সকলেশপুর নামটি এমন বাঙালি বাঙালি হলে কী হবে, স্থানটি যে প্রত্যন্ত দক্ষিণে এটা তো জানা ছিল না। ব্যাঙ্গালুরু এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ভাড়া করেছি কড়কড়ে চারটি হাজার টাকা গুণে। শীগগির পৌঁছুতে হবে। সওয়া দু’শ কিলোমিটার পথ। একলাই যাবো। ব্যাঙ্গালুরু থেকে ম্যাঙ্গালোর বন্দরে যাবার সোজা পশ্চিমমুখী যে এন এইচ ৪৮---সে-পথ ধরে সাড়ে চার ঘণ্টার সফর সকলেশপুর।
অত্যন্ত শর্ট-নোটিশে এখানে আসা, এক এস ও এস পেয়ে! কারণটা পরে বলছি। তবে এসে বুঝলাম, ভুল করিনি। অতীব চমৎকার সবুজে-সবুজ ছবির মত পাহাড়ি-শহর এই সকলেশপুর। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ওপরে, উচ্চতা তিনহাজার ফুট। শান্ত মনোরম পাহাড়ি শহরটি---উটিকে যেন হার মানায়। চারিদিকে কফি, এলাচ আর মরিচের বাগান। অপূর্ব এক সুবাস আকাশে-বাতাসে---এটি বড় ইউনিক! কলকাতা থেকে ভোর ছ’টা বিশে উড়ে ইন্ডিগো সাড়ে দশটায় নামালো ব্যাঙ্গালুরু। সকলেশপুরে রঘুরামাইয়া-সাহেবের বাগানঘেরা বাংলোয় যখন ঢুকছে আমার ট্যাক্সিটা তখনও সন্ধে ছ’টা বাজেনি। জুলাইমাসের লম্বা দিন তখনও যথেষ্ট আলোকোজ্জ্বল। আজ রথযাত্রা। অনেক জায়গায় ছুটি থাকে। আমাদের নয়। আমি ছুটি নিয়ে এসেছি।
পুরো নামটি তাঁর কাশীনাথুনি রঘুরামাইয়া---এটা পরে জেনেছি। ‘কে আর আর’ বলেই ইন্ডাস্ট্রিতে বিখ্যাত ছিলেন। আমরা রামাইয়া-সাহেব বলতাম। উনি যখন ব্যাঙ্কের চাকুরি থেকে রিটায়ার করেন, আমরা তখন সবেই কয়েক বছর মাত্র হল জয়েন করেছি। ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ব্যাঙ্কের ইন্ডাকশন-ট্রেনিং আমাদের তাঁরই কাছে পাওয়া। বেঁটেখাটো নাদুসনুদুস চেহারা হলে কী হবে, ওঁর পুরু প্লাস পাওয়ারের চশমা দিয়ে তাকানো দেখে আমরা ভয় পেয়ে যেতাম। গম্ভীর মানুষ। মানুষ কিন্তু অসাধারণ---নীতিবান, পরোপকারী ও যত্নশীল। তাঁর লেখা ব্যাঙ্কিং ল’-এর কেতাব আজও বহুপাঠ্য। স্বল্পবাক মানুষ। আমি আবার ব্যক্তিগতভাবে রঘুরামাইয়া-সাহেবের কাছে ঋণী ছিলাম এক বিশেষ কারণে। একবার এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে আমায় উনি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন । ব্রাঞ্চ-ব্যাঙ্কিং-এর কাজে ক্যাশ-শর্টেজ মস্ততম অপরাধ। আমার ব্রাঞ্চে একসন্ধ্যায় সেইটেই ধরা পড়লো । আমি তখন ট্রেনি-অফিসার মাত্র। আমাকে জুনিয়র পেয়ে স্কেপগোট করার এক চক্রান্ত হয়। রামাইয়া-সাহেব তদ্দিনে এইচ আর-এর জি এম হয়ে পড়েছেন। বুক দিয়ে আগলান আমায় তাবড় তাবড় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যুঝে। বাঁচিয়ে দেন---কারণ উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এতে আমার কোনো দোষ ছিল না। আমার জেল হয়ে যেতে পারতো উনি না থাকলে। আজীবন তাই ওনার কাছে কৃতজ্ঞ রয়ে গেছি আমি। আজ এতো বছর পরে দু’দিনের নোটিশে নিজব্যয়ে এদ্দূর আমার উড়ে আসার পেছনে সে-কারণটাও কাজ করেছে বটে।
