আশ্চর্যময়ী সম্পা. শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১৭; দীপ প্রকাশন - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ২২৪; ISBN: 978-93-86219-15-2
'Representation of the world, like the world itself, is the work of men, they describe it from their own point of view .....' — Simone de Beauvoir, The Second Sex (1949)
প্রখ্যাত ফরাসী তাত্ত্বিক ও দার্শনিক সিমোঁ-দ্য-বোভেয়ার এই একই গ্রন্থে অন্যত্র মন্তব্য করেছিলেন — "কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে (One is not born, but rather becomes a woman)"। পিতৃতন্ত্রের এই এক কৌশল — পরিবার ও সমাজে নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করা হয় জৈবিকভাবে, যাকে তাত্ত্বিকেরা বলেছেন 'জৈবিক নির্ধারণবাদ' (Biological Determinism), অর্থাৎ জন্মের সময় থেকে নারী ও পুরুষ যেহেতু সহজাত শারীরিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, তাই তাদের সামাজিক ভূমিকাও হয়ে ওঠে আলাদা। নারীর জন্যে ধার্য হয় গৃহের সংকীর্ণ পরিসর, পুরুষের জন্যে বাইরের ব্যাপ্ত পৃথিবী। আকাশ নয়, ঘরের চার-দেওয়ালই হয়ে ওঠে মেয়েদের চলাচলের 'সীমা-স্বর্গ', যেখানে কেবল — "রাঁধার পরে খাওয়া/ আর খাওয়ার পরে রাঁধা" (রবীন্দ্রনাথ)। তাই মনের মধ্যে ইচ্ছে-ডানার উড়ান থাকলেও একসময় মেয়েদের পড়াশোনা ও মেধাচর্চার অধিকার ছিল না। রাসসুন্দরী দেবী তাঁর 'আমার জীবন' (১৮৭৬) নামে আত্মকথায় কী অকপটভাবে লিখেছেন — "সমস্ত দিন গৃহকর্মে এমনভাবে নিমজ্জিত থাকিতাম যে কখন দিন আর কখন রাত হইত, তাহা আমার খেয়াল থাকিত না .... কিছুকাল পরে আমার লেখাপড়া করার শখ চাপিল ... বই পড়িতে চাহিবার জন্যে আমার নিজের উপরেই রাগ হইল, কারণ মেয়েদের যে পড়াশোনা করিতে নাই।" এ'তো ভারতের ছবি — তাহলে কি পশ্চিমী উন্নত দেশে নারীর অবস্থা আলাদা কিছু ছিল? না, সেইসব দেশেও মেয়েদের সবরকম স্বাধীনতা ছিল না। উন্নত দেশগুলিতেও রাজনৈতিক অধিকার সহ অন্যান্য অধিকার অর্জনের জন্যে মেয়েদের আন্দোলনে শামিল হতে হয়েছে (প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে — বিশেষ করে, ফ্রান্সে)। উল্লেখ্য যে, স্বাধিকার অর্জনের জন্যে যে লড়াই, তা যথেষ্ট কঠিন ছিল। যে সাম্য, মৈত্রীর আদর্শকে সামনে রেখে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, সেই যুগান্তকারী বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে মেয়েদের জন্যে পুরুষের মতো সমান-অধিকার চাওয়ার জন্যে গিলোটিনে চড়ানো হয়েছিল অলিম্প দ্য গোজ (Olympe de Gouges)-কে। ১৭৭৬ সালে আবিগেল অ্যাডাম্স (Abigail Adams)-কে জন অ্যাডাম্স (John Adams) যে ঐতিহাসিক চিঠিটি লেখেন, তার সারমর্ম ছিল এইরকম — "দেশ ও জাতির জন্যে গৃহীত আইনের নতুন ধারায় মেয়েদেরও যেন সম-প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকে।" একই সময়ে বিশিষ্ট ইংরাজ লেখিকা তাঁর আলোড়ন-তোলা গ্রন্থ "The Vindication of the Rights of Women"-এ লিখেছেন — "আমি পুরুষকে ভালবাসি আমার সহযোগী হিসেবে। কিন্তু তার শাসনদণ্ড বৈধ হোক বা অবৈধ, তা কখনোই আমার প্রতি প্রসারিত হতে পারে না।"
নারীর জন্যে ধার্য সমাজ ও পরিবারের এই সীমিত পরিসরে, যখন আমরা জানতে পারি, সেইসব নারীদের কথা — যারা ঘরের আগল ভেঙে ও ছক-বাঁধা জীবনের ঘেরাটোপ পেরিয়ে জীবনের নানা দিকে তাদের কীর্তি স্থাপন করেছেন — কখনো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কখনো সাহিত্য-শিল্প ক্ষেত্রে আবার কখনো জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে — তখন আশ্চর্য হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় থাকে না। যেসব নারী এই ছক-ভাঙা কাজে ব্রতী হয়েছেন, তাদের আমরা 'আশ্চর্যময়ী' বলতেই পারি! সঙ্গতভাবেই এমনই তিরিশজন 'আশ্চর্যময়ী'কে নিয়ে সম্পাদক শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাদের উপহার দিয়েছেন একটি সু-সম্পাদিত মূল্যবান গ্রন্থ, যার নাম "আশ্চর্যময়ী"। তিরিশটি প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে তিরিশজন নারীর কীর্তি ও সাফল্যের উপাখ্যান — যার মধ্যে ছ'টি লেখা পুনর্মুদ্রিত (অমলেন্দু দে, সুপ্রকাশ রায়, ধ্রুব গুপ্ত, মীনাক্ষি চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন ঘোষ ও অরুণ মিত্র)। লেখকতালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে যে বয়স ও অভিজ্ঞতায় প্রবীণ থেকে নবীন সকলের লেখাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আলোচ্য সংকলনে। ফলে পরিচিত নাম যেমন চোখকে টানে, তেমনই অপরিচিত বা স্বল্প-পরিচিত নামও আগ্রহ জাগায় তাদের লেখার দিকে। তবে তা কতটা উৎকর্ষ অর্জন করেছে, তার হদিশ পাঠক/ সমালোচক অবশ্যই পাবেন সেই লেখা পাঠের পরে।
প্রথমেই আসি পুনর্মুদ্রিত লেখাগুলির প্রসঙ্গে। গ্রন্থের প্রথম লেখাতে ঢাকানিবাসী গান্ধীবাদী নেত্রী আশালতা সেনের রাজনৈতিক ও গঠনমূলক কর্মজীবনের ব্যাপ্ত দিকগুলির ওপর চমৎকারভাবে আলোকপাত করেছেন অমলেন্দু দে। মাত্র ২২ বছর বয়সে একটি শিশুপুত্র সহ বিধবা আশালতা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সংকট ভুলে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশসেবার কাজে। আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাঁর সদর্থক ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। তবে শুধু আদর্শবাদের মোহাঞ্জনে নিজেকে নিমজ্জিত না করে আশালতা গড়ে তুলেছিলেন ঢাকায় 'কল্যাণ কুটির আশ্রম', 'সত্যাগ্রহী সেবিকাদল', 'নারীকর্মী শিক্ষাকেন্দ্র', 'নশঙ্কর মহিলা শিবির' প্রভৃতি। কারাবন্দী হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ঢাকা জেলায় প্রায় ৬১টি গ্রামে ও শহরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন — জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্যে। ১৯৩৩ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়েও তাঁর এই গঠনমূলক মানসিকতায় ভাঁটা পড়ে নি। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে ১৯৮৬ সালে এপার বাংলায়। অসম সাহসী ও লড়াকু মনোভাবাসম্পন্না আশালতা বাংলাদেশের মহিলাদের কাছেও এখনও অনুপ্রেরণার প্রতীক।
গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ বাস করত — তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল হাজং উপজাতি; আর এই উপজাতি সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আরেক এক আশ্চর্যময়ী — তার নাম রাসমণি। বিয়ের স্বল্পকাল পরেই স্বামীহারা বারো বছরের রাসমণিকে গ্রামবাসীরা 'ডাইনি' বলে সম্বোধন করত। দ্বিতীয়বার বিবাহ না করে কিংবা কোনও ব্যক্তির রক্ষিতা হিসাবে না থেকে রাসমণি বেছে নিয়েছিলেন দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন আর নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন নানা মানবিক ও সামাজিক কাজকর্মে। প্রসিদ্ধ বামপন্থী ইতিহাসবিদ্ সুপ্রকাশ রায়ের "তেভাগা সংগ্রাম" গ্রন্থ থেকে আলোচ্য রচনাটি সংগৃহীত। আলোচ্য রচনাটিতে (শহিদ রাসমণির কাহিনি) সুপ্রকাশ রায় তুলে ধরেছেন 'ডাইনি' রাসমণি থেকে 'ধাত্রী' রাসমণি এবং শেষ পর্যায়ে শহিদ রাসমণির উত্তরণের নানা পর্যায়, লড়াই, সংগ্রামকে। 'তেভাগা আন্দোলনে' হাজং ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সভা যখন চলত, তখন সভা ও মিছিলের পুরোভাগে থাকতেন রাসমণি তার নারীবাহিনী নিয়ে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, হাজং কন্যাদের মৃত্যুপণ সংগ্রামের জন্যে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন এই বীর নারী। তাঁর মূলধন ছিল জ্বালাময়ী বক্তৃতা, কর্মশক্তি এবং মুক্তির স্বপ্ন। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে 'ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী' পূর্ণ শক্তি নিয়ে হাজং অঞ্চলের ওপর আক্রমণ করে, জ্বালিয়ে দেয় গ্রাম, সমিতি, স্কুল, পাঠশালা, পাশবিক অত্যাচার চালায় কৃষক-বধূদের ওপরে। লাঞ্ছিত কৃষক-বধূ সরস্বতীর সম্মান রক্ষার্থে ছুটে যান রাসমণি। আগ্নেয়াস্ত্র-সজ্জিত ২৫জন সৈন্যের সঙ্গে কেবলমাত্র তিরধনুক, দা, বর্শা সম্বল করে যে যুদ্ধ হয় — তা ইতিহাসে স্মরণীয়। সরস্বতীর ইজ্জত লুণ্ঠনকারী সৈন্যটিকে সন্ধান করে বীর নারী রাসমণি দা'য়ের কোপে তার মুণ্ড ও দেহ বিচ্ছিন্ন করেন। তার পরিণামে দশটি বুলেট ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় রাসমণির দেহ। প্রায় দু'ঘন্টা ধরে সংঘটিত এই যুদ্ধ সোমেশ্বরী নদীর তীরে এক নারীর সাহস ও বীরত্বের এক নতুন উপাখ্যান রচনা করেছিল — সেই নারীর নাম রাসমণি, শহীদ রাসমণি। এই সংকলনে আলোচ্য রচনাটি একটি উজ্জ্বল সংযোজন, যা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। রাসমণি সত্যিই এক আশ্চর্যময়ী।
এখানেই শেষ নয়, সংকলনভুক্ত পুনর্মুদ্রিত লেখাগুলির মধ্যে রয়েছেন আরও চারজন নারী — যারা নিজেদের আলোতেই আলোকবর্তিকা! করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেশ্বরী দত্ত, তৃপ্তি মিত্র এবং কেয়া চক্রবর্তী। শ্রীমতী মীনাক্ষি চট্টোপাধ্যায় 'সর্বজয়া করুণা' শিরোনামে লেখাটিতে উপস্থিত করেছেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন এক ব্যক্তিত্বকে, যার মাধ্যমে আমরা ব্যক্তি করুণার চরিত্রের নানামুখী মাত্রা'র পরিচয় পাই। একজন অসাধারণ অভিনেত্রী হিসাবে যারা করুণাকে জানেন, তাদের কাছে আলোচ্য স্মৃতিচারণমূলক রচনাটি করুণার নানামুখী প্রতিভার দিশার সন্ধান দেবে — যেমন লেখক করুণা, সমালোচক করুণা এবং সর্বোপরি একজন সহৃদয়, উদার নারী করুণা — যিনি সেইসময়ে বাইশ বছরের তরুণী মীনাক্ষি চট্টোপাধ্যায়ের ও তাঁর সখীদের খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই 'কাছের মানুষ' হয়ে ওঠেন। তাদের সম্পাদিত 'সখীসংবাদে" প্রথম অনুরোধেই আত্মজৈবনিক ধারাবাহিক রচনা 'অর্ধশতক আগের নারী' লেখা শুরু করেছিলেন। করুণার এই উদার ও স্বচ্ছ মানসিকতার (তার জীবন-দর্শনেরও) প্রতিফলন দেখা যায় তার লেখাতে (আলোচ্য রচনাতে উদ্ধৃত) — 'জীবনের কাছে আমরা যা পাই তার যদি তার হিসাব কষি তবে দেখব লাভের অংশ আমারই বেশি।'
স্বর্ণকণ্ঠের অধিকারিণী রাজেশ্বরী দত্তের কণ্ঠ-নিঃসৃত 'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল' কিংবা 'দিন যায় রে বিষাদে'র মতো রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মনের মধ্যে যে কতোবার ভালোবাসা আর বিষণ্ণতার বোধ জাগিয়ে তুলেছে — তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। প্রখ্যাত কবি সুধীন দত্তের জীবনসঙ্গিনী রাজেশ্বরী ছিলেন স্ব-পরিচয়ে উজ্জ্বল। 'পরবাসে রাজেশ্বরী দত্ত' রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া বারোমাস পত্রিকায় (১৯৭৯)। অনেকেই তো রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষ ছুঁয়েছেন, তাহলে কোথায় রাজেশ্বরীর অনন্যতা? এই রচনায় শ্রী ধ্রুব গুপ্ত (যিনি নিজেও সঙ্গীতজ্ঞ) এই বিষয়টির ওপরেও জোর দিয়েছেন। রাজেশ্বরীর অনন্যতা এখানেই যে তিনি রবীন্দ্রনাথের দুরূহ গানগুলিকে কী অনায়াস দক্ষতায় কণ্ঠে ধারণ করেছেন ('এ মোহ আবরণ' বা 'অনন্তসাগর মাঝে'), অথচ কোথাও গানের বিস্তৃতি ক্ষুণ্ণ হয় নি বা তাল ভঙ্গ হয় নি। দুঃখের বিষয়, কবি সুধীন দত্তের প্রয়াণের পর এই প্রতিভাময়ী দেশান্তরী হন। কর্মরতা হন লন্ডনের 'স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ'-এ। স্বল্পকালের জন্যে স্বদেশে এসেছিলেন একটি বিশেষ গবেষণার কাজে। তবে স্বদেশবাস দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, কারণ এই সময়েই শিল্পী রাজেশ্বরী প্রয়াতা হন। ট্র্যাজেডি এই যে প্রবাসে না থেকে রাজেশ্বরী যদি এদেশেই থাকতেন, তাহলে তাঁর ব্যতিক্রমী অথচ ভাবগভীর গায়নপদ্ধতির প্রভাব সমৃদ্ধ করত পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের এবং নিশ্চিতভাবে এক অনন্য গায়নরীতি বেঁচে থাকত তাঁর উত্তরসূরীদের মধ্যে। সুলিখিত আলোচ্য রচনায় অধ্যাপক গুপ্ত প্রতিভাময়ী শিল্পীর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সম্পর্কেও যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন — যা নিঃসন্দেহে এই সংকলনের মর্যাদা বাড়িয়েছে।
