ISSN 1563-8685




গাড়ি কিনলেন পটলবাবু

শেষ অব্দি যেমনটি চাইছিলেন ঠিক তেমনটিই পাওয়া গেল। তার জন্য কম দৌড়োদৌড়ি করতে হয়নি পটলবাবুকে। ব্যাঙ্কে যেতে আসতে আড়ে আড়ে দেখছিলেন রঙিন ছাউনির তলায় একটা স্টল দিয়েছে মারুতি। ‘মনসুন ধামাকা’ নাম দিয়ে কি কি যেন সব ছাড়ও দিচ্ছে কয়েকটা মডেলের ওপর। ছাপোষা মানুষ উনি আর কদিন বাদেই রিটায়ারমেন্ট—আর বছর দুই বই তো নয়। ওদিকে এগোবেন কিনা স্থির করতে পারছিলেন না। তবে ওঁর যে আর একটা দিক আছে সেটাই বার বার কাতুকুতু দিচ্ছিল—সে কথা ওঁর ভৃত্য কাম সখা, উর্ফ রাঁধুনি উর্ফ গৃহিণী—বাইশ বছরের হরে তো জানেই। তা হ’ল ওঁর ঘর পালানো, দামাল টিনটিন মনের ঠিকানা।

তাছাড়া চিরকাল তো আর ‘পটলবাবু’ ছিলেন না! ওঁর পঞ্চাশের দশকের বাপ-মা অতশত পাবলো, পিকাসো, পিরহানোর খোঁজ রাখতেন না। তবু ভেবেচিন্তে যে নামটা বেছেছিলেন তা মোটের ওপর শুনতে খারাপ ছিল না—প্রতুল। কিন্তু পাড়ার যত বুড়োরা, মায় বয়সে কম ছোকরাগুলোও তাকে প্র্যাতলা, পাতলা, পাতলুনদা, কীসে না এনে দাঁড় করালে! শেষ পর্যন্ত ‘পটল’এ রফা হল। তবে অফিসের খাতায় ‘প্রতুল’এর সাথে বাবু যোগ হয়েই থেকে গেছে। তা যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সে ঘরের দরজায় এসেই দাঁড়াল—ছোট্ট একটা কচি তেঁতুলপাতা-রঙা হুড-খোলা অল্টো।

দেখতে গেলে গাড়ি কেনায় আর দৌড়াদৌড়ির কি থাকতে পারে,—ড্রাইভিং তো শখ করে শেখাই ছিল, আর রইল বাকি টাকার কথা, সেও পটলবাবু্র আছে। কখন কি লাগে, দোকা মানুষ,—হরেকে তো উনি বাড়ির লোকই মনে করেন কিনা। তা সে টাকায় হাত না দিয়েই, গাড়ির ডাউন পেমেন্টের ব্যবস্থাও করাই ছিল। আসলে ছুটোছুটি গাড়িটা কেমন দেখতে হবে তাই নিয়ে। খুব ছেলেবেলায় যবে মা ছড়ার ছবি বইটা উল্টে উল্টে সুর করে ‘হাঁকিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি কাল/আসছিল এক খ্যাঁকশিয়াল’ বলে ওঁর মুখে নরম চটকানো মাগুর মাছের ঝোল মাখা ভাত চালান করতেন সেই তবে থেকেই ছড়ার বইয়ের ওই হুড খোলা সবজে নীল গাড়িটা ভারি ভালবেসেছিলেন। এমনিতে তো আর মুখের হাঁ খুলতো না, ওই ছড়া শুনতে শুনতে আনমনা হলেই মার কার্য সমাধা। সেসব তো অনেকদিনের কথা।

মারুতি শো-রুমে গিয়ে অমন একটা গাড়ি চাইতে ম্যানেজার তো অবাক! এই ধুলো ধোঁওয়ার যুগে যখন কালো কাচ তুলে, এসি চালিয়ে গাড়ির মালিকরা জগৎ ভুলে যান তখন কিনা হুড-খোলা গাড়ি! কিন্তু পেড়াপীড়িতে কাজ তো হয়েছিলই। মাস দুয়েকের দৌড়ানো, তারপরই এলো হুড-খোলা কচি তেঁতুলপাতা রঙা এই ছোট্ট অল্টো। হুড একটা ছিল বটে, ছেয়ে রঙা মোটা কাপড়ের, যেটা ভাঁজ হয়ে থাকবে পিছনে, খুব গরমে, বর্ষায় যাতে তুলে দেওয়া যায়।

