ISSN 1563-8685




ঘোড়াটা ঘোড়াটা

নেকক্ষণ ধরে রাগ রাগ মুখ করে হাঁটলো ঘোড়াটা। বগ্‌-টগা বগ্‌-টগা - বগ্‌ ...। তোমরা হয়তো বলবে - ঘোড়াটা ছুটছিলো; কিন্তু তা না। ঘোড়াটা হাঁটছিলো। আর মনের ঝাল মেটাতে মাঝে মাঝে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলছিল - দ্যুৎ দ্যুৎ! এই কি একটা খাবার? দ্যুৎ দ্যুৎ। নিজে তো দিব্যি কুড়মুড় করে ... দ্যুৎ-দ্যুৎ! ...

কথাগুলি কিন্তু বলা হচ্ছিল মনে মনেই। তাই এক্কার মালিক কথাগুলো কিছুই শুনতে পেল না। অবশ্য শুনতে পেলেও বুঝতো কিনা বলা যায় না। সে যাই হোক না, শুনতে পেলো না। সে তার ময়লা সাদা পাগড়ির কোণা দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিয়ে আবার চিবোতে লাগল কুড়মুড় করে।

ছোটলাইনের যে রাস্তাটা ধরে 'শোনপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার' ঝিক্‌-ঝিক্‌ ঝক্‌-ঝক্‌ ঝিকি-ঝিকি - ঝক্‌ ঝক্‌ করতে করতে বারাণসী থেকে এলাহাবাদ-এর পথে দুল্‌কি চালে ছুটছিল সেই পথেরই পাশের কোনো এক অখ্যাত গ্রামের ধুলো-ধুলো পথ দিয়ে ঘোড়াটা যাচ্ছিল তার এক্কা নিয়ে। এক্কাটা খালি। কেবল তার বুড়ো মালিক হাতে তার ছপ্‌টিটা নিয়ে বসেছিল ঘোড়াটার লেজ ঘেঁষে। অহিমনপুরের কাছে তার বাড়ি। ভালোমানুষ চেহারার ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্যের বুড়ো-সুড়ো গেঁয়ো মানুষ। আধময়লা ধুতি আর কামিজ তার গায়ে। তার উপর মোটা খসখসে কাপড়ের পুরু-পুরু মতো পুরোনো এক 'সদরী'; মাথায় ফের দিয়ে জড়ানো সাদা কাপড়ের এক পাগ্‌ড়ি। চুল যে কয়গাছি আছে তেল না-দেওয়া মাথায়, তা সবই সাদা। সাদা তার দুপাশ দিয়ে নেমে-আসা গোঁফজোড়া এবং না-কামানো দাড়ি।

এ বছর অর্ধকুম্ভমেলা হচ্ছে প্রয়াগে। গঙ্গার কাছে সঙ্গমের দুদিকের বিস্তীর্ণ বালুচর জুড়ে কত যে নগর গড়ে উঠছে রাতারাতি! রেলগাড়িটা যখন দারাগঞ্জ স্টেশনের আগে গঙ্গার ওপর ব্রীজ দিয়ে ঝিমিঝিমি ঝম-ঝম করে যায়, তখন দেখা যায় বহুদূর জুড়ে কাপড়ের সারি সারি 'বাড়ি' দীঘির বুকে শাপ্‌লা-শালুকের মতো জেগে উঠছে। তার পাশে-পাশে কাছে দূরে টিন দিয়ে ঘেরা-ঘেরা কত জায়গা। কোনোটা চিকিৎসা কেন্দ্র, কোনোটা জনকল্যাণ দপ্তর। বালুর ওপরই রোলার চালিয়ে দুরমুশ পিটিয়ে দিগন্ত জুড়ে তৈরি হয়েছে চওড়া রাস্তা। তার ওপর গাড়ি যাওয়ার জন্য মোটা লোহার পাতের চৌকো চৌকো স্লেট দুসারি পাতা। সারি সারি আলোর খুঁটি, ঘরের কাঠামো, জলের পাইপ জায়গায়-জায়গায় জড়ো করা। গর্ত কাটা হচ্ছে ছ'টা আটটা করে এক এক জায়গায়। লোকে যাতে যেখানে-সেখানে ময়লা না করে তাই শৌচাগার তৈরি হবে এসব জায়গায়। .. ঠিক যেন জন্মাষ্টমীর সাজানো চলছে!

