[এই লেখাটির একটি ছোটো সাম্প্রতিক ইতিহাস আছে। শ্রী পৃথ্বীজিৎ বর্ধন 'পরবাস'-কে একটি চিঠি পাঠান শঙ্খ ঘোষের উপরে, যেটি জুলাই মাসে ছাপা হয়েছে। এখানে তার বাংলা অনুবাদ, সামান্য পরিবর্তন করে, দেওয়া হলো, যা থেকে এই লেখাটির উৎপত্তি বোঝা যাবে। 'মাস্টারমশায়' হচ্ছেন শ্রীমনীন্দ্রকুমার ঘোষ। আমরা লেখা ও ছবির জন্য পৃথ্বীজিৎ-বাবুর প্রতি কৃতজ্ঞ।
ছেলেবেলা থেকেই আমি শ্রী শঙ্খ ঘোষের নামের সঙ্গে সুপরিচিত। তার কারণ আমার জ্যাঠামশাই, স্বঃ নির্মল চন্দ্র বর্ধন। উনি ছিলেন পাকশীর (এখন বাংলাদেশে) প্রাক্তন শিক্ষক। আমার ধারণা, জ্যাঠামশায়ের প্রিয়তম ছাত্র ছিলেন শ্রী শঙ্খ ঘোষ। শ্রী শঙ্খ ঘোষ, এবং তাঁর পিতা, পাকশী স্কুলের প্রবাদপ্রতিম হেড-মাস্টারের উপর জ্যাঠামশায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি আমি। শ্রী শঙ্খ ঘোষ ১৯৯২/১৯৯৩ সালে তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে আমাদের বাড়িতে আসেন, এবং তাঁর ও তাঁর বাবার লেখা কিছু বিখ্যাত বইও উপহার দেন। (গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে শহর) পাকশীর 'ঘোষ পরিবার'-এর তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে ঁনির্মলচন্দ্র বর্ধন একটি স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা সম্পূর্ণ হয়নি। আমি সেই পাণ্ডুলিপির যতোটা পারি সংরক্ষণের চেষ্টায় আছি। এখন আমি সেটা আমার ভক্তিভাজন, শ্রদ্ধেয় শ্রী শঙ্খ ঘোষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
এই যোগাযোগের মাধ্যম হতে পেরে 'পরবাস' ধন্য। ]
মাস্টারমশায় ছাত্রদের হাতে অনেকখানি স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন, ক্লাস পার্লিয়ামেন্ট ও স্কুল পার্লিয়ামেন্ট-এর মাধ্যমে। প্রতি ক্লাসে আইন-শৃঙ্খলা, সাহিত্য, শিল্পকর্ম ইত্যাদি নানা বিভাগের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন কমিটির হাতে। প্রতিটি কমিটিতে মন্ত্রী ও কয়েকজন সদস্য ছিল, শ্রেণীশিক্ষক ওদের যে-কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রয়োজন হলে একটু অদলবদল করতে পারতেন, চলতি ভাষায় যে ছেলেটিকে মনিটর বলা হয় সব স্কুলে, সে ছিল 'আইনশৃঙ্খলা' মন্ত্রী। স্কুল পার্লিয়ামেন্টও এইভাবেই কাজ করত। আসল ব্যাপার হল এই যে, প্রতি শ্রেণীতে প্রতিটি ছেলেই কোনও না কোন কমিটির সদস্য হত। এইভাবে ছেলেরা স্কুলের ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িত থাকত। আইনশৃঙ্খলার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কোনো ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তার কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বসে অপরাধের বিচার করত। প্রতিক্লাসেই একটা খাতায় প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি মন্ত্রী সংক্ষেপে লিখে রাখত। পরদিন প্রথম পিরিয়ডে শ্রেণীশিক্ষক আগেরদিনের রিপোর্ট দেখে ব্যাবস্থা নিতেন। নিচের ক্লাসে প্রায়ই লঘুপাপে গুরুদণ্ডের ব্যাবস্থা থাকত; এক ছেলে অন্যছেলের বই বেঞ্চের নিচে ফেলে দিয়েছে--তার তিন পিরিয়ড বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকার ব্যবস্থা। মাস্টারমশায় মন্ত্রীকে বললেন, "ও যার বই ফেলে দিয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাইবে তোদের সবার সামনে; সেটা আরো বড়ো শাস্তি। কি বলিস তোরা?" মাস্টারমশায় যে তাদের মত নিয়ে কাজ করতেন এতে ছোটো ছোটো ছেলেরা বেশ খুসি হত।
