যে নিশুতি রাতে আকাশে চাঁদ ওঠে না, একটা তারাও দেখা যায় না, অন্ধকার এতো ঘন হয়ে থাকে যে নিজের হাত-পাও ঠাওর করা যায় না—চারিদিক হয়ে থাকে নিথর নিস্তব্ধ—ত্রিসীমানায় কোনো মানুষের চিহ্ন মাত্র দেখতে পাওয়া যায় না—তখন যদি মনে করো যে জগতে কেউ কোত্থাও নেই—তা কিন্তু সবসময় সত্যি নয়। কারণ ঠিক সেই সময়েই হয়তো তোমার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়ে পড়বে ও—ফিসফিসিয়ে বলবে কিছু কথা—হয়তো নিজের কথাই—কিংবা আবোলতাবোল কিছু —যেমন সে বলেছিলোআমায়—অনেকদিন আগে। সেসব যদি ওর নিজের কথাই হয়—তাহলে তা সত্যি—না মিথ্যে—না একেবারে আজগুবি তা আমি কোনোদিনই বুঝতে পারিনি। কিন্তু যেমনটি শুনেছি, তেমনটিই বলার চেষ্টা করছি এখন।
গল্পের শুরুটা হচ্ছে এক বিদ্বান মানুষকে নিয়ে। এইভাবে—
“যাও। ভিতরে যাও। ঘরের ভিতরে যাও। গিয়ে দ্যাখো কে আছে ঘরের ভিতরে—কি করছে সে ওখানে—আর কারা আছে—তারা কে কি করছে—সব গিয়ে দ্যাখো। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না দরজার সামনে। ঢুকে যাও ভিতরে। কি হোলো—ঢুকছো তো”?—কথাগুলো বললেন আমাদের গল্পের সেই বিদ্বান মানুষটি। ধরা যাক তাঁর নাম অচিন্ত্য রায়।
অচিন্ত্য রায় পণ্ডিত মানুষ। সেইসঙ্গে ভাবুক কবি দার্শনিক ও লেখক। কিছুদিন যাবৎ এসে উঠেছেন তাঁর এক বন্ধুর এক ফাঁকা বাড়িটিতে। কি এক লেখার তাগিদে। অচিন্ত্যবাবু একা মানুষ। কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই। কদিন যাবৎ চুপটি করে বসে আছেন দোতলার ঘরটিতে। আর তার লাগোয়া বারান্দায়। অচিন্ত্যবাবু কখনো সখনো বিশেষ কিছু লেখার সময় এইভাবে কোনো নির্জন আস্তানায় চলে যান। এই বাড়িটিও তেমনি।
এটি হোলো একটি পুরোনো শহরের সেকেলে পাড়ায়। লোকজন এখানে এমনিতেই খুব কম। এই সময়টায় এই অঞ্চলে আবার বেজায় গরম। দিনের বেলায় লোকজন বিশেষ বেরোতেই পারে না। সার সার বাড়িগুলো দরজা জানালা এঁটে থুম মেরে বসে থাকে। বিকেলের পর সূর্য ডুবলে, সন্ধের ছায়া নামলে খুটখাট করে খুলে যায় এইসব বন্ধ জানালা পাট। মানুষজন টুপটাপ বেরিয়ে পড়ে রাস্তাঘাট দোকান বাজারে। দেখা যায় এদিক ওদিক নানান মানুষের ছোটো বড়ো জটলা। তাদের আশেপাশে লেগে থাকা স্নিগ্ধ ছায়া। আর সবকিছুর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভারি মোলায়েম মিষ্টি বাতাস। অচিন্ত্যবাবু বারান্দা থেকে খুব মন দিয়ে দেখেন এইসব তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপার স্যাপার।
এইভাবেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর বারান্দার মুখোমুখি বাড়িটির জানালাগুলো কখনোই খোলা হচ্ছে না। প্রথমে তাঁর মনে হোলো যে তাহলে কি কেউ থাকে না ওই বাড়িটিতে? তারপর তিনি ভেবে দেখলেন যে তা কখনোই হতে পারে না। কারণ ও বাড়িতে কেউ না থাকলে জানালার সামনের রঙীন ফুলগাছগুলো অমন তাজা থাকছে কি করে? নিশ্চয়ই কেউ জল দেয়। পরিচর্চা করে। কিন্তু কে সে? ঘরে থাকে অথচ কখনোই বেরোয় না এতো ভারী আশ্চর্য বিষয়। কিন্তু কেন? বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন তিনি। আর সেইসাথে প্রতিদিনই দীর্ঘক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতে লাগলেন সেই অজ্ঞাত মানুষটিকে দেখার আশায়। কিন্তু দেখা মিললো না কারুরই।
কদিন বাদে এক মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ তাঁর চোখ চলে গেলো সামনের বাড়ির জানালার দিকে। আর তখনই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। ওপাশের জানালার পর্দার আড়ালে যেন বিদ্যুৎরেখার মতো মুহূর্তের জন্য দেখা দিলো এক অসামান্য রূপসী মেয়ের চেহারার আভাস। তারপরেই বন্ধ হয়ে গেলো সেই জানালাটা। অচিন্ত্য ভাবলেন যা দেখলেন তা সত্যি নাকি তাঁর নিজের মনের কল্পনা?
পরদিন সকাল থেকে বারবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন অচিন্ত্য রায়। ওদিককার জানালাগুলো আগের মতোই বন্ধ। সন্ধের পর দেখা গেলো ও বাড়ির একটি জানালা খোলা হয়েছে। কিন্তু সেই খোলা জানালার ওপারে যেন গাঢ় অন্ধকার। অচিন্ত্য খুব আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় এলেন। কিন্তু নাহ্। কাউকেই দেখা গেলো না এক মুহূর্তের জন্যেও। সন্ধেতেও নয়। রাতের বেলাতেও নয়। এইভাবে কটা দিন কাটলো।
তারপর হঠাৎ এক সন্ধেবেলায় নিজের ঘরের আলো জ্বালিয়ে অচিন্ত্য যখন এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় তখন তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁর নিজের ছায়াটা কিরকম লম্বাভাবে এসে পড়েছে উল্টোদিকের ওই বাড়ির বারান্দায়। এবং সেই জানালাটার উপর। নিজের ছায়াটাকে এইভাবে দেখে ভারী আশ্চর্য লাগলো তাঁর।
তারপরেই তাঁর মনে হোলো এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কি আছে। যে কোনো জিনিসের পিছনে জোরালো আলো থাকলে তার ছায়া তো সামনের দিকে পড়বেই। বিজ্ঞানের এই সহজ সূত্র ধরে তার ছায়াটা পড়েছে সামনের বাড়ির দেওয়ালে। বন্ধ জানালার সামনে। এইভাবে ওই ছায়াটির দিকে তাকিয়ে কেন কে জানে ভারী মজা লাগলো তাঁর। আর সেই সাথেই তাঁর কেন যেন মনে হোলো যে ওই বাড়িতে এখন কেউ নেই তাঁর নিজের ওই ছায়াটা ছাড়া। তখন অচিন্ত্য যেন মস্করা করেই ওই ছায়াটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন—“চমৎকার! অতি চমৎকার! তা এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও!” বলতে বলতে অচিন্ত্য রায় নিজের ঘরে ঢুকলেন। আর লক্ষ্য করে দেখলেন যে ছায়াটিও যেন ঢুকে গেলো ওই অন্ধকার ঘরের মধ্যে। রাতে বিছানায় শুয়ে ছায়ার চরিত্র সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন অচিন্ত্য রায়।
এইভাবেই শুরু হয়েছিলো গল্পটা।
কিন্তু সমস্যাটা হোলো এর পর থেকেই। পরদিন সকালে উঠে অচিন্ত্য আবার বারান্দায় এলেন। বাইরে চড়া রোদ। খুব অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর শরীরের কোনো ছায়া পড়ছে না। “এতো ভারী তাজ্জব ব্যাপার”—নিজের মনেই বলে উঠলেন তিনি। তারপর তাঁর মনে পড়লো গতরাতের ব্যাপার স্যাপারটা। মানে তাঁর সেই ছায়ার ব্যাপারটা। সেই যে সেই ছায়াটা দাঁড়িয়েছিলো উল্টোদিকের বাড়ির জানালার সামনে। তিনি মাথা নাড়লেন—সেও মাথা নাড়লো। তিনি হাত নাড়লেন—সেও হাত নাড়লো। তারপর তিনি ঠাট্টা করে বলেছিলেন ওকে ওই ঘরটার ভিতরে চলে যেতে। তারপর যদ্দুর মনে পড়ে তিনি ঢুকে গেলেন ঘরের ভিতরে। তো সেই ছায়াও যেন চলে গেলো সেই জানালা দিয়ে ওই অন্ধকার ঘরের মধ্যে। কিন্তু তারপর? তারপর কি হোলো?
