খানিকটা গোমুখাসনের মতোই পা মুড়ে বসেছিলেন দেবসেনাপতিবাবু। ঠিক সচেষ্টভাবে যে যোগাভ্যাস করছিলেন তা না। ওনার বসার ধরনটাই অমন। হাত দুটো যোগের কায়দায় পিঠের দিকে নিয়ে যাননি, দুপাশের বালিতে ভর দিয়ে রেখে, পিছন পানে একটু হেলে আয়েস করছিলেন আর কি! অনেকদিনের অভ্যাসে দেখেছেন বে-এশ আরাম দেয়। ওইভাবে পা ভাঁজ করে ধুতিটা ভালো করে পায়ের পাতার তলায় গুঁজে দিয়ে চাটাইয়ে বসেছিলেন উনি মুম্বাইয়ের চৌপাট্টিতে।
প্রতি শনিবার কুড়ি টাকা দিয়ে আধ ঘণ্টার জন্য চাটাই ভাড়া নিয়ে বসে থাকাটা আজ ওঁর অনেক দিনের শখ। তখন বম্বে মুম্বাই হয়নি। চাটাই ভাড়াও বোধহয় আরো খানিকটা কমই ছিল। সেইই কবে কলকাতা ছেড়েছেন----(কলকাতাও তখন কোলকাতা নয়)। সদ্য ইংরাজিতে এম,এ পাশ করে, একরকম প্রাণের ভয়েই যেন নানান জায়গায় দরখাস্ত দিয়ে যাচ্ছিলেন,---হঠাৎই বম্বের এক পত্রিকা অফিসে প্রুফ রিডারের কাজটা পেয়ে গেলেন। কোলকাতা যেন বুকের ওপর চেপে বসছিলো--- পালাতে পেরে বেঁচেছিলেন। সাগরিকা----না, না, ওতো শ্যামলী—না থাক। চৌপাট্টির এই আলো আঁধারি এত জীবন্ত যে ফেলে আসা অতীত যেন এখানে বেমানান।
বেশিরভাগ সময়ই দেবসেনাপতিবাবু লোক্যাল ট্রেনে করে চারনি রোডে এসে নামেন আর ফুটব্রীজ ধরে রাস্তা পেরিয়ে চৌপাট্টিতে চলে আসেন। পানিপুরিওয়ালার উনি পুরনো খদ্দের, পাশ দিয়ে গেলেই ও ডাকে ‘শেঠ ক্যায়া বনাউঁ, ওহি তিন মিঠা, দো তিখা?’ সেনাপতিবাবু মৃদু হেসে ছোট চ্যাপ্টা স্টিলের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। বেশি খেতে পারেন না, ওই তিনটে মিষ্টি ফুচকা, দুটো ঝাল। তারপরই আছে সুইট ক-অর্ন। যতক্ষন ভুট্টা ঝলসানো হয় চাটাইয়ে বসে এদিক ওদিক দ্যাখেন উনি। এতদিনের দ্যাখা, কিন্তু এ আলো আঁধারির কি তীব্র টান! এতটাই অস্পষ্ট সবকিছু যে বালির রং পর্যন্ত বোঝা যায় না! একটু দুরেই অনেকটা জায়গা জুড়ে কালো বুরখা পরে কিছু মুসলমানি মহিলা বসে আছেন চাটাইয়ে, শরীরের ভারি গড়নে মনে হয় ওঁরা সব গিন্নিবান্নি দলের। বোধহয় একটা বড় পরিবার, জোয়ান, বুড়ো, ক্ষুদে মিলে বেশ অনেকজন। ঢিমে লালচে আঁধারকে সাজিয়ে তুলেছে ছোট ছোট ব্যাটারি পোরা কাঁচ প্লাস্টিকে জল আর ছবি ভরা বাউন্স খাওয়া বল, এই কাছে লাফায় তো মুহূর্তে আরো ঘন অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চোখ মারছে সুতো বাঁধা ইয়ো ইয়ো। হাতে ঠেলা স্টলে লাগানো চিকমিকে এল,ই,ডি লাইটস—সব যেন জোনাক পোকার মত আরো ফুটে উঠেছে। তবে স্নিগ্ধতাহীন সব জোনাক, কিন্তু অনেক অনেক বেশি স্টাইলিশ, শহুরে—মুম্বাইয়া তো! একটু দূরে একটা বড় মেয়ে আলো দেওয়া গুলতি ছোঁড়ায় ব্যস্ত, ও ঠিক পারছে না। ওর বয়সানুযায়ী খেলাটা বোধহয় বেমানান, কিন্তু ওর কোনোও ভ্রুক্ষেপ নেই। দেবসেনাপতিবাবু দেখছিলেন ওকে লক্ষ্য করছে কিছু বিচ বয়, ভাবগুলো যেন একবার ডাকলেই শেখানোর ছলে হাত ধরে।
