প্রবাদ মালা; কল্যাণী দত্ত (তরুণ পাইন সম্পাদিত); থীমা প্রকাশন, কলকাতা-২৬; ১৯৯৯; পুনর্মুদ্রণ ২০১২; ISBN 978-93-81703-12-0
মোল্লা দিয়েছেন দাওয়াত (নেমন্তন্ন), সালগিরার(জন্মদিন)—আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে। ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটি গেল সারা গ্রামে। অনুষ্ঠানের দিন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। ওই এসেছেন চাচাতো ভাই, তাঁকে দেওয়া হল এক পাত্তর সুরুয়া। উনি ফুফাতো, তাঁকেও। ঐ তো উনি চাচাতো ভাইয়ের খালাতো ভাই, তাঁকেও। বেশ। উনি? চাচাতো ভাইয়ের ভায়রাভাই.......এদিকে সুরুয়া কমছে যে....তাঁকেও যে দিতে হয় এক পাত্তর, যদিও একবাটি জল মিশিয়ে। তারপর ‘শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন তার যে বাড়িওলা’ এসে যখন অনুযোগ জানায়, “মোল্লাসাহেব, এটা কি সুরুয়া? এতো পাতলা?” “আপনার পরিচয়?” “আজ্ঞে, আমি আপনার চাচাতো ভাইয়ের খালাতো ভাইয়ের ফুফাতো ভাইয়ের.....।” মোল্লার উত্তর, “জী, ওটা সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া........”!!
এই নিবন্ধে সেই আশঙ্কা রয়ে গেল কিনা, তাতেই ইতস্ততঃ।
তা নয়। আসলে, এক অষ্টাশি পৃষ্ঠার চটি বই যে এতো আনন্দ বয়ে আনতে পারে—বইমেলার স্টলে কেনার সময়ে তা ধারণা করতে পারিনি। এ’বইয়ের মূল্য তাই ষাট টাকার শতগুণ বেশি।
নমস্য সুশীলকুমার দে’-মশায়ের 'বাঙলা প্রবাদ' এক আকর কোষগ্রন্থ। আমাদের আজকের আলোচ্য গ্রন্থখানির প্রণেতা সংস্কৃতসাহিত্যের প্রখ্যাত অধ্যাপিকা কল্যাণী দত্ত (১৯২৭-২০০৩) দে-মশায়ের সে-গ্রন্থ পড়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৯৯-এ শমীকবাবুদের ‘থীমা’ গ্রন্থাকারে তা প্রকাশ করেন, পুনর্মুদ্রণ ২০১২। ইনসাইড ব্লার্বে লিখেছেন, “বইয়ের আলোচনা বা রিভিউ কোনো বইয়ের জন্ম দেয় এমন সচরাচর নজরে পড়ে না, অন্ততঃ বাঙলা ভাষায়। সুশীলকুমার দে-র চিরায়ত ‘বাঙলা প্রবাদ’ সংকলন গ্রন্থটি পড়ার সময় কল্যাণী দত্ত দেখেছিলেন, এই মহাগ্রন্থে অন্তর্ভুক্তি পায়নি অনেক প্রবাদ; সংগৃহীত প্রবাদের মধ্যেও রয়ে গেছে পার্থক্য। এই সব নিয়েই ‘আরও বাঙলা প্রবাদ’ নামে এক সম্পূরক নিবন্ধ লেখেন ‘সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা’-য় প্রায় চল্লিশ বছর আগে। প্রায়-হারিয়ে যাওয়া সেই সংকলনের সঙ্গে আরও কিছু জুড়ে দিয়ে জন্ম নিয়েছে এই বইঃ ‘প্রবাদমালা’।”
এই নিবন্ধটা সেই গ্রন্থ-সমালোচনা গ্রন্থের সমালোচনা কিনা, তাই সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া হয়ে যাওয়ার ভীতি। বাকিটা পাঠকের বিচার্য।
প্রবাদের ইতিহাস সাহিত্যের চেয়ে পুরনো। নাটক, কাব্য, উপন্যাসের মত আজকের সাহিত্যধারার যখন জন্ম হয়নি, প্রবাদ ছিল তখনও। প্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যায় প্রাচীন হিব্রু, বাইবেল (সলোমনের কাহিনি) বা জাতকের নাম। মহান বুদ্ধ, ঈশাদেব, থেকে আমাদের দাদূ-কবীর-রামকৃষ্ণদেব প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে লোকশিক্ষে দিতেন। প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে প্রথম কোষগ্রন্থ হয় মহাচিনে, তারপর নবজাগরণের ইটালিতে, ফরাসিদেশে ও ইংরিজিতে। সুশীলবাবু সেই ধারা বাঙলায় বয়ে এনেছেন অনেক পরে, যদিও বাঙলাভাষায় সেই প্রথম। কল্যাণীদিও সেই পথেই।
প্রবাদ-প্রবচনের এক সুবিধে (বা, অসুবিধে) হল এ’ লেখা থাকে কম, বোলচালে বেশি। সুবিধে এই কারণে যে এতে তার প্রচার বেশি। অসুবিধে এর গ্রন্থায়নে। তাই কোন্ প্রবাদের ‘সঠিক’ রূপ কী, তার বিচার আমার কাছে এক আপনার কাছে আরেক। বিচার কে করবে? সেই শেষ বিচারের অভাবে প্রবাদ-প্রবচন চলে নিজের ধারায়, ঘাটে ঘাটে রূপ তার বদলে যায়। সময়ের সঙ্গে পরিগ্রহ করে নতুন রূপও। এটাই তার সৌকর্য।
