ঘরে ঢুকে ছাতাটা ঝপ করে বন্ধ করলেন সুবিনয়। একরাশ জল ছড়িয়ে পড়ল সোফার চারপাশে। উফ কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি। আকাশ যেন পণ করেছে মেঘের দলাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আজ কলকাতার উপর ভেঙে পড়বেই। সপসপে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে হাঁক পাড়লেন ‘চা কই? একটু আদা দিয়ে চা বানাও।’ মালতীকে বলতে লাগে না। সুবিনয় সাফসুতরো হয়ে সোফায় এসে বসার আগেই টি-টেবিলে ধুমায়িত চা হাজির। চায়ে চুমুক দিয়ে সুবিনয় একটু ধাতস্থ হলে একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মালতী, ‘বায়না দিলে বাড়িটা?’ ‘হ্যাঁ দিলাম। তবে মালঞ্চ নয়, ব্যাঙ্কের পিছনে যে বিয়েবাড়িটা ভাড়া দেয় ওখানে বায়না দিয়েছি।’ ‘সেকি? মিষ্টি যে অত করে বলল।’ ‘থামো তো, যতসব ন্যাকামো। মালঞ্চতে বিয়ে না হলে কি ওর বিয়ের ভাত হজম হবে না? তোমার মেয়েকে বলে দিও, ওর পছন্দের ছেলের সাথে যে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছি এই ঢের। তার বেশি যেন আমার থেকে এক্সপেক্ট না করে।’ শেষের কথাগুলো হাওয়ায় ভাসল, কারণ গতিক সুবিধার নয় দেখে মালতী ততক্ষণে রান্নাঘরে মুখ গুঁজেছেন।
আটা মাখতে মাখতে ভাবছিলেন মালতী, পঁচিশবছরের সংসার। তবু একমাত্র মেয়ের বিয়েতে একটু সাধ-আহ্লাদ করার অধিকারটুকুও এখনও জন্মাল না। এখনও নিজের শখের কথা পাড়তে মেয়ের দোহাই দিতে হয়। স্কুলের চাকরিটা যে কেন ছেড়েছিলেন কুড়িবছর আগে, এখনও আফসোস হয়। নিজের রোজগার থাকলে তো আজ স্বামীর কাছে হাত পাততে হত না। কি করবেন, শয্যাশায়ী শাশুড়ি আর কোলের মেয়েকে নিয়ে তখন যা নাজেহাল অবস্থা ছিল।
মেয়ের ডাকে হুঁশ ফিরল মালতীর। মিষ্টি কম্পিউটার ক্লাস থেকে কাকভেজা হয়ে ফিরেছে। কলেজের বন্ধুকে বিয়ে করতে চেয়ে মায়ের কাছেই প্রথম আবদার পেশ করেছিল ও। তারপর কি করে যে বদরাগী সুবিনয়কে রাজি করিয়েছেন, তা শুধু মালতী-ই জানেন। কিন্তু ওই রাজি করানোটুকু ছাড়া আর বেশি রা কাড়তে পারে নি। বিয়ের তারিখ ঠিক করা, ছেলের বাবা-কাকার সাথে পাকাকথা বলা, মায় পুরুত খোঁজা সবই সুবিনয় নিজের ইচ্ছামত করেছেন। কিছু বলতে গেলেই বাঁধাবুলি ‘মা-মেয়ে মিলে যথেষ্ট লোক হাসিয়েছ। তোমাদের চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য ভাল যে আমি ওই