Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
গৌরী দত্তের

লেখা





ISSN 1563-8685




ঘাতক

ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই সিটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেল আজ।
হঠাৎ ড্রাইভারের সিটের পেছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম।
দুটো নম্বর।
সাদা কার্ডের উপর কালো কালি দিয়ে ঈষৎ কাঁপা হাতে লেখা।
উপরের নম্বর ০৯০৯১৩
নিচের নম্বর ৯১৫৪৪

নিচের নম্বর হুবহু আমার পুলিশ ব্যাজের নম্বর। বেশ কাকতলীয় ব্যাপার তো।
কিন্তু হবেও বা। আমার মেয়ে হলে ইয়ুং, সিনক্রনিসিটি—এসব অনেক কিছু বলতো।
কিন্তু গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর এমন হবে কেন।
ভাবলাম হয়তো কোনো মোবাইলের নম্বর—লেজটা মুছে গেছে।
ড্রাইভারের পিঠে টোকা দিয়ে লালাবাজারি কায়দায় আইনের নিয়মকানুন সমঝোতা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দিনশেষের শ্রান্তি আমার মাথায় পেটের বেলটের মতো টাইট হয়ে চেপে বসেছিল। চুপসানো বেলুনের মত নিজেকে দমশূন্য মনে হল।

ড্রাইভারকে ঢাকুরিয়ার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে চোখদুটো অল্প বিশ্রামের জন্য বুজলাম।
বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝে, প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কলের জলের মত। আকাশ ঢাকা থমথমে কালো কাদামাখা কাপড়ের মত মেঘে, তারা চাঁদ কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আমার পুলিশ চীফের জিপের ব্রেকে গোলমাল পাওয়া গেছে—কাল থেকে গ্যারাজে। তাই অনন্যোপায় হয়ে সাধারণ জনতার মত ট্যাক্সির শরণাপন্ন। কোনো রকমে বাড়িতে পৌঁছাতে পারলে ভাত মাছ খেয়ে শয়নং হট্টমন্দিরে।
রাস্তার উলটো দিকেই দাঁড়িয়ে ছিল ট্যাক্সিটা। এই বৃষ্টিতে এত রাতে এই সহজলভ্য বাহন—ভাগ্য বৈকি।

গত কয়েকমাস ধরে গোলপার্ক পুলিশ প্রিসিংক্টে যা তুলকালাম চলছে তা গত পঞ্চাশ বছরের কলকাতার ইতিহাসে অভাবনীয়।
তিন মাসে তিনজন পুলিশ অফিসার খুন হয়েছে, বন্দুকের গুলিতে।
পুলিশ প্রফাইলার সাব্যস্ত করেছে যে এগুলি এক আততায়ীর কাজ। সিরিয়াল কিলিং।
একটা প্যাটার্ন আছে। প্রতিটি টার্গেট পুলিশ অফিসার।
প্রতি আক্রমণ ঘটছে পূর্ণিমাতে। পত্র-পত্রিকায় ছেয়ে গেছে এই জিহ্বারোচক নামে—পূর্ণিমার পুলিশহনন।
তাছাড়া সিরিয়াল কিলিং-এর মুখ্য সাইন—প্রতিটি খুনে আছে আততায়ীর বিশেষ হস্তাক্ষরস্বরূপ এক আস্ফালন সাক্ষ্য—যাকে ক্রাইম বিশেষজ্ঞরা বলে—সিগনেচার অব সিরিয়াল কিলিং।
মৃতদেহের পাশে পাওয়া যায় সেই দিনকার তারিখ লেখা একটি কাগজ—সেই মাসের পূর্ণিমার তারিখ। জুন পনেরো, জুলাই তেরো, আগস্ট এগারো—তিন মাস এই চলেছে। আরো কতদিন এই সিরিয়াল কিলারের হত্যা চলবে কে জানে।
পুলিশ মহলে আতঙ্কের পারাক্রম গগনলেহি। আমজনতা উৎকণ্ঠায় পঙ্গুপ্রায়।

কতক্ষণ যে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম জানিনা।
একটা ঝাঁকুনিতে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে দেখলাম আশপাশ অচেনা। মৌচাক মিষ্টির দোকান নেই। গলির মুখে রিকশা স্ট্যান্ড নেই। বাড়ির কাছে ফুলের দোকান নেই। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সিওয়ালা?
বলেছিলাম—ঢাকুরিয়া—লোকটা কি শুনেছিল?