“গেলি তো গেলি চিরকালের মতো গেলি নাকিরে বাবা! হ্যাঁ! হতে পারে আমি একটু বেশি মস্করা করেছিলাম। বলেছিলাম—‘যাওনা – জানালার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে যাও না—ওই ঘরের ভিতরে—দেখে এসো না কে আছে ওখানে—আর অন্য কেউ আছে কিনা—তা একথা বলার মধ্যে দোষ কোথায়? তাহলে তুই কি রাগ করে এখনো ঢুকে আছিস ওই ঘরের মধ্যে? —নাকি অভিমান করে?—নাকি তোকে আটকে রেখেছে কেউ জোর করে?—নাকি এমন মজে গেছিস ওঘরে যে ফেরার আর নামটি নেই”? —এইসব আবোলতাবোল আকাশপাতাল হাবিজাবি নিজের মনেই বলতে থাকলেন আমাদের গল্পের বিদ্বান মানুষটি।
এদিকে বেলা বাড়তে থাকলো। কিন্তু তাঁর ছায়ার আর পাত্তা পাওয়া গেলো না। এইবার অচিন্ত্য রায় ঘাবড়ে গেলেন। গোটা বাড়িতে এদিক ওদিক অস্থিরভাবে পায়চারি করতে শুরু করলেন। মাঝেমাঝে বারান্দায় এলেন। বারান্দায় গিয়ে ও বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় হাঁক পাড়লেন—“হেই! কি হোলো রে? আসছিস না কেন এখনো—হেই”! কথাগুলো যেন অদ্ভুতভাবে ফিরে এলো তাঁর দিকে। সন্ধে গড়িয়ে এলো। ওপারের বাড়িটি একই রকমভাবে নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তাঁর চোখের সামনে। উনি আর সহ্য করতে পারলেন না সেই দৃশ্য। নিজের ঘরে চলে এলেন। ক্লান্ত শরীর আর মনে এলিয়ে পড়লেন তাঁর ইজিচেয়ারটির উপর। কিন্তু সমানে ভাবতে থাকলেন—“এইভাবে নিজের জায়গায় আমি ফিরবো কি মুখ নিয়ে? ছি! ছি! কি লজ্জা! কি লজ্জা! একটা জ্বলজ্যান্ত লোক অথচ তার ছায়া নেই।” দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুম হোলো না তার।
এইখান থেকেই হোলো গল্পের সমস্যাটা।
ভোর রাতে চুপিচুপি অচিন্ত্য বেরিয়ে পড়লেন ওই বাড়ি থেকে। হাঁটতে থাকলেন হনহন করে। এ রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে। কোথায় যেতে চাইছেন যেন নিজেই জানেন না। এইভাবে একটা ধূ ধূ মাঠের মাঝে এসে হাজির হলেন তিনি। দেখলেন দূর আকাশে সূর্য উঠছে। ফিকে আলোয় ভরে যাচ্ছে চারিদিক। উনি থামলেন না। এগিয়ে চললেন আগের মতোই। হনহন করে। যেন ওই দূরের ভেসে ওঠা সূর্যের দিকেই। এইভাবে চলতে চলতে বেলা বাড়লো অনেক। সূর্য উঠলো মাথার উপর।
তারপর এক সময় খুব ক্লান্ত হয়ে তিনি বসে পড়লেন একটা গাছের নীচে। খানিক বাদে মাথা তুলে অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে ছোট্ট একটা ছায়া! তাঁর নিজের ছায়া!
অচিন্ত্য রায় অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন সেই ছায়ার দিকে। অনেকক্ষণ ভাবলেন সেই ছায়াটার বিষয়ে। তারপর এই সিদ্ধান্তে এলেন যে এটি একটি নতুন ছায়া। তা হোক। তবু নিজের ছায়া তো। একথা ভেবে ভারী স্বস্তি পেলেন তিনি। আবার হাঁটতে শুরু করলেন। এবার আনন্দে।
এদিকে বেলা বাড়তে থাকলো। অচিন্ত্য হাঁটতেই থাকলেন। আর হাঁটতেই থাকলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর ছায়াটা তাঁর সামনে বেশ লম্বা চওড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনি নিজের মনেই বলে উঠলেন—“বা:। এতো দিব্যি লম্বা চওড়া হয়েছে দেখছি। আর হাঁটছেও আমার মতো ভারিক্কি চালে। তাহলে চলো। আমার ডেরায় চলো।”
সন্ধের আগেই অচিন্ত্য নিজের পুরোনো আস্তানায় ফিরলেন। ঘরে ফিরেই পরম শান্তিতে এসে বসলেন তাঁর পড়ার টেবিল চেয়ারে। তারপর আলো জ্বালিয়ে নতুন উৎসাহে শুরু করলেন তাঁর লেখালেখি। রাত বাড়তে থাকলো। উনি লিখে যেতেই থাকলেন। ঢং ঢং ঢং করে দেওয়ালে ঘড়িতে তিনটে বাজলো। উনি খাতার থেকে চোখ তুললেন। তখনই দেখলেন যে ওনার ছায়াটিও ঘাড় গুঁজে বসে আছে ওনার পাশটিতে! সেটি দেখে খুব খুশি হলেন তিনি। ছায়াটিকে উদ্দেশ্য করে সস্নেহে বললেন—"থাকো। আমার সাথে থাকো। আমার মতো করে।"
এইভাবে নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ঘাড় গুঁজে লেখাপড়া করে অনেকদিন কেটে গেলো আমাদের গল্পের এই বিদ্বান মানুষটির। এর মাঝে লিখে ফেললেন বিশাল ভারীভারী কয়েকটি বই। সেইসব বইপত্তর কজন পড়লো কে জানে। কিন্তু আমাদের গল্পের এই পণ্ডিত মানুষটির লেখাপড়াতে কোনো বিরাম ঘটলো না।
একদিন সন্ধেবেলায় ঘর বন্ধ করে আলো জ্বালিয়ে একইভাবে মাথা নীচু করে পড়াশোনা করে যাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হোলো।
"ভিতরে আসুন। দরজা খোলাই আছে"—ক্লান্ত স্বরে বললেন অচিন্ত্য। তারপরেই দেখতে পেলেন এক মাঝবয়েসী কেতাদুরস্ত লোক এসে ঢুকলো ঘরের মধ্যে। "কে আপনি? কি বলতে চান বলুন"—একই রকম ক্লান্ত স্বরে ফের বললেন তিনি।
"জানতাম। আমি জানতাম। আর ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম যে তুমি আমায় চিনতেই পারবে না"—গলা খাঁকরিয়ে উত্তর দিলেন সেই ঝকঝকে মানুষটি। অচিন্ত্য অবাক হয়ে তাকালেন লোকটির দিকে। আগাপাশতলা খুঁটিয়ে দেখেও তাকে চিনতে পারলেন না অচিন্ত্য।
আরে আমি তো তোমার ছায়া। কতকাল একসঙ্গে কাটিয়েছি। সব ভুলে মেরে দিয়েছো দেখছি—হৈ হৈ করে উত্তর দিলো লোকটি। আমাদের গল্পের বিদ্বান মানুষটি কিন্তু সত্যিই হতবাক।
"তুমি তো বসতে বললে না তাই আমি নিজে থেকেই বসি"—বলে সামনের টুলটা টেনে বসলো লোকটি। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে অচিন্ত্য এইবার লোকটির দিকে তাকিয়ে কোনোক্রমে বলতে পারলেন—"তুমি? তুমিই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছায়াটা না?" লোকটি খুব গম্ভীর হয়ে বললো—"হ্যাঁ। কিন্তু এখন আর আমায় ছায়া-টায়া বোলো না। আমার নতুন জীবনে আমার নাম ‘অতনু।" এ নামটা অবিশ্যি আমার নিজেরই দেওয়া।"
অচিন্ত্য থতমত খেয়ে বললেন—"বেশ তো। তবে তাই বলবো। কিন্তু এবার বলো দিকিনি তোমার ঘটনাটা। সত্যি করে বলো কি হয়েছিলো তোমার।" লোকটি, যাকে আমরা এরপর থেকে অতনু বলেই জানবো, আয়েস করে বসে বললো—"নিশ্চয়ই বলবো। কত কি যে বলার আছে। আর আমি তো সেসব বলতেই এসেছি। কিভাবে শুরু করবো তাই ভাবছি।"
অচিন্ত্য বললেন—"ওই ঘরে ঢুকে কি দেখলে সেটা তো আগে বলো।" অতনু বললো—"ও ঘরে কে ছিলো জানো? কবিতা।" অচিন্ত্য বিস্মিত হয়ে বললেন—"কবিতা? তার মানে?" অতনু এবার ধীরে সুস্থে বলতে শুরু করলো – "হ্যাঁ কবিতা। কবিতা ছিলো ওই ঘরে। আমার সৌভাগ্য যে আমি তার এতো কাছে আসতে পেরেছিলাম। কতক্ষণ কতদিন ছিলাম ওখানে কে জানে! কখনো মনে হয় কয়েক মুহূর্ত। কখনো মনে হয় হাজার বছর। ওখানেই তো পড়ে ফেললাম পৃথিবীর সমস্ত সেরা লেখাটেখা গুলো।" "বলো কি?"—অবাক হয়ে বললেন অচিন্ত্য। "অবশ্যই"—উত্তর দিলো অতনু।