ছেলেটার সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি। এর বেশি মাথানোয়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ সত্যি মানুষটা আজও যে কেন সেই পুরুষসিংহের ভোঁতা অহঙ্কারে মটমট করে চলেছেন! এমনিতে দিলদরিয়া মানুষ, চরিত্রদোষ নেই। শুধু ওই এক রোগ, ঘরের মেয়ে-বউকে শাসন করে দাবিয়ে রাখতে হবে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, শ্রদ্ধা শাসন করে নয়, ভালবাসা দিয়ে অর্জন করতে হয়। কিন্তু ফল হয় নি, উল্টে শাসনের মাত্রা তীব্রতর হয়েছে। ক্রমশ মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। মেয়েটাও কেমন যেন মনমরা তৈরী হয়েছে। বাবার ভয়ে জবুথবু হয়ে থেকেছে আজীবন। মাকে বকা খেতে দেখে দেখে পুরুষজাতটার ওপরই ওর মস্ত ঘৃণা। ও মেয়ে যে কোনদিন প্রেম করে বিয়ে করতে চাইবে, এটা মালতীর স্বপ্নাতীত ছিল। প্রথমবার যখন মিষ্টি বলল পার্থর কথা, নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারেন নি।
ফোনে ক্যাটারারের ছেলেটিকে চূড়ান্ত ধমকাচ্ছেন সুবিনয়। সারা পৃথিবীর ওপর ওঁর রাগ। এভাবেই সবার সাথে বচসা করতে করতে মানুষটা তাঁর জীবনের বাহান্নটা বছর কাটিয়ে দিলেন। মাঝে মাঝে মায়াও লাগে। নিজেকে দোষ দেন মালতী, হয়তো ওঁরই কোনও খামতি ছিল, তাই সুবিনয়ের মনমতো স্ত্রী হতে পারলেন না। ভাল মা হতে পারলেন কি? কে জানে মেয়েটার কপালে কি আছে। বিয়েটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেলে বাঁচেন। একটাই স্বান্ত্বনা, পার্থ ছেলেটা ভাল। শান্ত, মেধাবী। মা-মরা ছেলে তো, আদরের কাঙাল। মালতীর খুব মনে ধরেছে ওকে। মানুকে সুখে রাখবে ও, মায়ের মন মিথ্যে বলে না।
মিষ্টি এখনও জানে না যে ওর অত সাধের মালঞ্চতে বিয়েটা হচ্ছে না। খারাপ লাগছে মালতীর। ছোট থেকেই মালঞ্চর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি ওই ক্যাপসুল-লিফটটা দেখত আর বলত ‘মা যদি আমি বিয়ে করি, এই বাড়িটাতেই করব।’ তখন কলকাতায় শ্রীরামআর্কেড ছাড়া আর কোথাও ক্যাপসুল-লিফট ছিল না। শুধু মিষ্টি কেন, মালতীরও ওই বাড়িটাকে স্বপ্নপুরী মনে হত। সুবিনয়কে এত কথা বোঝানোর সুযোগ হয় নি, মানুষটার ধৈর্য বড়ই কম। তবে অনেক করে বলে দিয়েছিলেন যে যত টাকাই লাগুক, ওই বাড়িটাই যেন বুক করে আসেন। কিন্তু সুবিনয় শুনলেন না। আজ অবধি মালতীর কোন কথাটাই বা শুনেছেন?