রেললাইনের পাশেও বড় বড় পুরোনো স্টেশনগুলির মাঝে মাঝে একটা-দুটো করে ছোট-ছোট হল্ট তৈরি হয়েছে। নতুন এক একটা দু তিন কামরার ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি। সাদা আর হলুদের রঙ। আশেপাশে কয়েকটা সিমেন্টের বেঞ্চি। নতুন-নতুন লোহার খুঁটির ওপর ঝকমকে নতুন-নতুন নাম। ছোট্ট ছোট্ট গ্রামের যেমন-তেমন করে দিন-কাটানো মানুষেরা, তাদের বাচ্চা-কাচ্চা আর ঝি-বউয়েরা মেলা দেখতে যেতে পারবে বলে এত আয়োজন! নতুন-নতুন মাস্টারবাবুরা চকচকে খাতাপত্তর আর গোছা গোছা টিকিট নিয়ে সোঁদা সোঁদা জানালা ঘেঁষে বসবেন, টিন্‌টিন্‌ করে রেললাইন এর টুকরো লোহায় বড় একটা লোহার গজাল দিয়ে ঘন্টি বাজাবে লাইনম্যান আর টুক্‌টাক্‌ টিকিট কেটে অল্প দামের নতুন পোষাক পরা গ্রাম্য মানুষেরা কলকল করতে করতে চড়ে বসবে গাড়িতে। গাড়ি চলবে - হু-উ-উ-স!

এই সব মানুষদেরই কাউকে কাউকে অল্প ভাড়ায় এই সব স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে কিংবা স্টেশন থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বেড়াচ্ছিল এক্কাটা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছিল একটু। বুড়ো এক্কাওলা পাগড়ি খুলে তাই ঘুরিয়ে একটু হাওয়া খাচ্ছিল কিংবা দু-চার দানা কিছু ফেলছিল মুখে। ঘোড়ার ভাগ্যে জুটছিল ছোলা-জল, দানা-পানি।

কিন্তু খেতে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল ছোট ঘোড়াটার। দ্যুৎ! সেই যত পোকায় ধরা ছোলা! এত কিপটে কেন গো বুড়ো! নিজে তো কুটুরমুটুর কত কী চালিয়ে যাচ্ছ! আমার বেলাই যত আঁটিসাঁটি!

মনে মনে ঘ্যান-ঘ্যান করতে করতে একসময় খুব রাগ হল ঘোড়াটার। দাঁড়াও! মনে মনে ভাবল সে - দেখাচ্ছি তোমায়! বুঝিয়ে দিচ্ছি কত আমার দাম!

চওড়া যে পীচবাঁধানো রাস্তাটা সরায় জগদীশ লেখা নতুন বোর্ডটার পাশ দিয়ে রেললাইনের এপার থেকে ওপার হয়ে নাচের ভঙ্গিতে চলে গেছে। 'ক্রসিং'-এর দুপাশে তার দুটো লোহার গেট। রেলগাড়ি যেই 'পু-উ' করে শাঁখ বাজাতে-বাজাতে আসবে, গেট দুটো অমনি হাত ছড়িয়ে পথ আগলে দাঁড়াবে - লরী আর গরুর গাড়ি, এক্কা আর রিক্‌শা। সাইকেল আর পায়ে চলা মানুষের।

এক্কা যেই 'লেভেল ক্রসিং'-এর কাছে এসেছে অমনি দূর থেকে 'শোনপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার' হুড়মুড় করে বলতে লাগল - আসছি আসছি। - গেট দুটো তাড়াতাড়ি হাত-পা ছড়াতে লাগল। এক্কাটা তখন দুই গেটের মাঝখানে। বুড়ো সাততাড়াতাড়ি গাড়িটাকে লাইনের বাইরে আনলো বটে, তার পাগড়িটা খসে পড়ল গেটের এপাশে।

ফাঁকা রাস্তাটার একপাশে ঝকমকে সকালের রোদে এক্কাটাকে দাঁড় করিয়ে এক্কাওলা নামল সেটা থেকে। - যাই, পাগড়িটা নিয়ে আসি গে! - ভাবল সে। ছপ্‌টিটা বসার জায়গায় রেখে গেটের তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে ঢুকে আড়চোখে দূরের ব্যস্ত-সমস্ত রেলগাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে স্যুট্‌ করে পাগড়িটা তুলে নিয়েই গুঁড়ি মেরে বাইরে চলে এল সে। ধুলো ঝাড়লো গায়ের আর পাগড়ির। তারপর আবার মাথায় জড়ালো সেটা।

'শোনপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার' তখন এসে পড়েছে হৈ হৈ করে। সেদিকে তাকিয়ে বুড়ো দেখল জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে নাক বাড়িয়ে লোকেরা কি দেখিয়ে ভারি হৈ চৈ করছে। পেছন ফিরেই তার চক্ষুস্থির! আরে! দেখেছো কী পাজি!

