ISSN 1563-8685




দহন থেকে ফেরা পাণ্ডুলিপি


চরাচরসারে; দিবাকর ভট্টাচার্য; ভাষাবন্ধন, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১২

লেখক দিবাকর ভট্টাচার্য। বইয়ের নাম চরাচরসারে।

প্রচ্ছদে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় দীপ্যমান এক পাখি। এবং তার কাঁপা কাঁপা প্রতিবিম্ব। এ সূর্য মধ্যাহ্নের নয়। ভোর কিংবা বিকেলের। কোমল। উদাসীন এবং সরল।

আশ্চর্য সুন্দর প্রচ্ছদটি দেখলেই কী এক সুর যেন বেজে ওঠে। সে সুর বিষাদের। কিংবা ঠিক তাও নয়। যেন বিষাদ পেরিয়ে নির্লিপ্তির দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলে সেই সুর।

ভাষাবন্ধন থেকে এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে এই বই। আগেকার পয়লা বৈশাখের জায়গায় এখন তো বইমেলাই বই প্রকাশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়। অসংখ্য, অজস্র বই। সেই সমস্ত বইয়ের ভিড়ে শুধু আরও একটি বই নয় 'চরাচরসারে'। কখনোই নয়। প্রচ্ছদ থেকেই শুরু হয়ে যায় এই বইয়ের 'অন্যরকম' হয়ে ওঠা।

বইটি উল্টে পিছনমলাটের দিকে চোখ গেলেই পাঠকমহল ভরে যাবে এক অপরিসীম কৌতূহলে। এই বইয়ের রচয়িতা মারা গেছেন আজ থেকে দশ বছর আগে। নিজের সমস্ত লেখা তাঁর মৃত্যুর পরে ধ্বংস করে দেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যাবে ফ্রান্‌ৎস কাফকা নামের সেই মানুষটির কথা। সমস্ত বিশ্বের সাহিত্য-নির্মাণের গতিপ্রকৃতি বদলে গেল যাঁর হাতে, তিনিও তো মৃত্যুর আগে তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বলে গিয়েছিলেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে পুড়িয়ে ফেলতে। সেই লেখাগুলির মধ্যে ছিল 'দ্য ট্রায়াল'-এর মতন লেখাও!

কিন্তু কাফকার এই ঘটনা তো সত্যিই বিরল। বিশেষত আজকের দুনিয়ায় যখন আত্মপ্রচার, দলবাজি এবং তোষামোদের ভিতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে সুসজ্জিত সাহিত্যসৌধ। এমন ঘটনা সেখানে আমাদের কাছে চাঁদের উলটো পিঠ দর্শনের অভিজ্ঞতার মতন অতি বিরল এবং তুমুল কৌতূহলোদ্দীপক।

বইয়ের শুরুতে, সূচীপত্রের আগে লেখা রয়েছে Maurice Maeterlinck-এর এক অসামান্য পংক্তি — 'How many people begin to live only after they are dead and how many are dead before they lived.' এইভাবে, সূচীপত্র অবধি পৌঁছোনোর আগেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও পিছনমলাট এবং এই পংক্তি একটা আবহ তৈরি করে নেয়। চরম আগ্রহ তৈরি হয় গল্পগুলি নিয়ে।

কিন্তু শুধু সেই কারণেই এই বইকে 'অন্যরকম' বলা হবে তা নয়। এই বইকে 'অন্যরকম' বলার আসল কারণ এর গল্পগুলি 'অন্যরকম'। আসুন, এবার সেই গল্পগুলির কাছে যাই।