এই তন্বীগ্রন্থে লেখিকা প্রায় ছ’শোর কাছাকাছি প্রবাদের অবতারণা করেছেনঃ তাতে যেমন আছে সুশীলবাবুর বইয়ে লিখিত প্রবাদের নবরূপ/ব্যাখ্যা তেমনই বহু বহু প্রবাদ/প্রবচন যেগুলো সেই মহাগ্রন্থে ঠাঁই পায়নি। ভাগ্যিস কল্যাণীদি ধরে রেখেছিলেন, নয়তো কোথায় কবে হারিয়ে যেত এরা। এ’সব তাঁর বামুনমাসি, ফরাসি-পিসিমাদের (গ্রন্থখানি এঁদেরই উৎসর্গীকৃত) গালেগল্পে চলা কথ্য, ঠাঁই পায়নি কোনো অভিধানে, কিন্তু আপন মনের মাধুরী মিশায়ে মিশিয়ে আছে মনের মধ্যিখানে। এ’সবের হার্দিক মিল তাই অতি গহনে, কেবল কাগজে কলমে নয়।
এই বই থেকেই উদাহরণ দিইঃ যেমন, ‘অলবড্ডে’ ‘আলতুসি’ ‘ধুদ্ধুড়ি নেড়ে দেওয়া’ বা, ‘চিপ্টেন কাটা’—শব্দগুলির সঙ্গে পরিচিত আছেন কী? এ’গুলির অর্থ যথাক্রমে, ‘কোনো কাজ গুছিয়ে না করতে পারা’, ‘অল্পে কাতর (মেয়ে)’, ‘উচিত শিক্ষা দেওয়া’ [উপেন্দ্রকিশোরে এর ময়মনসিংহী প্রতিশব্দ পড়েছিঃ ‘ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব’] ও ‘সমালোচনা করে কথা বলা’। না-পরিচিত থাকলে কাতর হবেন না পাঠক, কারণ এ’সকল প্রবচন অবশ্য অবশ্যই আঞ্চলিক। কলেজিকালে এক বান্ধবীর মায়ের মুখে এ’হেন নানান বাক্ধারা শুনে অবাক হয়েছিলাম যার একটাও আমি জানি না যদিও সেসবের নিজ-আঞ্চলিক রূপের সঙ্গে আমি যথেষ্টই পরিচিত। জানা গেল, তিনি ব্রাহ্মণবেড়িয়ার, আমি হুগলির—তাই এই ফারাক। কল্যাণীদিও যেহেতু হুগলির (দেবানন্দপুর, শরৎচন্দ্ররা এঁদের প্রজা ছিলেন) তাই তাঁর লেখা প্রবাদ মোর মা-ঠাগ্মা-দিদ্মার স্মৃতি এত বেশি করে চাগায়, তাই চোখে আনে এতো জল।
এ’প্রসঙ্গে আমার মনে পড়া নানান প্রবাদের উল্লেখের লোভ সম্বরণ করতে পারছি না, যে-সবের স্থান কোনো অভিধানে নেই তথাপি আমরা ভাইবোনেরা কাকা-পিসি-মাসিরা এই কথ্যেই আজও কথা বলি। অবশ্যই নিজেদের মধ্যে, ‘বাইরে’-র কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে সে-সব শব্দ মুখে রুখে যায়—তিনি বুঝবেন না ভেবে। আপিসে জয়েন করেছেন এক মহিলা ফিনান্সিয়াল এনালিস্ট। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধেয়, শুনি, আরেক সহকর্মিণীকে বলছেন, “কী উপজ্ঝান্তি বিষ্টি রে বাবা! তুই অবিশ্যি উল্টোডাঙা থেকে রাজারহাট যাবার হুদোহুদো বাস-অটো পাবি।” ডেকে পাঠিয়ে শুধোই, “কী বললেন?” তিনি বেচারি ভেব্ড়ে অস্থির। “হুগলী জেলার? উত্তর কলকাতা?” এ’বার হেসে ফেলে মেয়েটি। ঘাড় নাড়ে। মুহূর্তে বড় আত্মীয় হয়ে পড়ে।
যাক্, এবার নিজস্মৃতি থেকে সেইসব কয়েকটি প্রবাদ-প্রবচনের কথা বলে শেষ করি যা সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া—যা সুশীলবাবু-কল্যাণীদির গ্রন্থেও নেই (‘পরবাস’-এর পাতা থাকতে হারিয়ে যাবার ভয়? গজেন্দ্রকুমার-আশাপূর্ণার লেখায় এমন বেশ কিছু প্রবাদ অবশ্য আজও ধরা আছে)। যেমনঃ
১। ‘হামার-খামার’ কাজ—অনেক কাজ (গৃহস্থালির)
২। ‘গাব জ্বাল দেওয়া’—অকাজে সময় নষ্ট করা
৩। ‘উলোমালা’—কোনো কিছুতে অতীব মাতোয়ারা হয়ে যাওয়া
৪। ‘এঁ নেই ওঁ আছে’—চালু প্রবাদেঃ ‘হেলে ধরতে পারে না, কেউটে’
৫। ‘মৈ-মাড়োন’ করা—কোনো স্থান অত্যন্ত অগোছালো করে রাখা
৬। ‘চরিচাপোটে’ বসা — বেশ গুছিয়ে-জমিয়ে বসা (যেমন, সান্ধ্য-আড্ডায়)
৭। ‘ধু্ল্ধাপাটি’ ঝগড়া করা— প্রবল বিবাদ
৮। ‘নৈ-নারাক্কা’ করা—কোনো কাজ অপটু ভাবে করা, ঘেঁটে রাখা
৯। ‘নগ্দা মুটের মত’ কাজ করা—চটজলদি অপরিণামদর্শী কাজ করা। ‘ধর্তক্তা মার পেরেক’।
১০। ‘নিমুড়ো-নিঝুড়ো’ অনুষ্ঠান— চাকচিক্যরহিত