"তা কি কি দেখলে সে ঘরে? কাকে কাকে দেখলে? সেখানে কি রাখা আছে নানান রঙের আলো ঠেকরানো অনেক রকমের রত্ন? সবচেয়ে সুন্দর দেখতে সব ফুলের তোড়া? অসামান্য রূপের দেবদেবীরা?"—দারুণ আগ্রহে একগাদা প্রশ্ন করে বসলেন আমদের গল্পের বিদ্বান মানুষটি।
"আরে না না। আমি তো ওইভাবে ভিতরে ঢুকিনি। ওই ঘরে এতো আলো ওখানে গেলেই তো আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি ছিলাম পাশের ঘরটায়। যেখানে সবকিছু ঢেকে ছিলো গাঢ় অন্ধকারে। আর ওই অন্ধকারে বসে বসেই একেবারে বদলে গেলাম আমি। তোমার কাছে যখন থাকতাম ঠিক যেন ভৃত্যের মতো তোমার পায়ে পায়ে ঘুরতাম। কিন্তু ওই ঘরে, ওই অন্ধকারে আমি ছিলাম একেবারে মুক্ত, স্বাধীন। ওখানেই আমি ছায়া থেকে গোটা মানুষে বদলে গেলাম।" বললো অতনু।
আর বলেই চললো—"আমার আগের জীবনের কথা ভাবো তো। তোমার পায়ের কাছে লেপ্টে প্রভুভক্ত ভৃত্য হয়ে জীবন কাটাতাম কিভাবে। অন্ধকারের পাঠশালায় এসে পুরোপুরি বদলে গেলাম আমি। আর তুমি? মুখ গুঁজে ঘর বন্ধ করে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ছাইভস্ম কি যে পড়ে গেলে আর লিখে গেলে তুমিই জানো। আর আমিও জীবনের এতটা সময় তোমার পাশটিতে ঘুরঘুর করে বরবাদ করলাম। তবে কপাল ভালোই ছিল পরের দিকে। তাই না তোমার কথার অপমানে ওখানে ঢুকেছিলাম আমি। ওই অন্ধকারে ঘরটিতে চুপটি করে কতো কাল যে ছিলাম। কতো কাছ থেকে দেখেছি ওকে। দেখেছি কতো কিছু তার সাথে ঝলমল করছে। ওই আলো ছায়ার মাঝে দিব্যি ছিলাম আমি। অনেক দিন বাদে ওখান থেকেই একটা পুরোদস্তুর মানুষের চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। তারপর যা বুঝলাম এই পৃথিবীটা বড়ো বেয়াড়া জায়গা ভাই। আমি তো এইভাবে মানুষই হতে পারতাম না যদি এইসব বেয়াড়ামিগুলো বুঝতে না পারতাম। ওই অন্ধকারের মধ্যে থেকেই সব কিছু শিখেছি আমি। আসলে পুরোপুরি অন্ধকারের মধ্যে যে কত কিছু আছে তুমি ভাবতেই পারবে না।"
অতনুর একটানা কথায় অবাক হয়ে অচিন্ত্য তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে।
অতনু আবার বলতে শুরু করলো—"ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কি করি? নিজেকে লুকিয়ে রাখলাম এক মহিলার শাড়ির আঁচলের পিছনে। এই শোনো, এসব কথা তোমায় বলছি তা বলে তুমি যেন এগুলো পাঁচকান কোরো না।" অচিন্ত্য বললেন—"আরে না না। আমি তো বেরোই না বাড়ি থেকে। কথাটথা বলবো কার সঙ্গে।" অতনু উত্তর দিলো—"হ্যাঁ এটা তোমার একটা মস্ত দোষ। ঘরের মধ্যে মাথা নীচু করে কিসব পড়ো আর লেখো তুমিই জানো। হ্যাঁ যা বলছিলাম শোনো। এইভাবে এর ওর তার পিছনে পিছনে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কতো জায়গায় না ঘুরেছি আমি। কিন্তু এতে আমার বিরাট লাভ হয়েছে। কত কি যে জানতে পেরেছি, দেখতে পেয়েছি তা তুমি ভাবতেই পারবে না। অন্য কেউ যা দেখতে পায় না, অন্য কারুর যা দেখার কথাই নয় সেইসব দেখেছি আমি। আর সেইসব দেখে কি বুঝেছি জানো? সব্বার মনে এইরকম গোপন অন্ধকার জায়গা আছে। অনেকে আবার চেষ্টা করে অন্যের ওই গোপন অন্ধকারে উঁকি মারতে। কিন্তু পারে না। কেউ আমার মতো সহজেই সেখানে ঢুকে যেতে পারে না। এই নিয়ে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে না কি বলবো তোমায়। আসলে আমি তো মানুষের চেহারা পেয়ে গেছি ততদিনে। তাই যে-কোনো মানুষের কাছে গিয়ে বলতে পারতাম—'তোমার অন্ধকার দিকটা আমি সব জানি। শুনবে নাকি?' ব্যাস্। সে থরথর করে কাঁপতে থাকতো আমার কথা শুনে।"
"তাই নাকি?" —ভারী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন অচিন্ত্য। অতনু সগর্বে উত্তর দিলো—"এই নিয়ে যদি বই লিখতাম তাহলে সাংঘাতিক ব্যাপার হতো একটা। কিন্তু আমি তার থেকেও অনেক বড়ো ব্যাপার করতে শুরু করেছিলাম তখন।" "কি রকম? কি রকম?"—সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন অচিন্ত্য। "বলবো—বলবো—সব বলবো। আগে তোমার খবর-টবরগুলো বলো দেখি।"
অচিন্ত্য একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—“আমার কথা আর কি বলবো। দেশে ফিরে এসে কয়েকটা বই লিখলাম—জীবনের 'শাশ্বত সুন্দর’ সম্পর্কে! ‘মানুষের ধর্ম’ সম্পর্কে। নাহ্। বিশেষ কেউ পড়েনি সেসব বই। ফলে এখন দিন চালানোই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।" অতনু বললো—"সেকি, এমন অবস্থা তোমার। তবে তোমারও দোষ আছে। ঘরের কোণে নিজেকে বন্দী করে জীবন সম্পর্কে কিছুই তো জানলে না তুমি। মানুষ সম্পর্কেই বা কতোটুকু জানো তুমি? আবার সেই নিয়ে বই লিখছো! এইভাবে এ জগতে নিজেকে একেবারে অচল করে ফেলেছো হে।" এই বলে অতনু একটু থামলো। অচিন্ত্য মাথা নীচু করে বসে রইলেন। অতনু বললো—"আমি কিন্তু তোমাকে কষ্ট দেবো বলে কিছু বলিনি। আসলে তুমি আমার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু। তাই তোমার ভালো চাই বলেই এতো দূর থেকে তোমায় দেখতে এলাম। এবার ওঠো দিকিনি। ওঠো। আমার সঙ্গে এসো।"
"সে কি? কেন? কোথায়?" খুব অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন অচিন্ত্য।
— "ঘরের বাইরে। খোলা আকাশের নীচে। যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই চলো"—বললো অতনু।
—"তার মানে?"—প্রশ্ন করলেন অচিন্ত্য।
— "চলো আমার সঙ্গে। দেশ দেখতে বেরোবে। আর দেখবে মানুষ। তোমার ওই বইয়ের পাতার বাইরে জগৎটা কিভাবে চলছে তা তোমার দেখা দরকার।" — "না। না। ওসব আমার পোষায় না।" — "ঠিক আছে। না পোষালে ফিরে আসবে। দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে কি চেহারা করেছো বলো তো? এরপর তো একটা শক্ত অসুখে পড়ে যাবে তুমি।"
অচিন্ত্য মাথা নীচু করে চুপ করে রইলেন। অতনু বললো—"অত কিছু ভাবার নেই। সব খরচপাতি আমার। তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাকবে। চাইলে লিখেও ফেলতে পারো আমাদের এই ভ্রমণবৃত্তান্তটা। বন্ধু হিসেবে অন্তত এইটুকু করতে দাও।" তারপর আবার হাসতে হাসতে বললো—"আর কিছু টাকা পয়সাও তোমায় দেবো ঠিক করেছি। কারণ আজ না হয় আমি রক্তমাংসের একটা গোটা মানুষ হয়েছি। কিন্তু একদিন তো আমি তোমার পায়ে পায়েই ঘুরঘুর করতাম—তোমার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতাম। সেদিন তুমিই ছিলে আমার মালিক। আজ আমার বিস্তর পয়সাকড়ি হয়েছে। তাই তোমার কাছে কোনো ধার রাখতে চাই না। তা কাকে টাকাটা দেবো বলো? তোমায়? না তোমার এখন যে নতুন ছায়াটা হয়েছে তাকে?"