ঘোড়াটা তার খালি এক্কাটা নিয়ে ছুট লাগিয়েছে। ফাঁকা পীচের রাস্তায় গড়গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।

হায়! হায়! চীৎকার করতে করতে বুড়ো দৌড়ল গাড়ির পিছনে। গেল! গেল! সব গেল! এক্কাটা ঘোড়াটা গেলে যে না খেয়ে মরতে হবে তাকে! এই! থাম! থাম!

ঘোড়াটা তখন ছুটছে আর বলছে মনে মনে -
সকাল থেকে কুটুরমুটুর চালাচ্ছিলে তো!
ভালো-ভালো খাবার-দাবার, দিচ্ছিলে না তো!
এমনতরো হায়-হায়-হায় কচ্ছিলে না তো!
আমার কথা ভুলেও মনে নিচ্ছিলে না তো!

- এখন কেমন লাগছে? ঘোড়ার সঙ্গে ছুটে কি আর মানুষ পারে? তায় বুড়ো মানুষ! অনেকখানি পেছনে পড়ে গেল এক্কাওলা। কপাল চাপড়াতে লাগল।

দৈবাৎ একজন মানুষ সাইকেলে চড়ে আসছিল সেই পথে। খালি এক্কা ছুটে আসতে দেখে প্রথমে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল কিছুটা। কিন্তু দূর থেকে বুড়োর চীৎকার শুনে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তাড়াতাড়ি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে।

অনেকটা পথ ছুটে ঘোড়াটাও একটু হাঁপিয়ে পড়েছিল। পথ বন্ধ দেখে পাশ কাটাতে গিয়ে হুড়মুড় করে নেমে পড়ল সে পাশের ঢেউ খেলানো ক্ষেতে। হলদে - সবুজ ফসলের কয়েকটি শীষ হাত বুলিয়ে দিল তার মুখে, তাজা গন্ধে মন ভরে গেল তার। দাঁড়িয়ে পড়ে বুক ভরে ঘ্রাণ নিল সে। দুটি চারটি গাছ চিবোতে লাগল একটু একটু। আর মনে মনে বলতে লাগল - বাঃ! বাঃ!

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছলো বুড়ো। ঘোড়াটাকে ব্যগ্রভাবে ফসল খেতে দেখে মনটা কেমন করে উঠলো তার। আহারে! - নিজেকে নিজে বলল সে - ক্ষিদে পেয়েছিল বেচারার!

কিন্তু এ যে পরের ক্ষেত! তুতিয়ে পাতিয়ে ঘোড়াটাকে তুলে আনল সে পথের ওপর। পকেট থেকে একমুঠো ছোলাভাজা বের করে ধরলো তার মুখের কাছে। ঘোড়াটা কপাৎ করে মুখে পুরলো কিছুটা। চিবোলো। উঁ! এই তবে খাচ্ছিলো এতক্ষণ ধরে! এই নাকি? এওতো সেই ছোলা! তফাতের মধ্যে তারটা ভেজা আর এটা শুকনো।

মনটা ভিজে গেল ঘোড়াটার। আহা! শুধুই সে রাগ করে হয়রাণ করেছে বেচারাকে! কেমন হাঁপিয়ে গেছে দ্যাখো! - আলতো করে মুখটা সে বুলিয়ে দিল মালিকের হাতে।

সাইকেলওলা বললে - ভালোই হল তোমার এক্কাটা পেয়ে। আমার গাঁ ঐ যে ঐ দিকে। আমার বাড়ির সবাই প্রয়াগে যাবে স্নান করতে। তাদের স্টেশনে আনতে যাবে তুমি?

বুড়োর আগেই ঘোড়াটা বলে উঠল - চিঁহিঁ-চিঁহিঁ! হ্যাঁ-হ্যাঁ!

এখন ঘোড়াটা সত্যিই ছুটছে। তার গলার ঘুঙুরে একটু একটু শব্দ হচ্ছে — ঝিনি-ঝিনি ঝিন-ঝিন ... চাকাগুলি বলছে — কোঁচ-ক্যাঁচ ক্যাঁচ-কোঁচ ... খুরে খুরে বোল উঠছে — টগ্‌বগ্‌-টগ্‌বগ্‌ টগাবগা-টগ্‌বগ্‌ - বগ্‌টগা-বগ্‌বগ্‌ বগ্‌বগ্‌-বগ্‌বগ্‌ ...



(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)