১১। ‘ফরকোট’ করা—অযথা ঝঞ্ঝাট বাড়ানো,ফ্যাকড়া বের করা
১২। ‘রাঁঢ়ের ঘরের কাত্তিক’—পুত্রতুল্য
চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই-প্রচ্ছদ গ্রন্থখানির। ইদানিং কলকাতার গাঙচিল-পারুল-লালমাটি-কারিগর ইত্যাদি প্রকাশনালয় যেসব চমৎকার চমৎকার বাঙলা বই-প্রকাশনার ধারা এনেছেন, মনে রাখতে হবে, থীমা-র হাতেই তার শুরুয়াৎ দু’-দশক আগেই। এই ভগীরথকে তাই সেলাম জানাতেই হয়।
ডিরোজিওর ক্লাস—শান্তিরঞ্জন বসু; ‘বাঙলার মুখ’ প্রকাশনা, মধ্যমগ্রাম, কলকাতা-১২৯; প্রথম প্রকাশঃ জুন ২০১২; ISBN 978-81-921186-9-7
“...তাঁর জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে বেশ কিছু গ্রন্থ বাংলাভাষায় রচিত হলেও, তাঁর শিক্ষাদানের বিষয় নিয়ে তেমন বিশেষ গ্রন্থ চোখে পড়ে না। সেইক্ষেত্রে এই গ্রন্থ একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।” দ্বিতীয় প্রচ্ছদপৃষ্ঠের এ’আশ্বাস পড়ে পাঠকের আশার ফানুস ফেঁপে উঠবে না? তাই নগদ সাতকুড়ি টঙ্কা ঢেলে আটানব্বুই পৃষ্ঠার কেতাবখানি কিনে ফেলা। এবং এক গাল মাছি।
সমকাল ও ভবিষ্যতের শিক্ষাপ্রাঙ্গনে তাঁর মাত্র বাইশ বছরের জীবন দিয়ে কবি-শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১) স্বছায়া কতদূর প্রলম্বিত করেছিলেন—তা এ’ বইয়ের আলোচ্য নয়, না তা এই নিবন্ধের আলোচ্য। ডিরোজিও ক্লাসে কীভাবে পড়াতেন ও ছাত্রদের সঙ্গে ভাববিনিময় করতেন, তাঁর ক্লাসের দৈর্ঘ্য কেমনভাবে কালেজপ্রাঙ্গন ছেড়ে মৌলা আলির দরগা পর্যন্ত প্রলম্বিত হত—এ’সবের সন্ধানই এই পুস্তকের দেবার কথা ছিল। তা না করে, মাত্র দু’টি দিন, ১৮২৯এর ৫ ও ৬ জুন তিনি নাকি ক্লাসে ছাত্রদের শুনিয়েছিলেন ইয়ুরোপে নানান ব্যক্তিগত সম্মুখসমরের ইতিহাস—অসি বা পিস্তল হস্তে—যা ‘ডুয়েল’ নামে পরিচিত। প্রায় শতখানেক পৃষ্ঠা ধরে কোন্রাজা কোন্গজা কখনও নারী কখনও একখণ্ড রুমাল বা একটা রাজহংসের জন্য ডুয়েল লড়ে কবরে চলে গেলেন বা জম্মের মত খোঁড়া হয়ে গেলেন—এ’পড়তে থাকা এক যন্ত্রণা!
এ’বইয়ের কৈফিয়তটা লেখকের ভাষ্যেই জানা গেল যে তাঁর আবাল্য ‘ডুয়েল’ সম্বন্ধে আগ্রহ ছিল (কেন?)। অনেক পরে অধ্যাপক অবন্তীকুমার সান্যাল ও পল্লব সেনগুপ্ত মশায়ের দু’টি নিবন্ধ পড়ে উনি এই বইটে নামিয়ে দিয়েছেন। না-ইতিহাসের চূড়ান্ত! কোন্গোত্রে ফেলা যায় এ’বইকে? ইতিহাস তো নয়ই, না-ইতিহাস ভিত্তিক গপ্প কাহিনি। ডিরোজিওর পড়ানোর পদ্ধতির ওপর কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ আজও চোখে পড়েনি। কী জাদুকাঠিতে উনি একটা প্রজন্মকে চাগিয়ে তুলেছিলেন তা জানার আগ্রহ আপামর পাঠকের। ঠিক এইখানে সুড়সুড়ি দিয়ে প্রকাশক যে বইখানি নিরীহ পাঠকের হাতে তুলে দিলেন, তাতে লোক ঠকানো বৈ আর কিছু হল না।
আরেকটি প্রশ্ন, যদি শান্তিবাবুর কোনো গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক উৎস থেকেই থাকে, তাতে কি ডিরোজিওর মাত্র ঐ দু’-দিনের পড়ানোর ইতিহাসই বিধৃত আছে? ডিরোজিও প্রথমে একজন কবি, তারপর এক মুক্তমনা শিক্ষক ও দেশপ্রেমী। গায়ে ইয়ুরোপীয় খুন থাকলেও নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিতে গর্বিত হতেন (তাঁর ‘To India—My Native Land’ কবিতা স্মরণীয়)। তিনি ছাত্রদের পরিচয় করিয়েছিলেন ইয়ুরোপের শ্রেষ্ঠ কবি শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের কর্মযজ্ঞে—শেক্সপীয়র-মিল্টন-বেকন-হিউম! সে-সব ক্লাস কেমন ছিল, কেমন হত রামগোপাল-দক্ষিণানন্দন-রাধানাথদের ভূমিকা—সে’সবই না পাঠক জানতে চান; কোন্কাউন্টের পিস্তলের গুলি কোন্ডিউকের নিতম্বের কোন্ অংশ ছ্যাঁদা করে চলে গেল সে-সব ছাইপাঁশ নয়। গ্রন্থের গালভরা নাম আর প্রচ্ছদে নজরটানা ছবি দিয়ে এ’হেন পাঠক-ঠকানো সমর্থনযোগ্য নয়।