ঘরদোর সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার ভার যে কমিটির হাতে ছিল, তার সদস্যরা ঘরের দেয়াল, মেঝে, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল ঝকঝকে তকতকে করে রাখত। স্কুল পার্লিয়ামেন্ট ছিল সব ক্লাস নিয়ে মোটামুটি একই রকমের প্রতিষ্ঠান। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগটা তারাই দেখত। এইসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে মাঝে মাঝে একটু কৌতূকের অবতারণা হত। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একবার স্কুলের সব ঘরদোর রঙ করবার সময় ছেলেরা নিজেদের ঘরগুলো নিজেরাই রঙ করে। অন্য সব ঘর মিস্ত্রিরা রঙ করে। বোধহয় বড়োদিনের ছুটি ছিল সে-সময়। স্কুল খোলার পর প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে সবার চক্ষুস্থির! সারা স্কুলের সব ঘরদোরের জানালা গাঢ় নীল রঙে রঞ্জিত। শুধু একটি ঘরের দোরজানালায় রেড লেড রঙ লাগানো হয়েছে--যেন ওই ঘরটি রক্তচক্ষু মেলে অন্য ঘরগুলোকে দেখে নিচ্ছে। ওই ঘরটি বোধহয় ক্লাস ফোর-এর। ছাত্র মাস্টারমশাইরা সব হাসি-তামাশা করছেন, ছোট ছেলেগুলোর কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে আমাদের মাস্টারমশায় ওদের ঘরে গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, "আমি খুব খুসি হয়েছি যে তোরা স্বাধীনভাবে একটা কাজ করেছিস। তবে, বেশিরভাগ যেটা করে, সেটা তো না মেনে পারা যায় না, এবার তোরাও রঙটা নীল করে নে, সেটাই তো নিয়ম।" মাস্টারমশায়ের কথা শুনে ওই বাচ্চাদের মুখে হাসি ফুটলো।
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগ (ইংরেজি নামটা ভুলে গিয়েছি--art & culture বা art & literature হবে বোধ হয়) থেকেই হয়তো কিছু ছেলে প্রথম বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মাস্টারমশায়ের ছেলে শঙ্খ ঘোষের নাম আজ কে না জানে? শিক্ষিত সমাজে সফল আধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও কবি হিসাবে শঙ্খ আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। ওরা হাতে লিখে যে পত্রিকা বের করত, তার মধ্যে ভবিষ্যতের অনেক কবি, সমালোচক ও চিত্রশিল্পীর সূচনা দেখেছি। প্রতিপদেই এদের উৎসাহ যুগিয়েছেন মাস্টারমশায়।
মাস্টারমশায় প্রতি বছর কোন না কোন বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যাক্তিকে Extension lectures দেবার জন্যে আমন্ত্রণ করতেন। ডঃ বিধুশেখর শাস্ত্রী, অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখার্জি, ডঃ শহীদুল্লা, হুমায়ুন কবীর, ওয়াজেদ আলি সাহেবের কথা মনে পড়ছে। এঁদের বক্তৃতায় ছাত্রশিক্ষক সবাই উপকৃত হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। আমার নিজের সবসময়েই মনে হতো, বদ্ধ জলার মধ্যে যেন নতুন একটা আলো, একটা বৃহত্তর জগতের আস্তিত্ব এসে পড়েছে--অনুভব করছি দিনে দিনে। এইসব শ্রদ্ধেয় অতিথিদের দেখাশোনার