অচিন্ত্য এবার মাথা তুলে বললেন—“তুমি কিন্তু এবার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো হে। বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলছো। মানুষ হয়ে তোমার নামযশ হয়েছে। তাও তুমি আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছো। এতে আমি খুব খুশি। আমারও অনেক শুভেচ্ছা রইলো। এরপর তুমি তোমার জগতে চলে যাও। আর আমি আমার জগতে থাকি।"
অতনু বললো—"আরে অতো রাগ করছো কেন? চলো। চলো। তোমাকে নিয়ে আমি যাবোই। এটা আমার বন্ধুত্বের অধিকার।" অচিন্ত্য বললেন—"বাহ্। বেশ সুন্দর কথা বলতেও শিখেছো দেখছি।" শেষ পর্যন্ত অচিন্ত্য বাধ্য হলেন রাজী হতে।
যাই হোক। ওরা তো বেরিয়ে পড়লো। অচিন্ত্য রায় অবাক হয়ে দেখতে থাকলেন পৃথিবীটা কি সুন্দর আর বিচিত্র। আর কতো ধরনের মানুষ। কতো ধরনের তাদের কথাবার্তা, চালচলন, আর সুখদু:খ। এইভাবে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর একদিন অতনু বললো—"চলো। অনেক জায়গা ঘোরা হোলো। এবার একটু কাজের জায়গায় যাবো।" অচিন্ত্য বললেন—"কাজের জায়গা মানে?" অতনু বললো—"একটা অদ্ভুত জায়গা আছে, সেখানকার জল হাওয়া এমন যে অনেক পুরোনো রোগ সেরে যায়। দ্যাখো আমার তো তেমন কিছু বয়স হয়নি। কিন্তু মাথার চুলগুলো হয়ে গেছে ধবধবে সাদা। এই চুলগুলো যদি ওখানকার আবহাওয়ায় একটু...।" অচিন্ত্য অতনুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন—"তুমি বিশ্বাস করো এইসব বুজরুকি? তুমি না শিক্ষিত হয়েছো? অতনু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো—"হ্যাঁ করি। তোমার ওই বিজ্ঞান দর্শন—তর্কশাস্ত্রে সবকিছুর উত্তর ঠিকঠাক মেলে? বিশ্বাস এমন একটা জিনিস যা তোমার বিদ্যে দিয়ে মাপা যায় না। যাকগে। এখন আমার সঙ্গে চলো।"
এইবার ওরা দুজনে এসে হাজির হোলো সেই তাজ্জব জায়গায়। দেখা গেলো সেখানে তো এসেছে অনেকেই। কিন্তু কেউ কাউকে মুখটি খুলে বলে না যে কি তার অসুখ কিংবা কোথায় তার গোলমাল। বরং সবাই উপর থেকে বেশ হাসিখুশি আর ফূর্তিবাজ। দেখেশুনে অচিন্ত্য রায়ের মনে হোলো যে এটা তার দেখা সবচেয়ে আজব জায়গা যেখানে সবকটা লোক, মানে ছেলে – বুড়ো – মেয়ে মদ্দ সবাই মুখোস পরে ঘুরছে!
যাইহোক। সেখানেই তাদের আলাপ হোলো এক অসামান্য সুন্দরী মেয়ের সাথে। যেমন আগুনের মতো রূপ তার তেমনই পয়সার গরম। তিনি নাকি এক বিরাট ধনী এবং ক্ষমতাবান মানুষের একমাত্র সন্তান। শুধু রূপ আর অর্থ নয় তিনি কিন্তু যথেষ্ট বিদুষী এবং বুদ্ধিমতীও। অবশ্য তিনিও যে মুখোস পরে আছেন যে কথা বলাই বাহুল্য! নাম তাঁর রাজন্যা।
দুই বড়োলোক অর্থাৎ অতনু আর রাজন্যার আলাপ হোলো সহজেই। কিন্তু রাজন্যা তো আর জানতেন না যে অতনু একদিন মানুষের ছায়া ছিলো, তাই মানুষের মনের অন্ধকার দিকটায় সে চলে যেতে পারতো এতো সহজে। অতনু তো দুচারটে কথার পরই তার নিজের ক্ষমতা দিয়ে বুঝতে পারলো রাজন্যার সমস্যাটা কি। এবং বুঝলো যে সেটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার! ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে সাধারণ মানুষ যতটা দেখতে পায় আর বুঝতে পারে, এই মেয়েটা তার চেয়ে অনেক বেশিগুণ দেখতে পায় আর বুঝতে পারে! ব্যাপারটা মাঝেমাঝে এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যেতো যে তাঁর নিজেরই চরম অস্বস্তি হোতো। আর হাজার চেষ্টা করেও রাজন্যা এটা শোধরাতে পারছিলেন না। তাই এখানে এসেই তাঁর নিজের রোগের কারণেই জানতে পারলেন যে এখানে এমন একজন আছে যার শরীরের ছায়া পড়ে না। ভারী কৌতূহল হোলো তাঁর। তাই নিজে থেকে আলাপ করলেন অতনুর সঙ্গে।
এদিকে বিশাল বড়ো মানুষের মেয়ে বলে কারো সাথেই খুব বেশী কথাটথা বলতে পারতেন না। আর অনায়াসে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলে বসতেন। তাই সে মুখের উপর অতনুকে বলে বসলেন—"আপনার রোগটা তো ভারী অদ্ভুত। পৃথিবীতে আর কারো এমন রোগ আছে বলে তো মনে হয় না।" অতনু বললো—"তার মানে?" রাজন্যা বললেন—"সেকি? জানেন না? আপনি এমন একজন মানুষ এবং সম্ভবত একমাত্র মানুষ যার ছায়া পড়ে না।"
রাজন্যার এই সরাসরি চোখা কথায় অতনু বেশ থতমত খেয়ে গেলো। সে পোড় খাওয়া মানুষ। অত সহজে ঘাবড়াবার লোক সে নয়। তাছাড়া সেও তো ম্যাজিক জানে। সঙ্গে সঙ্গে অতনু বলে উঠলো—"বাহ্! বাহ্! খুব ভালো! খুব ভালো! এর মধ্যেই অনেকটা সেরে উঠেছেন দেখছি! রাজন্যা দারুণ অবাক হয়ে বললেন—"তার মানে?" অতনু মৃদু হেসে বললো—"মানে তো খুব সহজ। আপনি এখানে এসেছেন আপনার রোগ সারাতে। আর সেই রোগটা তো প্রায় সেরে গেছে দেখছি।" রাজন্যা একেবারে 'থ’ হয়ে তাকিয়ে রইলেন অতনুর দিকে। কিন্তু তারপরেই খুব গম্ভীর হয়ে বললেন—"বুঝলাম না।" অতনু আবার মৃদু হেসে উত্তর দিলো—“এই যে বললেন না আমার ছায়া নেই—এটাই তো প্রমাণ করে দিলো যে আপনি আর বেশি বেশি দেখছেন না। অর্থাৎ যা ছিলো আপনার আসল রোগ। নয়তো দেখতে পেতেন আমার ছায়াটা কোথায় আর কিভাবে আছে।"
রাজন্যা অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলেন অতনুর দিকে। অতনু আগের মতোই হাসিহাসি মুখে বলতে থাকলো—“আপনার রোগটা তো ছিলো, সঠিকভাবে বলতে গেলে, অনেক বেশি দেখতে পাওয়া। এইজন্যেই আপনার এতো আপত্তি। আর এইটে সারাতেই তো আপনার এখানে আসা। এখানে এসে এইবার একটু কম দেখতে পেলেন আপনি। কেন জানেন? আমার ছায়ার কথা বলছিলেন না? বলছিলেন না আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমার ছায়া নেই। ভুল বলছিলেন। আমারও ছায়া আছে। এইবার আপনি সেটা দেখতে পেলেন না। কারণ সেটা আপনাদের মতো নয়। যাক্ গে আপনি যে এখানে এসে সেরে উঠছেন সেটাই সবচেয়ে আনন্দের।"
রাজন্যা রীতিমতো তাজ্জব বনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—"অন্য রকমের ছায়া? তাই আবার হয় নাকি?" অতনু বললো—"হয়। হয়। অবশ্যই হয়। সেই ক্ষমতা থাকলেই হয়। রাজন্যা ফোঁস করে উঠে বললেন—"প্রমাণ? প্রমাণ দেখান।" অতনু মুচকি হেসে বললো—"ওই যে লোকটাকে দেখছেন আমার পিছু পিছু ঘুরছে—ও আসলে আমারই ছায়া। ওকে আমি অনেক কষ্টে অনেক পরিশ্রম করে প্রায় মানুষের মতোই বানিয়ে নিয়েছি। একটা মানুষের মতোই দেখি ওকে। এমনকি লক্ষ্য করলে দেখবেন ওর নিজেরও আলাদা একটা ছায়াও দিয়েছি শুধু ওরই জন্য।"