আরেক আশ্চর্যময়ী তৃপ্তি মিত্রের ওপরে বিশিষ্ট কবি অরুণ মিত্রের লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রী মিত্রেরই লেখা 'পথের মোড়ে' (১৯৯৬) গ্রন্থে। অরুণ মিত্র ব্যক্তিগত আত্মীয়তার সম্পর্কের নিরিখে কিশোরীবেলা থেকে দেখেছেন তৃপ্তিকে — দেখেছেন তাঁর ক্রমশ উত্তরণ। দেখেছেন গণনাট্য সংঘের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, অভিনয় জীবনে জড়িয়ে পড়া। এই অভিনয়কে কেন্দ্র করেই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তাঁর পরিণয় — পরবর্তীকালে 'বহুরূপী'র এক অনন্যসাধারণ অভিনেত্রী হয়ে ওঠা। তবে তৃপ্তি মিত্রের নিজস্বতা, তাঁর বিশেষ বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর তাঁর অভিনয়কে এক বিশেষ শৈলী দিয়েছিল। এই লেখার এক জায়গায় শ্রী মিত্র বলেছেন — "তার কণ্ঠের ও বাচনের তীব্রতা এবং শিথিলতা প্রায়ই আমার ভেতরটাকে একইভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দিত এবং আমার পাষাণ চোখেও জল টেনে আনাত।" হ্যাঁ, শ্রী মিত্রের লেখাতে আমরা এই বিশিষ্ট অভিনেত্রীর ডাকনামটি জানতে পারি — "মণি"। নামটি সার্থক, সর্ব অর্থেই। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় কবি অরুণ মিত্র আমাদের জানিয়েছেন — "অভিনয়ের অনুধ্যানে অমন সার্বিক আত্মনিয়োজন আমি আর দেখি নি।" বাস্তবিকই, নাটকের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও নিষ্ঠা তৃপ্তি মিত্রকে তাঁর জীবনের অন্য এক সফলতার শীর্ষদেশের দিকে নিয়ে গেছে — যেখানে ব্যক্তিগত অভাববোধ বা সমস্যা তেমন ছায়া ফেলতে পারে নি। তবে জীবনের শেষ পর্যায়ে শারীরিক অসুস্থতা অভিনেত্রীকে টেনে নিয়ে গেছে যন্ত্রণা আর কষ্টের আবর্তে। স্বল্প পরিসরে সুলিখিত এই রচনা 'মণি'-আশ্চর্যময়ীদের অলঙ্কারে হীরকদ্যুতির মতো।
পুনর্মুদ্রিত শেষ লেখাটির নাম 'ফুলের মশাল' — রচয়িতা চিত্তরঞ্জন ঘোষ। আলোচ্য সংকলনভুক্ত এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে — 'কেয়ার বই' নামক গ্রন্থে। বাংলা নাট্যজগতে কেয়া চক্রবর্তী একটি উজ্জ্বল নাম। তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে 'নান্দীকার' নাট্যগোষ্ঠীর বিভিন্ন নাটকে। লেখক অধ্যাপক ঘোষ সংগতভাবেই মন্তব্য করেছেন — "আমার বিচারে, সব মিলিয়ে ধরলে এই মুহূর্তে তৃপ্তি মিত্র ছাড়া কেয়ার ওপরে স্থান পেতে পারে এমন মঞ্চাভিনেত্রী বাংলাদেশে নেই।" যারা সেইসময় কেয়া চক্রবর্তীর ঐ দাপুটে অভিনয়ের সাক্ষী ছিলেন, তারা নিশ্চিতভাবে সহমত হবেন এই মন্তব্যের সঙ্গে। শুধু অভিনয় নয়, কেয়া ছিলেন নাটকে নিবেদিত প্রাণ। তাঁর কাছে জীবন ও শিল্প ছিল সমার্থক। শৈশব থেকে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অভাববোধ, সমস্যা, নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা ইত্যাদি পেরিয়ে কেয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জীবনে। বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনার কাজ। ছাত্রছাত্রীদের জন্যে ছিল বুকভরা স্নেহ-ভালোবাসা, ঠিক ততটা ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতাই ছিল নাটকের প্রতি। 'বৃষ্টিভেজা বাড়ির' মতো রহস্যময় এক মৃত্যু কেয়াকে টেনে নিয়ে গেল জীবনের পরপারে। পেছনে পড়ে রইল তাঁর অসমাপ্ত কাজ। থিয়েটারের প্রতি তাঁর দুর্নিবার টান, বিরল প্রতিভার দ্যুতি-ছড়ানো তাঁর অসাধারণ অভিনয়, কোন কিছুই মৃত্যুর আহ্বানকে বিলম্বিত করতে পারে নি। অকালে ঝরে গেল 'কেয়াফুল' — যা নিশ্চিতভাবে অন্য ফুলের থেকে স্বতন্ত্র। এই রচনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বিষাদগাথা - যা পড়তে পড়তে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের চোখ। ভালোবাসার কথা শুনলে কেয়া নাকি বলে উঠতেন — "ভালোবাসে? কতটা? আমার জন্যে প্রাণ দিতে পারে?" সত্যিই, কেউ প্রাণ দিতে যেমন পারে নি, তেমনই অগণিত ছাত্র-ছাত্রী ও নাট্যানুরাগীর ভালোবাসাও কিন্তু কেয়ার আকস্মিক, রহস্যময় ও অকাল মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে নি। অধ্যাপক ঘোষের ব্যক্তিগত শোক ও বিষাদ-জারিত লেখাটি অর্ন্তভুক্ত না হলে এই সংকলনের গুরুত্ব হ্রাস পেত, নিঃসন্দেহে।