কে রঘুরামাইয়া রিটায়ার করে গেছেন আজ ঠিক বারো বচ্ছর হল। এতো বছরেও হোলি-দীওয়ালী-ন্যুইয়ারে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ধারায় ফাটল ধরেনি। এখন তো ফেসবুক-হোয়াটসএপের সুবিধে এসে গেছে। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ রঘুরামাইয়া-সাহেব ওয়েব-স্মার্টফোনেও দিব্যি সড়গড় হয়ে উঠেছেন দেখে বধাই দিয়েছি ওনাকে।
পরশু ভোর ছ’টায় এ’হেন এক্স-বসের কাছ থেকে ভয়েস কল পেয়ে যথেষ্ট অবাক হয়ে যাই। কারণ ওনার সঙ্গে যোগাযোগ মেসেজেই হয়, কথা হয়ইনা প্রায়। সাতসকালে তাঁর কল? গলার স্বর শুনে আরও ঘাবড়ে যাই। এতো ভেঙে পড়েছেন কেন উনি? ওঁর টিপিক্যাল দক্ষিণী উচ্চারণে সনির্বন্ধ অনুরোধ, "বাআট্টাচারিয়া, উইল ইট বি পাআসিবল ফ উ টু..."
অবশ্যই পাআসিবল। পিতৃতূল্য বৃদ্ধ বস্ কোনো বিপদে পড়ে ডেকে পাঠিয়েছেন, কী করে উপেক্ষা করি তাঁকে? বিশেষতঃ, আমার এক ঘোর বিপদের দিনে যখন উনি সহায় হয়েছিলেন?
শহরের চৌহুদ্দির বাইরে বাগানঘেরা মস্ত বাঙলো-টাইপের একতলা বাড়ি। কাঠের। একাই থাকেন রঘুরামাইয়া-সাহেব। সঙ্গী বলতে এক পুরনো ভৃত্যমাত্র। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হল। তখন অবসর-উপরান্ত কর্তা-গিন্নি আসামে থাকতেন একমাত্র পুত্রের কাছে। ছেলে আর্মিতে এখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। আমারই বয়সী হবে। বসার ঘরের পিয়ানোর ওপরে ছেলের ফুল ইউনিফর্ম ফোটো রয়েছে স্ট্যান্ডে, স্ত্রীরটির পাশেই। ওনার স্ত্রীকে আমিও একবার দেখেছিলাম। দেড়-দশক আগে কলকাতায় আমার বিবাহ-অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন যে রঘুরামসাহেব। দক্ষিণীদের মধ্যে এমন স্বর্ণাভ গৌরবর্ণা কম দেখতে পাওয়া যায়।
".....আমরা, আসলে, বুঝলে বাআট্টাচারিয়া, গুন্টুরের লোক। আজকের অন্ধ্রপ্রদেশে। ঠাকুর্দা এলাচের বাগান কিনে এই হাসান-জেলায় চলে আসেন ১৮৯০এ’। আমি অবশ্য ছোটবেলা থেকে হস্টেলে হস্টেলেই বেশি থেকেছি....।"
আসল কথায় আসছেন না দেখে আমার উশখুশানি ধরতে পেরেছেন পাক্কা এইচ.আর ম্যান। এবার কাজের কথায় এসে পড়লেনঃ "বড় ভয়ংকর বিপদে পড়ে তোমার শরণাপন্ন হয়েছি ইয়ংম্যান। আর কাকেই বা বলতে পারতাম? বড় ভয়ের কথা, বড় লজ্জার কথা ... আমার জেল হয়ে যেতে পারে...। আমি জানি, সন্তোষ, তোমার বাবা-কাকারা কলকাতার টপ ল’ইয়ার---ক্রিমিন্যাল সাইড, তাই না? অতএব ভাবলাম ..."
