হাজির খুব খুশী মনে। আমার ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই খুব ভালবাসতেন। এখন ছাত্ররূপে পেয়ে আরো খুশী। আমি বললাম, আমি আর যাচ্ছি না, আমি কিছু যন্ত্রের ভালমন্দ বুঝবো না। আপনি আপনার ছাত্রকেই নিয়ে যান। আমি টাকা দিয়ে দিলাম আর বলে দিলাম, যা কিনবেন খুব খেলো না হয়, একটু ভাল জিনিসই কিনবেন। দুজনে কিনতে বেরোল, খুব খুশী মনে। ফিরল সন্ধ্যাবেলায়। হাতে দেখি ভাল একটা খাপ সমেত নতুন গীটার। আমি বলি, এত দেরী কেন। ছেলে তো উচ্ছ্বসিত হয়ে কত কথা বলতে লাগল, জেঠু এখানে নিয়ে গেছে, ওখানে নিয়ে গেছে, এটা সেটা খাইয়েছে, এইসব। ভানুদা দেখি মুচকি হেসে বলছেন, গীটার পছন্দ করে মিস্ত্রীকে ওটা একটু ঠিক করতে বলে, সময় লাগবে তো, তাই বললাম, চল একটু ঘুরিয়ে আনি। তাই কলকাতায় দু একটা জায়গা ঘুরিয়ে আনলাম, আমিও এই সুযোগে একটু ছেলেবেলার মত ঘুরে নিলাম। এই আর কি।
সঙ্গে শিশুর মত সরল একটু হাসি।
আমি আর কিছু বললাম না। বুঝলাম ব্যাপারটা।
পরদিন থেকে শুরু হল ক্লাশ। মাস্টার আর ছাত্র দুজনেই সমান আগ্রহে শেখার ব্যাপারে এগোতে লাগল। ওনার নিজের তো কোন ছেলে ছিল না। একটি মাত্র মেয়ে। তাই আমার ছেলেকেই সমস্ত পুত্রস্নেহ উজাড় করে দিয়ে শিক্ষা চলতে লাগল। মাস্টারমশাই তো মাঝে মাঝেই ছাত্রের প্রশংসা করেন। আমি আর কিছু বলি না। বুঝি, এটা সত্যি যত না, ওনার স্নেহের আতিশয্যের কথা তার একটু বেশী। ভালই চলছিল। গোল বাধল উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর। ছেলে খুব ভাল একটা কলেজে দূরে পড়তে যাবে। তাহলে আর তো শেখা যাবে না ভানুদার কাছে। এই নিয়ে আমাদের সবারই মন খুব খারাপ। ভানুদার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল বেশ বুঝতেই পারলাম। প্রথমতঃ প্রিয় ছাত্রকে ছেড়ে দিতে হবে তার জন্য খারাপ লাগা, অথচ তার এই এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ, সেটাও আছে। আর একটা ব্যাপার আছে, যেটা আমি মুখে না বললেও বুঝেছিলাম, কিছু আর্থিক ক্ষতিও তো বটেই— একটা টিউশনি চলে যাওয়া তখন ওনার কাছে অনেক ক্ষতি। তখন উনি বেশ অর্থকষ্টে আছেন তো। এটা শুধু মনে মনে থাকল। কেউ আর কোন কথা বলি নি। আসলে তখন ওনার ছাত্র সংখ্যা খুব কম, আর এছাড়া তো ওনার অন্য কোন উপার্জন ছিল না, বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু হাতে কিছু করার ছিল না। এরপর ভানুদারও আমাদের বাড়ি রোজ নিয়মিত আসা বন্ধ হয়ে গেল, মাঝে মাঝে আসতেন। রোজ আসার যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমাদেরও খুব খারাপ লাগত। পরে বুঝেছিলাম এটা ছাত্রের ছোট্ট মনের কোণেও কোথাও দাগ কেটে ছিল। পরের মাসে ছেলে বলে পাঠাল, বাবা তুমি জেঠুর মাসের টাকা বন্ধ করো না। প্রতিমাসে যেমন দিচ্ছিলে, দিয়ে