এই সংকলনে আছে আরও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীদের কথা, যেমন — নটী বিনোদিনী, রেবা রায়চৌধুরী এবং শোভা সেন। আমরা যারা বিনোদিনীর 'আমার কথা' নামক আত্মকথা পড়েছি, তারা জানি যে বিনোদিনীর জীবনটাই ছিল নাটকের মতো — নানা চরিত্র, নানা সম্পর্ক, যন্ত্রণা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। উনবিংশ শতকের ৭০-এর দশকে বিনোদিনীর বাংলা থিয়েটারে পা-রাখা। তারপর নিজস্ব শৈলী ও প্রতিভার জোরে তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চের একজন সু-অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। তার সম-সময়ে আরও অনেক অভিনেত্রী থাকলেও তাঁদের কারও নামের আগে 'নটী' শব্দটির ব্যবহার ঘটেনি। নাট্যাভিনয়ের সঠিক পাঠ গ্রহণ করেছিলেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আশীর্বাদ — "মা তোমার চৈতন্য হোক"। অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ ও সুলিখিত "মরুভূমি আর মরীচিকার কথা" নামক রচনায় শ্রী সিদ্ধার্থ সেন যেভাবে এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে উপস্থিত করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
'গণনাট্যের কিংবদন্তি'-তে দেবাশিস হালদার তুলে ধরেছেন "ভারতীয় গণনাট্য সংঘের স্বর্ণপ্রসূ আদিপর্বের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী" রেবা রায়চৌধুরীকে। শুধু অভিনয় নয়, নৃত্য ও গীতেও তিনি ছিলেন পারদর্শিনী। তবে এই পরিচয় রেবার খণ্ডপরিচয়। তাঁর শিল্পীসত্ত্বাকে সম্পূর্ণভাবে জানতে গেলে জানতে হবে তাঁর আদর্শবাদকে, জীবনের সত্যানুসন্ধানকে। এই অনুসন্ধান প্রতিনিয়তই তাঁকে চালিত করেছে নিপীড়িত, শোষিত মানুষের শুভের দিকে। শুধু মঞ্চে অভিনয়, তাঁর আশ্চর্য অভিনয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে আছে মৃণাল সেন (মৃগয়া), গৌতম ঘোষ (পাড়), উৎপলেন্দু চক্রবর্তী (ময়না তদন্ত), সন্দীপ রায় (হিমঘর) পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলিতে। লেখক দেবাশিস হালদার যথার্থই বলেছেন — "জমিদার বাড়ির কন্যা হওয়া সত্ত্বেও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও বিশ্বাস থেকে উৎসারিত সাংস্কৃতিক চেতনাই তাঁকে কিংবদন্তি করেছে।"
প্রতিভাময়ী মঞ্চ ও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শোভা সেনকে নিয়ে লেখা অরূপ মুখোপাধ্যায়ের 'বাংলা রঙ্গমঞ্চের হেলেনে ভাইগেল' এই সংকলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। একদিকে শোভার দাম্পত্যজীবনে ঝড়, বিচ্ছেদ, অন্যদিকে অনন্য নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তকে গুরুরূপে পাওয়া — অসমবয়সী উৎপলের সঙ্গে প্রণয় ও পরিণয় — শোভা সেনের জীবনে দুই সমান্তরাল স্রোত। রচনার স্বল্প-পরিসরে শ্রী মুখোপাধ্যায় কি নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এই শিল্পীর জীবনের চড়াই-উৎরাইকে, যা নিশ্চিতভাবে পাঠককে সহায়তা করবে শ্রীমতী শোভা সেনের শিল্পীজীবন ও পাশাপাশি সমস্যা-কন্টকিত ব্যক্তিজীবনকে বুঝতে। এর আভাস হয়তো অনেকটা ধরা আছে শ্রীমতী সেনের আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ 'স্মরণে বিস্মরণে — নবান্ন থেকে লালদুর্গ'-তে। একজন যথার্থ শিল্পীর থাকে নিজস্ব স্বচ্ছ ভাবনা-চিন্তা এবং শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই বৈশিষ্ট্য একশো শতাংশ প্রতিফলিত হয়েছিল শোভার মধ্যে। সর্বোপরি সক্রিয় ছিল এবং আছে তাঁর প্রেমিকা সত্ত্বা, তাই তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে ছাতিম গাছের মতো ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর গুরু ও জীবনসঙ্গী অমিত প্রতিভাধর উৎপল দত্ত। ফলে অরূপ মুখোপাধ্যায় লেখার পরিশেষে যে মন্তব্য করেছেন — "তাঁর (শোভা সেনের) লক্ষ্য ও পরিকল্পনা পরিষ্কার। উৎপল দত্তের মহান, সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার বহন ও সংরক্ষণ" — তার সঙ্গে আমরাও সহমত না হয়ে পারি না।