নিজেকে এত শেকলে বাঁধা মনে হয় মাঝে মাঝে। খাঁচার ভিতরে পঁচিশবছর ধরে ডানা ঝাপটাচ্ছেন অথচ আজও পায়ের বেড়ি কেটে আকাশে উড়তে পারলেন না।
ভাবতে ভাবতে এত অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন যে প্রথম রুটি দুটো এক্কেবারে পুড়িয়ে ফেলেছেন। পোড়াগন্ধ পেয়ে মিষ্টি ঘর থেকে ছুটে এসেছে। সুবিনয় টের পাওয়ার আগেই ফেলে দিতে যাবেন, ঠিক যমদূতের মত রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আজকাল ভয় পেলে সারা শরীরে কেমন যেন কাঁপুনি আসে মালতীর। সুবিনয়কে দেখেই হাত থেকে গরম চাটুটা মাটিতে পড়ে গেল। ভাগ্যি পায়ের ওপর পড়ে নি, পড়লে আজকেই পায়ের দফারফা হত। মিষ্টি বাবাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল প্রাণপণে। পঁচিশবছরে এরকম অনেকবার ঘটেছে, খেতে বসে খাবারে পোড়াগন্ধ কি নুন-মিষ্টি কম-বেশি দেখে টান মেরে থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেছেন সুবিনয় আর মালতী স্বামীর মন রাখতে রাত বারোটা অবধি হেঁশেলের চৌহদ্দিতে ঘুরপাক খেয়েছেন। কিন্তু আজকাল যেন বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা হয়। শরীরে রাগ-উত্তজনা-অভিমান সবমিলিয়ে একটা গরম তরঙ্গ বইতে থাকে।
সুবিনয় একটা কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ফোনটা এসে পড়ে মালতীকে রেহাই দিল। বোধহয় পার্থর ফোন। মিষ্টি তখন ফোনে কথা বলতে বলতে উঠে এসেছে। তাই খানিকক্ষন অপেক্ষা করার পর আবার রিং করেছে পার্থ। বেচারা বুঝতে পারে নি কি প্রলয়ের মুখোমুখি হতে হবে। মিষ্টিরই কপাল খারাপ, ফোনটা সুবিনয়ই ওঠালেন। ও দৌড়ে ঘরে যাচ্ছিল, তার আগেই সুবিনয় বাজখাঁই গলায় পার্থকে বলতে শুরু করেছেন যে এখন এবাড়িতে ডিনার-টাইম। সুতরাং মিষ্টি এখন গল্প করতে পারবে না। আশ্চর্য, মানুষটার সাধারণ কথাগুলোও কেমন বকুনি মনে হয়।
রুটি হয়ে গেছিল, মিষ্টি মুখভার করে খেতে এল। চোখের কোনে জল। মালতীর নিজেকে আরও অসহায় মনে হয় এই সময়গুলোতে। একমাত্র মেয়েকে এতটুকু স্বাধীনতা দিতে পারলেন না। অবশ্য দেবেনই বা কোথা থেকে। ওঁর নিজের স্বাধীনতা বলতে কি কিছু আছে? ধার করা জিনিস অন্যকে ধার দেওয়া যায় না।
শুতে যাওয়ার আগে সাড়ে দশটায় টিভিতে একটা সিরিয়াল দেখেন মালতী। বেডরুমের টিভিতে সুবিনয় রোজ এই সময়ে ইচ্ছা করে খবর চালিয়ে রাখেন, অগত্যা মালতীকে বাইরের সোফায় বসে মশার কামড় খেতে খেতে টিভি দেখতে হয়। কেন যে এই ছেলেমানুষীগুলো করেন সুবিনয়, আজও বুঝতে পারলেন না। স্ত্রী সিরিয়াল দেখলে কি স্বামীর পৌরুষ খর্ব হয়? হঠাৎ বেখাপ্পা ফোন-রিং সিরিয়ালের ঘোর কাটিয়ে দিল। এস টি ডি কল। কলকাতার বাইরে তো থাকেন শুধু বড় ভাসুর। একটু টেনশন হল, কোনো বিপদ-আপদ নয় তো? এতরাতে ফোন করছে কেন? সুবিনয়ই ফোন তুলেছেন। নিচুগলায় কথা বলছেন শুনে আস্বস্ত হলেন মালতী। নাহ, তার মানে বিপদ-টিপদ নয়। বিপদ হলে সুবিনয় এতক্ষণে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতেন। ওঁর রাগ-অভিমান-উৎকন্ঠা সবেতেই এক প্রতিক্রিয়া হয়, জোরে চিৎকার।
কিন্তু তাহলে কে ফোন করল? কৌতুহলে ফেটে পড়ছিলেন মালতী, অথচ ঘরে গিয়ে শোনার হিম্মত নেই। ধমক খাবেন। উল্টোটা কিন্তু আকছারই ঘটে। মালতীর ফোন এলে পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে কথা গেলেন সুবিনয়। বিশেষত বাপেরবাড়ির কারুর ফোন এলে তো কথাই নেই, পাছে মালতী ওঁর নামে গালমন্দ করেন।
আর কৌতুহল সামলাতে পারলেন না মালতী। এস টি ডি-তে এতক্ষণ গল্প করার মত আত্মীয়বন্ধু ওঁদের নেই। গুটিগুটি পায়ে বেডরুমে ঢুকলেন। সুবিনয় তখন বলছেন ‘থ্যাঙ্কস দাদা, আপনি যে আমার কি উপকার করলেন বলে বোঝাতে পারব না। আসলে মেয়েটা তো বোকাহাঁদা, যা ইচ্ছে বুঝিয়ে দিয়েছে। ওরা জানে না যে ওরা ডালে-ডালে চলে তো আমি পাতায়-পাতায় চলি। আচ্ছা, এবার রাখছি দাদা। ধন্যবাদ।’ ফোন রাখার পর সুবিনয়ের খেয়াল হল মালতী পাশে দাঁড়িয়ে।
‘কে ছিল ফোনে?’