কান খাড়া আমার। এবার আর উশখুশানি নেই কোনো। কী হয়েছে ওনার? কেন এই ইমারজেন্সি কল? ‘আই জে জাতীয়-ব্যাঙ্কে’র রিটায়ার্ড জেনারেল ম্যানেজার কে. রঘুরামাইয়া, যাঁকে অদ্যাবধি মানুষ শ্রদ্ধা করে চলে, কী এমন দোষ করেছেন তিনি যে...
"স্যর, আমায় সব খুলে বলুন। আপনার সব কথা শুনব বলেই না এদ্দূর উড়ে এসেছি। কী ঘটেছে? জেলে যাবার প্রসঙ্গ উঠছে কেন?"
"কী বলি সন্তোষ... কোত্থেকে শুরু করি...?" বলতে থাকেন উনি। সন্ধে আটটা-টাটটা বেজেছে হয়তো তখন সবে। সূর্য অস্ত গেছে। ফ্রেশ-টেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বারান্দার বেতের সোফায় বসে চলছিল আমাদের বাক্যালাপ। বলে চলেন রামাইয়া-সাহেব, "বুঝলে হে, এই বার্ধক্যে এসে সহধর্মিণীর অভাবটাই সবচেয়ে বেশি করে অনুভব করি... রাধা ছিল আমার প্রতিবেশী ও বাল্যবান্ধবী, আমার পিতৃবন্ধুর কন্যা। বাবারা দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিবাহ দেন এই শহরেই। দীর্ঘ চারদশকের দাম্পত্যজীবন ছিল আমাদের... একদিনের তরেও মনোমালিন্য হয়নি। হবে কী করে? এত পেলব-স্বভাবের মানুষ ছিল রাধা..." দুঃখী-উদাস হয়ে পড়েন বৃদ্ধ।
কীই বা সান্ত্বনা আছে এর? কিন্তু সমস্যাটা কী? আমায় ডাকলেন কেন? আবার কথায় কথায় অন্য গল্পে সরে যাচ্ছেন কেন? আমার ফের উশখুশানি।
এক পরিচারিকা এসে ট্রে-তে করে কফিপট, কাপ-ডিশ, কুকিজ এনে নামিয়ে রাখলো সামনের টেবিলে। ঢালতেই টাটকা কফির গন্ধে মাতোয়ারা! পরিচারিকাটি নিতান্তই বালিকা। কৃশাঙ্গী, আবলুশ-কালো গাত্রবর্ণ। বয়সের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গিনী। পরনে ধবধবে সাদা সালোয়ার-কুর্তা। লাবণ্যময়ী। রামাইয়া-সাহেব তাকে দক্ষিণীভাষায় কিছু বলতে সে বাধ্যভাবে দু’-পাশে সম্মতির ঘাড় হেলিয়ে চলে গেল।
বালিকাটির অপসৃয়মান গতিপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মিনিটখানেক পরে উনি বললেন আমাকে, "দেখলে, সন্তোষ, মেয়েটিকে দেখলে?"
দেখলামই তো। এতে এতো দেখবারই বা আছেটা কী? ভাবি।
“ইনিই আমার ধর্মপত্নীঃ রাধা!”
এঁঃ!! ক্ক...ক্কী বললেন উনি? চমকে কিছুটা কফি চলকে পড়ে গেল আমার পিরিচে, কিছুটা পরনের সাদা পাঞ্জাবীর ওপরেও। "কী... কী বলছেন স্যর? এই বালিকা আপনার ধর্মপত্নী? আপনার স্ত্রী না পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন?"
"হ্যাঁ"--যেন বহু দুঃখে ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়েন উনি, "হ্যাঁ সন্তোষ, এটাও সত্যি ওটাও সত্যি।"
"কী করে সত্যি, স্যর? আপনি কি এই বয়সে ফের..."