মোট বারোটি গল্প আছে সংকলনে। শেষতম গল্পের নামে বইয়ের নামকরণ চরাচরসারে। সুতরাং সেটা দিয়েই শুরু করা যাক। এ গল্প, লেখক সুধীন দত্তকে নিয়ে। 'কিছুই হল না যার চরাচরসারে'। এ উপলব্ধি সুধীন দত্তের আত্মোপলব্ধি। এই 'কিছু' হওয়া মানে ফাঁপা খ্যাতির বেলুনে চেপে কৃত্রিম স্বর্গারোহণের ইচ্ছা নয়। সুধীন দত্ত চেয়েছিলেন সত্যিকারের লেখা লিখতে। এবং তাঁর মতে সেই ইচ্ছে, সৎ নির্মাণের সেই আপ্রাণ ইচ্ছে নিয়েই তাঁকে চলে যেতে হবে একদিন। একজন সৎ ও সাহসী লেখক কিভাবে তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে নিজস্ব নির্মাণের সঙ্গে এক আশ্চর্য জীবন যাপন করলেন এই গল্পের সেটাই মূল উপজীব্য। নিজের মুখোমুখি বসে আছেন লেখক। চলছে অবিরত সংলাপ। প্রায় পুরো গল্প (শুরুর কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে) জুড়ে রয়েছে এই সংলাপ। অথচ একেবারে শেষের আগে পাঠক বুঝতেই পারবেন না এই দুই পুরুষের কথোপকথন আসলে একই মানুষের স্বগতোক্তির বিড়বিড় উচ্চারণ ছাড়া কিছুই নয়। প্রচ্ছদের পাখি ও পাখিটির ছায়ার অর্থ এইবার পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

এই গল্পে যা বলা হয়েছে, বলা হয়নি তার থেকে বেশি। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা। গল্পটির বিভিন্ন অধ্যায়ের শুরুতে সরস্বতী পুজোর বিভিন্ন মন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এই মন্ত্রও এখানে সংলাপের মতন। লেখক যেন এইভাবে সরস্বতীর মুখোমুখি হতে চেয়েছেন। এই সরস্বতী কিন্তু কেবল দেবী সরস্বতী নয়। হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর কথাও উঠে এসেছে গল্পে। এইভাবে লেখক কখনও সরস্বতী নাম্নী ঈশ্বরীর শ্বেতপদ্মাসনা মূর্তির কথা বলেছেন। কখনও বিলীন হয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর ফিরে আসার কথা বলেছেন। নর্মদা-গঙ্গা, যমুনা-সিন্ধু সমস্ত নদীর জলে, 'সমস্ত জলে - বৃষ্টিতে - মেঘে' তার রয়ে যাওয়ার কথায় বিভোর হয়েছেন। এইভাবে কখনও পুরাণ, কখনও বা প্রকৃতির উৎস থেকে তিনি খুঁজে চলেছেন সৌন্দর্য, শক্তি ও সৃষ্টির প্রবাহকে। এক সত্যিকারের শিল্পীর মতন তাঁর এই তীব্র অন্বেষণ। 'চরাচর' শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল 'যা চলে এবং যা চলে না অর্থাৎ জঙ্গম ও স্থাবর সমস্ত কিছু।' এই 'সমস্ত কিছু'-র কাছেই তো নতজানু হতে হয় শিল্পীকে। তাঁর শিল্পসাধনার প্রেরণা খুঁজতে। সেই অনুসন্ধান ও ব্যর্থতা এবং পুর্নবার অনুসন্ধানের ইচ্ছে - এই নিয়েই রচিত হয়েছে 'চরাচরসারে'।