একদিন কলকাতায় মল্লিক বাজারে গিয়ে পিতলের পাকানো বাহারে হর্ন, পরী, গাড়ির সামনের কাচের দুপাশে লাগিয়ে দিলেন। খুঁতখুঁতে মানুষ তো, লাগাবার আগে ওগুলো পালিশ করে ল্যাকার করিয়ে নিলেন নিউ মার্কেটের কাছে এক বড় পালিশের দোকান থেকে। নানান ভুজুংভাজাং দিয়ে একবেলায় ডেলিভারিতে রাজি করিয়ে দুপুরের শোয়ে স্পিলবার্গের ‘অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন’টা বড় পর্দায় আর একবার সারা হয়ে গেল। টিভিতে ভারি ভালো লেগেছিল ওনার। এমনিতে ভেবেচিন্তে খরচ করলে হবে কি, মাঝে মাঝে কেমন যেন ভূতে পায় ওঁকে, ওই টিনটিন মনটাই বোধ হয় প্রমাদ ঘটায়।

গাড়ি দেখে হরের চাপা আনন্দে ভারি মজা পাচ্ছিলেন পটলবাবু। দেখলেন রোজ ছটায় হরে ওনাকে চা আর মারি বিস্কিটটা ধরিয়ে দিয়েই বাড়ির সামনের চত্বরে রাখা গাড়িটাকে কি আদর দিয়েই না ঝাড়ামোছা করছে! গোপালীর বাজার এলাকায় এ-পাড়াটা একটু মধ্যবিত্তই যেখানে সাইকেল আর তার বেশি হলে টু হুইলারেই কাজ চলে যায়। তাই চার চাকার গাড়ি দেখতে সক্কাল হতেই ছোটগুলো ভিড় করেছে, মায়েরা আরও ক্ষুদেগুলোকে ট্যাঁকে করে লজ্জা লজ্জা মুখে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। দাদু জেঠুরাও কাছের বুথ থেকে ডবল টোন দুধের পাউচ নিয়ে ফেরার পথে প্রশংসা কাম ঈর্ষা চোখে গাড়িটা দেখতে দেখতে গেলেন। কানাইদা তো বলেই ফেললেন ‘পটল গাড়ি নিলে? নতুনই তো দেখছি, তা বেশ বেশ, শখ মিটিয়ে ফেলো, দুদিন বৈ তো নয়। তোমার বৌদি তো কাল বিকেল থেকেই নাকেকাঁদা শাকচুন্নি হয়েছেন। সেই সাত সকালের চা দেওয়া থেকে রাতের মশারি গোঁজা অব্দি একই মশা কান্না ‘সবাই কিঁনলে, আঁমার আর কেঁ আছে, কেঁ-ই বা শোনে—সক্কাল থেকে খালি খ্যাঁটনের যোগাড়, যাই পায়ে মালিশটা দিই, এত ব্যথা, বাজার অব্দিই হাঁটতে পারি কই?’

সেদিন শনিবার পটলবাবু হরেকে বলে রাখলেন রবিবার সকালের জন্য বেশি করে লুচি আর আলুর সহজ দমটা করে রাখতে। সেই হিং ফোড়ন, টমেটো, ধনে গুঁড়োর মাখা মাখা লাল রঙা দমটা যা বোধহয় হরেই কেবল পারে। ঝালটা কমই হবে মনে করিয়ে দিলেন। তারপর একটু সন্ধে হতে বড় বড় মিকি ডোনাল্ডের স্টিকার সেলোটেপ দিয়ে গাড়ির দুই দরজায় আটকে দিলেন, আধো আলোয় দেখছিলেন হরের খুশী খুশী মুখটা, যদিও ও জিগেস করেনি কেন এত সব। ঘরে গিয়ে সাইকেল পাম্পটা দিয়ে কিছু রঙীন বেলুনও ফুলিয়ে লম্বা সুতোয় বেঁধে খাটের ছতরিতে ঝুলিয়ে রাখলেন।

পরদিন সকালে যেই ছোটরা গাড়ির চারপাশে ভিড় করেছে, কি সব বললেন ওদের পটলবাবু। সবাই যেন হাওয়ায় ভেসে যার যা বাহারে ফ্রক, জিন্স, বারমুডা আছে পরে এল, মায়েরা কেন যে ওদের চেপে ধরে মাথায় স্কার্ফ বেঁধে সাজ খানিকটা গড়বড়ই করে দিলে তা মায়েরাই জানে—খোলা গাড়িতে হাওয়া লাগবে তাই কি? কিন্তু পাছে গাড়ি চড়া বানচাল হয় তাই আর কেউ কিছু বললে না। হরেও রোজকার পাতলুন ছেড়ে পোশাকি জিনসে তৈরী,—সেই যেটা সেবার পুজোয় পটলবাবুর কাছে চেয়েছিল ও।

