মধ্যমগ্রাম স্টেশন রোডের ওপর শমীক দত্তদের চারপুরুষের কাপড়ের ব্যবসা। শমীকের বাবার যৌবন বয়েস পর্যন্ত যা ছিল “মধ্যমগ্রামের সবচেয়ে বিশ্বস্ত শাড়িবিপণি”, আজ প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল মেলাতে তাই “মহিলা-পুরুষ-ছেলে-বুড়ো--সব বয়সের, সব মানুষের সব বাজেটের অঙ্গসজ্জার একমাত্র পছন্দ!”-র স্লোগান বুকে নিয়ে মধ্যমগ্রামের সবচেয়ে জমজমাট বাজারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে জ্বলজ্বল করে।
কলেজ ফেরত শমীক রোজই একবার দোকানে ঢুঁ মেরে বাড়ি যায়। টাকাপয়সা বা মালপত্র কিছু বাড়িতে পাঠানোর থাকলে আর হাঁটা মারতে হয় না, বাবার গাড়িটা পাওয়া যায়, এই মতলবে। আজ উল্টো বিপদ হয়ে গেল। পুজো সবে মিটেছে। মাঝে দুটো মলমাস। বিয়ের লগনসার এখনো কিছু দেরি, কিন্তু দোকান থই থই করছে। বিরাট দলবল নিয়ে এক বিয়ের পার্টি!
বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, “ঋষি, পরিমল আর রাজু তো হিমসিম খেয়ে গেল। জফর, কাপ্তেন ছুটিতে, অসিত মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। তোমার একটু সময় হবে নাকি কাউন্টারে দাঁড়ানোর?
— কাকা নেই? শমীক বলে ফেলেই ঢোক গিলল।
— থাকলে তোমায় বলতাম? বাবার চোখ লাল হল একটু।
— সোনামনির জ্বর এসেছে দুপুর থেকে। ডাক্তার সরকার এসেছেন, তাই দীপু বাড়ি গেছে। সে না ফেরা পর্যন্ত অন্তত একটু সামলে দিয়ে যাও। এতবড় একটা পার্টি, আর আজই যত সব হাঙ্গামা… বাবা গজগজ করতে লাগলেন।
শমীকের একটু ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু বাবা মুখ ফুটে বলা মানে নিতান্ত আতান্তর। বাবা জানেন, ব্যবসায় শমীকের কোন উৎসাহ নেই। দুঃখ পান, তবু কোনদিন জোর করেন না ছেলেকে পারিবারিক ব্যবসায় জুতে দেবার জন্য। বরং মা একটু খিটমিট লাগায়। বাবা বলেন, “আমি তো লেখাপড়া করেও সারাটা জীবন বাড়ি আর দোকান, দোকান আর বাড়ি করেই গেলাম। কি লাভ হল? ওকে ওর নিজের কাজ নিজে খুঁজে নিতে দাও। আমার সে স্বাধীনতা ছিল না।"
রাজুদার পাশের কাউন্টারে ঢুকে পড়ল শমীক।
— একী কাণ্ড! তুমি? রাজুদা ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
— কাকা বাড়ি গেছে যে। যতক্ষন না আসে আমি ব্যাক আপ।
— ওঃ। এই নাও। বোনটিকে এই শিফনগুলো দেখাও দেখি। এ আমাদের মালিকের ছেলে মাসিমা! কলকাতার কলেজে পড়ে। আজ স্টাফ কম তো, তাই ব্যাকআপ দিচ্ছে। হেঃ হেঃ…
পাশের বয়স্কা মহিলা নিশ্চয়ই বোনটির মা মাসি কেউ হবে।
— সমু, দিদিভাইকে ভালো দেখে একটা শাড়ি চয়েস করিয়ে দাও দেখি। কিচুত্তেই পচন্দ হচ্চে না…
শমীকের সামনে আঠারো উনিশ বছর বয়সের ফর্সা, ছিপছিপে, টগর ফুলের মত দেখতে একটি মেয়ে। কালো রঙের একটা মিরর ওয়ার্কের কুর্তি আর জিন্স পরে শাড়ির পাহাড়ের অন্যপারে কেমন অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। চোখের চশমাটা একটু নেমে এসেছে, চুলগুলো ঝামর হয়ে কাঁধের ওপরে লুটিয়ে আছে। বাঁহাতে একটা চুলের গুছি মুখে নিয়ে চুষছে আর ডানহাতের সরু লম্বা আঙ্গুলগুলো দিয়ে আদর করেছে গোলাপি রঙের একটা শাড়িকে।
শমীক জোর করে চোখ নামিয়ে নেয়।
— বিয়েতে পরবেন, না রিসেপশন পার্টিতে?