লেখক সুধীন দত্তের মতোই লেখক দিবাকর ভট্টাচার্যও রচনা করতে চেয়েছেন সৎ আখ্যান। যে আখ্যানগুলির পরতে পরতে রয়েছে দর্শন, মনন এবং ইতিহাস চেতনার এক সুনির্মিত সংমিশ্রণ। তবে সংকলনের সবকটি রচনার ক্ষেত্রেই যে তিনি সমানভাবে সফল তা অবশ্য নয়। আবার কোথাও কোথাও অত্যন্ত রকম সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন। যেমন 'অথচ' নামক গল্পটি। গল্পের শুরুতে 'দেখলাম স্নেহাংশুদা হাসছেন।' আর একদম শেষ লাইন 'আমার মুখের সামনে - স্নেহাংশুদা - হাসছেন।' এই দুই হাসির মাখখানে ঝুলে রয়েছে আখ্যান যার মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ একটি নাটক। যে নাটকের প্রধান চরিত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর। গল্পের মধ্যে পুরো নাটকটি পাঠ করেছেন স্নেহাংশুদা। শুনছে তাঁর এক স্নেহের মানুষ কাঙ্কর। 'ফর্ম'-এর দিক থেকে এই গল্প অত্যন্ত অভিনব। নাটকটিতে রয়েছে দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনযুদ্ধের কাহিনী। বাংলার এক সাধারণ জমিদারবাড়ির সন্তান থেকে অসামান্য যুগপুরুষে অভূতপূর্ব উত্থান নিয়ে এই নাটক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আলাদা নাটক হিসেবে রচনা না করে কেন এই নাটকটিকে একটি গল্পের মধ্যে রাখা হল। নিছক চমক সৃষ্টি করতে? নাকি লেখকের সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য ছিল? উত্তর পাঠক পেয়ে যাবেন গল্পের শেষে পৌঁছে। কোন যন্ত্রণার নিরিখে দ্বারকানাথ আর স্নেহাংশুদা মিলে গেলেন, শতাব্দীর সীমারেখা পেরিয়ে দুই সময়ের দুই মানুষকে কী নিপুণতায় মিলিয়েছেন লেখক, তা জানতে গেলে পাঠককে গল্পটি পড়তে হবে। এখানে তা উহ্যই থাকুক। কেবল জেগে থাকুক স্নেহাংশুদার কোমল করুণ হাসিটি। যা পাঠককে গল্পটির দিকে আকর্ষণ করবে।

আরেক আশ্চর্য গল্প 'অপূর্ব রতিমঞ্জরী'। অতীত খনন করে আনা আরেক উজ্জ্বল হীরকখণ্ড। এই সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের শুরুতেই দেখি মৃণালিনীকে। সুদীর্ঘ বাতিদানের অপরিমিত আলোয় উদ্ভাসিত তার নগ্ন শরীর। ঘরের তিন দেওয়ালের তিন আয়নায় তার তিনটি প্রতিবিম্ব। এইভাবে আলো-আঁধারে মৃণালিনীর নগ্ন শরীরের রেখাগুলি যেন এক নয়, নির্মাণ করে অনেকগুলি মৃণালিনীকে। দেওয়ালের ছবি থেকে সেদিকে নিবদ্ধ অঘোরনাথের দৃষ্টি। অঘোরনাথ মৃণালিনীর সদ্যমৃত স্বামী।

গল্পের শুরুতে এই আশ্চর্য দৃশ্যটি যেন তেলরঙে আঁকা এক প্রাচীন ছবি। এমনই তার নির্মাণশৈলী। নগ্নতা ও নান্দনিকতা মিলেমিশে রয়েছে যার মধ্যে। গল্পটিও তাই নিয়ে। লেখক সচেতনভাবে গল্পটির শুরুতেই এইভাবে প্রস্তুত করে নেন পাঠককে। পাঠক ঐ দৃশ্যের সিংহদ্বারের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেন আখ্যানের ভিতর। শতাব্দীপ্রাচীন বাংলার এক হারিয়ে যাওয়া সময়ে। অনেক পড়াশোনা করে এই গল্প লেখা হয়েছে। অবশ্য এই বইয়ের অনেকগুলি লেখাই তাই। মৃণালিনী - অঘোরনাথের এই আখ্যানে 'বামাবোধিনী', 'রহস্য-সন্দর্ভ' প্রভৃতি প্রাচীন পত্রিকার নাম উঠে এসেছে। এসেছে 'মালাই বরফ'। কিংবা প্রাচীন সব ছড়া বা প্রবাদ। অনুসৃত হয়েছে প্রাচীন কথনশৈলী। এমনকি চিঠিপত্র ইত্যাদির ভাষাও সেই সময়ের। যা রীতিমত গভীর অধ্যয়ন না থাকলে সম্ভব নয়। অবশ্য শুধু গঠনশৈলী নয়। গল্পের আখ্যানভাগও সমান চমকপ্রদ। এইরকম বিষয় নিয়ে লিখতে চাওয়ার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট লেখকের অভিপ্রায়। বাংলাভাষায় অঘোরনাথের মতন চরিত্র বড়ই বিরল। সৌন্দর্যপিপাসু হতভাগ্য মানুষটিকে পরম যত্নে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। অবশ্য মৃণালিনীও কিছু কম জীবন্ত নয়, 'বলুন না, বলুন না কিভাবে দাঁড়াব?' এই আর্তিময় সংলাপে মৃণালিনীর যে মূর্তি ফুটে উঠেছে তাকে পাঠকের সহজে ভোলার কথা নয়। এইভাবে চরিত্র ও আখ্যান দুই দিক দিয়েই লেখক চেয়েছেন এক 'অন্য' ভূবনের কথা বলতে যে ভূবনের দেখা অন্তত সাম্প্রতিক বাংলাসাহিত্যে খুব একটা মেলে না।