ক্যুইন্স নেকলেসকে আর রানির হার মনে হয় না দেবসেনাপতিবাবুর। দূরে আকাশ ছুঁতে যাওয়া হাই রাইজের আলো তাকে করেছে ফুলউলির গলার কটা বল খসে পড়া সোনালি কাঁচপুঁতির মালা। সেই যারা গাড়ির জানলা দিয়ে ফুল গলিয়ে দেয়। ভারি মায়া ওদের চোখের চাওয়াতে। একটা বেন টেন ছাপ লাল টি শার্ট পরা ক্ষুদে,—আড়াই বছুরেই বোধহয়, কি লাফটাই না মারছে, লাফিয়ে তিন পাক গড়িয়ে আবার লাফ! একটূ দূরে চাটাইয়ে একে অন্যের পিঠে ঠেস দিয়ে বসে দুজন, ওরাই বোধহয় ক্ষুদের বাবা মা। আজ ওনার ছেলে থাকলে ওই লম্ফবীরের বাবার মতোই বয়স হতো হয়তো।
নিজের অজান্তেই পিছু হটতে গিয়ে রুখে গেলেন দেবসেনাপতিবাবু।
কাছে, দূরে, চারদিক থেকে পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমার গানের টুকরো ভেসে আসছিল। ‘তেরে ঘর কে সামনে এক ঘর বনাউঁগা’র সাথে পাল্লা দিয়ে ‘জরা হটকে, জরা বঁচকে ইয়ে হ্যায় বম্বে মেরি জান’---। দুটো কলিই দেবসেনাপতিবাবুর বড় প্রাণের---মিটি মিটি চোখে ইতি উতি চেয়ে উনিও গুনগুনিয়ে গলা মিলিয়ে দিলেন। গানগুলো আসছিলো ছোট ছোট জিপ গাড়ি, মোটর সাইকেল থেকে, ওগুলো ব্যাটারীতেই বোধহয় চলে, ক্ষুদেদের মন লোভাতে বিচবয়-রা ওগুলো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ কে যেন ধপ করে পাশে এসে বসল। ওই গণপতিয়া-ই, ওর ঘাম মাখা কালো মুখটা চকচক করছে আর চিকমিকিয়ে উঠছে ওর এক কানে পরা পাথর বসানো মাকড়ি।
সেনাপতিবাবু ওর দিকে ঘুরে বসলেন। ‘ক্যামন আছিস রে, বাজার ক্যামন চলছে তোর?’ বলতেই গণপতি এক গাল হেসে বললে ‘অচ্ছা হ্যায় শেঠ, বোলো আপ ক্যায়সে হো?’---- দুটো কথা হতে না হতেই সেই আড়াই বছুরে ওর মিনি জিপে চড়ে বসল আর গণপতি অতি যত্নে ওকে বসিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে গেল গাড়ি।
আজ যেন দেবসেনাপতিবাবুর মনের ভাবগতিক একটু পিছনপানেই। এমনিতেই ওঁনার মনে হয়, এই আলো-আঁধারিতে কাছের মানুষের মুখও স্পষ্ট বোঝা না যাওয়াটার একটা ভারি সুবিধে আছে। কোনো কৌতূহল মাখা ‘কি ভাবছ’র মুখোমুখি হতে হয় না, বেশ নিজের মনের নুড়ি পাথরগুলো নাড়াচাড়া করা যায়।---অন্যমনস্কভাবেই চোখে পড়ল পানপাতার মত বা আর একটু সঠিক বললে বলা যায় লিটল হার্টস বিস্কুটের মত এক গুচ্ছ রঙ্গিন বেলুন নিয়ে বুড়ো বেলুনওয়ালাটা ছুটে যাচ্ছে। সেনাপতিবাবুর এই এক মুস্কিল, ভাষা নিয়ে ঘাঁটেন বলে সদাই মনে হয় তুলনাটা কি ঠিক হল? নিজের নামটা নিয়েই কত চিন্তা ভাবনা করেন মাঝে মাঝে, কি যে এত বড় নাম, কিন্ত বাবা- মা রেখেছিলেন, তাতে ওনার কিছু করার ছিল কি? সে যাইহোক, সুতোয় ধরা হাওয়ার টানে তেরছাভাবে ওড়া বেলুনগুলোকে কোথায় যেন দেখেছেন দেখেছেন মনে হ’ল; এর সাথে একটা গান