যাবে। ছাত্র আর মাস্টারমশাইএর মনের মাঝে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া চলছিল তার ফলাফলটাই শুধু বুঝলাম। ভানুদার বাড়ি গিয়ে টাকা দিতে গেলাম। উনি তো লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে সাতহাত পিছিয়ে গেলেন, ওমা সেকি কথা! আমি তো আর শেখাই না, টাকা দেবে কেন? ওঁর আত্মাভিমানে আঘাত লাগল। আমি তখন বললাম, আমি কিছু জানি না। আপনার ছাত্রের আদেশ। উনি চুপ করে গেলেন। চোখে জল এসে গেল ওনার, স্থাণুর মত নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি টাকা দিয়ে চলে এলাম। তারপর থেকে প্রতিমাসেই আমি আগে যেমন দিতাম তেমনই দিয়ে যেতে থাকলাম। আমি বুঝলাম উনি আমার ছেলের শিশুমনে আঘাত দিতে চাননি। নিজের অভিমানকে স্নেহের কাছে শ্রদ্ধার কাছে নতি স্বীকার করালেন।
সম্প্রতি বেশ কিছুদিন ওনার আর কোন অনুষ্ঠান হচ্ছিল না। আসলে গীটারের চল কমার জন্যেই হোক আর ওনার বয়স বাড়ার জন্যেই হোক একমাত্র বিনাপয়সায় কোন অনুষ্ঠান হলে আয়োজকরা ডাকতেন, অর্থাৎ ওঁরাও ভানুদার এই অবস্থার সুযোগ নিতেন। আর ভানুদাও কিছু পয়সাকড়ি চাইতেন না। বাজাতে পেলেই খুশী। উনি আসলে ওনার অস্তিত্বটা হারানোর ভয় পাচ্ছিলেন। তাই সবার সামনে সব সময় থাকতে চাইছিলেন। আর মনের কোণে জীবনে নামী কেউ বড় না হওয়ার দুঃখটা পুষেই রাখতেন, কোন অসতর্ক মুহূর্তে হয়ত বেরিয়ে আসত। তাই খুব বেশী করে বাজাচ্ছিলেন কোন ঠাকুর মন্দিরে বা ওই ধরনের মন্দিরের সামনে কোন ভক্তিগীতির অনুষ্ঠানে। বুঝতে পারি এর পিছনের মানসিকতা। হারিয়ে যাওয়ার, ফুরিয়ে যাওয়ার আগে একজন শিল্পীর শেষের দিকের অন্তর উজাড় করার আকুতি। কেউ না শুনুক দেবতা তো শুনবেন, এই মানসিকতা থেকেই প্রায় রোজই কোথাও না কোথাও বাজাতে যেতেন। সংসার যে তখন কিভাবে চলছে তা আমিই জানি। দুটি চারটি ছাত্র-ছাত্রী আর এপাশ ওপাশ থেকে কিছু ভালোবাসার সাহায্য, এই দিয়েই কোনমতে চলে। অর্থকরী আর কিছু তো শেখেননি, মেয়েটিও বিরাট কিছু করে না। তবু অযাচিত ভাবে কারোর কাছে হাত পাততে কখনও পারতেন না। আমাকে প্রায়ই বলতেন আজকে যেও, অমুক জায়গায় আমার বাজানো আছে; যেতাম আমিও কখনও কখনও। সব সময় তো আর সুবিধা করতে পারতাম না। ওনার কিন্তু বাজানোর নিষ্ঠা কখনোই কম দেখতাম না।
সেদিন এক জায়গায় গিয়ে ছিলাম। বাড়ি ফিরছি, তখনও বাড়িতে ঢুকিনি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
— হ্যালো দাদা, বৌদি বলছি।
কান্নায় ভেঙেপড়া স্বরে ওপাশ থেকে আওয়াজ এল।
— হ্যাঁ বলুন, কি ব্যাপার?-- উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করি।
—শীঘ্র আসুন, আপনার দাদা কেমন করছেন।