"না, মিঃ বাআট্টাচারিয়া, তা নয়। আমি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিনি।"
"তবে? তবে?" আমি কফি খেতে ভুলে গেছি।
"বলছি, বলছি তোমায় সব।
'শুরুটা এই ভাবে হয়েছিলঃ এই ধরো,... দিনের মধ্যে দশবার চশমা হারানো আমার বহুকালের বদ-অভ্যাস। এই বাগানে খুলে ফেলে চলে এলাম তো এই কাবার্ডের ওপরে তো ওই বাথরুমের ভেতরে। মাসখানেক আগে এই সোফাটায় এসে বসেছি, সকালের কাগজখানি পড়বো... এ’পকেট ও’পকেট...চশমা আর খুঁজে পাই না। বাগানে কি ছেড়ে এলাম, না বাথরুমে, ভাবছি। আর তক্ষুনি ওই মেয়েটি আমার চশমাটা এনে এই টেবিলের ওপরে ঠক্ করে রেখে দিলো, আর গলায় বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বললে, 'চশমাটা ঠিক জায়গায় রাখা আর কবে অভ্যেস করবে?' ‘আপনি’ নয়, একেবারে ‘তুমি’! চশমা পেয়ে খুশি হবার বদলে তার গলায় কর্তৃত্বের সুরে অবাক হয়ে গেলাম আমি। বাচ্চা এক পরিচারিকা আমার সঙ্গে এই সুরে কথা বলার সাহস পায় কী করে? আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে ওপাশে চলে যেতে যেতে বলে গেল, ‘আজ শনিবার। রাতে জোলাপ খেয়ে শুতে ভুলো না।’ শুনে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। আমার এ’পুরনো অভ্যেসের কথা জানলো কী করে এই নতুন ঝি? গত শনিবার খেতে ভুলে গেছি—এটাও তো বটে।
আমার খাসচাকর রামনকে তখনই তলব করে জানা গেল, বাগানের কাজে তাকে সাহায্য করার জন্যে এক মালিনী রাখা হয়েছে সম্প্রতি, এটি তারই কন্যে।
"সেই আমার অবাক হবার শুরু। তারপর থেকে কী বলব তোমায় সন্তোষ, আমার জীবনের প্রতিটি গোপনীয় কথা, খাস-অভ্যেস, সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা, স্বামীস্ত্রীর অন্তরঙ্গ বিষয়--কিছুই এই মেয়েটির অজানা নেই। আর কী কর্তাত্বির সুরে কথা বলা তার, যেন ঘরের মালকিন সে-ই। দাসীর কন্যা। চাইলে এক মুহূর্তেই বিদায় করে দিতে পারি তাকে--সেটা কি সে জানে না? কিছুদিন আগে ঠিক এই ভাবনাটাই যখন আমার মনে এসেছে---সন্ধেবেলায় ঐ রাইটিং টেবিলে বসে ভাবছি, কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়ে অসংকোচে আমার দু’কাঁধে হাত রেখে আলগোছে মাথাটা টেনে নিয়েছে তার বুকে। চমকে ছাড়াতে গিয়ে অনুভব করেছি যে এই সঙ্গ বড্ড উপভোগ করছি আমি। পিছন থেকে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, ‘চলে যাবো? বলো, আমি চলে যাবো? তুমি বললেই আমি চলে যাবো।’
"না, সন্তোষ, না, আমি তাকে চলে যেতে বলতে পারিনি। বরং গভীর আবেগে কুর্সিখানি ঘুরিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে দু’হাত আঁকড়ে ধরে শুধিয়েছি, 'কে তুমি? তুমি কে? কোত্থেকে এলে?’
"'যাঃ ছাড়ো আমার হাত। যেন চেনো না আমায়...’ বলে আমার বুকের চুলে একটু বিলি কেটে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল সেই ছলনাময়ী!