—এ কি মশাই, কোথায় নিয়ে আসলেন? থামুন, থামুন কি করছেন—
চিৎকার করে উঠলাম।

শহরের বাইরে কোথাও এসেছি মনে হল। দোকান পাট কম। বাতাস আরো ঠাণ্ডা। জলীয় গন্ধ।
বৃষ্টি আর নদীর গন্ধে তফাৎ আছে। শহুরে মানুষদের কাছে নদীর গন্ধে অচিন নির্জনতা।
—গাড়ি ঘোরান। কোথায় এনেছেন?—
আমার বিরক্তিটা রাগের কাছাকাছি যেতে গিয়ে একটা অন্য অনুভূতিতে আটকে পড়ল।

এতক্ষণে ড্রাইভার মুখ ফেরালো।
পকেট থেকে সার্ভিস-টর্চটা ফস করে জ্বেলে ওর মুখে ফেললাম। উজবুক না মাতাল?
সুদর্শন মুখ। ভাসা ভাসা চোখ, চেক সার্ট, কলারওয়ালা, ইস্ত্রির নিয়মানুবর্তিতাও আছে, আমার পুলিশ আকাডেমির ট্রেনড্‌ চোখ চকিতে দেখে নিল।
ঠিক হিসেব মিলছে না, মন বলল।

কলকাতায় নতুন নাকি ছোকরা?

—আমায় চিনতে পারছেন?—
একটু হেসে বলল সে। এ আবার কি অদ্ভুত কথা।

থুতনিতে একটু টোল।
কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হল। তবে এত লোককে দেখি, কতজনকে মনে রাখা যায়?

প্ল্যান করে জনহীন অকুস্থলে নিয়ে এসেছে। উদ্দেশ্য কি?
উর্দি তকমা ছাড়া সাধারণ জামাকাপড় পরে আছি, কিন্তু জ্যাকেটের তলায় বেলটে আমার ছায়াসঙ্গী, ম্যাগনাম চুয়াল্লিশ ছয় ব্যারেল পুলিশ রিভলবার।
কোমরের কাছে আমি হাত বেঁকাতেই, বিদ্যুতগতিতে একটা ছোট্ট কালো খ্যাঁদা-নাকের হুলোবেড়াল হাতিয়ার হয়ে ছেলেটির হাতে বসল।
স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পাঁচশো মনে হল। শক্তিশালী বন্দুক। শঠে শঠ্যং।

চোয়াল শক্ত করে নিচু উদারায় সে বলল,
—ওই চেষ্টাও করবেন না।
হাত গুটিয়ে নিলাম।

—মনে পড়ে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে?
ছেলেটি বলে চলেছে। আবৃত্তি করা গলা। দৃষ্টি কোনো এক সময়ে কোমল কালো টলটলে সরোবর ছিল হয়তো, এখন কষ্টিপাথর—শক্ত দুই শিলাখণ্ড।

—সেই কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যায়। মা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া শেষ করে গড় হয়ে ঠাকুর প্রণাম করছিলেন। এমন সময় আপনি ও আরো তিনজন পুলিশ কড়ানাড়ার বদলে বুটের ধাক্কায় দরজা প্রায় ভেঙে ঘরে ঢুকলেন।
আপনারা খোঁজ করছিলেন আমার আঠারো বছরের দাদা বাদলের। আমার তখন বয়স দশ, ভয়ে ঘামছিলাম। বাবা বললেন বাদল বাড়ি নেই। মা আপনাদের কাঁপা হাতে প্রসাদ দিতে গেলেন, গৃহস্থের লক্ষ্মীমন্ততায়। সঙ্গীন আবহাওয়া হাল্কা করার জন্যে।
আপনি জামবাটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নারায়ণের মূর্তিতে বাটি টুকরো হয়ে গেল। নারকোল নাড়ু, কলা, মুগের ডালমাখা সব মাটিতে গড়াগড়ি গেল।