রাজন্যা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন অতনুর দিকে। অতনু একটু গর্বিতভাবে বললো—"আসলে কি জানেন? সবাই যা করে—যেভাবে চলে—আমি তার থেকে অন্যভাবে করতে ভালোবাসি।" তারপর একটু অহংকারী হাসি হেসে অতনু বললো—"তাহলে বুঝলেন তো যে আমার একটা ছায়া আছে। এবং সেই ছায়াটি সকলের ছায়ার থেকে আলাদা। আর সেটিকে আপনি দেখতেই পাননি। তার মানে আপনার রোগ প্রায় সেরে গেছে।" অতনুর কথা শুনে রাজন্যা মুক্তোর মতো হাসি ছড়িয়ে বললেন—"ঠিক বলেছেন।"
রাতে একা একা নিজের ঘরে শুয়ে রাজন্যা ভাবছিলেন ওই লোকটির অর্থাৎ অতনুর কথা। সত্যিই কি দারুণ ক্ষমতা ওনার। কিন্তু এইখানকার জলহাওয়ার যা গুণ তাতে যদি উনি তাড়াতাড়ি সেরে যান তাহলে তো উনি এই জায়গায় আর থাকবেন না। ভাবতে ভাবতে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো রাজন্যার। পরদিন সকালেই আবার দেখা করতে ছুটলেন অতনুর কাছে। এবার অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলেন তিনি অতনুর সঙ্গে। আর যতোই কথা বললেন ততই যেন মুগ্ধ হলেন তিনি। কারণ অতনু তো বলে যেতে লাগলো একের পর এক রাজন্যার দেশের সব খুঁটিনাটি হাঁড়ির খবর। অতনু তো আগে সেসব জায়গায় গিয়েছে। দিনের পর দিন থেকেছে। নানান জনের পিছনে ছায়ার মতো ঘুরেছে। তাই ও যা জানে তা অনেক লোকের পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। আর এই ব্যাপারটাই রাজন্যাকে দস্তুরমতো তাজ্জব বানিয়ে দিলো। রাজন্যা ভাবলেন এই লোকটি রীতিমতো এক তুখোড় মানুষ নয়তো এতো কিছু জানলো কি করে। এইসব ভাবতে ভাবতে রাজন্যা ফিরে গেলেন নিজের ঘরে। কিন্তু সেই দিনই সন্ধেয় আবার অতনুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন তিনি। অর্থাৎ অতনুর প্রতি রাজন্যার বেশ দুর্বলতা জন্মে গেলো একদিনেই। কিন্তু যতোই হোক খুব বড়ো মানুষের মেয়ে তো সব কিছু মেপে জুপে এগোতে চাইলেন রাজন্যা। তাছাড়াও তিনি নিজেও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আর বিচক্ষণ। তাই সেই দিন সন্ধেবেলায় দু চার কথার পর রাজন্যা চাঁদের আলোর মতো এক মুখ হাসি ছড়িয়ে অতনুকে বললেন—"আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো? কিছু মনে করবেন না তো?" অতনু মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েও মুখে হাসি এনে বললো—"নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।"
রাজন্যা বললেন—"বলুন তো মাঝরাতে আকাশে যখন কোনো তারা দেখা যায় না, চাঁদ ওঠে না, তখন জগৎকে কে আলো দেয়?" বলেই আবার একগাল হেসে বললেন—"এই প্রশ্ন শুনে আমায় পাগল-টাগল ভাবছেন নিশ্চয়ই।" অতনু মুচকি হেসে বললেন—"মোটেও না। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে আমি আর নাই বা দিলাম। ওই যে—ওখানে আমার ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। ওকেই জিজ্ঞেস করুন না। ওই পেরে যাবে এসবের উত্তর দিতে। ওকে আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছি তো সেইভাবে। তবে একটা কথা—ওর সঙ্গে ছায়া বলে ব্যবহার করবেন না। তাহলে ওর ভীষণ অভিমান হবে। একটা কথারও উত্তর পাবেন না তখন। আসলে মানুষের মতো মনে করেই সবসময় ব্যবহার করি কিনা ওর সঙ্গে তাই অন্যরকম ব্যবহার পেলে ও ভারী দু:খ পাবে। কিন্তু আপনি যদি ওর সঙ্গে এমনভাবে ব্যবহার করেন যাতে ও বোঝে যে ওকে একটা মানুষ বলেই গণ্য করা হচ্ছে, তাহলে দেখবেন ও সত্যিই কতো ভালো।" অতনুর কথায় সত্যিই মুগ্ধ হলেন রাজন্যা। ভাবলেন লোকটি অর্থাৎ অতনু কি বিরাট মনের মানুষ। বললেন—"নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি আপনার কথা মতোই কাজ করবো।"
অতনুর ছায়া অর্থাৎ অচিন্ত্য এসব কথার বিন্দুবিসর্গও জানলেন না। তিনি চুপটি করে বসেছিলেন দূরে। রাজন্যা এসে তার সঙ্গে হেসে আলাপ করলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর ঐ প্রশ্নটির উত্তর। অচিন্ত্য খুব মন দিয়ে শুনলেন প্রশ্নটি। তারপর অতি শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন—“ভালোবাসা।” রাজন্যা সেই উত্তরে মুগ্ধ হলেন। এরপর রাজন্যা বললেন—"এই রোদবৃষ্টি জলঝড়ে সময়ের হাতে সবকিছুরই ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। কিছু কি আছে যা এসবের মধ্যেও অপরিবর্তিত থাকে?" অচিন্ত্য একদৃষ্টে রাজন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—"অবশ্যই আছে। তার নাম অক্ষর। আমাদের মুখের ভাষার লিখিত রূপের পরমাণু। এর কোনো ক্ষয় নেই।" রাজন্যা স্তম্ভিত হলেন এই উত্তর শুনে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে খুব মিষ্টি করে হেসে আবার বললেন—"এটা শেষ প্রশ্ন। বলুন তো দেখি আমি কোন দেশ থেকে এসেছি?" অচিন্ত্য মৃদু হেসে উত্তর দিলেন—"বিশাল নদী, শক্তিমান যোদ্ধা আর সুন্দরী নারী কোথা থেকে এসেছে তার কখনো বিচার করতে নেই—তাদের দিকে শুধু তাকিয়ে থেকে দেখতে হয় কিভাবে তারা এগিয়ে চলেছে।" উত্তর শুনে রাজন্যা হেসে গড়িয়ে পড়লেন। অচিন্ত্য অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নীচু করলেন। রাজন্যা তখনই স্থির করলেন আর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। যার ছায়া এতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান আর রুচিবান তার মালিক তাহলে কি বিরাট মাপের! সেই রাতেই অতনুকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তিনি। আর অতনুও সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি দিলো। সব কিছু পাকা হয়ে গেলো এক রাতের মধ্যেই। ঠিক হোলো রাজন্যা নিজের বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত এসব কথা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে।