ফরাসি বটানিস্ট ভিক্টর জকমঁ (১৮০১-১৮৩১) ১৮২৮-এ’ ভারতে আসেন। নানা নিরক্ষীয় উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহে উত্তরভারত-লাদাখ-তিব্বত চষে ফেলেন। বম্বেতে প্রয়াণ, ১৮৩১। লাহৌরে মহারাজ রঞ্জিত সিংহের দরবারের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে কিন্তু ডিরোজিওর নামোল্লেখ মাত্র নেই। সেই পালতোলা জাহাজের কালে তিনমাসের সমুদ্রযাত্রা ডিঙিয়ে “রামমোহন ও ডিরোজিওর সঙ্গে কথা বলতে” জাকমঁ ভারতে আসেন—লেখকের এ’উক্তি বালখিল্য। ১৮২৮-এই রামমোহন আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গেলেও ডিরোজিওকে তখন কে চেনে? তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এক ফরাসি বটানিস্ট আসবেন কেন? কী কথা? শান্তিবাবুর এই উক্তির ভিত্তি কী? জকমঁ যে একজন বিশ্বমানের বটানিস্ট ছিলেন সেকথা এ’ বইয়ের কোত্থাও লেখা নেই, তাঁকে এক ‘গবেষক লেখক’ ও মিউজিওলজিস্ট বলে পরিচয় করানো হয়েছে। তদুপরি এক বটানিস্ট হিন্দু কলেজের ক্লাসে এসে ‘ডুয়েল’ নিয়ে ভাষণ দিয়ে গেলেন—এ’ তথ্যও ঠিক হজম হচ্ছে না। অবন্তী সান্যাল মশায়ের সেই নিবন্ধখানি অবিশ্যি আমি পড়িনি; পড়লে শান্তিবাবুর অনুপ্রেরণার হদিশ পাওয়া যেত। পল্লববাবুর প্রবন্ধটি পড়েছি, তাতে এইসব ডুয়েল-টুয়েল ছাইপাঁশ নেই।
বইখানিতে সম্পাদনার কোনো পরিচয় নেই, অজস্র বানান ভুল, মুদ্রণপ্রমাদ (উৎসর্গ-পত্রেও!)। ‘উৎকর্ষতা’, ‘সন্তর্পন’, ‘ব্যঘাত’, ‘ক্যাসানোভা বহুবল্লভা ছিলেন’ বা Louis V কে ‘লুই পনেরো’ লেখা চোখকে পীড়া দেয়। য়ুরোপীয় নামগুলি কখন রোমান হরফে লেখা হবে কখনই বা বাঙলায়, তার কোন নিয়ম নেই, যখন যেমন ইচ্ছে লেখা হয়েছে। ১৮২৯-র পাঁচুই জুনের ক্লাসে ডিরোজিও সেই বছরেরই ২১শে মার্চে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ডুয়েল লড়ার কাহানি শোনাচ্ছেন! সেই প্রি-টেলিগ্রাফকালে পালতোলা জাহাজে ডাকবাহী ‘প্যাকেট শিপ’-এর পক্ষেও (জাতে দ্রুতগামী ‘ক্লিপার’) তিনমাসের কমে লণ্ডন থেকে কলকাতা পৌঁছন সম্ভব ছিল না।
এরপরেও লেখক জানাচ্ছেন, ডুয়েল নিয়ে বাঙলায় ব্যাপক চর্চা হওয়া প্রয়োজন। কেন? উনি মাত্র এক শতাংশ লিখতে পেরেছেন। বাকি ‘সহস্রাংশ’ এখনও লেখা বাকি!!
জানিনা, সে-লেখা প্রকাশ করতে কে এগিয়ে আসবে, এবং কেন? আমি বাপু তার সমালোচনা লিখতে পারব না।
বাঙলা রচনা—ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, সম্পাদনাঃ তপনকুমার ঘোষ; ‘পত্রলেখা’; কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০১৩; ISBN 978-93-81858-49-3
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জ্ঞানতাপস কে?
এহেঃ, মস্ত গোলমেলে প্রশ্ন হয়ে গেল যে! জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্র থেকে সত্যেন্দ্র-মেঘনাদ-মহলানবীশ-শহিদুল্লাহ্প্রমুখ হয়ে আজকের অমর্ত্য পর্যন্ত বহু নাম মনে ভিড় করে আসছে যে। আবার সূর্যসম গুরুদেব----তাঁকে বাদ দেওয়া যায় নাকি, যাঁর শিল্পীপ্রতিভা পাণ্ডিত্যকে ঢেকে দিয়েছে? স্যর যদুনাথ সরকার? গিরীন্দ্রশেখর? সুনীতিকুমার? এ’হেন নানা জ্ঞানক্ষেত্রের দিকপাল নামের টানাপোড়েন। বিজ্ঞান, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস---কোন্ক্ষেত্রের কোন্পণ্ডিতকে ছেড়ে কাকে নেব? তবে কি বহু বিষয়ের বহুমুখী প্রতিভাই এ’ক্ষেত্রে মানদণ্ড হওয়া উচিৎ? ইংরিজি polymath শব্দের বাঙলা ‘বহুমুখী প্রতিভাধর’ করলে যেন শব্দটির তীব্রতা হারিয়ে যায়। যে অর্থে এরিস্টটল, ভিঞ্চি, আল বিরুনি, ইব্ন রশিদ polymath ভারতীয়দের মধ্যে তার উদাহরণ কৈ?