সব ফেলে তাড়াতাড়ি দৌড়াই। ওনাদের তো আর ভরসার মত ছেলে কেউ নেই। আমার ওপরই একটু ভরসা করেন ওঁরা। গিয়ে দেখি চেয়ারে বসে আছেন ভানুদা। কোলে সাধের গীটারটা বাজানোর ভঙ্গীতে। শুধু ঘাড়টা একটু হেলে গেছে আর শ্লথ ভঙ্গীতে এলিয়ে আছেন একটু। বৌদি বলেন, এইমাত্র বাজার থেকে এসে বাজাতে বসেছিল মানুষটা। বলছিল, একটা অনুষ্ঠানে কাল বাজানো আছে। তাই নতুন দু একটা গান প্র্যাকটিস করতে হবে। তাই বাজাচ্ছিল। আমি ঐ গীটারের বারটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি এই অবস্থা।
দেখলাম হাতে গীটারের আংটিগুলো তখনও পরা রয়েছে। চট করে বুকে হাত দিয়ে হৃদপিণ্ডের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলাম। অনভ্যস্ত হাতে নাড়ি বোঝার চেষ্টা করলাম। কিছু ভালো মনে হল না। সঙ্গে সঙ্গে এক জানাশোনা অ্যাম্বুলেন্সকে ডাকলাম। মিনিট পনেরর মধ্যে নিয়ে গেলাম কাছের হাসপাতালে। ওখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ইমারজেন্সীর ডাক্তারবাবুরা বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে মাথা নিচু করলেন। লিখে দিলেন, "ব্রট ডেড"। আমাদের বললেন, ভর্তি করার আর দরকার নেই। উনি এখন অনেক দূর পৌঁছে গেছেন। মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। সত্যি যেন দেখতে পেলাম, ভানুদা হাসতে হাসতে চলেছেন তাঁর প্রিয় গীটারটা নিয়ে তাঁর প্রাণের দেবতার পায়ে সঙ্গীতের অর্ঘ্য দিতে। ফিরে এলাম। আমার চোখের সামনে আর বুকের ভেতরটা যেন অন্ধকার হয়ে এল।
তবে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। এই মৃত্যুই তো ওনার প্রাপ্য ছিল। উনি সারা জীবন সত্যি শিল্পীর মর্যাদা চেয়েছিলেন। আমাদের মত স্বার্থপর মানুষরা ওনাকে না দিতে পেরেছি অর্থ, না যশ-প্রতিষ্ঠা। ওনার কোন নামী-দামী, ধরা-করার মত খুঁটিও ছিল না, যাদের ধরে সহজে উপরে ওঠা যায়। তবু শত অর্থাভাবের মধ্যেও মুখের হাসি, শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ও নিষ্ঠা এবং সততা তাঁকে প্রকৃত শিল্পী করে তুলেছিল। শিল্পের মধ্যে থাকা অবস্থায় মৃত্যু, এতো একজন প্রকৃত শিল্পীর সারা জীবনের স্বপ্ন আর সাধনা। সেই মৃত্যুই ভানুদাকে সাধারণ থেকে অসাধারণত্বের সিংহাসনে বসিয়ে দিল। একই মৃত্যু পেয়েছিলেন অনেক সত্যিকারের বড় শিল্পীরা, যেমন, মহানায়ক উত্তমকুমার, প্রখ্যাত নট দানীবাবু, জাদুকর পি সি সরকার (সিনিয়র) যাঁদের নাটমঞ্চেই জীবনের যবনিকাপতন হয়েছে। মানুষের সমাজে আমরা ভানুদাকে তাঁর স্বীকৃতি দিতে পারিনি। কিন্তু তাঁর শিল্পের দেবী তাঁকে অশ্রদ্ধা করেননি। প্রকৃত শিল্পীর মর্যাদা দিয়ে বড় শিল্পীদের সঙ্গে একাসনে বসিয়েছেন। জীবনে যে সম্মান উনি পাননি, মৃত্যুতে সেই আসন চিরকালের জন্য অক্ষয় হয়ে রইল, যেখান থেকে তাঁকে কেউ কোনদিন আর টেনে নামাতে পারবে না ।
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)