— বিয়েতে। আমার দিদির বিয়ে।
— ও বাবা! তাহলে তো জামাইবাবুকে ইমপ্রেস করার ব্যাপার আছে। সমু একটু হাসল।
— না। — অ্যাঁ!
— পাশের বাড়ির ছেলে। ছোটবেলা থেকে দেখছি। গুষ্টির সব্বাইকে চিনি। এমনকি বন্ধুগুলোকেও। ইমপ্রেস করা-টরার কোনো সিনই নেই।
— এঃ… এটা বাজে ব্যাপার। কোনো সারপ্রাইজ নেই।
— আছে। একটা সারপ্রাইজ আছে।
— কী-ঈ? শমীকের মুখ দিয়ে বোকার মত প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে।
— বলব কেন?
— ওঃ বেশ। বোলো না। এই পিঙ্কটা কেমন লাগে?
— কেমন লাগে?
— কি কেমন লাগে? আবার শমীক বোকা হয়ে যায়।
— কী অপদার্থ! এই আপনি দোকানদার? এই পিঙ্ক শিফনটা পরলে আমায় কেমন দেখাবে সেটা যদি না বলতে পারেন তবে দোকানদার হয়েছেন কেন?
বোনটি তো রীতিমত চোখ গরম করছে! এবার শমীকও ভদ্রভাবে একটু ডিফেন্স নেয়।
— কী আশ্চর্য! আমি কি শাড়ি পরি নাকি?
— বারে! আমিই বুঝি শাড়ি পরি? সেই ছোদ্দার বিয়েতে লাস্ট। তাও বাসর অবধি টানতে পারিনি। খুলে গিয়েছিল।
— আচ্ছা, তুমি একটা কাজ করো। এসো। এই আয়নার সামনেটায় এসে দাঁড়াও। এবার… এই… এইভাবে শাড়িটা গায়ের ওপর নিয়ে দেখো। শমীক এই টেকনিকটা দোকানের বাকি কর্মচারিদের দেখে দিব্যি শিখে নিয়েছে।
আয়নায় নিজেকে বেশ মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে বোনটি। পিছনে দাঁড়ানো শমীকের বুক থেকে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
— বেশ মানিয়েছে না?
— কী? শমীকের ঘোর কাটে।
— কী আবার? শাড়িটা!
— ওঃ। হ্যাঁ।
— সারপ্রাইজ না একটা আছে, জানেন?
— এঁ?
— ওই যে তখন বললেন না… কোনো সারপ্রাইজ নেই… সেটা ঠিক নয়, জানেন তো! একটা সারপ্রাইজ আছে।
— ও। কৌতূহল গিলে নিয়ে শমীক এবার সাবধান হয়ে যায়। এ পাগলিকে আবার প্রশ্ন করলে হয়তো বলবে, “আপনি দোকানদার, অত খোঁজে আপনার কি দরকার?”
— রাগ হল বুঝি? জিজ্ঞাসা করবেন না, তাই তো? আচ্ছা, আমিই বলছি। বোনটি এবার বিপজ্জনক রকম এগিয়ে আসে। প্রায় কানের গোড়ায় মুখ। শমীকের নাকে ওর গায়ের ঘাম আর পারফিউম মেশানো গন্ধ এসে লাগে। শমীক ভয়ে মুখ ঘোরাতে পারছে না। ওর খোলা চুলগুলো শমীকের নাকে ঢুকে যেতে পারে।
— লন্ডন থেকে কাকার বন্ধুর ছেলে আসছে, জানেন। সে ইমপ্রেসড হলে বেশ হয়--না, বলুন?
— তা তো নিশ্চয়ই। লন্ডন বলে কথা! শমীক ভাবে, উফফ… কাকা যে কখন আসবে!