আরেকটি গল্প 'রসাতলে'। এই গল্পে লেখক হেঁটেছেন আরও পিছন দিকে। মধ্যযুগ এ গল্পের সময়কাল। সেই সময়ের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের মধ্যে যারা সুস্থ ও সবল তাদের নিবেদন করা হত চিকিৎসার গবেষণার জন্য। এদের বলা হত রোমথা। কবিরাজদের কাছে তারা ছিল গিনিপিগসদৃশ। বিভিন্ন ওষুধ তাদের দেহে প্রবেশ করিয়ে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতেন কবিরাজরা। গল্পের প্রধান চরিত্র রাজবৈদ্যের কথা অনুযায়ী, 'যাদের নিয়ে গবেষণা করেছি, বিষাক্ত ওষধি প্রয়োগ করেছি তারা সকলেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী। মৃত্যু তাদের অবধারিত ছিলই। আমার জন্যই দীর্ঘায়িত হয়েছে তাদের জীবন।' উত্তরে তিনি তিরস্কৃত হয়েছেন এভাবে, 'জীবন? না দীর্ঘায়িত হয়েছে, বিস্তারিত হয়েছে তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা?' এ তিরস্কার তিনি শুনেছেন তাঁর নাতির মুখ থেকে। যে নাতি তাঁর কন্যা সুবলার মোহের সঙ্গে তাঁর রোমথার ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার বীভৎস সঙ্গমের ফল। সেই বিকৃতদেহী সদ্যোজাত শিশুটি কেবল ক্রন্দন ছাড়া আর কিই বা জানে! তবু রাজবৈদ্যের সঙ্গে নির্মিত হয়েছে তার কথোপকথন। গড়ে উঠেছে সুদূর মধ্যযুগের এক আশ্চর্য আখ্যান।

ইতিহাসের গর্ভ থেকে এভাবেই লেখক সংগ্রহ করেছেন তাঁর রচনার বীজ। তারপর আশ্চর্য সব আঙ্গিকে বুনেছেন আখ্যানের নকশি কাঁথা। এ তাঁর খুব পছন্দের স্টাইল। পাশাপাশি আরেকটি স্টাইল তাঁর খুব পছন্দের। যে স্টাইলে লেখা হয়েছে তাঁর 'যাত্রা' কিংবা 'শূন্যস্থান' নামক গল্প। যেখানে ফ্ল্যাশ ব্যাক-এর মাধ্যমে পুরো গল্পটি বলা হয়েছে। এবং এই গল্পগুলিতে কোনো ইতিহাসচেতনা নয়, মূলতঃ জীবনের যে মূল দর্শন - 'চরৈবেতি, চরৈবেতি' - সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও 'যাত্রা'র তুলনায় 'শূন্যস্থান' অনেক বেশি অভিনব। কেন না, এই গল্পটির প্রধান কথক চরিত্র হল একটি পুরোনো বাড়ির ছাদের রেলিঙ ও তার ছায়া।