‘কেউ না। একজনকে আমি একটা ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিতে বলেছিলাম। ছেলেটা ছোটবেলায় পাটনাতে থেকেছে তো, তাই।’
‘কোন ছেলেটা?’
‘কেন তোমার হবু জামাই, পার্থ।’
‘তো? সে তো প্রায় পনেরোবছর আগে। এতদিন পরে নতুন কি জানতে পারলে ওর সম্বন্ধে?’
‘নতুন এই জানলাম যে পার্থর মা গাড়ি-চাপা পড়ে মারা যান নি, উনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ওঁর মাথার দোষ ছিল। শান্তি?’
‘ওহ সে তো খুব দুঃখের খবর। কিন্তু এসব জেনে এখন কি লাভ হবে তোমার?’
‘লাভলোকসান জানি না। তবে এ বিয়ে হচ্ছে না। কাল সকালেই ওঁদেরকে মানা করে দেব। পাগল ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারব না আমি।’
‘মানে? কি বলছ কি তুমি? বিয়ে ভেঙে দেবে? আর যে মাত্র একমাস বাকি? তাছাড়া মা পাগল ছিল, ছেলে তো নয়? ওকে পাগল বানাচ্ছ কেন? তুমি নিজেই তো বেশ কয়েকবার পার্থর সাথে কথা বলেছ, আমি কত গল্প করেছি। কই একবারও তো ওর ব্যবহারে অসংলগ্নতা চোখে পড়ে নি? দোহাই তোমার, মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেল না।’
‘তুমি থামবে? রাত হয়েছে শুতে চল।’
এভাবেই পঁচিশ বছর ধরে মালতীকে নস্যাৎ করে এসেছেন সুবিনয়। মালতী ভালভাবেই জানেন সুবিনয়কে আটকানোর সাধ্য ওঁর নেই। সুতরাং এখন একমাত্র ঈশ্বরই ভরসা। কি জানি সকালে কি কুরুক্ষেত্র বাধবে, ভয়-ভাবনায় রাতভর দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না মালতী। পাশে সুবিনয় অবশ্য যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। একবার ভাবলেন এখনই মানুকে গিয়ে সব জানিয়ে দিলে কেমন হয়? অন্তত সকালে উঠে তো এতবড় শকটা পাবে না বেচারা। তারপর মনে হল সকাল আর রাত, কি ফারাক হবে।
ছটায় ঘুম থেকে ওঠেন সুবিনয়, মর্নিংওয়াকের টাইম। কিন্তু আজ মুখ-হাত ধুয়ে এসে আবার বিছানায় বসে পড়লেন। নাকি ওয়াকে যেতে ইচ্ছা করছে না। মালতী বুঝতে পারছিলেন ওপরে শান্তভাব দেখালেও মানুষটা ভিতরে ভিতরে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পার্থর বাবা কটায় ঘুম থেকে ওঠেন জানা নেই। জানলে নিশ্চয় এতক্ষণে তাঁকে ফোন করা হয়ে যেত সুবিনয়ের। চা বানিয়ে এনেছেন মালতী। সুবিনয় এখনও ভদ্রতা করে অপেক্ষা করছেন। ঠাকুরঘরে গিয়ে একটু বেশিক্ষণ মাথা ঠুকে এলেন, ‘ঠাকুর, মেয়েটাকে রক্ষা কর। ছেলেটাকেও বাঁচাও। আগে পাগল ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আজকের পর দুটো ছেলেমেয়েই না পাগল হয়ে যায়।’
