Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে মহুয়া সেন‌ মুখোপাধ্যায়ের
লেখা




ISSN 1563-8685




অপেক্ষা

মঙ্গলবার বিকেল ৪:৩০

কটা ওয়েটিং এরিয়া।

সুদৃশ্য সোফা চেয়ার টেবিল, ম্যাগাজিন হোল্ডার, কোট র‍্যাক-এ সাজানো--তিনদিকে বিশাল ঘরে স্বচ্ছ দেওয়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছে--বিভিন্ন লেভেলের ক্যারাটে ক্লাস চলছে। সাদা, কালো, বাদামি--ছোট বাচ্চা থেকে কিশোর কিশোরীরা ক্লাস করছে। সাউন্ডপ্রুফ ঘরে ওদের সমবেত অঙ্গ সঞ্চালন খুব ভালো লাগে দেখতে; আর দরজা খুলে গেলে ভেসে আসছে সমবেত হুঙ্কার ধ্বনি। অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে আছে মৌসুমী--পাশ থেকে ভেসে এলো

"আপনার পাশের টেবিল থেকে টাইম ম্যাগাজিনটা একটু দেবেন?"

ম্যাগাজিনটা বাড়ানো হাতে দিয়ে ভদ্রলোককে দেখলো ও। অল্পবয়স, স্বচ্ছ নীল চোখ, ব্লন্ড চুল, সুকুমার একটু ছেলেমানুষি মাখানো মুখ--সব মিলিয়ে বেশ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন--

"আমার নাম জেমস আমার দুই ছেলে মেয়ে ট্রেভর আর এমিলি ওই ক্লাসে--আর আপনার বাচ্চা?" ভারী ভালো লাগলো জেমসের হাসিটা। মৌসুমী হাত বাড়িয়ে দিলো--

"আমি মৌসুমী। আমার ছেলে সোহম ওই রুমেই তো।"

"কতদিন শিখছে?"

"প্রায় এক বছর।"

"মাস্টার সিন কিন্তু ভীষণ ভালো ইন্সট্রাক্‌টর।"

"হ্যাঁ সত্যি খুব ভালো--ওই জন্য দিনে দিনে স্টুডেন্ট বেড়েই চলেছে--খুব ডিসিপ্লিনড উনি।" মৌসুমী একমত।

"আমি আসলে অনেক দিন বাদে বাচ্চাদের নিয়ে এলাম--ওদের মা ই আসে ... খুব ভালো লাগছে এসে"--কেমন একটু অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠলো জেমস। তারপরেই একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে--

"আমি না, আসলে প্রায় দেড় মাস হসপিটালে ছিলাম।"

"সে কি? কেন?" মৌসুমী কৌতূহল একদম চাপতে পারল না। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা--তারপর মৌসুমী বলে উঠলো--

"প্লিজ কিছু মনে করবেন না..."

"আরে না না... আমার আসলে খুব খারাপ একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল নভেম্বর মাসে।"

"ওহ...কি ভাবে?"

জেমস বললো সেদিন ওদের বাড়িতে ওর বৌ মারিয়া ছিল না, বাচ্চাদের নিয়ে নিজের মা'র বাড়ি গেছিল। তখন ওর ছোটবেলার বন্ধু আসে তার নতুন কেনা হারলি-ডেভিডসন নিয়ে।

জেমস-এর মোটর সাইকেলের খুব শখ। একটু টেস্ট ড্রাইভ করার ইচ্ছেতে. চেষ্টা করছিল এক্সিলারেটর গিয়ার্ এগুলো বোঝার। নিজের বাড়ির ড্রাইভওয়েতেই। হঠাৎ কি হয়ে গেল, শুধু কন্ট্রোল হারিয়ে যাওয়াটা মনে আছে ... পরে বুঝেছে এক্সিলারেটর আর ব্রেক-এ কিছু গণ্ডগোল করে ফেলে ও। বাড়ির সামনে ইলেকট্রিক পোস্ট-এ ধাক্কা মেরেছিল। হেলমেট ছিল না মাথায়। হেলিকপটার অ্যাম্বুলেন্সে বস্টনের ম্যাস জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়...মারাত্মক স্কাল ফ্র্যাকচার।