আবার, জ্ঞানপ্রতিভার কথা উঠলে কেবল আধুনিক যুগের কথাই ভাবব কেন? বাঙালি জ্ঞানান্বেষণের ইতিহাস বৃটিশ-ঔপনিবেশিকতার চেয়ে বহু প্রাচীন যে! বুদ্ধপূর্বযুগে সাংখ্যদর্শনের উদ্গাতা খুলনাবাসী কপিলমুনির খ্যাতি নেপালের কপিলাবস্তু (স্থাননামটি তাঁরই নামে) থেকে তামিলক্ষেত্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালী শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর আজও তিব্বতে প্রায়-তথাগতের মর্যাদায় পূজিত। ভক্তিমার্গের সর্বোচ্চে ওঠার আগে নদীয়ার নিমাই পণ্ডিত ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ-স্বীকৃত নৈয়ায়িক পণ্ডিত। বাঙালি মধুসূদন সরস্বতীর (“পারংবেত্তি সরস্বত্যা.......”) সামনে বাদশাহ্ আকবর করজোড় করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঊনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ভাগে, যখন বাঙলার ‘নবজাগরণ’ বিপুলবিক্রমে গতিবান, কয়েক বছরের আগেপিছে জন্ম নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ-প্রফুল্লচন্দ্র-উপেন্দ্রকিশোর-নরেন্দ্রনাথ, ঐ উত্তর-কলকাতাতেই জন্মগ্রহণ করেন শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ শীল---কালে যাঁর জ্ঞানপ্রতিভাকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিয়ে যাবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন দত্ত থেকে বিনয় সরকার মশায়। পরমহংসদেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর মুহ্যমান নরেন্দ্রনাথ ‘মিস্টিসিজম’-এর ব্যাখ্যা পেতে ছুটে যান তাঁর স্কটিশের টপার ক্লাসমেট ব্রজেন্দ্রের কাছেই! বাঙালি polymath প্রতিভা বলতে তাই ব্রজেন শীলের নামই প্রথমে মনে না এসে উপায় নেই।
ব্রজেন্দ্রনাথ প্রণীত গ্রন্থতালিকায় একবার চোখ বুলোলে এটা প্রতীত হতে বাধ্যঃ গণিতের ওপর তাঁর মহাগ্রন্থ A Memoir on the Co-efficient of Numbers: A Chapter on the Theory of Numbers (1891); ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসঃ Neo-Romantic Movement in Bengali Literature (1890-91); ধর্মতত্ত্বঃ A Comparative Study of Christianity and Vaishnavism (1899); সমালোচনা-সাহিত্যঃ New Essays in Criticism (1903); রসায়ন ও তার ইতিহাসঃ Introduction to Hindu Chemistry (1911); নৃতত্ত্বঃ Race-Origin (1911); দর্শনঃ Syllabus of Indian Philosophy (1924); জীবনী ও ইতিহাসঃ Rammohan Roy: The Universal Man (1933); আর শেষ বয়সে কলকাতায় ফিরে ভগ্নস্বাস্থ্য ও প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় ইংরেজিভাষায় লিখলেন মহাকাব্যঃ The Quest Eternal (1936)---যার তুলনা হয় গ্যেটের ‘ফাউস্ট’-এর সঙ্গে!!!
বাপ রে! সাধে কি তাঁকে “চলমান বিশ্ববিদ্যালয়” বলা হত? সুধীন দত্ত তাঁকে ‘সক্রেটিস বংশের শেষ কুলপ্রদীপ’ বলেছিলেন; ‘বিদ্যার দিগ্গজ’ বা ‘চলন্ত বিশ্বকোষ’-এর মত বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন বিনয় সরকার মশায়। প্রিয় ছাত্র ব্রজেন্দ্র গণিত না দর্শন কিসে এম.এ. পরীক্ষা দেবে---তাই নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে সেকালে টানাপোড়েন চলেছিল। ব্রজেন্দ্র অবশ্য তখন মিউজিয়মে বসে বায়োলজি পড়তে মত্ত! সেই দর্শনে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম হলেন তিনি---চারটে পেপারের প্রত্যেকটা থেকে মাত্র একটা একটা করে উত্তর লিখে। জ্ঞানের গভীরতার আন্দাজ তাঁর অধ্যাপকগণ তার মধ্যেই পেয়েছিলেন। আশ্চর্য নয় তাই যে বিশ্বভারতীর উদ্বোধনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকেই সভাপতি পদে বরণ করে নেবেন (১৯২১)। আচার্যদেবের সম্বন্ধে আরেকটি তথ্য জানা ছিল না, এ’বই থেকে জেনে পুলকিত হলুমঃ দিলীপকুমার রায় ব্রজেন্দ্রনাথের মহীশূরের বাড়ি থেকে লক্ষ্মৌয়ে বন্ধুকে চিঠি লিখছেনঃ “ধূর্জটি, ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্বন্ধে যদি কিছু জানতে চাও তো এঁনার পায়ের কাছে এসে বসো!” সম্পাদকের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্যঃ “কে কাকে কার কাছে কী জানতে পাঠাচ্ছেন!” চমৎকার! সুধীপাঠক, বাক্যটি ফের পড়ে উত্তরটি মনে মনে যাচিয়ে নিন!
সেকালের ধারা মেনে এ’হেন মহান হস্তীর বঙ্গভাষায় রচনার সংখ্যা অত্যল্প, নানাস্থানে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার নবীন প্রকাশনালয় ‘পত্রলেখা’ এক মস্ত কাজ করলেন দুই মলাটের মধ্যে তাকে বেঁধে ফেলে। আর কী তার পরিধি! ‘বিশ্বভারতী পরিষদ সভায় ভাষণ’, ‘ভারতীয় স্থপতি শিল্প’, ‘ওড়িশার মন্দিরগাত্রের চিত্র’ থেকে ‘শিক্ষাবিস্তার’ এমন এমন সব বিষয়ে লিখিত ব্রজেন্দ্রনাথের বাঙলা প্রবন্ধমালা স্থান পেয়েছে এই তন্বী কেতাবে। স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পত্রাবলীর আদানপ্রদান ও চমৎকার একাধিক সাক্ষাৎকার।
ব্রজেন শীল ‘বিদ্যের জাহাজ’—এইটুকুর বাইরে কত কী-ই যে জানতুম না, এ’বই পড়ে জানা গেল, যেমনঃ
১) যুবক মহলানবীশকে রবীন্দ্রনাথ পাঠান সুহৃদ ব্রজেন্দ্রের কাছে ‘মানসজীবনের মূলধন’ সংগ্রহ করতে। প্রশান্তের মনে নতুন বিষয় ‘রাশিবিজ্ঞান’-এর বীজ সেখানেই উপ্ত হয়েছিল বলে তাঁর জীবনীকার লিখছেন!
২) ‘শেষের কবিতা’-র পটভূমি শিলং বটে, কিন্তু গুরুদেব উপন্যাসটির শেষভাগ লেখেন ‘ব্যালাব্রুয়ি’তে বসে---মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯২১-৩০) হিসেবে যা তখন আচার্যদেবের নিবাস। রবীন্দ্রের পাঠে সে-লেখার একাংশ শুনে ব্রজেন্দ্র আপ্লুত ! প্রশান্তচন্দ্র আবার তখনই এসেছেন স্ট্যাটিসটিক্সের কিছু পেপার তাঁকে দিয়ে শুধরে নিতে!!