ছুটল গাড়ি, উড়ল বেলুন। পিছনের সীটে কচি-কুচোগুলোকে নিয়ে হরে বসল, কোলে লুচি আলুরদমের ডেকচি। পটলবাবু ড্রাইভ করতে করতে মুচকি হেসে মনে মনে আউড়ালেন ‘হাঁকিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি কাল/আসছিল এক খ্যাঁকশিয়াল/সামনে এলে দেখতে পাই/ক্ষান্ত মাসির নাতজামাই’। গোপালী বাজার, সালুয়া ছাড়িয়ে কেশিয়াড়ীতে সর্বমঙ্গলার মন্দিরে এসে থামল গাড়ি, একটা নারকেল ভেঙ্গে পুজো দেওয়ার পর আরও খানিক এগিয়ে ভসরাঘাটের কাছাকাছি ধান খেতের পাশে সোনাঝুরি গাছতলায় হল ছোট একটা চড়ুইভাতি। শেষ পাতে নলেন গুড়ের রসগোল্লা পড়তেই মনে মনে তারিফ করেই ফেললেন হরের, ওটা ওঁর মনে ছিল না।

এরপর আরো কত ড্রাইভ করেছেন পটলবাবু, কখনো অমাবস্যার রাতে এক আকাশ তারা দেখে বলেছেন ‘চল হরে, একটু ডিমের ভুনি খিচুড়ি বানা, গাড়িটা বার করি।’ ঘন বসতি ছাড়িয়ে শালবনের একপাশে গাড়ি রেখে তারা-ঢাকা আকাশের তলায় রাতের খাওয়া সারা, কখনো অঘ্রাণের সকালে পাকা ধানের হিল্লোলের দিকে শুধুই চেয়ে থাকা। কিন্তু সেই প্রথম রবিবারে বেলুন উড়িয়ে ছোটদের নিয়ে প্রথম ড্রাইভ—তার স্বাদ যেন অনন্যই ছিল।

এ-ধরনের সাধারণত কম শোনা অবাক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলাতে পটলবাবুর জুড়ি ছিল না বলেই বোধহয়, আজব সব ঘটনারা পটলবাবুকে তাক করেই যেন রাখত। মফঃস্বলের জামা পরা শহর মেদিনীপুর, সেখান থেকে আমন্ত্রণপত্র গেল পটলবাবুর কাছে কার র‍্যালিতে যোগদানের জন্য। ফি বছর দুগগো পূজোর আয়োজন করে মেদিনীপুর ‘সখের ক্লাব’। এবার ক্লাবের মধ্যমণি নান্টুদার ইচ্ছে হল বিজয়ার পর কার র‍্যালি, তাতে পুরনো নতুন যে কোনো গাড়িই অংশ নিতে পারবে। নাই বা ওদের বাবা কাকাদের গাড়ি থেকে থাকুক, আকাশ ছোঁয়া তেলের দামকে তুড়ি মেরে পিসতুতো, খুড়তুতো দাদারা তো ইয়ন, আইকনের দিকে হাত বাড়িয়েই ফেলেছে। রাস্তা ভাল না, পথচারীই ঠিক মতো চলতে পারে না, তার মধ্যেই পেশ হল ক্লাব সভাপতি নান্টুবাবুর উরু চাপড়ানো প্রস্তাব—বিজয়া উপলক্ষে নাটক থেটার নয় কার র‍্যালিই।

বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ (তাতে আশ্চর্যভাবে বাবা কাকারাও ছিলেন কিন্তু), ঘরের কাছে মা সিদ্ধেশ্বরী গ্যারেজে গিয়ে কটা পড়ে থাকা, মোটামুটি চলতি এম্ব্যাসাডার, হুড-খোলা মিলিটারি জিপ সারাবার বায়না দিয়ে এলেন, তার সাথে এও বলে এলেন গ্যারেজ মালিককে ‘বাবা অমল, চার ছ মাস চালাব, তারপর তোমার গাড়ি তোমারি থাকবে, বরং সারানো হলে বেচতেও সুবিধে হবে তোমার।’ তবু সাবধানি মানুষগুলো হাত খুলে খরচ করতে পেরে যেন বেঁচে গেলেন। ছেলেমানুষি লাল, নীল, হলদে সব রং বাছলেন গাড়ি পেইন্টের জন্য। একটা ১৯৫০ সালের ফিয়াটও ছিল, অমল সেটা ভারি যত্ন করে রেখেছিল, হাত বদল হলে আর যদি ফিরত না পায় তাই ওটার কথা ওঠায় হাঁ হাঁ করে উঠে সেটা নিজেই র‍্যালিতে চালাবে ঠিক করে রাখল। ক্লাবের পুজোর চাঁদা থেকে বেঁচে যাওয়া টাকায় মাংসের ঝোলের আয়োজনে আলু বাড়িয়ে, জমা ফাণ্ডের টাকা অল্প জুড়ে ছাপানো হল র‍্যালিতে যোগদানকারীদের জন্য সোনালি পাড় দেওয়া ছিমছাম কিছু কার্ড যার একটা কেশিয়াড়ীর এদিকে পটলবাবুর কাছেও পৌঁছালো। ছেলেরা এঁচে রেখেছিল কলেজ স্ট্রীটের কার্ড পাড়ায় বায়না দিতে যাওয়ার নামে মস্তি করে নেবে খানিক, কিন্তু নান্টুদা আগে থেকে আঁচ করে পাড়ার জগুদার প্রেসেই কাজ দিল। কখনও না হওয়া র‍্যালির মত ব্যাপারে কাছের মানুষদের যতটা জুটিয়ে নেওয়া যায় ততই না আনন্দ!

থানা পুলিশের পারমিশন নান্টুদার দৌড়াদৌড়িতেই হল। বাকিরা একটু গাঁইগুঁই করলে ‘নানুদা ওটা তুমিই সারো, থানা দেখলে সেই সেবারের মোটর সাইকেল লাফড়ায় কেস খাওয়ার কথা মনে পড়ে গা ছমছম করে।’ নান্টুদা সোৎসাহে বললে ‘আরে ভাবস ক্যান? উয়ো সব মেরা বাঁয়ে হাত কা খেল!’—খুব মেতে উঠলে নানুদা এমন ভাষার খেল দেখিয়েই থাকে।

সব মিলিয়ে দশজন গাড়ির মালিক নাম দিলেন। বাবা-কাকাদের দলের পাঁচ জন, তাতে অহীনবাবুর বন্ধু হিসাবে পটলবাবুও ছিলেন। আর এলেন সার দোকানের নকুলেশ্বর পাড়ুই, শাড়ি ব্যবসায়ী দামোদর দাস, সিমেন্ট-লোহা রডের প্রভুরাম সিঙ্ঘানিয়া; গদিতে বসে বসে আর ড্রাইভার চালিত গাড়িতে চড়ে এদের লাইসেন্স প্রায় পচতেই বসেছিল। অবশ্য কর্তাদের গাড়ি চালানোয় রপ্ত করতে ড্রাইভারদের খানিক কাজ বাড়ল। তবে সাবধানের মার নেই—ঠিক হল ফাইন্যাল দিনে পেশাদারিরা পাশেই থাকবে! অহীনবাবুরা সিদ্ধেশ্বরী গ্যারেজের অমলকে ধরে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে, এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে দুগগা বলে তৈরি হতে থাকলেন। পীযূষদা রবিদাদের নতুন গাড়ি তো ছিলই, তবু জেঠূ কাকুদের কাণ্ডকারখানা একটু অপাঙ্গে দেখে ওরাও কোলকাতা থেকে দুটো পুরনো ক্যাডিল্যাক আর বিটল আনিয়ে ফেললে।

নান্টুদাকে করিৎকর্মা বলতেই হয়— ট্র্যাফিক বিভাগের এক অফিসারের সাথে বসে র‍্যালির রুটও ঠিক করে ফেললে—ক্ষুদিরাম চক থেকে শুরু করে পোস্ট অফিস মোড়, গোলকুয়া চক, ধরমা ধরে কাঁসাই ব্রীজ পার হয়ে মোহনপুর, ইন্দাবাজার, পুরাতন খড়্গপুর পেরিয়ে আই,আই,টি পেরিফেরি রোড দিয়ে সবশেষে কেশিয়াড়ী। সময়টা একটু রোদ-পড়া ছায়া ছায়া সন্ধেবেলাই ধরা হল।