এতক্ষণ যেসব আশ্চর্যময়ীদের কথা বলা হল, তাদের সঙ্গেই সম-পঙ্ক্তিতে খুঁজে পাওয়া যায় আরও অনেককেই আলোচ্য সংকলনে। মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থ-সমালোচনার স্বল্প পরিসরে প্রত্যেকের সম্পর্কে স্বতন্ত্র আলোচনা সম্ভব নয়, তাই আরও কয়েকটি লেখার উপস্থাপিত কয়েকজন আশ্চর্যময়ীদের কীর্তির ওপর আলোকপাত করে চলে যাব উপসংহারে।
শিল্পশিক্ষার সূচনাপর্ব ছিল চিত্রকলায়, কিন্তু মীরা মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন নামী ভাস্কর! এই যশস্বী শিল্পীকে সমীর ঘোষ উপস্থাপিত করেছেন 'স্রোতের বিপরীতে' নামক রচনায়। মীরার এই শিল্প-জীবনও যেন এক দীর্ঘ যাত্রাপথ! রং-তুলিতে সহজাত দক্ষতা ছেড়ে তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন ভাস্কর্যকে এবং এই বিষয়ে দেশ-বিদেশ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন। তবে পরবর্তী জীবনে তিনি প্রথাসিদ্ধ পথে হাঁটেন নি। তাই তৎকালীন ভারতীয় ভাস্কর্যের গতানুগতিক প্রয়োগ-কৌশলে তিনি আকৃষ্ট না হয়ে, তিনি যথার্থ শিল্পীর মতোই দেশজ লোকশিল্পের ধারার মধ্যে মনের খোরাক অন্বেষণ করেছেন। লেখকের ভাষায় — "দেশজ লোকশিল্পের ধারার মধ্যেই (মীরা) খুঁজেছেন আধুনিক বা বলা যায় সমকালীন জীবনযাপনের রূপকল্প। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় লোকশিল্পীদের কাছে পৌঁছতে। তাদের জীবনধারার সঙ্গে শিল্পের যে নিবিড় একাত্মতা— তার সঙ্গে পরিচিত হতে।" ব্যক্তিগত জীবনে (অনেক নারীর মতোই) নানা সমস্যা, অন্তরায় পেরিয়ে — একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতার হিম শীতলতায় নিমজ্জিত থেকেও মীরার একমাত্র স্বপ্ন ছিল 'সৃজন', তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃজন-আনন্দের মধ্যে দেখতে চেয়েছেন জীবনকে। ধন্যবাদ, লেখক সমীর ঘোষকে, এই চমৎকার লেখাটির জন্য।
স্বাধীনতা আন্দোলন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জড়িত থেকে যেসব নারীরা স্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছেন — তাঁদের কথাও বিধৃত হয়েছে বিভিন্ন লেখায়; যেমন — সৌম্য বসুর লেখায় 'সন্তোষকুমারী দেবী', নিত্যানন্দ ঘোষের 'কমলা দাশগুপ্ত', তন্ময় পালের 'লীলা নাগ', সন্দীপন মিত্রর 'প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার', গার্গী চক্রবর্তীর লেখায় 'কল্পনা দত্ত' এবং অরুন্ধতী ভট্টাচার্য রচিত 'বীণা দাশ' কৃতিত্ব ও প্রতিভার অজস্র নুড়ি-পাথর ছড়ানো। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে পিতৃতন্ত্রের ঘেরাটোপে নিয়ন্ত্রিত জীবনের ছকভাঙা সহজ কাজ ছিল না। পেরেছিলেন এইসব আশ্চর্যময়ীরা। আলোচ্য লেখাগুলির মধ্যে উল্লেখ্য গার্গী চক্রবর্তী এবং অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের লেখা। তবে প্রীতিলতার ওপরে সন্দীপন মিত্রর লেখাটি ('সংগ্রামের বর্ণমালা') আগ্রহ ভরে পড়তে গিয়ে হতাশ হতে হয়েছে। সাড়ে চার পাতা ভূমিকার পর প্রীতিলতার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে মুদ্রিত দু'টি পাতা। এই নবীন লেখক সম্পর্কে সম্পাদকের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। এই পর্বে অবশ্যই আলাদা করে উল্লেখ করার মতো লেখা হল শিবাদিত্য দাশগুপ্তর 'স্তালিননন্দিনী'। ইলা সেন ওরফে ইলা মিত্রর ঘটনাবহুল জীবন, তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, জেলবন্দী অবস্থায় তাঁর ওপরে সংঘটিত পৈশাচিক অত্যাচার — এই সবকিছুকে শ্রী দাশগুপ্ত তথ্যনিষ্ঠতায় উপস্থাপন করেছেন আলোচ্য রচনায়। প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'পারুল বোন' মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুভাষের কবিতাতেই খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ভাবনার সাদৃশ্য — "ফুল খেলার দিন নয় অদ্য/ মৃত্যুর মুখোমুখি আমরা/ চোখে নেই স্বপ্নের গাঢ় নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদে সেঁকে চামড়া।"