ভার আমার উপরই থাকত। ফলে, তাঁদের সাহচর্য, তাঁদের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে আলোচনায় শুধু আনন্দই পাইনি, অনেক পাথেয় পেয়েছি জীবনে চলার পথে। ওয়াজেদ আলি সাহেবের সঙ্গে রাত বারোটা পর্যন্ত সরস কথাবার্তা; দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা থেকে শুরু করে নিজের স্কুলজীবন পর্যন্ত নানা প্রসঙ্গে কথা বলে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন সেদিন। ডঃ শহীদুল্লা ছিলেন অত্যন্ত সরল খাঁটি পণ্ডিত মানুষ। শাস্ত্রীমশায় অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ; কলকাতা থেকে আমাদের ওখানে আসার আগে লিখে জানিয়েছিলেন, "আমার খাওয়াদাওয়ার জন্যে আপনারা ব্যস্ত হবেন না। ২/৪ টে কাঁচকলা, একটু খাঁটি ঘি আর তিনটে নতুন ইঁট আনিয়ে রাখবেন। আমি স্বপাকে খাই, বাড়িতেও তাই। বৌমাদের হাতে খাইনা, যদিও ওরা আমার অত্যন্ত প্রিয়।" একটু অবাকই হয়েছিলাম। বহুবৎসর রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে কাটিয়েও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে এত বাছবিচার, কিন্তু ছাত্র অভিভাবকদের সামনে ধর্মবিষয়ে এতো সুন্দরভাবে (ব্যাখ্যা) করলেন উনি যে সবার মনে তা সুন্দর ও সহজবোধ্য মনে হল। হুমায়ুন কবীর সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল রত্ন। যখন উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা দেশের আবহাওয়া বিষাক্ত করে তুলেছে সে সময় তিনি কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। মাস্টারমশায় এঁদের মতো বিশিষ্ট লোকদের এনে ছেলেদের মনের প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। আমার মতো অনেক শিক্ষকও যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিলেন।
"All work and no play makes Jack a dull boy"--এই প্রবচনটি মাস্টারমশায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। শুধু খেলাধুলাই নয়, আবৃত্তি, অভিনয়েও সব সময়ই ছেলেদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। নাটক অভিনয়ের ব্যাপারে যদিও দায়িত্বটা আমার থাকত, তবু নিজে আড়ালে থেকে অনেক শক্ত কাজই করে দিতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের 'মুক্তধারা' 'অচলায়তন,' বিধায়ক ভট্টাচার্যের 'রামগড়ে একারাত্রি,' রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুন্ঠের খাতা' প্রভৃতি অনেক নাটকই সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল সেসময়। ইংরেজি নাটিকা 'The Discovery'র অভিনয় দেখে ইংরেজ অফিসাররাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিশেষ করে মাস্টারমশায়ের ছেলে শঙ্খ-র অভিনয় দেখে এক সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওর জন্যে একটা পুরস্কারই ঘোষণা করে বসলেন। শঙ্খ করেছিল কলম্বাসের বালকভৃত্য Pepe-র চরিত্রে অভিনয়। যখন বিদ্রোহী নাবিকরা কলম্বাসকে খুন করবার জন্যে ছুটে আসছিল, তখন তাদের বাধা দিতে উদ্যত সেই বালকভৃত্যের সজল চোখ আর আবেগপূর্ণ উত্তেজিত কন্ঠস্বর এখনও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। 'অচলায়তন'-এ শঙ্খ বোধ হয় পঞ্চকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। ওর অভিনয়-ক্ষমতা সবাইকে মুগ্ধ করত। তবু মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হত, ভয় হত, পাছে এমন মেধাবী ছেলের ক্লাসের পড়াশোনায় শৈথিল্য আসে। মাস্টারমশায় কিন্ত সে ভয় করতেন না।