দাদা উঠোনপাড়ার খিড়কি দিয়ে পালাচ্ছিল—টর্চের আলোয় আপনার হাবিলদার চিৎকার করে জানাল। আপনার সাগরেদ ও আপনি কয়েকটা খারাপ গালাগালি করে পিছনের আমবাগানের দিকে ছুটলেন।
আলো আঁধারের ওই ছায়াবীথির মধ্যে দিয়ে দাদা এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছিল, যেমন করে ট্রেনিং ক্যাম্পে ওদের শেখানো হয়েছিল। আপনিও ট্রেনড, দু হাত জড়ো করে রিভলবার তুলে টিপ নিলেন। পর পর ছয়টা গুলি বজ্রের মত, চক্রের মত, অগ্নিবাণের মত ছুটে গেল।
পিঠে গুলি লেগে পড়ে গেল দাদা। শুনেছিলাম দুটো গুলি লেগেছিল।
ওর মুখ থেকে লাভার মত ভলকে ভলকে বেরচ্ছিল রক্ত আর সিন্নি।
মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।

আমি এক দৃষ্টে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই মুহূর্তের অনিবার্যতা সম্বন্ধে আমার আর কোন সংশয় রইল না। নানা কথা মনে হতে লাগল।
সেই আমার কেরিয়ারের প্রথম কাউকে মারার হাতেখড়ি। লক্ষ্মীপূর্ণিমার সন্ধ্যায়। বাদল খাসনবিশ।
আমার বয়স তখন পঁচিশ। তার আঠারো। প্রায় সমসাময়িক আমরা—অথচ অন্তহীন ভাবে অসম।

প্রথম প্রাণিহত্যার পরে মানসিক খেসারত দেয় সকলেই। আমিও দিয়েছিলাম সেইসময়।
কিন্তু তারপর—তারপর ডিউটি, দায়িত্ব, অনুশীলন, ন্যায়, অন্যায়বোধ, ভ্রান্তি, নিষ্ঠুরতার মধ্যে পার্থক্য কেমন যেন মিলেমিশে যেতে লাগল সময় ও পরিবেশের চাপে।
আমার ভেতরটা সেই কোর্টহাউসের ডরিক কলামগুলোর স্থবির ও ঘনীভূত মার্বেল পাথরে পরিণত হতে থাকল।

ছেলেটি তার আগ্নেয়াস্ত্র আমার ডান রগে মোতায়েন করল।
আমার হাত দুটো ধীরে মাথার উপরে তুললাম। টর্চটা আমার হাত থেকে সীটের নিচে পড়ে গেল। কিন্তু ওর চোখের প্রত্যয় একটা সার্চলাইটের জ্যোতি হয়ে আমার সমস্ত ভিতরটা দেখতে লাগল।

সেই আলোয় ট্যাক্সির নম্বরগুলির রহস্য পরিষ্কার হয়ে আসল আমার মাথায়। আজ সেপ্টেম্বরের পূর্ণিমা। নয়ই সেপ্টেম্বর।

ট্যাক্সির ওপরের নম্বর ০৯০৯১৩ যদি যতি দিয়ে ভাগ করে লিখি, তাহলে হবে আজকের তারিখ—০৯/০৯/১৩

পিস্তল ক্লিকের আগে একবার বাইরের আকাশের দিকে তাকালাম। পরিপূর্ণ এক চাঁদ মেঘ কেটে বেরিয়ে আসছে। আর রং বদলাচ্ছে। শাদা, সিপিয়া, ছাই, নীলচে ও রক্তের মত টকটকে লাল।




(পরবাস-৫৯, এপ্রিল ২০১৫)