"সেই থেকে শুরু, সন্তোষ, সেই থেকে আমার জীবনটাই আমূল পালটে দিয়েছে ঐ কন্যে। সারাদিন আমার প্রতি পল প্রতি অনুপল দখল করে আছে রাধা।"
"রাধা?’ মশুগুলতা ভেঙে শুধোই আমি।
"হ্যাঁ, 'রাধা'", বললেন রামাইয়া-সাহেব, "শোনোই না... এর কয়েকদিন পরে আমি বাগানে সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ফিরছি। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে দূর থেকে শুনি পিয়ানোতে ফিফথ সিম্ফনি... আমার অবাক হবার কি আর শেষ হবে না? অনপড় গ্রাম্য বালিকা দেখি অসাধারণ দক্ষতায় এই পিয়ানোটি বাজিয়ে চলেছে। মনে পড়ল, চাকুরিজীবনে বম্বেতে থাকাকালীন গৃহিণী এক গোয়ানিজ পিয়ানিস্টের কাছে বহু বছরের তালিমে...আমি দৌড়ে ঘরে ঢুকে ‘রাধা...রাধা...’ বলতে বলতে...সে বাজনা থামিয়ে সিটিং স্টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর নির্দ্বিধায় বাহু উন্মুক্ত করে এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করল আমাকে...গভীর চুম্বনে ভরিয়ে দিলো আমার অধরোষ্ঠ! ভরিয়ে দিলো, ভরিয়ে দিলো আমাকে...সেই পরিচিত দেহঘ্রাণ...সেই ভঙ্গিমা...নেশাগ্রস্তের মত তার দিকে তাকিয়ে দেখি গলায় তার একগাছি মুক্তোর মালিকা...! ক্ষোভভরা কণ্ঠে বলে উঠল সে, 'দিনটা এবারও ভুলে গেলে জি এম সা’ব? ...আজ যে সাতুই আষাঢ়!’ মনে পড়ল, আমাদের পঁচিশতম বিবাহ-বার্ষিকীতে রাধাকে আমি এক মোতিহারই উপহার দিয়েছিলাম বটে।"
দীর্ঘ কাহানির শেষপ্রান্তে এসে শ্রান্ত বৃদ্ধ দু’হাতে মুখ ঢেকে সোফার পিঠে হেলান দিয়ে পড়েন। বলা বাহুল্য, আমার বিস্ময়ের আর অবধি ছিল না, তার মধ্যে অবিশ্বাস বারো আনা। সত্যি, এ’গপ্প আমার গুরু কে. রঘুরামাইয়ার মুখে না শুনলে ভাবতাম কোনো জোচ্চোরের পাল্লায় পড়েছি, যার অসদুদ্দেশ্যটা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ওনাকে কিছুক্ষণ জিরোতে দিয়ে এবার সরাসরি বললাম, "স্যর, এতোক্ষণ আপনি যে গল্প শোনালেন, তাতে অলৌকিকতা থাকতে পারে কিন্তু কোনো ক্রিমিন্যাল অফেন্স নেই। কিন্তু আপনি সেই পার্টিকুলার কারণেই না আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন, আমার বাবা-কাকার সঙ্গে লিগাল-কন্সালটেন্সি করতে চাইছেন? তাহলে, এই গল্পের সিকুয়েল হিসেবে আমি যা অনুমান করছি তা কি সত্যি?"
অনেকক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর বৃদ্ধ বললেন, “হ্যাঁ, সন্তোষ, আমি মানছি, আমার আরও সংযত হয়ে থাকা উচিত ছিল। আমার বয়স, উচ্চ সামাজিক সম্মান, আমার পুত্রের সম্মান...সব...সব কিছু জলে দিলাম? দেশের আইন তো আমায় ক্ষমা করবে না...তার চোখে তো আমি ক্রিমিন্যাল! এ’তো অপরাধ, কানুনি অপরাধ...নাবালিকার সঙ্গে...না না সন্তোষ, বলো আমার এখন কী করা উচিত? আমি কি...? কৃতকর্মজনিত সব লজ্জা ভুলে আমার এখন আইনি উপদেশ চাই, যেটা এই ছোট্ট শহরে পাওয়া যাবে না। আর...আর...এর ফলস্বরূপ যদি সে হয়ে পড়ে...না না ওকে বালিকা ভেবো না...ও ঋতুমতী...!!"
