Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে অনন্যা দাশের
লেখা


বই


ISSN 1563-8685




রিশিনের দুশ্চিন্তা

সোহমের কাছ থেকে কথাটা শোনার পর থেকেই রিশিনের মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় কিলবিল করতে লাগল। তাও তো ভালো যে সোহম এত কিছু জানে, রিশিন তো প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক করে বুঝে উঠতেই পারেনি। ওর মামার শরীরটা বেশ কিছুদিন ধরে খুব খারাপ যাচ্ছিল। এবারে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কেমন ঘুড়ি টুড়ি নিয়ে তৈরি হয়ে ছিল রিশিন আর সোহম যে ছাদে গিয়ে মামার সঙ্গে ওড়াবে কিন্তু মামার শরীরটা এতটাই খারাপ হল যে ছাদে ওঠা তো দূরের কথা বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছিলেন না মামা। অথচ গতবার বিশ্বকর্মা পুজোর সময় কী মজাটাই না করেছিল ওরা। এবারে রিশিন আর সোহমকে একাই ঘুড়ি ওড়াতে হল। আর ওটা মোটেই ভালো পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঘুড়ি কেটে কুটে একশেষ! রিশিনদের বাড়ির তিনটে বাড়ি পরেই থাকেন দাদু, দিদা আর মামা। রিশিন রোজ বিকেলে গিয়ে হাজির হয় মামার বাড়ি আর দিদাকে জিজ্ঞেস করে, “আজকে মামা কেমন আছে?”

দিদা শুকনো মুখ করে বলেন, “না দাদু, ওর শরীরটা একেবারেই ভাল নেই। খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। হাঁটা-চলা করতেও খুবই কষ্ট হচ্ছে। সাধারণ কাজকর্মগুলোও পাহাড়ের মতন ঠেকছে এখন ওর কাছে। কী যে হবে জানি না,” বলে দিদা আঁচলে চোখ মোছেন।

মামা ওদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে পারেন না, সাইকেল চালাতে পারেন না, এমন কী কথা বলতে বলতেও এত হাঁপিয়ে পড়েন যে গল্প পর্যন্ত বলতে পারেন না! আগে মামাই বাজার করতেন কিন্তু এখন আর পারেন না, দাদুকেই সব করতে হয়। ওই রকমটাই চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে।

তারপর সেদিন স্কুল থেকে ফিরে রিশিন দেখল, মার মুখ গম্ভীর। ওকে খেতে দিয়ে মা বললেন, “রিশিন আমি জানি না তুমি কতটা বুঝতে পেরেছো কিন্তু তোমার মামার হার্টের অসুখ হয়েছে। আজ সকালেই খবর এসেছে যে ডোনার পাওয়া গেছে। রক্তের টাইপও মিলেছে তাই মামাকে তড়িঘড়ি করে আজই প্লেনে করে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানকার একটা বড়ো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মামা। এখন অপারেশানটা চলছে। ডাক্তার বলছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো তোমার ছোটমাসি আর মেসো ওখানে থাকে। ওরাই তো দীপের নামটা দিল্লীতে ডোনার লিস্টে দিয়ে রেখেছিল।”

সব শুনে রিশিন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় মার ফোনটা বেজে উঠল। ওদের অন্য যে সব আত্মীয়স্বজনরা আছে তারা মাকে ফোন করে করে সব খবর নিচ্ছে তাই মা তাদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

রিশিন খাবারটা খেয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে সোহমদের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হল। সোহমের মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন। সোহম তাই স্কুল থেকে ফিরে এটা খাব না, সেটা খাব না বলে বলে ওদের সব সময়ের কাজের লোক রেখামাসিকে জ্বালাচ্ছিল। রিশিনকে দেখেই বলল, “রেখামাসি সারাদিন ধরে যত বিশ্রী জিনিস রান্না করে আর আমি স্কুল থেকে ফিরলেই আমাকে বিরক্ত করে! কোথায় শিঙ্গাড়া, চপ, নুডুলস, পিজা এই সব রান্না করবে তা না যত উচ্ছে, করলা, লাউ, বেগুন – ওয়াক!”

রেখামাসি হেসে ফেলল, “তোমার মা যা রান্না করতে বলেছে সেই সবই তো রেঁধেছি গো! আসুক মা ফিরে!”

হঠাৎ সোহমের খেয়াল হল রিশিন চুপ করে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তখন জিগেস করল, “তোর আবার কী হল ওই রকম মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দীপমামার শরীর আরো খারাপ হয়েছে নাকি?”

“মামাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মামার তো হার্টের অসুখ তাই হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

সোহম বিজ্ঞের মতন বলল, “ও! তা তুই হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের মানে বুঝিস?”

রিশিন ভয়ে ভয়ে বলল, “না, তেমন না। তুই কিছু জানিস?”

সোহম গলা নামিয়ে বলল, “রেখামাসি তো মা-বাবা অফিস থেকে ফেরার আগে পর্যন্ত টিভি সিরিয়াল দেখে। সেই রকমই একটা সিরিয়ালে দেখাচ্ছিল তখন দেখলাম।”

“কী দেখলি?” সোহমটা যেন কেমন! সব কথা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করতে হচ্ছে!

সোহম বিজ্ঞের মতন বলল, “একটা লোকের শরীর খারাপ হচ্ছিল, হার্টের অসুখ, ঠিক তোর দীপমামার মতন। তারপর কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া অন্য একটা লোকের হার্ট এনে ওর হার্টের জায়গায় বসিয়ে দিল ডাক্তাররা। অনেকক্ষণ ধরে অপারেশান চলল।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী, লোকটা বেমালুম বদলে গেল!”

“অ্যাঁ! বদলে গেল? বদলে গেল কেন বলছিস? সেরে উঠল বল!”

সোহম ঘাড় নেড়ে বলল “না, না, সেরে তো উঠল কিন্তু বেমালুম পালটে গেল! আগের মতন রইল না! বুঝলি না? তবে শোন। আমাদের ভালো লাগা খারাপ লাগা সব কিছু তো হৃদয়ের সঙ্গে জড়িত। অসুস্থ লোকটা আগে ভাল লোক ছিল। সবাইকে খুব সাহায্য-টাহায্য করত। সবাই তাকে খুব ভালবাসত কিন্তু যার হার্টটা পেল সে ছিল খুব খারাপ। তার একটা কম্পানি ছিল তাতে যারা কাজ করত তাদের সবাইকে খুব কষ্ট দিত সে। খুব কিপটেও ছিল, বদমেজাজি ছিল, সবাই তাকে বেদম ভয় করত। তাই যে লোকটা ওর হৃদয়টা পেল সেও ধীরে ধীরে ওর মতন হয়ে যেতে লাগল! তাই বলছি তোর মামাও বদলে যেতে পারে!”

সোহমের কথা শুনে রিশিনের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

সোহম এদিকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বলল, “খুব সাংঘাতিক ব্যাপার তাই না? ভাব যদি সেনজেঠুর মতন খিটখিটে হয়ে যায়, যে বাচ্চাদের একদম পছন্দ করে না, সব সময় তাদের নামে নালিশ করে! কালকেই খাট থেকে লাফিয়ে একবার নেমেছি, শব্দ হল কী না হল অমনি লাঠি নিয়ে এসে হাজির! মা-বাবাকে আবার সেই ক্ষমা চাইতে হল। মা তো জেঠু চলে যাওয়ার পর রেগে বলল এখান থেকে চলে গিয়ে অন্য কোথাও একতলাতে বাড়ি নিতে হবে আমার জ্বালায়!”

রিশিনও মুখ চুন করে বলল, “অত খারাপ না হলেও রজাদার মতনও তো হয়ে যেতে পারে। সব সময় পড়ছে, খেলাধুলো করে না, কোন জোক্স বোঝে না! তাহলে তো আমাদের সঙ্গে আর কোনদিন ক্রিকেট খেলবে না বা ঘুড়িও ওড়াবে না!”

“বা ওই লাল্টুদার দোকানে বসা লোকটার মতন হয়ে যায় যদি? সব সময় চিৎকার করে আর গালাগালি দেয়?”

দুজনে মিলে সেই নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করল।

রাতে দিল্লি থেকে খবর এল যে অপারেশান সফল হয়েছে। মা-বাবা তো শুনে ভীষণ খুশি হলেন। রিশিনও খুশি হল, তবে পুরোপুরি খুশি হতে পারল না। অথচ মা-বাবাকে অত খুশি দেখে নিজের দুশ্চিন্তার কথা ওদের বলতেও ইচ্ছে করল না।

মা-বাবা প্রায়ই দিল্লিতে ফোন করেন। মাঝে মাঝেই রিশিন শোনে ওনারা বলছেন মামা বদলে গেছেন। বাবা তো অফিসের টুরে দিল্লি ঘুরে এসে বললেন, “যে দীপ এখান থেকে গিয়েছিল তার সঙ্গে আজকের দীপের কোনও মিলই নেই!”