— কী মজা না বলুন? বাকিংহাম প্যালেস, বিগবেন, উইলিয়ম-কেট-জর্জ-শার্লট, প্রিন্সহ্যারি…
— উফফ… বলুন না কোনটা নিই? পিঙ্কটা একটু ফ্যাকাসে নয়? ম্যাজেন্টার ওপর এই জরদৌসিটা বেশি ভালো না? কিন্তু মা দেবে না জানেন। বাজেটের অনেক ওপরে… দেখুন না একটু ডিস্কাউন্ট করা যায় কিনা…
— আচ্ছা তুমি আগে পছন্দ তো করো, তারপরে দামের কথা।
— আবার বলে পছন্দ করো! বলছি না আপনি পছন্দ করে দিন! আমি শাড়ির ব্যাপারে ভীষণ কনফিউসড হয়ে যাই। এই দিদি, তোর হল? এদিকে একবারটি আয়না প্লীজ।
শেষে বিয়ের কনে এসেই বোনকে উদ্ধার করে। ওদিকে কাকা এসে পড়েছে। শমীকেরও ছুটি।
— এ কী! আপনি চললেন?
— হ্যাঁ। আমার ছুটি।
— বউভাতের লেহেঙ্গাটা যে হল না এখনো!
— ওটা তিনতলায়।
— ভালো দেখাবে তো লাল শিফন পরলে? দিদিটার আবার ক্যাটকেটে রঙ পছন্দ!
— কি করে জানব ভালো দেখাবে কিনা? আমি তো আর তোমায় লাল শিফন পরে দেখতে পাবো না! আরেকটা দীর্ঘশ্বাস… কী যে হচ্ছে শমীকের আজকে!
— অ্যাঁ! এবার বোনটির অবাক হওয়ার পালা।
— খুব সুন্দর দেখাবে। আর ইমপ্রেসডও হবে। শমীক একটু হাসার চেষ্টা করল।
— কে?
— লন্ডনের ডবলডেকার। শমীক আর দাঁড়ায় না।
এর তিনমাস পরে। শীত প্রায় যাই যাই, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। শমীক, রাতুল আর অরুণাভ কলেজ থেকে বেরিয়ে রাধুদার দোকানে রোল খেয়ে জম্পেশ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে হেদোর পাশ দিয়ে আবার কলেজের দিকেই হাঁটা লাগিয়েছে, এমন সময়ে পিছন থেকে মিহি গলায় কেউ “এই যে... এইযে শুনছেন... এইযে আমি... আমি ডাকছি... আপনাকে নয়... ওই ওকে...”
রাতুল শমীককে ঠ্যালা মারে, এই, তোকে ডাকছে।
— আমায়? কে?
— ওই তো ওপারে... লাল শাড়ি...
ফিরে তাকাতেই শমীকের বুকে ধোঁয়া আটকে যায়। কেলো রে! রাস্তার ওপর পলাশের আগুন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে — বোনটি!! শমীক কাঁপা পায়ে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথ বদল করে।
— আপনি? মানে, তুমি? এখানে?
— আপনাকে দেখাতে এলাম।
— কী?
— শাড়িটা! বারে! আপনি যে বলেছিলেন, না দেখলে বুঝব কি করে ভালো লাগবে কিনা!
— তাই দেখাতে এলে? শমীকের অবাক হওয়া কেটে গিয়ে এবার পেট গুলিয়ে হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ভয়ে হাসতে পারছে না। হাসলে যদি পাগলির সাঁকো নড়ে যায়!
— হ্যাঁ । বোনটি একগাল হাসে। হাসলে আবার গালে টোলও পড়ে যে! শমীক কি এবার মরে যাবে?
— বেশ দেখাচ্ছে। কি করে জানলে এখানে আমায় পাওয়া যাবে?
— বারে! আমি যে বেথুন! কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তো বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে তোমায় ঝারি করি... তুমি এমন ক্যাবলা, দেখেও দ্যাখো না... কত সাধ্য সাধনা করে দিদির হাতে পায়ে ধরে তোমাদের দোকানে দিদির বিয়ের বাজার করতে রাজি করিয়েছি জানো? বাগবাজারে থেকে কেউ মধ্যমগ্রামে বিয়ের বাজার করতে যায়? নেহাত দিদিটার বিয়ে হয়ে যাবে বলে কেউ ওর সব আবদার ফেলতে পারেনি... তারপরে বিয়েতে কী হল জানো তো...
পাগলি তারপরেও অনেক কথা বলেছিল, কিন্তু শমীক কিছু শোনেনি।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)