"প্রায় দশ দিন কোমাতে ছিলাম। তবে আশ্চর্য কি জানেন জ্ঞান ফেরা পরেও কিন্তু কিছু বঝতে পারিনি। মানে ব্যথা...যেরকম হবার কথা ঐরকম জখমে।"

মৌসুমীর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।

"আমি এখন একশো ভাগ ফিট...অবিশ্বাস্য! তাই না?" জেমস বললো।

জেমস দেখলো মৌসুমী তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওর বাদামি চোখদুটো বিস্ফারিত। মুখটা একটু লাল।

"আরে আমি এখন একদম ঠিক আছি... কোনো চিন্তার কিছু নেই।"

"না - তা নয়"--একটু দম নিলো মৌসুমী। "আসলে ব্যাপারটা এতো অদ্ভুত বা কোইন্সিডেন্টাল..."

"কিরকম?

"আসলে আমারও একটা বড়ো এক্সিডেন্ট হয় অক্টোবর মাসে?"

"রিয়েলি"?

"হ্যাঁ। এই জায়গাটার খুব কাছে। একটা এইট্‌টিন হুইলারের সাথে। ছেলেকে এই কারাটে থেকেই আনতে আসছিলাম আমি।"

"কি বলছেন? অক্টোবর মাসে...ডসন স্ট্রিটে তো? সেদিন তো আমি আনতে এসেছিলাম। আমি দেখেছিলাম...আমি না শুধু--বেশ কয়েক জন পেরেন্টস দেখেছে যারা বাড়ি ফিরছিলো। আমার পেছনে বাচ্চারা...ওহ! কি সাংঘাতিক। গাড়িটার আর কিছু ছিল না। সারা রাস্তা ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে গেছি...গাড়ির মানুষগুলোকে রক্ষা করো। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না--ওই গাড়িতে আপনি ছিলেন!"

"লাকিলি আমি একাই ছিলাম। আর ওই এক্সিডেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছি অক্ষত। মিরাকেল নয়?"

একটা হঠাৎ নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে দুজনের মধ্যে--ঘরের মধ্যে সূর্যের আলো একটা দিক পরিবর্তন করে। কেমন একটা আলোছায়ার খেলা শুরু হয়।

ক্লাস শেষ হয়--পেরেন্টসরা এসে দাঁড়ায়। একে একে আসে--সোহমের বাবা, ট্রেভর-এমিলির মা। বাচ্চারা বেরিয়ে যায়। মৌসুমী, জেমস বসে থাকে।


বৃহস্পতিবার বিকেল ৪:৩০


য়েটিং রুমটার কোণের দিকে আলাদা দুটো চেয়ারে বসে আছে মৌসুমী আর জেমস।

বাইরে ঠাণ্ডার সাথে ঝকঝকে রোদ্দুরের বিকেল ...

প্রত্যেকবার দরজা খোলা বন্ধর সাথে সাথে তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া ভেতরে এসে রাক্ষুসে দাঁত নখ বসিয়ে দিচ্ছে। শরীরের ভেতরের শিরা ধমনীর মধ্যে বয়ে যাওয়া উষ্ণমতাকেও যেন জমিয়ে বরফ করে দিচ্ছে।

"আজ এতো টেম্পারেচার ড্রপ করেছে।....কি ঠাণ্ডা"--মৌসুমী নিস্তব্ধতা ভাঙে।

"তবে খুব রোদ আছে কিন্তু"--জেমস উত্তর দেয়।

ওরা ফিরে আসে...

ওরা অপেক্ষা করে...

শুধু ওরাই জানে না....



(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)