সেই রাতেই অতনু অচিন্ত্যকে ডেকে বললেন—"শোনো। তোমার সঙ্গে বিশেষ জরুরী কথা আছে। আর এ কথা কেবল তোমার আর আমার মধ্যেই যেন থাকে। বাইরের কেউ যেন টুঁ-শব্দটিও জানতে না পারে। বুঝলে?" অচিন্ত্য অবাক হয়ে তাকালেন অতনুর মুখের দিকে। অতনু বললো—"শোনো মন দিয়ে শোনো। রাজন্যাকে আমি বিয়ে করছি। কথাবার্তা হয়ে গেছে। তুমি হয়তো জানো রাজন্যার বাবা বেজায় বড়োলোক। আর তেমনি ক্ষমতাবান। বিয়ের পর আমি রাজন্যাদের ওখানেই থাকবো। আর তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে। ওখানে কিন্তু তোমাকে সবাই আমার ছায়া বলে জানবে। আর তুমিও সেটা মেনে নেবে। তুমিই যে আসল মানুষ আর আমিই যে এককালে তোমার ছায়া ছিলাম একথা ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ জানতে না পারে।" অচিন্ত্য ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললেন—"তার মানে?" অতনু একটু হেসে বললো—"মানে খুব সহজ। তোমার সারাজীবনের মতো একটা হিল্লে হয়ে গেলো। মানুষ হিসেবে এতকাল বেঁচে থেকে কি বা পেলে? এবার ছায়া হিসেবে বাকিটা জীবন বাঁচো। দেখবে আরাম কাকে বলে। এর জন্য কেবল তোমাকে আমার পায়ে পায়ে ঘুরতে হবে। অর্থাৎ ছায়াদের যা কাজ, যা ধর্ম।" অচিন্ত্য কোনোক্রমে বলতে পারলেন—"কি সাংঘাতিক!" অতনু উত্তর দিলো—"সে তো বটেই। কিন্তু তোমায় এসব ভাবতে কে বলেছে? এখন তৈরী হও দিকিনি। কাল সকালেই রাজন্যার দেশে পৌঁছাবো আমরা। সেইখান থেকেই রাজন্যার বাড়ি।" আমাদের গল্পের বিদ্বান মানুষটি অর্থাৎ অচিন্ত্য রায় তার এক সময়ের ছায়া অর্থাৎ অতনুর কথায় স্তম্ভিত হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অতনুর গর্বিত মুখের দিকে।
তারপর খুব আস্তে করে যেন নিজের মনে নিজেকেই বললেন—"কিন্তু এতো ধাপ্পা। মেয়েটিকে ধাপ্পা দেওয়া। তার পরিবারকে ধাপ্পা দেওয়া।" অতনু বললো—"তোমাকে কে বলেছে জ্ঞান দিতে? তুমি তোমার কাজটা ঠিক মতো করো না। বলছি তো তুমি থাকবে রাজার হালে।" এইবার অচিন্ত্য মাথা তুলে স্পষ্ট গলায় বললেন—"আর যদি তা না করি? যদি মেয়েটিকে গিয়ে বলে দিই যা যা সত্যি সব—তাহলে?" "তাহলে তোমার কপালে অশেষ দু:খ আছে। জীবনে এতো ভোগান্তি পেয়েও কিছুই শিক্ষা হয়নি তোমার তা বুঝতেই পারবে"—বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললো অতনু। অচিন্ত্য মাথা নীচু করে গুম হয়ে বসে রইলেন।
অবশ্য অতনুর ঘুম ছুটে গেলো। খালি মনে হতে লাগলো—"আচ্ছা উদো লোকের পাল্লায় পড়া গেলো। এতদূর এসে কেঁচে যাবে দেখছি ব্যাপারটা!" পরদিন রাজন্যা তার বাড়ি ফিরলে গোপনে দেখা করলো অতনু। "একি! একরাতের মধ্যেই কি চেহারা হয়েছে তোমার"—চমকে উঠে বললেন রাজন্যা। অতনুর উস্কোখুস্কো চেহার দেখে। "আর বোলো না। কেলেঙ্কারি হয়েছে। ভয়ানক বিপদ"—বললো অতনু।
—"সেকি! আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে। এখন আবার কি বিপদ?" জিজ্ঞাসা করলেন রাজন্যা। —"আমার ছায়াটা। আমার এতকালের বিশ্বস্ত ছায়া। মারাত্মক অসুখে পড়েছে সে।" —"তার মানে?" —"মানে আর কি! আমিই দায়ী। আমার জন্যেই হোলো।" —"আর কি হোলো সেটা খুলে বলবে তো?" —"মাথাটা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে তার। জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে যে আমিই নাকি তার ছায়া। আর সে হোলো তার মালিক। আসল মানুষ।" —"কি সব্বোনাশ!" —"আর বলো কেন?" —"তা সে কোথায়? সেকি এখানে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে?" —"হ্যাঁ। তা তো বটেই।" —"সরিয়ে ফেলতে হবে। এখুনি"—খুব শান্তভাবে বললেন রাজন্যা।
"তা কি করে সম্ভব? এতদিনের বিশ্বস্ত অনুচর আমার"—যেন দারুণ উদ্বেগে বলে উঠলো অতনু। "ভেবো না তুমি। কিচ্ছু ভেবো না এ নিয়ে। ব্যাপারটা আমার হাতেই ছেড়ে দাও। ও আছে কোথায় এখন?"—একই রকম শান্তস্বরে বললেন রাজন্যা। "আছে এদিক সেদিক কোথাও। যাবে আর কদ্দূর"—উত্তর দিলো অতনু। "ঠিক আছে। আমি দেখছি ব্যাপারটা। আমারও খুব খারাপ লাগছে জানো। সে দিন কতো কথা হোলো ওর সঙ্গে। কি চমৎকার মানুষ। কি ভদ্র। আর কি বিদ্বান। কিন্তু কপাল। এই প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে তাকে বাকি জীবনটা টানতে হবে ভাবতেই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে"—খুব নরম গলায় যেন নিজেকেই বললেন রাজন্যা। "ঠিক তাই। আর কোনো দিনই ভালো হয়ে উঠবে না ও"—হতাশ কন্ঠে মন্তব্য করলো অতনু। "এই ভয়ঙ্কর জীবন থেকে ও যেন অবিলম্বে মুক্তি পায়"—যেন বরফের মতো শীতল কণ্ঠস্বরে উত্তর এলো রাজন্যার দিক থেকে।
পরদিন রাতে বিরাট ধুমধামের সঙ্গে রাজন্যা আর অতনুর বিয়ে হয়ে গেলো। সেই বিয়েতে এমন জাঁকজমক হোলো যা কেউ দেখেনি কোনোদিন। আশ্চর্য সব আলোর মালায় সাজানো হোলো চারিদিক। সেই সাথে তেমন বাজনা তেমন গান তেমন হৈহুল্লোড়। আর অঢেল খানাপিনা। এইভাবে প্রচুর আলো, দারুণ হৈচৈ আর বিরাট ফূর্তির মধ্যে কেটে গেলো রাতটা!
আমাদের গল্পের বিদ্বান মানুষটি কিছুই দেখতে পেলেন না। কারণ এর একটু আগেই তিনি এই বিয়ের আসরের কাছেই সবার চোখের আড়ালে থাকা একটা ছোট্ট ঘুপচি ঘরে কুঁকড়ে মুকড়ে স্থির হয়ে গেছেন একটা নোংরা বিছানার উপরে। সবার অলক্ষ্যে।
অবশ্য অতনু এসেছিলো তাঁকে দেখতে। এরই ফাঁকে। মাঝরাতে। একা। দেখেছিলো যেন কাপড়ের পুঁটলির মতো পড়ে আছে অচিন্ত্যের ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শরীরটা। সেই ছোট্টঘরের সামনের দেওয়ালে এসে পড়েছিলো অচিন্ত্যের মৃতদেহের ছায়াটা।
হঠাৎ সেই ছায়াটাকে দেখে অতনুর মনে হয়েছিলো যেন একটা কুকুর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। অতনু অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়েছিলো সেই অদ্ভুত ছায়া কুকুরটির দিকে।
—তারপর? —তারপর আর কি? —শেষ হয়ে গেলো আমদের এই বিদ্বান মানুষের গল্পটা।
এরপরেও কিছু দেখতে চাইলে—শুনতে চাইলে—তো অনেক অন্ধকার চাই—চাই অনেক নিস্তব্ধতা।
তবে চোখ বন্ধ করো—একমনে চোখ বন্ধ করো—দেখতে পাচ্ছো? দেখতে পাচ্ছো কত্তো আলোর মালায় ভরে আছে এই শহরটা?