আমরা যারা 'জেলের ভেতর জেল', 'শতাব্দী শেষের গল্প' পড়েছি, তাদের কাছে মীনাক্ষি সেন একটি অতি পরিচিত নাম। শ্রীমতী কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চমৎকার লেখায় তুলে ধরেছেন সেই মীনাক্ষিকে, যিনি ছিলেন কৃষ্ণার 'নেন্কো' (রাশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে মা'কে নেন্কো বলে ডাকা হয়)। অত্যন্ত স্বাদু গদ্যে কৃষ্ণা নিয়ে এসেছেন জেলবন্দী অবস্থার সেইসব দিনগুলিকে, যেখানে তাদের কতো না মিষ্টি-মধুর কাণ্ড — কবিতা লেখা, চুল কেটে ফেলা, খুনসুটি করা। জেল থেকে মুক্তির পর মীনাক্ষির জীবনের উত্তরণের কাহিনীও আছে — তার অ্যাকাডেমিক পাঠ গ্রহণ, সত্যেনের সঙ্গে প্রণয় ও পরিণয়, সন্তানলাভ ইত্যাদি। এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে লেখা এসব ঘটনা — যে মন ছুঁয়ে যায়! সত্যেনের আকস্মিক প্রয়াণের পর মীনাক্ষির শোকাহত অবস্থার কথা পড়তে পড়তে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে চোখ। কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই লেখা 'আশ্চর্যময়ী'র সম্পদ।
আলোচ্য সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কৃষ্ণভাবিনী দাস (অম্লান দত্ত), জ্যোর্তিময়ী দেবী (রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী), আশালতা সিংহ (আশিস পাঠক), রাধারাণী দেবী (শুভাশিস চক্রবর্তী), সাবিত্রী রায় (অনল পাল)-এর মতো নারীদের কথাও। এঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রতিভার ছাপ রেখেছেন — যা সমসময়েও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো কৃতী নারীকে নিয়ে লিখেছেন অণির্বাণ রায়। এই লেখাটিতেও প্রত্যাশা ছিল বেশি, কিন্তু সে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলির উল্লেখের জন্যে ধন্যবাদার্হ লেখক। তবে সুকুমারী ভট্টাচার্যের জন্যে বিভিন্ন জনের দৃষ্টি/অভিজ্ঞতার কি খুব দরকার ছিল? সুকুমারী তো স্ব-পরিচয়েই দ্যুতিময়ী!
আলোচ্য সংকলনটির যে বৈশিষ্ট্য আকৃষ্ট করেছে তা হল — বাঙালি রমণীর ছক-ভাঙা জীবনে কৃতিত্বের উপস্থাপনায় কোনও প্রথাসিদ্ধ ভৌগোলিক মানচিত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি — তাই এপার বাংলার ব্যাপ্ত পরিসরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও। মনোরমা বসু, জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামালের কৃতিত্বের উপাখ্যান তুলে ধরেছেন যথাক্রমে বুদ্ধদেব ঘোষ, সব্যসাচী দেব ও সুশান্ত ঘোষ। প্রতিটি রচনাই সুলিখিত। তবে আলাদা করে উল্লেখ করা যায় সব্যসাচী দেব-এর 'শহীদ জননী' লেখাটি। সন্তানের মৃত্যুতে শোকাতুর না হয়ে জাহানারা ইমাম তাঁর শোককে পরিণত করেছিলেন ক্রোধে। তাই তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি'। লেখক অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করেছেন — "২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন হচ্ছে এর ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত পরিণাম।" সারা প্রবন্ধের পরিসরে ছড়িয়ে আছে জাহানারার কর্মকাণ্ডের নানা ছবি — গণসমাবেশ, গণস্বাক্ষর-সংগ্রহ, সংসদ অভিযান, মানববন্ধন ইত্যাদি। তিনি মুখোমুখি হয়েছেন নানা বাধার, নানা সমস্যার — কিন্তু তাঁর সাহস ও মানসিক জোরের সাহায্যে এগুলি অতিক্রম করতে পেরেছেন। তবে অতিক্রম করতে পারেন নি মারণব্যাধির হাতছানিকে। ১৯৯৪ সালে বিদায় নিয়েছেন কর্মবহুল জীবন থেকে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অসম্পূর্ণ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে তরুণ প্রজন্ম ব্রতী হয়েছে। মহীয়সী এই শহীদ জননীর ওপর শ্রী সব্যসাচী দেবের লেখাটি তথ্যনিষ্ঠ ও হৃদয়গ্রাহী।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্ ও কলকাতার পাঠভবন স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাত্রী শ্রীমতী উমা সেহানবীশকে নিরে রচিত সত্য রায়ের 'মানুষ গড়ার কারিগর' লেখাটিও প্রশংসনীয় — যা পাঠ করলে শ্রীমতী উমার কর্মকৃতিত্বের নানা দিকের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন পাঠক।