৩) আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস’ লেখার সময় ব্রজেন্দ্রনাথের সাহায্য চান। উনি ‘প্রাচীন হিন্দু পরমাণুতত্ত্ব’ অধ্যায়টি লিখে দিয়েছিলেন।
৪) ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গবেষণার কাজে ব্রজেন্দ্রনাথের কাছে নানা ভাবে সাহায্য পেয়েছিলেন---লিখেছেন স্মৃতিকথায়।
৫) কারা ভিড় জমাতেন না ব্রজেন্দ্রনাথের বৈঠকখানায়? জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্র-বিপিন পাল থেকে হীরেন দত্ত-সুরেন দাশগুপ্ত!! জ্ঞানের সুবাসের এমনই টান!
ব্রজেন্দ্রনাথের রচনার মানবিচার বা সমালোচনার যোগ্যতা নেই , কারণ তিনি জ্ঞানপর্বত হলে এই নিবন্ধকার মূষিকের নখাগ্রমাত্র । তবু পুস্তকের ক্রেতা ও পাঠকের একটা নিজস্ব অধিকার থাকবেই। সেই সূত্রেই লিখিঃ
১) ওড়িশার মন্দিরগাত্রে যৌন স্থাপত্যের কারণানুসন্ধানে আচার্যদেবের ব্যাখ্যা এইরূপঃ কাম-ক্রোধাদি পরিত্যাজ্য তাই মন্দিরের বাইরের গায়েই তাকে ‘বীভৎসরূপে’ চিত্রিত করে (অর্থাৎ কামাদি শূন্য হয়ে) তবে দেবস্থানে প্রবেশ---এ’মত মানা গেল না। আর দ্রাবিড়জাতি স্বভাবতঃই promiscuous, এহেন মত তো যথেষ্ট racist! অপরপক্ষে, দক্ষিণের মন্দিরগাত্রের চিত্র তো রীতিমত উচ্চাঙ্গ শিল্পের মধ্যে পড়ে। সেকালে ভিক্টোরিয় ছুঁচিবাই ছিল না কিনা, তাই যৌনতা জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গের মধ্যেই গণ্য হত---এই মতই অধিক গ্রহণীয়।
২) একাদশ শতকের তামিল বৈষ্ণবগুরু রামানুজদেবের ভজনে ক্যাথলিক প্রভাব পড়েছিল বা বহু প্রাচীন তামিল সাহিত্যিক ধর্মমতে ক্রিশ্চান ছিলেন---আচার্যদেবের এ’হেন মতের পুষ্টি পাইনি। অধিকতর তথ্যের প্রয়োজন ছিল।
৩) ইংরিজি থেকে বাংলা প্রতিশব্দীকরণের সমস্যা আজও আছে, সেকালে আরও বেশি ছিল। মানছি। তবু বাংলা রচনায় এত এত রোমান হরফে ইংরিজি শব্দ চক্ষুপীড়া দেয়। Architecture, sexual relation, obscene mural decoration—ইত্যাদি শব্দ যাদের সহজ বাঙলা তর্জমা সম্ভব, সেগুলিও রোমানে কেন পড়ব? সম্পাদক মশায় কী বলেন?
দু’একটি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছেঃ ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়’ (পৃঃ ৫২, ‘হয়নায়’ ছাপা হয়েছে), বা ‘সাতন্ত্র্য’ (পৃঃ ৭৯) ইত্যাদি। পরিশিষ্ট-১-এ আচার্যদেবের অপ্রকাশিত আত্মজীবনীর ‘My Mental History’-সূচিপত্রখানি পড়তে বেশ লাগে। রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠির মধ্যে ‘কালিদাস’ বা ‘দ্বিজেন্দ্রনাথে’র নামোল্লেখের পাশে পাশে ফুটনোটের চিহ্ন থাকলেও তা আসলে দেওয়া হয়নি।
যাহোক্, বইটির উপস্থাপনা সুন্দর। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে পড়ে ভালো লেগেছে। সেটাই মনে থেকে যাবে।
(*) ব্রজেন্দ্রনাথের ৭২তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে
Rammohun Roy: a critical biography—Amiya P Sen; Penguin/Viking; 2012; ISBN 9780670084272
বর্ধমান জেলার অন্তঃপাতী বর্ধিষ্ণু রাধানগর গ্রাম। কুলীন ব্রাহ্মণ কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ দরবারের উচ্চপদ থেকে অবসর নিয়ে পৈতৃক এই গ্রামে বসবাস করতে লাগলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে। দরবার থেকে ‘রায় রায়ান’ উপাধি তাঁরই পাওয়া। তৎপুত্র ব্রজবিনোদও মুর্শিদাবাদে নবাব আলিবর্দির দরবারে উচ্চপদে ছিলেন। রামকান্ত হলেন ব্রজবিনোদের পঞ্চম পুত্র, যিনিও বাপ-ঠাকুর্দার মত নবাব দরবারেই কর্মরত ছিলেন। রামকান্তের দ্বিতীয়া পত্নী তারিণী দেবীর দ্বিতীয় গর্ভধারণ এমন এক পুত্রের জন্ম দিতে যাঁর হাত ধরে নাকি ভারতের উত্তরণ ঘটবে মধ্য থেকে আধুনিক যুগে। বঙ্গাব্দ ১১৮০ বা ১১৮৭ হিজরি সন। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকামতে অব্দ ১৭৭৪---তখনও ভারতে তার চল হয়নি। জ্যেষ্ঠ জগমোহনের সঙ্গে মিলিয়ে কনিষ্ঠের নাম রামমোহন রাখা হল। জানিনা ঠিক কোন্ক্ষণে এ’শিশুর জন্ম, যাকে নিয়ে রকমারি বাকবিতণ্ডা বিতর্ক, কতই না কথা উপকথা, নব নব মূল্যায়ন বিগত প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী হয়ে চলেছে। বিশেষতঃ, রামমোহনের জীবনের প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর নানা প্রশ্নচিহ্নে ঢাকা। যেমন, তিনি নাকি প্রথম যৌবনে তিব্বতে গিয়ে লামাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে এসেছিলে! এ’গপ্পের উদ্গাতা তাঁর জীবনীকার একেশ্বরবাদী ল্যান্ট কার্পেন্টার মহাশয়, যিনি নাকি রামমোহনকে কোথাও তিব্বতের গল্পটা বলতে ‘শুনেছিলেন’। এবং শুনেই হাতে গরম লিখে দিলেন। রামমোহন নিজে কিন্তু কোত্থাও লেখেননি যে তিনি তিব্বত গিয়েছিলেন। এর চেয়ে বরং এই তথ্যই বেশি বাস্তব যে জীবনের প্রথম বেশ কয়েক বৎসর রামমোহন নিজগ্রামেই বিদ্যাশিক্ষা করেন। পূর্বভারতে তখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চাইতে তন্ত্রের প্রাদুর্ভাব যথেষ্ট। গুরু হরিহরানন্দ কূলাবধূতের নিকট তাঁর তন্ত্রে দীক্ষা হয়।
নবযুবা রামমোহনের জীবনের এর পরের প্রায় বিশ বছর হল অর্থোপার্জনের ইতিহাস---চড়াসুদে মহাজনী কারবার, কোম্পানীর কাগজের কেনাবেচা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পুরো ফয়দা উঠিয়ে ‘অনুপস্থিত জমিদার’ হিসেবে গোবিন্দপুর-রামেশ্বরপুরের তালুক ক্রয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবা ও দাদা এই সময় জমিদারীর দেনা চোকাতে না পেরে কারাবাস করেন। সমর্থ দ্বিতীয় পুত্র তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন না। শেষে দাদা এসে হাতেপায়ে ধরায় চড়া সুদে এক হাজার টাকা ধার দেন! মা তারিণী দেবীর সঙ্গে এই সময় থেকেই তাঁর গভীর মনান্তর, যিনি শোকেদুঃখে শেষ বয়সটা পুরীর মন্দির ঝাঁট দিয়ে কাটান। সেখানেই প্রয়াণ (১৮২২)---পুত্রের আপার সার্কুলার রোডের প্রাসাদে (এখন কলকাতা ডি সি নর্থের দপ্তর) তখন নর্তকী নিকির অনুষ্ঠান চলছে! তাই মূর্তিপূজার বিরোধিতার কারণে মায়ের সঙ্গে মনান্তর ও মোকদ্দমা---এ’হেন সিনেমার গল্প মেনে নেবার কোনো কারণ নেই। বরং রামমোহন ১৮০৩ নাগাদ বাপের জোড়াসাঁকোর যে বাড়ির উত্তরাধিকারী হন তার পূর্বশর্তই ছিলো গ্রামে কূলদেবতা রাধাকৃষ্ণের নিত্যপূজা চালিয়ে যেতে হবে। ১৮১৪-এ’ সে বাড়ি ভাগ্নে গৌরদাসকে লিখে দেওয়ার আগে পর্যন্ত রামমোহন সে-শর্ত পালন করেন নি---এমন তথ্য নেই। বরঞ্চ, ক্রমে ব্রহ্মোপাসক হিসেবে জমতে থাকা তাঁর খ্যাতিতে এ’হেন মূর্তিপূজা বিপরীত প্রচার ঘটাতে পারে, তাই ঐ দান---এমন মত পাওয়া যায়। অর্থাৎ, পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন বা তিনি পিতৃসম্পত্তি হেলায় ত্যাগ করেছিলেন---এ’হেন গপ্পের কোনো ভিত্তি নেই। বরং, এই পিতৃসম্পত্তি হারানোর ভয়েই রামমোহন আজীবন উপবীত ধারণ করে রেখেছিলেন---এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদ, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ ছিল, নিজে যার বাইরে ছিলেন না।
১৮১৪-১৫ নাগাদ ত্রিশ হাজার টাকায় উত্তর কলকাতার প্রাসাদ কিনে রামমোহন যখন পাকাপাকি বসবাস করতে এলেন তখন তিনি শহরের এক ধনী গণমান্য ব্যক্তি; উচ্চ ইউরোপিয়ান থেকে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের রইস আরবি-ফারসির অধ্যাপকগণ তাঁর সুহৃদ। চলনে বলনে আদব কায়দায় পাক্কা নবাব। ‘শৈবমতে বিবাহ করা’ যবনী রক্ষিতা ঘরে। তাঁর সুদের কারবারের কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ তাঁর থেকে ক্রমে দূরে সরে যান। রামমোহন তখন ক্রিশ্চান ধর্মের দিকে ঝুঁকেছেন, ইউনিটারিয়ান উইলিয়ম এডাম তখন তাঁর মিত্র, চার্চে প্রতি রবিবার আনাগোনা। সে-হুজুগও বেশিদিন থাকেনি। পরে এডাম ভগ্ন হৃদয়ে আমেরিকা চলে যান, কিন্তু ভবিষ্যত ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর বীজ এখানে পুঁতে দিয়ে।
রামমোহন কেন হিন্দুশাস্ত্রের দিকে ঝুঁকলেন, কী করে হিন্দুশাস্ত্রের এক নব-ব্যাখ্যাতা হয়ে উঠলেন---সে-সম্পর্কে সেকালে সুশোভন সরকার বা একালে আশিস নন্দীর ব্যাখ্যা প্রণিধানযোগ্য। বর্তমান জীবনীকার অমিয়বাবু গবেষণা করে কোনো আনকোরা তথ্য তুলে আনেন নি, বরং যুক্তিগ্রাহ্য মন নিয়ে রামমোহনের জীবন ও কর্মের নানান ব্যাখ্যার পুনঃপাঠ করেছেন। যেকোনো ‘মহাপুরুষ’ সম্বন্ধে বিশদতর জানতে এইভাবে চোখের রঙিন চশমা খুলে রাখার প্রয়োজন আছে। স্তালিনের ওপর মন্টিফিওরের সাম্প্রতিক লেখা বা মাওয়ের নব জীবনীকার শ্রীমতি জাং চ্যাং এমনই ফসল।