সুবিনয় ফোনে কথা শুরু করেছেন। ঠাকুরকে ফেলে রেখে বসবার ঘরে দৌড়ালেন মালতী। কে জানে কি বলতে কি বলে, সামলাতে হবে তো। সুবিনয় ততক্ষণে তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন। পার্থর বাবা ওপাশ থেকে কি বলছেন জানা নেই। সুবিনয়ের একপেশে বক্তব্য, ‘যান যান মশাই। অনেক দেখেছি আপনার মত ভদ্রলোক। পরিবারের ইতিহাস চেপে গিয়ে বিয়ে দিচ্ছিলেন। এখন ধরা পড়ে গিয়ে আবার গলার জোর দেখানো হচ্ছে। কি করবেন শুনি? এ বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেব না। আমার একমাত্র মেয়ে, তাকে কিনা আপনার পাগল ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার ফন্দি? কি বললেন? আমি পাগল? মানে? সাহস তো কম নয় মশাই আপনার?’ আর থাকতে পারলেন না মালতী। উঠে গিয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন। খুব খারাপ লাগছিল। পনেরবছর আগে ভদ্রলোকের স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে। না জানি কত কষ্ট করে মা-মরা ছেলেটাকে মানুষ করেছেন উনি। আর এখন এত আনন্দের মুহূর্তে এভাবে তাকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে? এ পাপ ওঁরা রাখবেন কোথায়? ঈশ্বর যদি মিষ্টির ওপর দিয়ে এর শোধ তোলেন?
এদিকে কথার মাঝে ফোন কেটে দেওয়ার স্পর্ধা দেখে সুবিনয়ের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। পার্থর বাবার ওপর যেটুকু চেঁচানো বাকি ছিল, মালতীকে গালিগালাজ করেই তার সাধ মেটাচ্ছেন এখন। এসব সময়ে মালতীর মৃত বাবাকে টেনে আনেন সুবিনয় কথায় কথায়। বংশমর্যাদার ধুয়ো তুলে বউকে অপমান করাও বোধকরি পৌরুষের লক্ষণ। নীরবে শুনে যাচ্ছিলেন মালতী। আজকাল এসবকথায় কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না ওঁর। সবরকম ইমোশনের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। হঠাৎ চমক ভাঙল, আচ্ছা সুবিনয়ের এই ষাঁড়ের মত চিৎকারেও মিষ্টি এখনও জাগছে না কেন? অন্যদিন হলে তো বাবার চিৎকারে মাকে বাঁচাতে ছুটে আসে ও। হঠাৎ বুকের মধ্যে অজানা ভয় তোলপাড় করে উঠল। মিষ্টি ঠিক আছে তো? কি ভেবে ছুট দিলেন মিষ্টির বেডরুমের দিকে।
দরজায় ইয়েল লক লাগানো, বাইরে থেকে খোলা যায়। একটুক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর সাড়াশব্দ না পেয়ে মালতী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। বিছানাটা খালি। যদিও চাদরটা কুঁচকানো। তার মানে রাতে এখানেই ঘুমিয়েছে। ঠাহর করে চোখে পড়ল বালিশের ওপর রাখা চিঠিটা। কাঁপা হাতে পড়তে লাগলেন। ‘মা, আমি চললাম। ভয় নেই, আত্মহত্যা করছি না। পার্থর সাথে পাটনা যাচ্ছি। ওখানে ওর পিসি আছেন, কথা হয়ে গেছে। ওঁরা আমাদের বিয়েটা দিয়ে দেবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, খুব সম্ভবত পরশুই। কাল রাতে কর্ডলেসে প্যারালাল-কানেকশনে বাবা