অনুমান করি, এ’ পরশুর আগের রাতের ঘটনা। যার পরেই কাকভোরে উনি আমায় ফোনে জরুরি তলব করেন।
মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম রাত দু’টো বাজে। ঘুম আসছে না। আসা সম্ভবও নয় রঘুরাময়াইয়া-সাহেবের ঐ গল্প শুনে। ফের বলি, এ’কহানির বক্তা উনি না হয়ে অন্য কেউ হলে তাকে ঠগবাজি বলে উড়িয়ে দিতাম আমি। বুড়োবয়সে ওনার ভীমরতি ধরে থাকতে পারে কিন্তু উনি তো আর পাগল হয়ে যান নি। ওনার অবসর জীবনের কর্মহীনতা, বিপত্নীক অবস্থা, মনে নানান কল্পনার জাল বুনে থাকতে পারে। কিন্তু সত্যিই উনি ভয় না পেলে, বিপদ আঁচ না করলে আমা-হেন জুনিয়র এক অফিসারকে ডেকে এতো কথা শোনাবেন কেন? আচ্ছা, সাহেব কোনো লুক্কায়িত শত্রুর পাল্লায় পড়েননি তো, যে বা যারা ভেতর থেকে ওনার সব খবর নিয়ে এসে ওই মেয়েটিকে লেলিয়ে দিয়েছে কোনো গূঢ় ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে? লক্ষণীয়, কোনো জাতিস্মরের গল্পের সঙ্গে খাপ খায় না রামাইয়া-সাহেবের এই অভিজ্ঞতা, কারণ হিসেবমত ওনার স্ত্রীর মৃত্যুর সময় এই মেয়েটি পাঁচ-সাত বছরের ছিল।
হঠাৎ বাইরে থেকে কেমন এক হালকা ছট্ ছপ্ ছপ্ শব্দ শুনে চিন্তার রেশটা কেটে গেল। কোনো বেড়াল-টেড়াল ঢুকেছে বোধহয়। গরমও লাগছিল খুব। বৃষ্টি হয়নি, কিন্তু ভ্যাপসা। ঘরের দরোজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এসে শব্দটা ডানদিক থেকে আসছে মনে হল। দু’পা হেঁটে বাঁক ঘুরে জ্যোৎস্নাধোয়া মধ্যরাত্রে দেখি প্রশস্ত বারান্দার কাঠের মেঝেয় খড়ি দিয়ে চৌখুপ্পি চৌখুপ্পি ঘর কাটা রয়েছে--এক্কা-দোক্কা খেলার ঘর, আর তাতে এই মাঝরাতে একা একা আপনমনে একপায়ে ডিঙি মেরে লাফিয়ে লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলে চলেছে সেই বালিকা। ছাদ থেকে ঝুলন্ত এক হলদে বাল্ব ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। মেয়েটির মাথায় পনিটেল, পরনে দুধ-সাদা ফ্রক--ছপ্ ছপ্ ছট্ করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দূরে-দূরের ঘরে ফেলছে হাতের এক গুচ্ছবাঁধা সেফটিপিন-জাতীয় কিছু বস্তুর ড্যালা আর মুখে মৃদু স্বরে ধ্বনি, ‘কিত্ কিত্ কিত্ কিত্’।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি মধ্যরাত্রে সেই বালিকার আপনভোলা খেলা দেখে। কতক্ষণ দেখেছি জানিনা, কারণ আমাতে আমি ছিলাম না তখন। পরিবেশটা ভাবো, বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিরালা-নিঝঝুম মধ্যরাত্র। চারিভিতে মস্ত মস্ত মহীরূহের জঙ্গল। এক শতাব্দী-প্রাচীন বাংলো-বাড়ি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। কেউ কোত্থাও নেই .... এক অবাক-বালিকা একা একা ক্রীড়ামগ্ন!
হঠাৎ এক রাতজাগা পাখির কর্কশ চীৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
মেয়েটিও চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটি সম্পূর্ণ অন্ধ! চোখে মণি নেই কোনো--যেন বিলকুল সাদা পাথর!!!
এমন সময় মাথার ওপর থেকে ‘খিঁক খিঁক’ হাসি শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি বারান্দার উঁচু চালের কাছে কাঠের ফ্রেমের জয়েন্টে বসে আপন মনে হেসে চলেছেন ‘আই জে জাতীয় ব্যাঙ্কে’র রিটায়ার্ড জি এম শ্রী কাশীনাথুনী রঘুরামাইয়া, নিচু গলায় জপছেন, ‘রাধা, রাধা, রাধা, রাধা’।
চোখে সেই পুরু প্লাস-ফাইভ চশমা।
গলায় এক ছড়া মুক্তোর মালা!
(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)