শুনেই তো রিশিনের বুকটা ধক করে উঠল। মামা কি তাহলে সত্যিই বদলে গেছেন? কিন্তু বড়োরা তো আর বুঝতে পারবে না ছোটদের পছন্দ করছে কিনা কেউ। সেটা শুধু ছোটরাই বোঝে! ছোটমাসিদের বাড়িতে কোন বাচ্চা নেই তাই বুঝবেই বা কী করে!

রিশিন একদিন স্কুলে থেকে ফেরার পথে দেখল ব্যানার্জীকাকু একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করছেন কয়েকটা টাকার জন্যে।

বেচারা রিকশাওয়ালা মিনমিন করে বলছে, “আর মাত্র দুটো টাকা দিন বাবু!” তাতেই ব্যানার্জীকাকু রেগে যাচ্ছেন!

মামা ওই রকম হয়ে যাবেন না তো?

তিন মাস পরে মামা ফিরে এলেন। এই তিন মাস রিশিন খুব ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে, কী হবে না হবে ভেবে। সেদিন রিশিন স্কুল থেকে ফিরতেই মা বললেন, “তোমার দীপমামা ফিরে এসেছে! যাবে নাকি একবার দেখা করতে? তাহলে খেয়ে দেয়ে ঘুরে এসো একবার।”

রিশিন খেয়ে দেয়ে বাড়ি থেকে বের হল বটে কিন্তু একা যেতে সাহস করল না। সোহমের বাড়ি গিয়ে তাকে অনুরোধ করল, “এই সোহম, মামা ফিরেছে। আমি দেখতে যাচ্ছি। তুই আমার সঙ্গে যাবি?”

দুই বন্ধুতে চোখাচোখি হল।

ওরা যেতে দিদা হাসি মুখে দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “এসো দাদু! ওমা আবার সোহম দাদুভাইকেও নিয়ে এসেছ! তা ভালোই করেছ। যাও মামার ঘরে চলে যাও, ঘরেই আছে দীপ।”

দুজনে আস্তে আস্তে মামার ঘরে গিয়ে ঢুকল। মামা তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছেন মনে হল।

একি চেহারা হয়েছে মামার! সত্যিই মামা পালটে গেছেন! স্বাস্থ্যটা অনেকটা ভালো হয়েছে কিন্তু মাথাটা মনে হয় কামানো হয়েছিল ওখানে তাই মাথা ভর্তি খোঁচা খোঁচা চুল, মুখময় দাড়ি! সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে বলে চোখগুলো লাল লাল! রিশিনের তো বেশ ভয়ই লাগছিল।

ওদের দেখেই মামা গম্ভীর গলায় বললেন, “এই যে তোরা এসে গেছিস! তোদের কিন্তু আমার মোটেও পছন্দ নয়! একটা কিছু যদি ঠিক করে করতে পারিস!”

রিশিং আর সোহমের তো ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কী বলছেন মামা? কী করতে পারেনি ওরা?

মামা বলে চলেছেন, “আমি তিন মাসের জন্যে দিল্লি গেলাম আর তোরা ইন্ডিয়াকে সিরিজটা হারিয়ে দিলি!” বলে হা হা করে হাসল মামা। তারপর বলল, “কি রে দুজনে কোণে ভূত দেখার মতন দাঁড়িয়ে রইলি কেন? আয় বোস!”

পরক্ষণেই চিৎকার করে দিদাকে বলল, “মা, রিশিন আর সোহমের জন্যে দিল্লি থেকে যে-সব জিনিসগুলো এনেছি সেগুলো বার করে দাও তো!”

মাসদুয়েক পরে যখন রিশিন আশ্বস্ত হল যে মামা সত্যিই বদলে যাননি তখন একদিন সাহস করে মামাকে কথাটা বলল চুপি চুপি। মামা তো ওর কথা শুনে হেসেই খুন!

বলল, “তুই ভাবছিলি আমি বদলে যাব? দূর বোকা! আমাদের বাড়িতে মাটির নিচ থেকে জল তোলার যে পাম্পটা আছে সেটাকে দেখেছিস? আমাদের হার্ট তো সেইরকমই একটা পাম্প, শুধু রক্তমাংসের তৈরি আর রক্ত পাম্প করে! ওই সব সিনেমা সিরিয়ালের সব গল্প যদি বিশ্বাস করিস তাহলে তো আর দেখতে হবে না। যত্ত রকম আজগুবি জিনিস দেখায়!”

বলে মামা নিজের মাথা টোকা মেরে বলল, “কে কী রকম হয় সেটা এইখান থেকে ঠিক হয়, বুঝেছিস? যতদিন না আমার ব্রেন ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে ততদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস যে আমি বদলাব না!”




(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)