তাহলে এইবার তুমি দেখতে পাচ্ছো এক এক করে অনেক কিছু—
দ্যাখো—দ্যাখো—দেখতে থাকো—
আলো ঝলমলে রাতটার শেষে সবাই যখন হৈহুল্লোড় আমোদ আহ্লাদ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, অতনু তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো রাজন্যার ফুলের মতো ঘুমন্ত মুখটার দিকে। সেই মুখটার পাশে খানিকক্ষণ আগেই দেখে আসা ছায়াকুকুরের চেহারাটা বারবার ভেসে আসছিলো অতনুর চোখে। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেলো রাজন্যার। চোখ মেলে চেয়েই তিনি বললেন—"তুমি কি দেখছো অমন করে আমার দিকে তাকিয়ে।" অতনু থতমত খেয়ে বললো—"না না। কিছু না। চলো বাইরের বাগানে যাই।" রাজন্যা বললেন—"সেকি? এতরাতে?" অতনু বললো—"তাতে কি হয়েছে? চলো না—বাইরে কি চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে।" সে কথা অবিশ্যি সত্যিই। বাইরেটা তখন উত্তাল হাওয়ায় যেন ভেসে যাচ্ছিল, বাগানের ছোটো-বড়ো সব গাছগুলো সেই হাওয়ার ঢেউয়ে দোল খাচ্ছিল পাগলের মতো। উপরের আকাশে হু হু করে ভেসে যাচ্ছিল ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের টুকরো। যার মধ্যে দিয়ে মাঝেমাঝেই ভেসে উঠছিলো নিখুঁত গোলাকার চাঁদটি। অর্থাৎ সেটি ছিলো এক আশ্চর্য সুন্দর পূর্ণিমার রাত। বাগানের প্রতিটি গাছ, সে গাছগুলির প্রতিটি পাতা আর ফুল যেন এক মায়াবী আলোছায়ায় মাখামাখি হয়েছিলো। সেই আলোছায়ায় রাজন্যাকে একটা রুপোয় মোড়া বড়োসড়ো একটা পুতুলের মতো লাগছিলো।
কিন্তু অতনুর চোখ চলে গেলো অন্যদিকে। অর্থাৎ রাজন্যার গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা ঢেউখেলানো ছায়াটির দিকে। রাজন্যা অবশ্য তা লক্ষ্য করলেন না। উদ্দাম হাওয়া আর ঝলমলে চাঁদের আলোয় দারুণ খুশি হয়ে কতো কথাই না তিনি বলে যেতে লাগলেন মনের আনন্দে। অতনুর কিন্তু মনে হতে লাগলো যেন একটা বিরাট সরীসৃপের মতো ক্রমশ বড়ো হয়ে বাগানে হিলহিল করে নড়ছে রাজন্যার ছায়াটি!
দুদিনেই অতনুর ধারণা হোলো যে রাজন্যার চেহারাটা যতটা সুন্দর, ওর ছায়াটা ঠিক ততটাই কুচ্ছিত। এই বিশ্রী ছায়াটার হাত থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তাই সে ভাবতে লাগলো সারাক্ষণ। অনেক ভেবে একটা অদ্ভুত উপায় খেললো তার মাথায়। সে উপায়টি যেমন উদ্ভট তেমনই ভয়ঙ্কর।
কিন্তু ওই যে বলেছিলাম না যে এই লোকটা ম্যাজিক জানতো, তাই ওর পক্ষেই সম্ভব ছিলো এইসব বিদঘুটে কাজ করা। যাইহোক, অতনু ঠিক করলো এরপর থেকে কোনো সামান্য আলোর আভাসেও সে রাজন্যার মুখ দেখবে না। তাহলেই রাজন্যার ছায়ার হাত থেকে সে মুক্তি পাবে। মোদ্দাকথায় তার মানে দাঁড়ালো এই যে অতনু এলে রাজন্যাকে থাকতে হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে। অন্যসময় অবশ্য রাজন্যা যেমন খুশি তেমন থাকতে পারে। অতএব তাই হোলো। যেহেতু অতনুর কথাই শেষকথা। কারণ সে যে ম্যাজিক জানে। যতরাজ্যের দুষ্টুবুদ্ধির ম্যাজিক।
অতনু সারাদিন নিজের মতলবে কতো কীই না করে বেড়াতো। ওদিকে রাজন্যাও নিজের মনে ঘুরে বেড়াতো নিজের জগতে। অতনু রাজন্যার কাছে আসতো নিশুত রাতে নিকষ অন্ধকারে। মানে অতনু আসার আগেই রাজন্যাকে ঢুকে পড়তে হোতো নিরেট কালো অন্ধকার ঘরের মধ্যে। অতনুর নিয়ম। অমান্য করে কার সাধ্য।
কিন্তু এইভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটাতে থাকলে কি আর সুস্থ থাকা যায়? তাই রাজন্যাও কাহিল হয়ে পড়লো কিছুদিন বাদেই। কোনো এক অজানা রোগ এসে বাসা বাঁধলো তার শরীরে।
যদিও অতনু এসব কিছু জানতে পারলো না। কারণ রাজন্যার সাথে তার তো দেখা হোতো গভীর অন্ধকারে। এদিকে রাজন্যাও হয়তো মনের দু:খে কিংবা অভিমানে অতনুকে বললেন না একটি কথাও এসব ব্যাপারে। তাই অতনু জানতেও পারলো না। এইভাবে অন্ধকারের আড়ালে কতো বড়ো সর্বনাশটা তার ঘটে যাচ্ছিলো। জানলো যখন তখন সব শেষ হয়ে গেছে।
সেটা ছিলো এক ঘন বর্ষার রাত। অতনু যথারীতি নিশুত রাতেই রাজন্যার ঘরে এলো। অন্ধকারে অভ্যস্ত অতনু ঠিক বুঝতো রাজন্যা কোথায় কিভাবে শুয়ে বসে আছে। অতনু রাজন্যার বিছানার পাশে গেলো। রাজন্যার হাতে হাত রাখতে গিয়ে দেখলো সে হাত যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা আর পাথরের মতো শক্ত। সে হাত ছুঁয়ে অতনু চমকে উঠলো। তারপর তার হাত রাখলো রাজন্যার কপালে, গালে। সবই যেন পাথর হয়ে গেছে। অতনু বিশ্বাস করতে পারলো না এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা।
তখনই আলো জ্বেলে ফেললো অতনু। আলো জ্বেলে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলো রাজন্যার মুখটা। অতনু দেখলো কাগজের মতো সাদা মুখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়া মুক্তোর মতো ফেনা লেগে রয়েছে অদ্ভুতভাবে। আর তার ঘোলাটে চোখদুটো নিশ্চল মেঘের মতো স্থির। অতনু থরথর করে কেঁপে উঠলো সেদিকে তাকিয়ে। তারপর মাথা নীচু করে বসে রইলো রাজন্যার শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটার পাশটিতে।
রাত বাড়তে লাগলো নি:শব্দে। আলোর শিখা ছোটো হতে লাগলো ক্রমশ। হঠাৎ মাথা তুলতেই অতনুর চোখ পড়লো সামনের দেওয়ালে। সেখানে যেন স্থির হয়ে আছে অতনুর পরিচিত একটা ছায়া! যাকে দেখে যার কথা ভেবে অতনু ভারী কৌতুক বোধ করতো কদিন আগেও। অর্থাৎ সেই মাথা নীচু করে কুঁকড়ে পড়ে থাকা ছায়াকুকুরটি! অতনু আবাক হয়ে দেখলো ঠিক সেই ছায়া কুকুরটাই তো এসে হাজির হয়েছে রাজন্যার নেতিয়ে পড়া দেহের ছায়ার আকৃতিতে। রাজন্যার প্রকাণ্ড বিছানার পাশের দেওয়ালটির গায়ে। অতনুর আরো যেন মনে হোলো রাজন্যার কুঁকড়ে পড়ে থাকা মৃতদেহটার এই ছায়া যেন দেওয়ালের গায়ে এই ছায়াকুকুর হয়ে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে তারই দিকে। অতনুর অসহ্য মনে হোলো। তাই সমস্ত আলো নিভিয়ে আবার ঘন অন্ধকারে সবকিছু ঢেকে দিয়ে রাজন্যার ঠাণ্ডা শরীরটা ছুঁয়ে পাথরের মতো বসে রইলো অতনু।
এইভাবে রাজন্যার অকালে চলে যাওয়াটা অনেকের কাছেই খুব মর্মান্তিক বলে মনে হোলো। পরদিন সকালে অসংখ্য ফুলের মাঝেও তাকে দেখাচ্ছিলো একটা নিখুঁত সাদা পদ্মের মতো।
শেষ যাত্রার একটু আগে সেই বিরাট ঘরটায় রাজন্যাকে যখন ফুলে সাজিয়ে শোয়ানো ছিলো, অতনু তখন চুপটি করে একা বসেছিলো ওই ঘরেররই এককোণে। হঠাৎ সে দেখতে পেলো একটা লম্বা ছায়া এসে পড়েছে রাজন্যার শোয়ানো শরীরটায়। ছায়াটি যেন পরমযত্নে নিজেকে নিয়ে ঢেকে রাখতে চাইছে রাজন্যার দেহটিকে।
অতনুর মাথাটা দপ্ করে জ্বলে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো—নাহ্। কোত্থাও কেউ নেই। তাহলে কি তারই চোখের ভুল? এতটাই ভুল?