এবার রইল গাড়ি আর চালকদের সাজের পালা। সন্ধেবেলা হয়ে সুবিধেই হল। প্রায় সব গাড়িই ব্যাটারি চালিত এল,ই,ডি লাইটে সেজে উঠল—প্রভুরামের মারোয়াড়ি পাগড়ি, শেরওয়ানি, বাঙালিবাবুদের সবে অষ্টমী অঞ্জলিতে পরা ধুতি পাঞ্জাবী র‍্যালিতে রঙের ছিটে বাড়িয়ে দিয়ে আর একবার বেরলো। সাজ যাতে দেখা যায় পারমিশন নিয়ে গাড়ির ভিতরের আলো জ্বালিয়ে রাখা হবে ঠিক হল, খোলা জিপের তো সুবিধা ছিলই তাই আর আলাদা কিছু ব্যবস্থা লাগল না; আর পটলবাবু? উনি তো আরো মেতে উঠলেন। ওনার হুড খোলা গাড়ি— হরের ইচ্ছেয় কিছু আলো তো লাগানোই হল। বেশিটা পটলবাবুর প্রিয় কার্টুন নায়ক নায়িকারাই জুড়ে রইল, গাড়ির দু দরজায় মিনি আর মিকি স্টীকার আর পিছনের সীটের মাথায় চির নতুন টিনটিনের একটা মানুষ সমান হোর্ডিং। কেশিয়াড়ীর কাছাকাছি বসবাসকারী পটলবাবু কোথা থেকে যে এসব যোগাড় করতেন তা উনিই জানেন, কিন্তু যোগাড় ঠিকই হয়ে যেত।

দিনটা ছিল শনিবার। হাল্কা ভাত মাছের ঝোল খেয়ে দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়লেন পটলবাবু মেদিনীপুরের দিকে। সন্ধে ছটা—ক্লাবের ছেলেদের উত্তেজনা যেন তাজা তুবড়ি, শুধু সলতেয় মোমবাতিটি ধরানোর অপেক্ষা। নান্টুদা ট্র্যাফিক অফিসারের মোটরসাইকেলের পিছনে কেমন করে যেন জায়গা করে নিলে। বাকিরা যে যার টু হুইলার, সাইকেল মেজেমুজে বেলুন উড়িয়ে চড়ে বসলে; পরলে পুজোর সেরা সব টি-শার্ট। ট্র্যাফিক অফিসার আগে আগে এগোতে থাকল, নান্টুদার হাতে সবুজ ফ্ল্যাগ। দুপাশে বেশ কিছু সাইকেলারোহী ট্র্যাফিক কনস্টেবল ঘিরে রইল র‍্যালি, উপচে পড়া ভিড় সামাল দিতে—চোখের মনের এ-হেন তৃপ্তি জেলাবাসী যে আর কখনো পায় নি। কারা যেন ব্যান্ডের ব্যবস্থাও করেছিল, ক্ষুদেরা বাবা কাকাদের কাঁধে চড়ে এমন তালে তালে পা দোলাতে থাকলে যে ঘাড় খুলে যাওয়ারই যোগাড়, কিন্তু এই প্রথম বোধহয় ওদের এই বেয়াদপির জন্য ‘থাম! নইলে মারব এক চাঁটি’ শুনতে হল না। শ্বাশুড়ি দিদিশ্বাশুড়িরা পাশে আছেন ভুলে গিয়ে বৌদি ননদ একসাথেই কোমর হাল্কা নাচিয়ে ফেলাতে বড়রা না দেখার ভান করলে। আর পটলবাবুর পাশে বসা হরের খুশী তো কথায় না বোঝানোর মতই।

র‍্যালি শেষ হওয়ার পর পটলবাবু শুনতে পেলেন হরে কাদের যেন বলছে, ‘না, না কিছু না তো, ও আপনাদের চোখের ভুল!’ উনি এগিয়ে যেতেই এক সাথে অনেকেই প্রশ্ন করলে ‘আচ্ছা, আপনার গাড়ির ব্যাক সীটে যে দুজন বয়স্ক বয়স্কা একটু ঢাকাঢুকি দিয়ে বসেছিলেন, ওরা কারা?’---হরে আর একবার হাঁ হাঁ করে উঠে কথাটা উড়িয়ে দিলে। ওর কাছে ওটা আলো আঁধারিতে চোখে ধাঁধা লাগা ছাড়া কিছুই না, কিন্তু পটলবাবু মৃদু হেসে মনে মনে আউড়ালেন ‘হাঁকিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি কাল----’। মা আর বাবু বলত ‘তুই গাড়ি কিনলে চড়বই চড়ব’, আর উনি মানেন চলে গেলেও সবাই পাশের ঘরেই আছেন, সে ঘরের চাবি এ ঘরের কারো কাছে নেই, তাই ওদিকের ফিসফাস, আলোচনা, সিদ্ধান্ত কিছুই জানা যায় না।



(পরবাস-৫৮, নভেম্বর ২০১৪)