আলোচ্য সংকলনের আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য লেখা হল পার্থসারথি মিত্রের 'প্রেম, মৃত্যু কি পর্বত — এক রাজকন্যের গল্পও'। কে এই রাজকন্যে? সবাই তাকে চেনেন। পর্বতকন্যা ছন্দা গায়েন। এই তো ক'দিন আগেও সোশ্যাল মিডিয়া সরব ছিল তাকে নিয়ে — "ফিরে এসো, ছন্দা, ফিরে এসো/ রোজকার জীবনের ছন্দে"। কী কঠোর পরিশ্রম আর মনের জোর নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন ছন্দা পর্বতারোহণের জন্যে, কারণ তাঁর দুচোখে ছিল স্বপ্ন — পর্বতের শিখর ছোঁয়ার স্বপ্ন! তবে এই যাত্রাপথ তো কুসুমাকীর্ণ নয়, পদে পদে বাধা-বিপদ, অনিশ্চয়তার হাতছানি। ঐ হাতছানির মায়াবী টানেই ছন্দা হাজারও ঝুঁকি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন 'ইয়ালুং কাং' জয় করতে। তবে আর ফিরে আসা হয় নি। পর্বতের রাজকন্যা চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেলেন তুষারাচ্ছন্ন আরেক পৃথিবীতে। মন-ছোঁয়া এই লেখা অকালপ্রয়াতা ছন্দা গায়েনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘও বটে!
শেষে বলবো, এই সংকলনের আরেকটি চমৎকার লেখার কথা — লেখক মধুময় পাল। 'ছিন্নপত্রে জড়িত জীবনে' তিনি এক প্রতিভাময়ী শিল্পী 'শাকিলা'কে হাজির করেছেন। মিডিয়ার দৌলতে আজ শাকিলা সু-পরিচিত। তবে তাঁর জীবন যেন এক চলচ্চিত্র! তালতলা বাজারে ডিমবিক্রেতা মায়ের সঙ্গে আসা শাকিলা কিভাবে বিশিষ্ট শিল্পী বলদেব রাজ পানেসরের চোখে পড়ে যান — কিভাবে শাকিলার মধ্যে থাকা শিল্পীসত্তার বিকাশ হয় — আবার দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার আবর্তে পাক খায় তাঁর জীবন এবং তারপর আবার 'কোলাজ' বানিয়ে শিল্পী-জীবনে প্রত্যাবর্তন — শাকিলার জীবনের এই 'Journey'-কে চমৎকার মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন মধুময় পাল। সবচেয়ে বড় কথা, শাকিলার ছবির বৈশিষ্ট্যকে যে-ভাষায়, যে-ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আলোচ্য লেখায়, তা নিঃসন্দেহে নবীন পাঠককে কৌতূহলী করে তুলবে আর আমাদের মতো প্রবীণদের স্মৃতিকাতর করে তুলবে। শাকিলার সৃজনে "বাংলার লোক ভাবনায় যে মাতৃকল্প ফিরে ফিরে আসে, তার কথা ঋত্বিক ঘটক বলেছেন সিনেমায়, বিজন ভট্টাচার্য বলেন নাটকে .... শাকিলার চিত্রনির্মিতি বিস্ময়করভাবে সরল।" মধুময় পালের এই লেখা যে আশ্চর্যময়ীকে উপস্থিত করে আমাদের সামনে — তা পরবর্তী প্রজন্মের তরুণীদের কাছে অনুপ্রেরণার মাইলফলক।
জর্জ বার্নাড শ বলেছিলেন — "Life is not about finding yourself, life is about creating yourself." এই সংকলনভুক্ত বিভিন্ন লেখায় উপস্থাপিত আশ্চর্যময়ীরা পিতৃতন্ত্রের লৌহশৃঙ্খল ছিঁড়ে হয়তো জীবনের নানা দিকে নিজেদের 'সৃজন'ই করেছেন। সুখের কথা, এই সংকলন সম্পাদনা করেছেন একজন পুরুষ। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার 'মানবীবিদ্যা' পাঠ দিতে গিয়ে বারবার বলা হয়েছে এমন সব কাজে পুরুষের অন্তর্ভুক্তির কথা। নারীদের সাফল্যের ইতিহাস। উপাখ্যান অনুসন্ধানে কেন শুধু নারীরাই এগিয়ে আসবেন? শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাদের এই অসন্তুষ্টিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এমন এক চমৎকার সংকলন উপহার দিলেন — তার জন্যে তিনি নিশ্চিতভাবেই ধন্যবাদার্হ। নয়নশোভন প্রচ্ছদ এবং প্রায় মুদ্রণ-প্রমাদ বিবর্জিত এই গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণযোগ্য। তবে লেখক-পরিচিতির ক্ষেত্রে বর্ণানুক্রমিক বিন্যাস থাকলে ভালো লাগতো।
এই ধরনের কাজ আরও হোক। সম্পাদকের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা থাকলো।
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)