শেষকৃত্যের পর অতনু আবার এসে বসলো সেই ঘরে। যে-ঘরে রাজন্যা নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার সমস্ত স্মৃতি। অতনুর চোখ চলে গেলো সেই শূন্য পালঙ্কের দিকে। অতনুর মনে হোলো রাজন্যার শরীরটা যেন এখনও পড়ে আছে সেখানে। অতনু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ওই পালঙ্কের দিকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো পালঙ্কের উপরে পাতা শয্যাটির দিকে। আবার তার মনে হোলো সেই লম্বা ছায়াটা এসে যেন লুটিয়ে পড়ছে সেই পালঙ্কের উপর। অতনু দৌড়ে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো কার ছায়া পড়েছে এইভাবে রাজন্যার মৃতদেহের উপর। নাহ্। কাউকে দেখতে পাওয়া গেলো না। এবার ঘরে এসে অতনু আলোটা একটু বাড়িয়ে দিলো। পালঙ্কের চারদিকেই ঘুরে ফিরে এসে দাঁড়ালো।
নাহ্। আমার কোনো ছায়া পড়বে না এই পালঙ্কে। যেদিক থেকেই আলো পড়ুক না কেন আমার উপর। কখনই না। কোনোভাবেই না—নিজের মনেই বললো অতনু। তারপর একটা একটা করে নেভাতে থাকলো ঘরের আলোগুলি। যাকিছু ছিলো ওই ঘরে তাদের সবকিছুর ছায়াই ঘন হতে থাকলো সাথেসাথেই। তারপর একে একে সব আলো নিভে গেলে সব ছায়া একাকার হয়ে গেলো এক গভীর অন্ধকারে। সেই অন্ধকারকে গায়ে জড়িয়ে পাথরের মূর্তির মতো স্থির বসে রইলো অতনু। অতনুর বার বার মনে হতে লাগলো—এই তার চিরপরিচিত অন্ধকার যেখানে সে আর রাজন্যা বসে একান্ত মুহূর্ত কাটিয়েছে। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে। তারপর হঠাৎই একসময় সে মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলো সেই অন্ধকার ঘর থেকে। সেই প্রকাণ্ড বাড়িটা থেকে। বাইরে তখন মাঝরাতের ঝকঝকে নীল আকাশ।
অতনু হাঁটতে লাগলো হন্হন্ করে। এ রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো। পিছনে পড়ে রইলো সেই বিরাট বাড়ি। সেই জমকালো অভিজাত পাড়া। সেই বিশাল শহর। এইভাবে অতনু এসে হাজির হোলো শহরের শেষ সীমানায়। প্রকাণ্ড গোল চাঁদটা তখন অতনুর ঠিক মাথার উপর, তারাভরা আকাশের তলায়।
অতনু ক্লান্ত হয়ে একসময় বসে পড়লো একটি পাথরের চাঁইয়ের উপর। খানিকবাদে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো চাঁদটা কিছুটা হেলে গেছে আকাশের গায়ে। আশপাশের ছোটো ছোটো বাড়িঘরগুলোর লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে সামনের রাস্তার উপর।
অতনু আবার হাঁটতে শুরু করলো। আগের মতোই হনহনিয়ে। যেন তার খুব তাড়া। কোথাও পৌঁছাতেই হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তাই অলি গলি মাঠঘাট পেরিয়ে অতনু চলতে থাকলো। আর চলতেই থাকলো। পাগলের মতো।
এইভাবে সে এসে পৌঁছালো তার সেই বিদ্বান বন্ধুর গোপন ডেরায়। মানে বুঝতে পারছো তো—আমাদের গল্পের সেই বিদ্বান মানুষটির কথা বলছি। নিশ্চয়ই এরমধ্যেই ভুলে যাওনি তার নামটা—অচিন্ত্য—অচিন্ত্য রায়।
যাইহোক অতনু যেন পাগলের মতো ঢুকলো সেই বাড়িটায়। আগে থেকেই সেটা ছিলো একটা পুরোনো পাড়া। পুরোনো বাড়ি। সেটা এতদিনে আরো পোড়োঝোড়ো হয়ে গেছে। অতনু যেন ক্ষ্যাপার মতো সেই বাড়িতে ঢুকেই সোজা চলে গেলো অচিন্ত্যর লেখাপড়ার ঘরে। সেইঘর থেকে সেই জানালা থেকে অতনু তাকিয়ে দেখলো সামনের দিকে। অর্থাৎ সামনের মুখোমুখি সেই বাড়িটা সেই ঘরটা যেখানে তাকে ঢুকতে বলেছিলো তার তখনকার মালিক অচিন্ত্য। জীবনটাই তার পুরো বদলে গিয়েছিলো যে ঘরে ঢুকে, অতনু একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সেই ঘরের দিকে। তারপর ওই ঘর থেকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওই সামনের মুখোমুখি বাড়িটার দিকে পা বাড়ালো অতনু।
ওই দুটো বাড়ির মাঝের রাস্তাটা যেন শেষ রাতের চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো তখন। অতনুর অসহ্য লাগছিলো ওই আলোর ঝলমলানি। তার মনে হচ্ছিলো যে পারলে চাঁদটাকে চেপে ডুবিয়ে দেয় কোনো কালো জলের গভীরে।
ওই বাড়িতে ঢুকে অতনু যেন সম্মোহিতের মতো সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে দাঁড়ালো সেই ঘরের সামনে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চারিদিক নিথর। নিশ্চুপ। কোত্থাও কোনো জনপ্রাণী নেই। ওই বন্ধ দরজার সামনে অতনু দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মূর্তির মতো একা। সাক্ষী রইলেন শুধু দূর আকাশে হেলে পড়া ক্ষয়াটে চাঁদটা।
সেই সময়েই—আর ঠিক সেই সময়েই—এক দারুণ দমকা হাওয়ায় চারদিক যেন থরথর করে কেঁপে উঠলো। আকাশের চাঁদটা হঠাৎই যেন ঢেকে গেলো ঘন মেঘের আস্তরণে। মুহূর্তেই চারিদিক ছেয়ে এল গাঢ় অন্ধকার। আর তখনই সেই ভয়ানক ঝোড়ো হাওয়ায় বিকট আওয়াজ করে খুলে গেল সেই ঘরের বন্ধ দরজার পাল্লা দুটি। তারপর সেই ঘরের সেই নিশুত অন্ধকারে ঢুকে যেন সেই অন্ধকারেই একেবারে মিশে গেলো অতনু।
এর অনেক কাল বাদে এমনই এক নিশুত রাতে—যখন আমার চারিদিকে কেউ কোত্থাও নেই—শুধু জমাট বেঁধে আছে নিস্তব্ধ অন্ধকার—তখনই হঠাৎ মনে হোলো কেউ যেন নি:শব্দে এসে দাঁড়ালো আমার পাশটিতে—আর ফিসফিস করে বলতে লাগলো কিসব কথা—আপন মনেই। তখনই তো শুনেছিলাম এই আশ্চর্য গল্পটা—ওর কথা থেকেই।
এরপর থেকেই আমার মনে হয় এইভাবে ও বেরিয়ে পড়ে কখনো কখনো—গভীর অন্ধকারে—একা।
তাই বলছি—যদি কখনো গভীর আঁধার আসে তোমার চারিধারে—যে আঁধারে তোমায় চুপটি করে বসে থাকতে হবে এক্কেবারে একা—নিশ্চুপে—তখন হয়তো তুমি টের পাবে কেউ এসে দাঁড়ালো তোমার পাশটিতে আর ফিসফিস করে বলতে লাগলো কিছু কথা—নিজের মনেই—নিজের কথা—জেনে রেখো এই মানুষটিই হোলো ওই অন্ধকার ঘরে হারিয়ে যাওয়া লোকটা—অর্থাৎ আমাদের গল্পের অতনু।
(পরবাস-৬০, অগস্ট ২০১৫)