এইভাবে গ্রন্থটির বারোটি আখ্যানে (স্বাভাবিকভাবেই সব ক'টি নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়) লেখক যা গড়ে তুলেছেন তার কোনোটি পাঠককে বেশি ছোঁবে, কোনোটি কম। কিন্তু ছোঁবেই, এ-কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। প্রতিটি রচনাতেই লেখকের নিষ্ঠা চোখে পড়ে। তাঁর 'অন্যরকম' হয়ে ওঠার, 'নতুনরকম' হয়ে ওঠার সযত্ন প্রচেষ্টা প্রায় সব লেখাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ন্যারেটিভ লিনিয়ারিটির প্রচলিত ফর্মকে ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। কখনো সংলাপ দিয়ে সাজিয়েছেন আখ্যানের শরীর। কখনো লেখার মধ্যে চিঠি বা দিনলিপির অংশ ব্যবহার করে সাধুভাষা মিশিয়ে দিয়েছেন। কখনো বা গল্পের মধ্যে রয়ে গেছে সম্পূর্ণ একটি নাটক। পাশাপাশি প্লট হিসাবেও কত অদ্ভুত বিষয় বেছেছেন তার দু-একটি উদাহরণ তো এই আলোচনাতেই বলা হয়েছে। তবে একটা কথা, কোনো কোনো লেখায় তিনি এত বিরাট কালখণ্ডকে ধরতে চেয়েছেন, যা গল্পের পরিসরে ধরতে চাওয়া ঠিক নয়। মনে হয় কাহিনীগুলির সেক্ষেত্রে আরো বিস্তৃতির প্রয়োজন ছিল।

পরিশেষে আবার ফিরে আসি গ্রন্থটির নামগল্পে। 'চরাচরসারে' জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া সুধীন দত্তের একটি সংলাপের খণ্ড অংশে — '... আমি সেদিন থাকব না। কিন্তু আমার লেখা থাকবে। সেই লেখা থেকেই সৃষ্টি হবে আরো অনেক নতুন ধরনের লেখা - পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।' এ গল্পকে কেন যেন লেখক দিবাকর ভট্টাচার্যের জীবনীর খণ্ডাংশ মনে হয়। বাস্তবিক জীবনী নয়। মানসিক জীবনী। এ যেন তাঁরও লেখকসত্ত্বার ইচ্ছে মনে হয়। কোন্‌ নীরব অভিমানে লেখক তাঁর কণ্ঠস্বর অশ্রুতিগোচর রাখতে চেয়েছিলেন তা আমাদের অজানা। কিন্তু সেই ইচ্ছের গোপন অন্তঃস্থলে কি সুধীন দত্তের ইচ্ছেটাও মিশে ছিল না? কখনো ঠিক তিনি চাননি তাঁর আখ্যানগুলি পৌঁছে যাক নিমগ্ন মননশীল পাঠকের হাতে। কিংবা কোনো নবীন লেখক প্রেরণা খুঁজে নিক তাঁর আখ্যানের শরীর থেকে। নিশ্চয়ই চেয়েছেন। না হলে এ সংলাপ কেন দেবেন তিনি, সুধীন দত্তের মুখে? তাই মনে হয়, প্রকাশক ভাগ্যিস তাঁর কথা শোনেন নি! তাই আগুনের মধ্যে চলে যাওয়ার কথা যে অক্ষরদের তারা ছাপার অক্ষরে ছড়িয়ে পড়তে পারল। এখন দেখার, কোনো নবীন লেখক সেই অক্ষরগুলিকে টেবিল ল্যাম্প হিসেবে নির্মাণ করে তার তলায় রাখা সাদা পাতায় শুরু করেন কিনা, নতুন কোনো রচনা।



(পরবাস-৫২, অক্টোবর, ২০১২)