পাকশী স্কুলের সহকর্মীদের মধ্যে আরেকজনে মাস্টারমশায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের পণ্ডিতমশায়। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও আই-এ পাশ করে ১৯২১-এর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পড়া ছেড়ে দেন। মোহভঙ্গ হবার পর সংস্কৃত সাহিত্যা পরিষদ থেকে কাব্য ও ব্যাকরণের উপাধি-পরীক্ষা পাশ করেন (কাব্য-ব্যাকরণতীর্থ)। চেহারাটা মোটেই হেড পণ্ডিতের মতো নয়। টিকির অস্তিত্ব নেই, পায়ে আমাদের মতো 'নিউকাট' জুতো, মেদহীন সুস্থ দেহ। এরকম সুদর্শন সদানন্দ পুরুষ খুব কমই দেখেছি জীবনে। শুধু অধ্যাপনাতেই নয়, co-curricular activities-এও তিনি ছিলেন স্কুলের অমূল্য সম্পদ। আমার চেয়ে ৫-৬ বছর আগে পাকশী স্কুলে এসেছেন; কিন্তু স্কুলে কোনোদিনই আবৃত্তি, অভিনয় বা গানের কোনো অনুষ্ঠান দেখেননি। ১৯৩৬-এ সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজত্বের রজতজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে স্কুলে ছেলেদের আবৃত্তি, অভিনয় ও গানের আয়জন করা হয়। অভিনয় ও আবৃত্তির ভার আমি নিই। পণ্ডিতমশায় নেন গানের ভার। 'পূজা'-পর্যায়ের কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানোর গুণে ভালোভাবে উতরে গেল; নাটক ও আবৃত্তিও খুব প্রশংসা পেল রেল কলোনিতে।
দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৪০ থেকে মাস্টারমশায়ের উৎসাহে আবার স্কুলে পড়ার মতো খেলাধুলা ও অভিনয়, গানে আনন্দের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। বলা বাহুল্য ওই নতুন পরিবেশ সৃষ্টিতে মাস্টারমশায় আমার, অনিলবাবুর ও পণ্ডিতমশায়ের অকুন্ঠ সাহায্য পেয়েছেন। তিনি B.T. ছিলেন না। কিন্তু আমরা যা বইএ পড়েছি তা ভারি সুন্দরভাবে হাতেকলমে করে দেখাতে শুরু করলেন উনি। ফলে, ছেলেদের কাছে স্কুলটা হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয় মিলনভূমি। অনিলবাবু হস্টেলে থাকতেন। সেখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল। অনিলবাবু প্রায়ই নিজের টাকায় বাজার থেকে ভালো মাছ তরকারি আনাতেন। হস্টেলের ছাত্ররাও ওঁর মতোই ওইসব খাবার সমানভাবেই খেত। ওঁর food charge-এর অতিরিক্ত মোটা টাকা উনি এভাবে খরচ করতেন। কেউ এ-নিয়ে কিছু বললে উনি বলতেন, "ছোট ছোট ছেলেদের না দিয়ে একা কি করে ভালো খাবার খাই বলুন?" হস্টেলের নতুন ঠাকুরটি ছিল মৈথিলী ব্রাহ্মণ, ২৭-২৮ বছর বয়স। দেশে কয়েক বিঘা চাষের জমি ঋণের দায়ে মহাজনের কাছে বাঁধা। অনিলবাবু একবার ঠাকুরকে ঋণশোধের টাকা দিয়ে ওর জমি উদ্ধার করে দেন। ঠাকুর অনিলবাবুকে দেবতার মতো মনে করত। ছাত্রদের যাতে কষ্ট না হয় তা তো দেখতোই, স্কুলের সব ছাত্রদেরই অত্যন্ত ভালোবাসত।
(-- অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। বাকি অংশ পাওয়া যায়নি।)
(পরবাস-৪৯, অক্টোবর, ২০১১)