রামমোহনের জীবনের নানান ঘটনাবলী বাঙালি পাঠকের অজ্ঞাত নয়। তার ক্রমপাঠও বর্তমান নিবন্ধের পরিধির বাইরে। গুটিকয় তথ্য তবু আলোচনা করা যেতে পারে। ত্রিশ বছর বয়সে, ১৮০৪-এ’ রামমোহনের প্রথম গ্রন্থের প্রকাশ, মুর্শিদাবাদ থেকেঃ ‘তুহ্ফৎ-উল-মুয়াহিদিন’ (‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার’)। ম্যাক্সমূলার তো লিখেছেন, রামমোহনের সমগ্রজীবনের ধর্মচিন্তার নির্যাস এতে ধরা আছে। তাহলে বাকি ত্রিশ বৎসরব্যাপী তিনি যে গ্রন্থের পাহাড় লিখে গেছেন---সে-সব কি অনাবশ্যক না বাহুল্য? থাক্ সে বিতর্ক।
রাখলে তো অনেক বিতর্কই রেখে দিতে হয়। নৈলে, প্রথম জীবনে ইসলামের একেশ্বরবাদিত্বে, পরে উইলিয়ম এডামের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে খ্রিস্টীয় ইউনিটারিজমে বিশ্বাসী রামমোহন বেদান্তভিত্তিক ধর্মালোচনার দিকে ঝুঁকলেন কেন? তাহলে তো সুশোভন সরকার মশায়ের ব্যাখ্যায় ফিরে যেতে হয়। বেদান্ত রামমোহনের কাছে এক ‘মুখড়া’ ছিল যার মাধ্যমে বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে তিনি পৌঁছুতে চেয়েছিলেন ও পেরেছিলেন।
সতীদাহ আন্দোলনের সঙ্গে রামমোহনের নাম ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এ’সম্বন্ধেও কিছু মিথের স্পষ্টীকরণ দরকার। কিশোর রামমোহন নিজের বৌদিদিকে সহমরণে যেতে দেখে এ’হেন কুপ্রথার মূলোচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর হন---এই চালু গল্পের কোনো ভিত্তি নেই। বড়দা জগমোহনের মৃত্যুর সময় রামমোহন রঙপুরে, বয়স ৩৭। জগমোহনের বিধবা সহমৃতা হয়েছিলেন---এমন কোনো তথ্য নেই। তাঁর মা-ও তো দীর্ঘ বিশ বছর বৈধব্যজীবন কাটান। কৈ তাঁকেও তো সহমৃতা হতে হয়নি? ‘সতী’-র যে কোনো বৈদিক ভিত্তি নেই, গুজরাটি স্বামীনারায়ণ গোষ্ঠীর সহজানন্দ স্বামী (১৭৮১-১৮৩০) আধুনিককালে প্রথম সে-মত তুলে ধরেন যিনি সামাজিকস্তরে ব্যাপকভাবে এ’ শোধন আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কলকাতার বিশপ রেজিনাল্ড হেবার (১৭৮৩-১৮২৬) বম্বেতে একবার তাঁকে মিলে মুগ্ধ হন। দিল্লির রেসিডেন্ট চার্লস মেটকাফ ১৮১৪-এ যখন সেখানে সতীদাহ রদ করে দেন, কৈ তা নিয়েও তো এত মাতামাতি হয়নি। মোটামুটি হিসেবে, ভারতের মোট জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ তখনই মুসলিম, বৌদ্ধ-জৈন ইত্যাদি ছাড়া চল্লিশভাগের বেশি হিন্দু নন। তাঁদের মধ্যেও বিশাল সংখ্যক নিম্নবর্গীয়দের বাদ দিলে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুর সংখ্যা তাই ৮% এর বেশি হবার কথা নয়, আর সতীদাহ অবশ্যই সামান্য কিছু উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরই সমস্যা। যেমন, রামমোহনের পরিবারের মত শোভাবাজারের দেব বংশেও সতীদাহের প্রথা ছিল না। তাই এই মুষ্টিমেয়র সমস্যা নিয়ে তৎকালীন কাগজওলাদের কেন এত হৈ চৈ, বোঝা কঠিন।
আর, প্রথম শিক্ষিত বাঙালি হিসেবে কালাপানি পার হওয়া? বক্সার যুদ্ধে হেরে মুঘল বাদশাহ্ দ্বিতীয় শাহ্আলম তখন ইলাহাবাদ দুর্গে বন্দী। ১৭৬৬তে, মানে রামমোহনের বিলাতযাত্রার ৬৫ বছর আগে, ইংলন্ডেশ্বর তৃতীয় জর্জের কাছে তদ্বির করতে দূত পাঠালেন ক্যাপ্টেন সুইনটনকে, সঙ্গী তাঁর নদীয়ার বাঙালী মুন্সি এহ্তেশাম উদ্দিন। ফার্শিতে লেখা তাঁর চমৎকার ভ্রমণকাহিনি রয়েছে, ‘শিগার্ফ-নামা-এ-বিলায়েত’ (বিলাতের আশ্চর্য দৃশ্যাবলী)। প্রচার পায়নি । ঢাকা বাংলা একাডেমী অবশ্য এখন তার বঙ্গানুবাদও প্রকাশ করেছে। উচ্চবর্ণীয়ের মধ্যেও রামমোহনের ৫০ বছর আগে চিৎপাবন ব্রাহ্মণ হনুমন্তরাও বিলেতে যান পেশোয়া রঘুনাথ রাওয়ের দূত হয়ে, ১৭৮০ খৃঃ। কম লোকে জানে। আসলে, নেপোলিয়ন-বিজয়ের পর বলদর্পী ইংরেজের তখন দেখানোর দরকার পড়েছিলঃ ‘দেখ, কী-হেন দেশ আমরা জয় করেছি! কালোকোলো আধাল্যাংটা নয়, রীতিমত সাতটা ভাষা জানা ছ’-ফুটি ধর্মনায়ক!’ রামমোহন তাই বিলেত-ফ্রান্সে সফল।
বস্তুতঃ, সব বিতর্ক ফেলেও এ’পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্বের ছায়া তো গত দু’শ বছর ছেয়ে আছে, আরও দু’শ বছরও থাকবে। এ’রকম ‘ক্রিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ তাই আরও লেখা হতে থাকবে। হোক্। স্বাগত জানাই।
(পরবাস-৫৪, জুন ২০১৩)