আর নবীনজেঠুর কথাবার্তা শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম কি ঘটতে চলেছে। তারপর আড়ি পেতে তোমার আর বাবার কথাও শুনেছি। রাতেই ডিসিশন নিয়ে ফেলেছিলাম যে আমাদের পালাতেই হবে। পার্থর বাবাও বেশ রাগী মানুষ। মেয়ের বাবার কাছে গালাগালি খেতে ওঁর অহং-এও নিশ্চয় বাধবে। সুতরাং একটা তুমুল গন্ডগোল অবধারিত। সৌভাগ্যক্রমে পার্থ এককথায় রাজি হয়ে গেল। তুমি কষ্ট পাবে জানি, একমাত্র মেয়ের বিয়েতে সাজতে পারলে না, আনন্দ করতে পারলে না। উল্টে বাবা নিশ্চয় এতক্ষণে জিভ দিয়েই তোমার ছাল ছাড়াচ্ছে বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে আমি পালিয়ে গেছি বলে। কিন্তু কি করতাম বল? তোমাকে পঁচিশবছর ধরে শিলনোড়ায় পিষ্ট হতে দেখেছি, কোনদিন মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের কর নি। কে বলবে তুমি এককালে স্কুলে পড়াতে। বাবা তোমার গলার আওয়াজটাই বোধহয় ছিনিয়ে নিয়েছে। তাই আজ এই দুর্দিনে তোমার দিক থেকে কোনো সাহায্য পাব এমন দুরাশা আমার নেই। উল্টে তুমি হয়তো আমাকে ঘরে আগল দিয়ে বোঝাতে বসতে যে আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার্থকে ভুলে যাই। সে আমি পারব না মা। অনেক কষ্টে নিজের মনের মতন একজনকে খুঁজে পেয়েছি, যে তেইশ বছর ধরে আমাকে প্রতিনিয়ত চোখ রাঙিয়ে দাবিয়ে রাখবে না। আজ তার হাত ধরে আকাশে উড়ান দিলাম। দেখি ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায়। তোমার আশীর্বাদ সবসময় আমাদের সাথে থাকবে, সে আমি জানি। তাই আলাদা করে আর আশীর্বাদ চাইলাম না। বাবাকে পারলে বুঝিও। অন্তত আমার ওপর রাগ করে নিজের শরীরের ওপর যেন অত্যাচার না করে। প্রণাম নিও। - ইতি, তোমার মিষ্টি।’
কানে যেন ঝিঁঝিঁ ডাকছিল মালতীর। হাত-পাও কিরকম অবশ হয়ে এসেছে। সুবিনয় যে ফোনে আবার পার্থর বাবার সাথে ঝগড়া শুরু করেছেন, খেয়ালই হয় নি। এবার আস্তে আস্তে বাস্তবে ফিরে এলেন মালতী। উঠে গিয়ে সুবিনয়ের হাত থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিলেন, ‘আমার স্বামীর একটু মাথার দোষ আছে, মেয়ের বাড়ি বলে বদনামের ভয়ে এতদিন চেপে রেখেছিলাম। দয়া করে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আর হ্যাঁ, আমি কাল পাটনা যাচ্ছি। আপনি জানেন কিনা জানি না, ওরা পাটনায় আপনার বোনের বাড়ি গেছে। বোনের ঠিকানাটা একটু দেবেন প্লিজ? পরশু ওদের বিয়ে। আপনিও পারলে চলে আসবেন। শুভকাজে শুভাকাঙ্খীদের পাশে থাকাটা খুব জরুরি।’
ফোন রেখে হতভম্ব সুবিনয়ের পাশ কাটিয়ে গটগট করে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন মালতী।
(পরবাস-৫০, ফেব্রুয়ারি, ২০১২)