ISSN 1563-8685




আবু বকর ও তার আয়না

মি এখানে সেই গল্প করব, যে একদিন আবু বকর বিটুমিন ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তার এক ছোট গর্তের মধ্যে একটি ছোট ভাঙা কাচ খুঁজে পেয়েছিল আর সে কাচের দিকে তাকিয়ে প্রথম তার মনে হয়েছিল কি যেন এক উজ্জ্বল বস্তু চকচক করছে কারণ সূর্যের আলো কাচে পড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এবং এ থেকে আসলে বলা যায় কাচটি সাধারণ কোন কাচ ছিল না, এটি একটি আয়না ছিল। আবু বকর নিচু হয়ে বসে হাতের বাজারভর্তি ব্যাগটি পাশে রেখে কাচ তথা আয়নার টুকরাটি হাতে নিয়ে ঘুরে ফিরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখল, আয়নাটি ছিল ত্রিকোণাকার। আবু বকরের আয়নার টুকরাটি ভালো লেগে গেল। সে টুকরাটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়।

তার ঘর খুব ছোট। সেই ছোট ঘরের এক কোণে সে টুকরাটি ঝুলিয়ে রাখল, এই আয়নার টুকরার মধ্যে এমন কোন বিশেষ সৌন্দর্য ছিল না। তবুও কেন জানি আবু বকরের তা ভাল লেগে গেল। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। কারো ভালো লাগা, খারাপ লাগায় হস্তক্ষেপ করার মত অনধিকার চর্চায় আমরা অভ্যস্ত নই। তাই আমরা সমস্ত মনোযোগ দিয়ে আবু বকর এবং তার আয়নাসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।

আবু বকর সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নার টুকরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখত। ঘুমানোর আগে আরো কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। এই ছিল প্রথম প্রথম আয়নার সাথে তার সম্পর্ক।

আবু বকরের নিজের কোন বাড়ি ছিল না। এই শহরে সে এমনি একজন ছিল যে যার কেউ নেই। বস্তুত পৃথিবীর সব মানুষেরই কেউ নেই হয়ত--তাই আবু বকরের এই কেউ না-থাকা গল্পের বা তার জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। আবু বকর ধনী ব্যক্তি সোবাহান সাহেবের বাড়িতে বাজার আনার কাজ করত। এছাড়া সামান্য আরো কিছু টুকিটাকি কাজ। সোবাহান সাহেবের জন্যই বাজার আনতে গিয়ে সে আয়নার টুকরাটিকে পড়ে থাকতে দেখেছিল।

সোবাহান সাহেব ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি স্ত্রী, কন্যা নিয়ে বসবাস করতেন এবং একটি বিশেষ ধরনের “অর্থনৈতিক স্ক্যান্ডালে” জড়িয়ে পড়ায় তার বউ মেয়েকে নিয়ে তার কাছ থেকে দূরে সরে যান। সোবাহান সাহেব তখন বিপর্যস্ত ছিলেন এবং আবু বকর তখন তার ছোট আয়না নিয়ে বিছানায় বসে শান্তভাবে নিজের মুখশ্রী দেখছিল।

সোবাহান সাহেব মদ্যপায়ী ছিলেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে তার মদ্যপানের মাত্রা বেড়ে যায়। একদিন গভীর রাত্রে আবু বকর যখন তার ছোট আয়নার টুকরার সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে ছিল তখন শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে উপর থেকে ডাক এল, আবু বকর...আবু বকর...

আবু বকর প্রথমে শুনতে পায় নি। একসময় তার মোহ ভাঙে এবং সে ডাক শুনতে পায়। সোবাহান সাহেব মাতাল অবস্থায় ডাকছেন। তার যেতে হবে। কিন্তু আবু বকরের উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে উঠল কিন্তু আয়নার টুকরা হাতেই রয়ে গেল তার। সোবাহান সাহেব অত্যধিক মদ্যপানের ফলে বমি করেছেন। মেঝেতে বমির স্রোত। তাঁর চোখ দুটি লাল।

আবু বকর বলল, স্যার ডাকছেন।

সোবাহান সাহেব বললেন, হ্যাঁ। আমারে এক গ্লাস পানি দে।

আবু বকর দেখল সোবাহান সাহেব বমিতে মাখামাখি হয়ে ঢুলছেন। তাঁকে বিদঘুটে দেখাচ্ছে। সোবহান সাহেবের জন্য তার মায়া হল। লোকটা অসম্ভব ভাল।

সে বমির উপর দিয়ে হেঁটে সোবাহান সাহেবের সামনে গিয়ে বলল, স্যার, পানি খাওয়ার দরকার নাই। আপনে ঘুমান।

হাতের আয়নার টুকরাটি অত্যন্ত ধারালো ছিল। আবু বকর তা দিয়ে একটানে সোবাহান সাহেবের কন্ঠনালী কেটে দিল প্রায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে আবু বকরের শার্ট ভিজিয়ে দিল। এক অদ্ভুত শব্দ করতে করতে বমি মাখা মেঝেতে তড়পাতে লাগলেন সোবাহান সাহেব।

আবু বকর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল যতক্ষণ না দেহের নড়াচড়া বন্ধ হয়। সোবাহান সাহেবের দেহ স্তব্ধ হবার পর আবু বকর বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ এবং আয়নার টুকরাটি পরিষ্কার করল।

তারপর সে নিজের রুমে এসে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে একা হয়ে গেল। যেন চারপাশে আর কিছু নেই।

পরদিন সকালে সোবাহান সাহেবের লাশ রুমে পড়ে থাকতে দেখে কাজের লোকেরা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। যখন পুলিশ বাড়ির সদস্যদের জেরা করতে যায় তখন সবাই লক্ষ করে আবু বকর আসে নি। সবার মনে ধারণা হয় আবু বকর এই কাজ করেছে এবং করে পালিয়ে গেছে।

কিন্তু আবু বকর তখনো তার নিজের রুমেই ছিল। বিছানার উপরে। তার প্রিয় ছোট আয়নাকে সাথে নিয়ে। এই ভাঙা তুচ্ছ আয়নাকে তার ভালো লেগে গেছে। এটি তাকে শিখিয়েছে সবার মধ্য থেকে একা হবার গোপন মন্ত্র। এবং সে বুঝতে পেরেছে জীবন কিছুই না, প্লাস্টিকের ব্যাগে এক জেলিফিশ মাত্র।



(পরবাস-৫৯, এপ্রিল ২০১৫)