যেন জুড়ে আছে। বেশি ভাবতে হ’ল না, মনে এল সিইনটা ‘আনন্দ’ সিনেমার আর গানটা মান্না দের দরাজ গলায় ‘জিন্দগী এক অজীব পহেলি, কভি ইয়ে হঁসায় কভি রুলায়’, এতদিন হয়ে গেছে সব কথাগুলো বোধহয় ঠিক হ’ল না। কিন্তু দিনটা জ্বলজ্বল করছে। সেদিন যে ক্লাস বাংক করে শ্যামলীর সাথে প্রথম সিনেমা যাওয়ার দিন, হাতিবাগানের ‘মিত্রা’য়। ইউনিভার্সিটি থেকে সোজা ট্রামে করে হাতিবাগানের চৌমাথা, আর একটু হেঁটেই হল। ট্রামের টিং টিং আওয়াজ যেন কানে এল এইমাত্র,-----সত্যি! মনের আজব গতি, সে যেন জলে ভাসা পাতা, হাওয়ার টানে এগোয়, পেছোয়------। সেদিন শ্যামলীর প্রবল আপত্তিতে কিছু খাওয়া হয়নি, দাদা ,কাকারা তো সদাই ও পাড়ায় ঘুর ঘুর করছে, যদি চোখে পড়ে যায়! সেই শ্যামলীই হয়ে উঠেছিল ওঁর আদরের সাগরিকা। নিজের সাথে মস্করা করে সেনাপতিবাবু ভাবছিলেন চৌপাট্টির এই আলো আঁধারিতে শ্যামলীকে দেখলে মা ওর শামলা রং ধরতেই পারত না। শ্যামলী, ওঁর আদরের সাগরিকা অভিমান করে বলেছিল ‘মার কথা ফেলতে পারবে না তো আমায় বাঁধলে কেন’?---কাউকেই ফেলতে পারেন নি উনি, সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন এই মুম্বাইয়ে---মুম্বাই যখন ছিল বম্বে।
হিসেব নিকেশের ইচ্ছে আর নেই দেবসেনাপতিবাবুর। মা গত হয়েছেন বেশ কিছু বছর হ’ল, মার শেষ সময় পাশে ছিলেন; সব মিটতে আবার ফিরে এসেছেন ওঁর প্রিয় কর্মস্থলে।
তবু অঙ্কের বাইরে কেন জানি মাঝে মাঝে বেশ রাগ ধরে ওনার। কেন, কেন সেদিন শ্যামলীকে নিয়ে চলে আসেন নি, এতে মার কিছু অসম্মান হ’ত কি? নাহয় মাকে বলেই আসতেন---বাঙ্গালির রোম্যানটিসিজম কি কেবলই বিরহের মাটিতে ফুল ফোটায়?—এমনই কত কি আনমনে ভাবছিলেন চাটাইয়ের দাম মেটাতে মেটাতে। হঠাৎই চোখে পড়ল এক মেয়ে,---সবুজ পরী বলবেন কি? পাতা রঙা স্যাটীনের পাটিয়ালা আর খাটো কুর্তা পরা। ওই রঙেরই ওড়নায় মাথা খানিক ঢাকা—মনে হয় বিবাহিতা, সঙ্গে শেরওয়ানি পরিহিত কেউ,-স্বামীই হবেন; এমন সলাজ স্বপ্ন ভরা চাহনি দুজনের-মন তো তাই বলছে। কিন্তু একি--যতটুকু দেখা গেল আলো আঁধারিতে---এযে অবিকল শ্যামলী! এতগুলো বছর না কেটে গেলে হয়তো ছুটেই কাছে চলে যেতেন! শুনেছিলেন এক অবিকল মুখচ্ছবির দুজন মানুষ অনেক সময়ই দেখা যায়---কি জানি তাই কি প্রেমের এই সুখচ্ছবি দেখে মন ভরে গেল দেবসেনাপতিবাবুর! ওঁর স্বপ্ন বেলাভূমিতে আর এক নতুন স্বপ্ন এসে জুড়ল যেন। এক ভরপুর প্রেমের স্বাভাবিক পরিণতি যেন জ্যোৎস্না রাতে জোয়ারের মত ওঁকে ভরিয়ে দিয়ে গেল! ফিরতি ভিড়ে মিশে যেতে যেতে দেবসেনাপতিবাবু মৃদু হেসে ভাবছিলেন এই বলিষ্ঠ, জাগন্ত পটভূমিকায় এই পরিণতিই যেন মানায়, এ-যে অনেক মানুষের আনন্দভূমি, এ-যে স্বপ্ন বেলাভূমি—মুম্বাইয়া স্টাইল।
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)